জোয়ার-ভাটা পর্ব-৩+৪

0
359

#জোয়ার-ভাটা
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৩।

চন্দ্র ও সূর্যের ভূপৃষ্ঠের জল স্থলভাগকে আকর্ষণ করে যার ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রত্যহ একস্থানে উঠে আর অন্যস্থানে নেমে যায়। যাকে বলা হয় জোয়ার-ভাটা।ঠিক যেন মার্জানের জীবনের মতো। মার্জান সপ্তপর্ণ দৃষ্টিতে পূর্ণিমার রাতের জ্বলজ্বল চাঁদ আর সমুদ্রের জোয়ার তরঙ্গ দেখে যাচ্ছে। জলের গতির মতো জীবনটা-ও কত গতিপথ ছুটছে। মার্জান সাদা রঙ্গের টপে রাতের পরি মনে হচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ের শীতল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কেশ। রাতের আঁধারে শান্ত পৃথিবীর বুকে স্পষ্ট শোনাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। মার্জান এবার সমুদ্রর খুব কাছে চলে গেলো। সমুদ্র-ও ওঁকে বিনা দ্বিধায় স্পর্শ করে গেলো পা জোড়ায়। মার্জানের এবার ভাড়ী বুক-টা হালকা হতে শুরু করেছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে নিশ্বাস ভড়ে নিচ্ছে ভুড়ি ভুড়ি। মার্জান বলল,

” সমুদ্রের বুক খুব বড়। কত কিছু লুকিয়ে আছে ওঁতে। কত রহস্য আছে, কত দুঃখ আছে, কত কষ্ট আছে, আছে গভীরতা। এই বুকের মাঝেই প্রাণ হারিয়ে ফেলার ক্ষমতা-ও আছে। আছে কত মানুষের করা স্বগতোক্তি। ”

তাহের শেখের বাড়িতে আয়োজন চলছে, মার্জানের আহুতির। ঘর ভর্তি মেহমান, আর গান বাজনায় দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো যেন। সময় কতটা দ্রুত চলে যাচ্ছে যেন মার্জানের জীবন থেকে। দু’দিন পর মার্জানের জম্মদিন। ১৮ বছরে পা দিবে সে। আর সে’দিন নাকি বিয়ে নামক বাঁধনে বেঁধে দিবে তাকে? আচ্ছা! ওর দোষটা কথায়? এ-তো সব ঘটনার মাঝে সব দোষ কি মার্জানেরই ছিলো? মার্জান এবার তীরে বসে পড়লো। পূর্নিমার আলোয় ফকফক করছে চারপাশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জলস্থলে যুগল। মার্জান একপলক চতুর্দিক দৃষ্টি দিয়ে মাথা নত করে ফেললো। পরক্ষণেই কিছুটা মনে পড়তেই চমকে তাকালো ওর ডান পাশটায়। একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওর থেকে খানিকটা দূরে। মার্জানের খুব চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছে ভাবতেই মনে পড়লো ওই-দিনের হোটল রুমের ওই ছেলেটির কথা। ওঁর শরীরে কম্পন ধরে গেলো। কালো শার্ট প্যান্ট পড়া যুবকটি এক সাইট মার্জান দেখেছিলো সেদিন ঘুম ভাঙ্গার পর। যার সাথে একটি পুরো রাত কাটিয়েছে, তাকে দেখবার কোনো আকর্ষণ দেখা গেলো না ওঁর মাঝে। ঠিক তার উল্টো কাজ করে বসলো ওঁ, এক ছুটে ভয়ে দুরুদুরু বুকে পালিয়ে চলে গেলো। কেন সে পালিয়ে এলো? কি কারণ? লজ্জায় নাকি ভয়?সে’দিন রাতের কথা মনে পড়তেই মার্জানের হাড়গোড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসে, অসাড় লাগে শরীর। কিভাবে একটি ছেলেকে জোর করেছিলো নিজের কাছে আসতে? নিজের অসহায়ত্বের সময়টুকু সপে দিতে অপরিচিত একজনের কাছে। মার্জান আর কিছু ভাবতে পাড়লো না। মন শুধু বলে চলছে,

” পালা, পালা মার্জান, পালা!”

মার্জান হাঁপাতে লাগলো ওঁর গাড়ির সামনে এসে। কাঁপা-কাঁপা হাতে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই পেটে মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো ওঁ। গাড়ির ভিতর পেটে হাত দিয়ে ব্যথায় চিৎকার করতে লাগলো। এ নিয়ে ঠিক দুবার এমন পেট ব্যথায় ভুগছে। মার্জানের কেমন জানি লাগলো। ভেবেই নিলো সকাল সকাল অপরিচিত কোনো হসপিটালে গিয়ে চেকাপ করিয়ে আসবে ওঁ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরেরদিন সকালে সে হসপিটালে ফুল বডি চেকাপ করিয়ে আসে। ডাক্তার জানায় রিপোর্ট একদিন পরে দিবে। মার্জান চলে আসে। ও চাইলেই পাড়ত পারিবারিক ডাক্তারের কাছে যেতে। কিন্তু এতে করে টগর চিন্তায় পড়ে যাবে। আর এ’কদিন যাবত টগরের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ওঁর মা। টগরের মুখটি দেখেই তো বেঁচে আছে মার্জান। নয়তো কবেই নিজেকে শেষ করে দিতো হয়তো।

দেখতে দেখতে মার্জানের জম্মদিনটি চলে এলো। বাড়ি সবাই ব্যস্ত তখন। মার্জানকে ঘিড়ে ওঁর আত্মীয় স্বজনরা। কথা চলছে কি কি এসেছে ছেলের বাড়ি থেকে, তা নিয়ে চলছে কথা বার্তা। একজন-তো বলেই উঠলো,

” মার্জান কি ভাগ্য তোর, সোনার টুকরো ছেলে পেয়েছিস, আকাদে এত কিছু পাঠিয়েছে, বিয়ে হলো না জানি কি করে বল?”

মার্জানের এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। ওঁর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। এই একটা মাসে একটি বাড়ে-ও ভাদ্রের সাথে ওঁর দেখা হয়-নি। কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই মার্জানের। এসব ভেবেই প্রশ্ন করলো মার্জান ওঁর বোনকে,

” ভাদ্র এসেছে কি?”

” হ্যাঁ আপু, ভাইয়াতো সকালেই চলে এসেছেন। নিজ হাতে সব করছেন।”

মার্জানের ভয় ভয় করছে। যত সময় ঘনিয়ে আসচ্ছে ততই ধুকপুক করছে বুক। মার্জান একটি পিংক গাউন পড়েছিলো। বার্বি ডলের মতো লাগছে ওকে। নিজ রুম থেকে গাউনটি হালাকা উপরে উঠিয়ে বেড়িয়ে এলো। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, এখন বিকেল। তবে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। মার্জান এদিক-ওদিক খুঁজে চলছে ভাদ্রকে। ঠিক তখন স্টোর রুম দিয়ে যেতেই কিছু আপত্তিকর শব্দ দাঁড়িয়ে পড়লো মার্জান। কিন্তু সে-দিকে খুব একটা খেয়াল করলো না। মানুষের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে বরাবরই ওঁর মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু,, নিজের নাম শুনে পা থেমে গেলো। কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মার্জান এবার গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। জানালার ধারে একটু ফাঁক করা। উঁকি দিতে চক্ষু ছানাবড়া ।

মার্জানের বিশ্বাস হচ্ছে না যেন, এসব কি দেখছে? রিয়ানা ভাদ্রের একদম কাছাকাছি। খুব চক্ষুকটু দৃশ্য। ছিঃ। নিজের বোনের বাগদত্তার সাথে কি-না শেষ পর্যন্ত? কিন্তু রিয়ানার মাত্র ১৫ বছর বয়স। এ বয়সেই এসব কি? ঝটকা এবার খেলো মার্জান যখন শুনলো,

” ডার্লিং, কেন করছো বিয়ে তুমি ওই ফালতু মেয়ে মার্জানকে, যা চেয়েছিলে, তাতো পেয়েছোই। ওঁর বাবার হোটেলতো তুমি লিখিয়েই নিয়েছো। আর -কি চাই।”

ভাদ্র আরো আলিঙ্গন হলো রিয়ানার সাথে। বলল,

” মার্জাকেও চাই আমার!”

কপাট রাগ দেখিয়ে রিয়ানা দূরে সরে গিয়ে বলল,
” তাহলে আমি কে?”

ভাদ্র মুখে দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। ওঁর হাত জোড়া খেলা করতে লাগলো রিয়ানার কচি শরীরটিতে। রিয়ানার রাগ যেন গলে গেলো। ভাদ্র রিয়ানার কানে ঠোঁট লাগতেই কেঁপে উঠলো। ভাদ্র বলল,

” তুমি আমার এক মাত্র ছোট বউ। তবে তোমার এখনো ১৮ বছর হতে অনেক সময়। এই তিনটে বছর না হয় মার্জান হোক তোমার রিপ্লেসমেন্ট। ”

মার্জান পা যেন এঁটে গেছে জায়গায়। জমে গেছে। এসব কি শুনছে সে? কক্সবাজারে মার্জান এর বাবা আরহাম মালিকের একটি হোটেল গড়েছিলো। এই হোটেলটি ওঁর বাবার স্বপ্ন ছিলো। বাবা মারা যাবার আগে এক মাত্র সন্তান হিসেবে মালিক হোটেলটি ওঁর নামে লিখে দিয়ে গেছিলো আরহাম মালিক। ভাদ্র ছিলো ওঁদের বংশের এক মাত্র ছেলে। মার্জানের হাসবেন্ড হিসেবে ওর নামেই চলে যেতো। কিন্তু তার আগেই এই হোটেলটি লিখিয়ে নিয়েছিলো ভাদ্র। মার্জানের মনে পড়লো। একবার ভাদ্রের একটি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কাজ করেছিলো মার্জান। কিছু ডকুমেন্টস এসাইন করেছিল সেদিন। হয়তো সে-দিন নিজের ভাগ্য নিজ হাতে আগ্নেয়গিরিতে দিয়েছে?বিশ্বাসঘাতক! মার্জান পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু পিছনের টেবিলের সাথে ধাক্কা লেগে ধেমে গেলো। শব্দ হতেই এলার্ট হলো ওঁরা। চটজলদি বের হতেই দেখতে পেলো মার্জান জল ভর্তি চোখে তাকিয়ে আছে ওঁদের দিক। মার্জানকে দেখেই ভাদ্র গম্ভীর হয়ে গেলো। রিয়ানা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। যেন যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। রিয়ানা বলল,

” দিদুভাই! তুমি সব শুনে আর দেখে ফেলেছো বুঝি?”

মার্জান জবাব দিলো না। ঘৃণায় তাকিয়ে রইলো শুধু। তা দেখে ভাদ্র বলল,

” ভালোই হয়েছে, সব জেনে গিয়েছো। ”

মার্জান ঘৃণিত নজরেই বলল,

” তোমার থেকে পোষা কুকুর অনেক ভালো। ”

“মার্জান!”

হাত তুলতে নিলো ভাদ্র। মার্জান তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,

” আমার সাথে বেইমানি করে ঠিক করনি তুমি। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। বুঝলে ঘৃণা। ”

রিয়ানা বলল,

” মার্জান… ও আমার দিদুভাই। সহজসরল দিদুভাই। তোমার ঘৃণা ওর না কিছু আসবে না আমার। ভাদ্র যা চেয়েছিলো, তা ও পেয়ে গেছে। তোমার চিন্তা করো এবার। ইফ ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, নানাজান উনার সম্পত্তি থেকেও তোমাকে বাদ দিয়েছে। কি করবে এখন তুমি বলো?”

মার্জান কখনোই টাকা-পয়সার লোভ করেনি। ওঁর বিশ্বাস কর্ম করলেই ফল। কিন্তু ওঁর দুঃখ ওঁর বাবার গড়া কষ্টের মালিক হোটেলটি নিয়ে। মার্জান এবার বলল,

” সম্পত্তি বা টাকা-পয়সার লোভ আমার নেই রিয়ানা। তবে বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে ভয়। এরা সুচ ফুঁটিয়ে দেয়।”

রিয়ানা বাহু চেপে ধরলো আলিঙ্গন ভাবে ভাদ্রর। বলল,

” হিংসে হচ্ছে বুঝি মার্জান? ভাদ্র তোকে নয় আমাকে ভালোবাসে। তাই এসব বলছিস তো?”

মার্জান ফিকে হাসলো,

” একজন মা,দ,কদ্র,ব্য সেবনকারী ভালো হতে পারে, কিন্তু একজন চ,রি,এহীন ব্যক্তির চ,রি,ত্র কখনো ভালো হতে পারে না!”

এ পার্যায় থাপড় পড়র জোড়ে মার্জানের গালে। মার্জান ছিটকে পড়লো নিচে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। ভাদ্র রাগে গজগজ করছে,

” এই চরিত্রহীনকেই বিয়ে করতে হবে তোমার মার্জান!”

মার্জান চকিতে উত্তর দিলো,

” তার থেকে বরং মরাটাই আমার জন্য শ্রেয়!”

” এত ঘৃণা! ”

হাসলো ভাদ্র। হাটু ভেঙে বসে পড়লো মাটিতে। মার্জানের চুলের মুঠি টেনে ধরে মুখ হালকা উঁচু করলো,

” এই ঘৃণত ব্যক্তিটি কেই দিন রাত চোখে দেখতে হবে তোকে।”

একদলা থুতু ফেলে দিলো মুখে মার্জান। বলল,

” তোমার স্বপ্নে!”

ভাদ্র রাগ এবার তিড়তিড় করে বাড়লো। টেনে তুলে নিয়ে গেলো ওই স্টোর রুমটির ভিতরে। ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ফ্লোরে। মুখ থুবড়ে পড়লো মার্জান। বুঝে উঠার আগেই টান পড়লো গাউনে। চিৎকার করে উঠলো মার্জান,

” কি করোছো, ছাড়ো। যেতে দাও আমাকে!”

ভাদ্র শয়তানি হাসলো,

” আমি তো ভেবেছিলাম এক মাস আগেই ওই রাতে ত্যাজ কমে গেছিলো। কিন্তু না! ভুল ছিলাম। যাই হোক যা বিয়ে পর হতো, তা না হয় আজ হবে। যদি-ও সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস আমার পছন্দ না। কিন্তু আলাদা। তোর লতানো শরীর আমার মাথা পাগল করে দেয়। ”

বলেই এবার গাউনের নিচের ভাগ টেনে ছিঁড়ে ফেললো ভাদ্র। এদিকে চিৎকার চেঁচামেচি করছে মার্জান। আরেকবার, আরো একবার কি মুখোমুখি হতে হবে এসব কিছুর? আরো একবার?

” হেল্প, রিয়ানা হেল্প, মা, নানাজান…!”

কেউ আসছে না। কেউ শুনছে না। গান বাজানার আওয়াজে কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না মার্জানের আর্তনাদ। ভাদ্র এবার মার্জানের উপর উঠতেই পিছন থেকে কেউ বাড়ি মারলো ভাদ্রের মাথায়। ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে পড়তে লাগলো রক্ত। ফ্লোর মেখে যেতে লাগলো রক্তে। ছিটেফোঁটা পড়লো এদিকে সেদিকে। পড়লো মার্জান মুখে। ভাদ্র মাথায় তীক্ষ্ণ ব্যাথা নিয়ে পিছনে ফিরলো। চোখ বড় বড় করে বলল,

” আ-প-নি..!

চলবে,

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৪।

পৃথিবীর বুকে হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমেছে। গর্জন করছে বিদ্যুৎ। ঝড়ের প্রকপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। মার্জানের জীবন-টাও যেন ঠিক এই ঝড়ের প্রকপে লন্ড-ভন্ড হচ্ছে। নিস্তব্ধ চতুর্দিকে শুধু আসমানী তান্ডবের আওয়াজ গুঞ্জন তুলছে। গুমোট পরিস্থিতিতে এবার একটি চিৎকার শোনা গেলো,

” ভা’দ্র”

গলাটা ছিলো রিয়ানার। মুহুর্তে তান্ডবে হতভম্ব হয়ে গেছিলো ওঁ। নিজেকে তটস্থ করে এক ছুটে গেলো ভাদ্রের কাছে। ভাদ্র ততক্ষনে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। ভাদ্র’র আধো খোলা চোখ আর কম্পিত গলায় বিড়বিড় করছে,

” মা’মী।”

টগরের রাগে গা কাঁপছে। নিজের মেয়েকে নরকের পশুর হাতে তুলে দিতে চাইছিলো? কত সর্বনাশ টা-ই করছিলো টগর। টগরে রাগ যেন কমছেই না। হাতে ফুলদানি দিয়ে আরো একটি বাড়ি বসাতে যেতেই নিজেও চিৎকার করে উঠে টগর। পিছন থেকে রিয়ানা একটি কাঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টগরের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে। এ-সব কি হচ্ছে? নিজের ভাগ্নী যাকে মেয়ের থেকে কম দেখে-নি কখনো সে নাকি ওঁর গায়ে হাত তুলেছে? টগরের চোখ এবার ঘোলাটে হয়ে আসচ্ছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিয়ের ঘর বলেই নিচে নামছিলো ওঁ। কিন্তু মার্জানের চিৎকারে ছুটে এসে এসব কিছু দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছিলো। তাই সামনে যা পেয়েছে তা দিয়েই বা’ড়ি মে’রে’ছে। কিন্তু রিয়ানা এমন কিভাবে করতে পারে? কিভাবে?

এত কিছু মধ্যে হতবুদ্ধি মার্জান ছুটে এলো মায়ের কাছে। চিৎকার করে ডাকছে,

” মা, মা ওঠো! মা কথা বলো, রিয়ানা এইটা কি করলে তুমি?”

রিয়ানার চোখে মুখে কোনো ভাব দেখা গেলো না। মুখ ফুঁটে বলল শুধু,

” আমি-তো কিছু করিনি, যা করেছো তুমি করেছো।”

বলেই হাতের কাঠটি মার্জানের পাশে ছুঁড়ে মারলো। মার্জান আকাশ থেকে পড়লো যেন। এসব কিছু বলছে ওঁ? মার্জান আবার কিছু বলবে এর আগেই ঢুকলো সুরভি! ঘটনা কি ঘটে গেছে বুঝতে পেরেই তিলকে তাল বানিয়ে ডাকলেন সবাইকে।ভাদ্র আর টগরকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। রিয়ানা মেকি কান্না করা শুরু করেছে কখন থেকে, এসব কিছু দেখে ভয় পেয়েছে যেন এমন ভাব। সুরভি মেয়েকে সান্তনা দিচ্ছে। তাহের শেখ নাতনিকে আদুরে কন্ঠে বলতে বললে, ঘটনার বর্ণনা করলো বিপরীত ভাবে,

” নানাজান… আ-মি আমি দেখেছি দিদুভাই ভাদ্র ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করছে, কথার মাঝেই আপু ভাইয়াকে বা-ড়ি মা-রে। খালাজান যখন ফিরাতে যায়, খালাজানের মাথাতেও আপু বা-ড়ি দেয়।”

বলেই মায়ের বুক জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো। হুহু করে কান্না করতে লাগলো।

সব কিছু শোনার পর, মার্জানকে নানাজান ঠান্ডা দৃষ্টিতে দেখলেন। বললেন,

” শেষ পর্যন্ত খাল কেঁটে কুমির এনেছি আমি! যদি টগরের কিছু হয়? আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”

মার্জান নিরবে কাঁদছে। হাটু মুড়ে বসে আছে। মিন মিন করছে,
“আমি আমি কিছু করিনি নানাজান। আমি মা’রি ‘নি কাউকে!”

কিন্তু কে শোনে কার কথা?
হসপিটালের করিডোর বসে আছে সবাই। চিন্তিত মুখ। ফিনাইলে গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডাক্তার এবার বের হলেন। জানালেন,

” মিসেস টগর কোমায় চলে গেছে। আর মিঃ ভাদ্র এখন ঠিক আছে।”

উপস্থিত সবাই এবার নড়েচড়ে উঠলো। টগরের কথা শোনে তাহের শেখ জমে গেছে। উনি তপ্ত দৃষ্টিতে তাকালেন মার্জানের দিকে। মার্জান উঠে এদিকেই আসছে মা’কে এক পলক দেখবে বলে। কিন্তু ওঁর পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়লো তাহের শেখ। কঠোর গলায় বললেন,

” আজ এর এই মুহুর্তে থেকে তুমি আমার এবং টগরের কেউ না। এই খান থেকে চলে যাও। আমি চাইলে তোমাকে পুলিশে দিতে পারতাম মার্জান কিন্তু এতে করে আমার মান-সম্মানটায় দাগ পড়বে। ”

মার্জান কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

” নানাজান বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি। আমি মাকে দেখতে চাই, একটি বার দেখতে চাই। আমাকে যেতে দাও!”

নানাজান শুনলেন না। সুরভীকে ডেকে বলেন,
“আমার পরিবারে ত্রৃসীমানায় যেন না দেখি।”

সুরভী খুব খুশি হলো। মার্জানকে টেনে নিয়ে ফেললো হসপিটালের বাহিরে। ছিকটে পড়লো মাটিতে মার্জান। ঝড়-বৃষ্টির তান্ডবে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সুরভী হাসছে। বলল,

” আজ তোর বাপ থাকলে খুব ভালো হতোরে মার্জান, দেখতে পেতে নিজের মেয়ের কি ভিক্ষারীর মতো অবস্থা হয়েছে। ”

মার্জান এবার কাঁপা কন্ঠে চেঁচালো। ঠান্ডায় জড়িয়ে আসচ্ছে কথা,

” আমি তোমাদের কি করেছি, কেন করছো এমন আমার সাথে? কেন দেখা করতে দিচ্ছো না আমার মার সাথে?”

সুরভী হাসলো হো হো করে,

” তোর মা? সিরিয়ালি?হাসতে বাধ্য করলি। ওহো, হ্যাঁ ভুলেই গেছি, টগর তো তোকে সত্যিটি বলেই নি।”

মার্জান চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। এই কয়েকটি মাসে ওঁর সামনে কত কিঠু দেখবে?

” তুই তো তোর মায়ের আপন সন্তান-ই না।তুই তো তোর বাপের নাজায়েজ সন্তান। বেচারি টগরতো কখনো মা হতে পারেনি। ভালো মানুষ, আর ভালো মন বলেই তোকে পেলে বড় করেছে!”

মার্জান অবিশ্বাস্য চোখে চাইলো। মাটিতে থেকে উঠবার খুব চেষ্টা করেও পারলো না। সারা শরীর অসাড়তা ঝেঁকে বসেছে। চোখ জোড়াও বন্ধ হতে চাইছে।

” খালাজান তুমি… তুমি মিথ্যা বলছো, বুঝলে, মিথ্যা বলছো, মা আমাকে বলেছে আমি তাঁর রক্ত। ”

” ও-হো নাদান মার্জান, একবার তোমার খুব বড় এক্সিডেন্ট হয়, রক্তের প্রয়োজন ছিলো।সেই মুহূর্তে টগর তোমাকে দয়া দেখিয়ে রক্ত দিয়েছিলো। তাই হয়তো বলেছে”

মার্জান এসব মানতে নারাজ। ওঁ ধীরে ধীরে উঠবার চেষ্টা করলো।

” মিথ্যা বলছো। মিথ্যা বলছো তুমি। আমি.. আমি মায়ের সাথে দেখা করবো।”

” সুরভী সত্যি বলছে, তুই টগরের মেয়ে না।”

তাহের শেখের কন্ঠে মার্জানের পা সেখানেই জমে গেলো। ধপাস করে বসে পড়লো আবার। টগরের হাসি হাসি মুখটি ভাসছে ওঁর চোখে। টগরের করা আদর, শাসন, ভালোবাসা গুলো অনুভব করছে। আবেগে আপ্লুত মার্জান হাত জোর করলো এবার,

” নানাজান, একটি বার একটি বার দেখতে দাও না মাকে, দূর থেকেই দেখবো শুধু!”

” নাহ্। কোন মুখে দেখতে চাস তুই? যে মা তোর জন্য এত লড়াই করেছে, সে-মাকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলি, হাত কাঁপলো না তোর? একটি বার? এখন কোন মুখে দেখা করতে চাইছিস?”

ধিক্কার জানালের এবার তাহের শেখ। মার্জান এসব কিছু আর সইতে পারছে না।

” আমি মাকে মা’রি’নি। মা’রি’নি। মাকে রিয়ানা মেরেছে। ”

বলেই ঢুকরে উঠলো মার্জান। সুরভী ঘাবড়ে গেলো তখন। দু’কদম এগিয়ে এসে চড় বসালো গালে। চুলের মুঠি টেনে বলল,

” আমার মেয়েকে এখন কালপ্রিট বানাতে চাইছিস? সাহস কত? আর একটি বার মিথ্যা বলে দেখ। মেরে এখানেই পুতে দিবো।”

এর ছেড়ে দিলো মার্জানকে। মার্জান সেখানেই লুটিয়ে পড়লো। হাড়গোড় ভেঙ্গে আসছে এবার। আধো খোলা চোখে শুধু দূরে যেতে দেখলেন তাহের শেখ আর সুরভীকে। মার্জান নিজেকে সঠিক প্রমান করার জন্য বার বার বলছে,

” আমি কিছু করিনি, মাকে মা-রি’নি। মা… মা গো… মা!”

মার্জানের পেটে মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভব হতে গলা কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো শুধু। এর পর পুড়ো পৃথিবী অন্ধকার করে চোখ বুঝলো মার্জান।

সারা-রাতের ঝড়-বৃষ্টির পর সকালের মিষ্টি নরম সোনালী আলো কিশোরী হাসির মতো ঝলমল করছে। পাখিরা গাইছে গান। গতিশীল পৃথিবীর গতিপথের ধ্বনি। মার্জান পিট পিট করে চোখ খুললো এবার। হসপিটালের সাদা চাদর মুড়ি শুয়ে আছে মার্জান। মার্জানকে চোখ খুলতে দেখেই এক বৃদ্ধা বলে উঠলেন,

” মার্জান বেবি এখন কেমন লাগছে?”

মার্জান ওঁর সামনে ওঁর বাবার বাড়ি কাজের মহিলা মনোরমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ফুপিয়ে উঠে বলল,

” আন্টি, মা…”

“আমি জানি বেবি। তুমি কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে!”

মার্জান বলল,

” কিছু ঠিক নেই আন্টি। কিছুই না। সবাই আমাকে ভুল ভাবছে, কেউ আমাকে মায়ের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না!”

বলেই আবারো কাঁদতে লাগলো ওঁ। মনোরমা তখন বলে উঠলো,

” বেবি, সত্যি কখনো চাপা থাকে না। তুমি কেঁদো না। সত্যিকে লুকিয়ে রাখতে তো পারা যায় কিন্তু মুছে ফেলা যায় না। আর তোমার এই অবস্থা এতো টেনশন নিয়া ঠিক না বেবি। তোমার বাচ্চার উপর প্রভাব পড়বে!”

মার্জানের বাচ্চার কথা কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো,

” বাচ্চা…!”

মনোরমা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। মার্জান থম মেরে গেলো। নিজের জীবন নিয়ে টানাটানি এর উপর এই বাচ্চা? কিভাবে পারবে মার্জান সামলাতে এইসব কিছু?

কিছুক্ষণ পর….
ডাক্তারের কেবিনে বসে আছে মার্জান। এতক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে বলল,

” মেম আমি এই বাচ্চা চাই না।”

ডাক্তার মার্জানকে আজব নজরে দেখলো। বলল,

” আজ-কালকের ইয়াং জেনারেশনদের কি যে হয়েছে? একে অপরের কাছে আসতে সময় লাগে না। কিন্তু বাচ্চা চলে এলেই মারতে চলে আসে।”

কথা গুলো গায়ে বিঁধলে চুপ রইলো মার্জান। ডাক্তার তখন এবসন পেপার এগিয়ে দিয়ে বললেন ফিলাপ করে জমা দিতে কাউন্টারে। মার্জান তাই করলো। কিন্তু সাহস এবার হারিয়ে গেলো ওটির ভিতরে এসে। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো একটি মেয়ে বাচ্চা এবোট করিয়েছে। ট্রের মাঝে একটি বাচ্চার সদ্য গড়ে ওঠা ছোট ছোট হাত-পা, মাথা, শরীর। কেঁটে কেঁটে বেড় করে রাখা। কি নির্মম দৃশ্য মার্জানের হাত পা শিউরে উঠলো। নিজের অজান্তেই পেটের মাঝে হাত চলে গেলো। চোখ দিয়ে পড়তে লাগলো জল গড়িয়ে। মার্জানের চোখে ভাসতে লাগলো বার বার ওই ছোট শরীরটা। একটি নার্স এসে নিয়ে গেলো সেই ট্রে টা। মার্জানের কি হলো সে নিজেও গেলো পিছুপিছু। নার্সটি ওই ট্রে টির বাচ্চাটাকে বাহিরের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। মুহূর্তেই দু’টো কুকুর এসে কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিলো বাচ্চার ছোট ছোট মাংসের পিন্ড গুলো। চোখের সামনে এসব দেখে গা গুলিয়ে এলো মার্জানের। বমি করে বসলো ওঁ। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই ওঁর বাচ্চার সাথে-ও এমনটি হবে? ফেলে দিয়া হবে কোনো ডাস্টবিন, ছিঁড়ে-বিড়ে খাবে এই কুকুর গুলো? বুকে মাঝে ভাড় ভাড় মনে হচ্ছে মার্জানের। নিঃস্বার্থ এই পৃথিবীর বুকে কেউ নেই এখন পাশে। এঁকা জীবন কিভাবে পাড় করবে ওঁ বা এই বাচ্চাটিরই বা কি হবে? কি নাম দিবে এই বাচ্চাটিকে? নাজায়েজ, নষ্ট রক্ত আরো কত কিছুই না শুনতে হবে? মার্জানের কাছে না-হয় বাবা ছিল টগরের মতো মা ছিলো, কিন্তু এই বাচ্চাটির তো কেউ থাকবে না! মার্জান যুদ্ধ করতে লাগলো এক প্রকার মনের সাথে।

” ম্যাম চলুন এবার আপনার পালা!”

একটি নার্সের গলা ভেসে এলো। ভেঁজা চোখে তাকালো মার্জান। পাশেই এসে দাঁড়ালো মনোরমা। বলল,

” মার্জান বেবি, মা হওয়া ভাগ্যের বিষয়। বাচ্চাটি কি দোষ করেছে বলো? বাকিটা তুমি যা ভালো বোঝো!”

মার্জান মনোরমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দূর থেকে একটি ছোট বাচ্চার হাসির খিলখিল শব্দ কানে বাঁজতেই তাকালো মার্জান। আহ্ কি সুন্দর হাসি, কি মায়াবী, কত মিষ্টি সেই অনুভূতি। মার্জানের ভাবনার আবার ফোঁড়ন কাঁটলো নার্সের কন্ঠে,

“ম্যাম চলেন জলদি!”

বলেই হাত টেনে তুলে নিয়ে যেতে লাগলো ওটির ভিতরে। হসপিটালের সাদা কাপড় পড়িয়ে শুয়ে দিলো বেডে। ওটির তীব্র আলোটি ধাম করে জ্বলে উঠলো। কি করবে মার্জান? নিজের মনের সাথে এখনো চলছে লড়াই… মন বলছে ছুটে পালিয়ে যেতে। ওইদিক মস্তিষ্ক বলছে…. নাহ্ যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে।শেষ পর্যন্ত কি তাহলে এই নিষ্প্রাণ শিশুটি খবার হতে চলেছে ওই কুকুর গুলোর???

চলবে,