জোয়ার ভাটা পর্ব-৫+৬

0
347

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৫।

পাঁচ বছর পর….
ভোররাতের স্বপ্নদেখে ঘুম ভেঙে গেলো মার্জানের। স্বপ্নটা ঠিক পাঁচ বছর আগের সেই হোটেল রুমটিতে কাঁটানো অচেনা, অজানা পুরুষটিকে নিয়ে। স্বপ্নের মায়ায় আচ্ছন্ন করে রইলো তাকে। চতুর্দিক এবার আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। মার্জান পর্দা সরিয়ে নিলো। পাঁচ বছর আগেই যে শহরটা ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়ে ছিলো সুইজারল্যান্ড। আজ আবারো ফিরে এসেছে সেই শহরটিতে।কিছু হিসেব নিকেশ ক্লোজড করতে। যা মার্জানের ছিলো, তা ফিরিয়ে নিতে। মার্জান সপ্তপর্ণ শ্বাস লুকিয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। বিছানার উপর ছোট্ট মৃণাল ঘুমিয়ে আছে ছোট ছোট হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মার্জান হেসে ফেললো। ছেলেটি ওঁর এতো ঠান্ডার মাঝেও গায়ে কিছু রাখতে চায় না। মার্জান আবারো কাথা টেনে গায়ে জড়িয়ে দিলো। মৃণালের ঝলমলে সিল্কি চুলে হাত বুলিয়ে কঁপালে চুমু খেলো মার্জান। এই বাচ্চাটি আজ ওঁর সব। পারেনি মার্জান.. পারেনি সেদিন নিজের অস্তিত্বকে বিলিন করতে। তবে মার্জান অনেক খুশি.. খুব বেশিই খুশি। মৃণালের মা হতে পেরে। সে এখন গর্বের সাথে বলে মৃণালের মা সে। মৃণাল খুব বাধ্যগত, বুদ্ধিমান ছেলে। বাচ্চাটির ধবধবে ফর্সা রং আর মায়াবী হাসির প্রেমে পড়ে যায় সবাই।ছোট মুখটিতে মায়ের প্রতিছবি। নাক আর চোখ গুলোর মিল নেই। কিন্তু এই ছোট বাচ্চাটির শরীরে লুকেমিয়া নামক রোগে বাসা বেঁধেছে শরীরে। মার্জানের চোখে জল টলমল করে উঠলো। জীবনে চলার পথে কত কাঠিন্যের স্বীকার হচ্ছে মার্জান। মার্জান ছেলেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক তখনি কলিং বেল বেঁজে উঠলো। মার্জান চটজলদি উঠে গেলো। মৃণালের ঘুম যেন না ভাঙ্গে সেভাবেই ধীরে সুস্থে নেমে দরজা খুলতেই ঝাঁপটে ধরলো কেউ।

” মার্জান… ও মেরে জান… তুই সত্যি চলে এসেছিস! আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি… আমাকে একটি বার ফোন দিস নি!”

কন্ঠে আনন্দ, উল্লাসের সাথে অভিমান ও প্রকাশ করলো শীপ্রা। মার্জানের এবার যেন শ্বাস আঁটকে আসতে লাগলো,

” ওঁ মেরি মা… ছাড় আমাকে মেরে ফেলবি নাকি? আগে ফোন চেক কর। এসেই ফোন করেছি নাম্বার বন্ধ করে বসে আছিস! আবার আমাকে বলছিস?”

শীপ্রা জিব কাঁটলো,

” ও.. হো! ভুলেই গেছিলাম চার্জ করতে ভুলে গেছি বোধয়। হে হেহে।”

ওঁদের কথার ছোট একটা কিউট বাচ্চা চোখ ঢলতে ঢলতে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে,

” জান..মৃণাল উঠে গেছে কিসি করো!”

মৃণালের কথা শুনে শীপ্রা বলল,

” ওহো মৃণাল, আপনাকে এই নাইট সুটে আরো সুন্দর লাগছে। আজ না-হয় কিসিটা জানের বদলে আমি করে দি?”

মৃণাল হেসে বলল,

” ওহো প্রীটি আন্টি, তুমি আমাকে পড়ে কিসি করো, প্রথম কিসি-তো জান করবে।”

বলেই দৌড়ে কোলে উঠে গেলো মার্জানের। মার্জান মৃণালের গালে চুমু খেলো। শীপ্রা বলল

“ছোট বোম আপনি কি আমাকে আপনার গার্ল ফ্রেন্ড বানাবেন?”

চট করে উত্তর দিলো মৃণাল,
” ও হো আন্টি, মৃণাল জানে, ও পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর, কিউট ছেলে, তবে কি, ওঁর তো মা-ই সব। তুমি বরং তোমার কোনো বন্ধুকে করে নাও!”

মার্জান হেসে ফেললো। শীপ্রা উল্টো ক্ষেপে গেলো। বলল,

” আমাকে রিজেকশন? দেখে নিবো হুহ।”

মৃণাল হেসে ফেললো। ওঁর ছোট কিউট নাকটা টিপে দিয়ে বলল মার্জান,

” মৃণাল চলেন এবার ওশারুমে যাই।”

মৃণাল চটজলদি নেমে গিয়ে ছুটলো ওয়াশরুমে, যেতে যেতে বলল,

“ও-হো মম আ’ম নট কিড।”

ছোট থেকেই দেশের বাহিরে থাকার কারণে মৃণাল খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারে। শুধু তাই নয়, নিজের কাজ গুলো আরো ছোট বয়স থেকেই নিজেই করতে শিখিয়েছে মার্জান। শীপ্রার মা আর ছেলের ভালোবাসা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে। মার্জানের হাতে হাত রেখে বলল,

” চিন্তা করিস না মার্জান ভাইয়া সব ঠিক করে রেখেছে।”

মার্জান ছোট শ্বাস ছাড়লো। শীপ্রা মার্জানের ছোট বেলার বান্ধবী। দুঃখ সুখের সাথী। এই দেশ ছাড়বার সময় অনেক সাহায্য করেছে মার্জানকে। এবং কি এখনো করে যাচ্ছে। মার্জান ভাবনায় ঢুবে ছিলো। ঠিক তখনি শীপ্রা বলল,

” দোস্ত চল বাহিরে যাই রাতে কিছু খাইনি। এখনতো ইঁদুর দৌড়াচ্ছে পেটে।”

” জান মৃণালের ও পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। ”
পিছন থেকে বলল মৃণাল। একদম টিপটপ করে রেডি সে। মাথা ছোট একটা কেপ লাগিয়ে নিয়েছে। ড্রেসের সাথে মেচ করে। শীপ্রা হা হয়ে বলল,

” মৃণাল…আমি কিন্তু ক্রাশ্ড তোর উপর!”

মৃণাল ভাব নিয়ে বলল,

” ইতনি সুন্দর হু মে কেয়া কারু!”

সবাই হেসে ফেললো। মার্জান বলল,

” বাহিরে কিছুই খাবো না এত সকালে, তোরা বস আমি কিছু বানিয়ে আনছি। ”

বলেই উঠে চলে গেলো মার্জান। শীপ্রা তখন মৃণালকে কাছে টেনে নিলো। মৃণালকে গভীর ভাবনায় মগ্ন দেখে জিজ্ঞেস করলো,

” কি হয়েছে মৃণাল, তুমি কি ভাবো?”

মৃণাল গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,
” ভাবছি, জানের জন্য একটা বয়ফ্রেন্ড দরকার। যে জানের খেয়াল রাখবে। মৃণাল তো ছোট, জানের খেয়াল রাখতে পারে না।”

শীপ্রার বড্ড মায়া লাগলেও, হেসে ফেললো। মজা করে বলল,

” তোমার মাকে তাহলে বিয়ে করিয়ে দি?”

মৃণাল গাল ফুলিয়ে বলল,
” আমি নিজেই খুঁজবো এমন কাউকে। যে জানের সাথে আমাকেও চাইবে!”

থম মেরে গেলো শীপ্রা। এতটুকু ছেলে, আর ভাবনা কত বড় বড়। সত্যি বয়সের আগে বড় হচ্ছে মৃণাল। মায়ের জন্য কত টেনশন।শীপ্রার চোখে পানি চলে এলো মা-ছেলের ভালোবাসা দেখে।

ঘড়িতে ১২ টা বেঁজে ৩৫ মিনিট। দুপুরের রোদ এবার মাথার উপর। হসপিটালের প্রতিটি কক্ষে পড়ছে গাছপালার ছায়া। বাসা বেঁধেছে চড়ুই। ওদের চু চু চা শোনা যাচ্ছে। পিনপতন নীরবতা ভেঙে শীপ্রা বলল,

” ভাই কোনো পথ কি নেই!”

রাহাত ডাক্তারের সাদা এপ্রন গায়ে গম্ভীর দৃষ্টি মেলছে প্রতিটি রিপোর্টে। বলল এবার,

” মার্জান, মৃণালের বাবাকে এখন খুব দরকার। নয়তো মৃণালকে বাঁচানো খুব মুশকিল। তবে আমি চেষ্টা করবো। অন্য কারো সাথে ওঁর ব্রণ ম্যারো মিলে কি-না। যদি-ও ৪০% চান্স। কিন্তু ওঁর বাবা হলে বেশি ভালো হয়।তাই সাজেস্ট করবো বাবাকে যত সম্ভব আসতে বলো!এই চিকিৎসা অনেক টাকার প্রয়োজন পড়বে মার্জান। আর হ্যাঁ যত জলদি পারো ভর্তি করিয়ে দিয়ো মৃণালকে হসপিটালে। যেন ওর ট্রিটমেন্ট খুব জলদি শুরু করতে পারি আমরা।

মার্জান চিন্তায় পড়ে গেলো। সেই রাতের ওই পুরুষটিকে কোথায় খুঁজবে মার্জান? কোথায়? ওরা কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো। যদিও চার বছর আগে এ শহর ছাড়ার সময নিজের বাবার বাড়ি যেটা মার্জানের নামে ছিলো তা বিক্রি করে গেছিলো মার্জান। এর সাথে টিভিতে অনেক অ্যাডভার্টাইজমেন্ট ও কিছু শো-তে কাজ করে নিজের সেভিংস করেছিলো। এখনো কিছু আছে সেভিংস। তবে মার্জান ওই যুবকটিকে কোথায় খুঁজবে? মার্জানের মাথায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠতে দেখে মৃণাল ওর মধুর কন্ঠে অকপটে বলে উঠলো,

” জান? মৃণালকি মারা যাবে?চিন্তা করো না.. মৃণাল তোমার বেস্ট পার্টনার খুঁজে দিবে, যে মৃণালের মতো খেয়াল রাখবে!”

মলিন কন্ঠে শুধালো মৃণাল। মার্জান ঢুকরে উঠলো। ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,

” আমার মৃণালের কিছু হবে না, আমার আর কাউকে চাই না। মৃণালকেই চাই।”

মৃণাল নিজেও কেঁদে উঠলো। দু’জনকে এভাবে সেন্টি হতে দেখে শীপ্রা বলল,

” উফ, আবার শুরু হলো তোমাদের ড্রামাটিক ভালোবাসা। এবার কিন্তু আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছি। করো করো দেখাও সবাইকে তোমাদের রিলেশন কত মধুর। ”

মৃণাল বলল,

” জান তুমি এমন বান্ধবী কিভাবে পেলে বলো? কথায় কথায় আমাদের দেখে শুধু হিংসে করে। হুম!”

শীপ্রা চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” হয় তো কি করবো বলো তো মৃণাল! এক কাজ করো, তুমি আমার সাথে ডেটে চলো এক দিনের জন্য যদি একটু কমে হিংসে টা?”

মৃণাল জবাব দিলো,

” তাহলে কিন্তু কোলে করে রাখতে হবে আমি কিন্তু হাটতে পারবো না!”

শীপ্রা হেসে দিলো। গাল টেনে বলল,

“ওক্কে মেরি জান!”

মৃণাল নাক মুখ কুঁচকে ফেলল,

“ডোন্ট টাচ মাই নোস, তাহলে কিন্তু যাবো না আমি!”

হাত দুটি উপরে তুলে বলল শীপ্রা,

” আচ্ছা বাবা সরি”

এর পরেই মার্জানকে বলল,

” চল আজ তোদের আমি ট্রিট দিবো। আমার পছন্দের জায়গায়। ”

রাজি হলো মার্জান। আলিশান রেস্টুরেন্টের রুফ টপে দাঁড়িয়ে ওঁরা। চতুর্দিকে মানুষের ভীড়। এখানের খাবার সব থেকে জনপ্রিয় যেন। শীপ্রা গেছে সিট বুকিং দিতে। মার্জান পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো। আবারো এন্টারটেইনমেন্ট জগতে প্রবেশ করতে চলছে মার্জান। ওর এক ফ্রেন্ড যার নাম নির্ঝর সে খুব পপুলার অ্যাক্টর। নতুন একটি শো শুরু হতে চলেছে, যাতে নতুন মুখ খুঁজছে ওঁরা। কাল সকালে ওর ইন্টারভিউ। মার্জানের কথার মাঝেই কত গুলো বডিগার্ড ঢুকলো রেস্টুরেন্টে। কাউন্টারে গিয়ে খালি করতে বলল রুফ টপ। কোনো এক ভি আই পি আসচ্ছে এখানে লাঞ্চ করতে, সেই বুক করে নিয়েছে পুরোটা। কিছুক্ষণ পরেই দীর্ঘকায় এক যুবক কালো প্যান্ট আর শার্টে ঢুকলো। যুবকটির পিছন পিছন একটি সুন্দর তরণী এক প্রকার দৌড়ে যাচ্ছে,

“গ্রীষ্ম প্লিজ আমার কথা শোনো। আই লাভ ইউ.. আই লাভ ইউ লট। আমার কথা শোনো সামার!”

চেচিয়ে উঠলো রাত্রী। গ্রীষ্ম দাঁড়ালো না। চলে যেতে লাগলো। পিছনে না ফিরেই বলল,

” কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি না। তোমাকে কেন? আমি কোনো মেয়েকেই পছন্দ করি না। আই হেইট গার্লস!”

সকলের সামনে এভাবে রিজেকশনে মিয়ে গেলো রাত্রী। গ্রীষ্ম এভাবে সকলের সামনে অপমান করবে ভাবেনি সে। এদিকে রেস্টুরেন্টে সবাই ঘুরঘুর করে দেখছে তাঁদের। মার্জান কথা বলার মাঝে চোখ পড়লো সেখানে। মার্জান সেই রাতে যুবকটির সাইট ফেইস দেখেছিল ঠিকি। কিন্তু এই যুবকটি কি সেই? মার্জান উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো। ছেলেটির লম্বা কাঁধ ছাড়া আর কিছুই দেখা গেলো না। মৃনাল বলল তখন হেসে,

” ওয়াও, জান… এই আঙ্কেলটা কত কুল। তার আগে পিছনে কত গার্ড দেখো। তবে, উনি আমার থেকে সুন্দর না। তাই না জান!”

মার্জান ছেলের দিকে তাকালো। ছেলেটি একদম ওর মতো দেখতে, কিন্তু দেহের গঠন আঙ্গুল, চোখ, নাক, চুল সব যেন ওঁর বাবার মতোই। মার্জার মৃণালের গালে পরম ভালোবাসা নিয়ে স্পর্শ করলো,

” হ্যাঁ আমার বাচ্চা সব থেকে সুন্দর!”

মৃণাল বিশ্ব জয়ী হাসি দিয়ে আকড়ে ধরলো ওঁর মাকে। তখনি শীপ্রা রাগে ফুঁসতে ফুসঁতে ওদের কাছে এলো,

” শালারা সব পোশা কুকুর, ভি আইপি দেখে নি লালা টপকাতে শুরু। সরি মার্জান চল অন্য কোথাও যাই। এটা বুকিং করে নিয়েছে কানো নবাবজাদা।”

মার্জান মাথা নাড়ালো। এরপর ওড়া চলে গেলো অন্য একটি রেস্টুরেন্টে।

রাতের আঁধারে টিম টিম তারা গুলো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। ঝুপ করে হয়তো নেমে পড়বে বৃষ্টি। ভিজিয়ে দিবে শহর। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে দিবে মুহূর্তেই। মার্জানের জানা নেই, এত বড় শহরটিতে দেখা মিলবে কি আবার ওই রাতের পুরুষটির সাথে? আর দেখা হলেই বা কি? মার্জানকে কি মনে রেখেছে সে? মেনে নিবে কি ওঁর বাচ্চাটাকে? মার্জানের আফসোস ছিলো না, মৃণালের বাবা নেই বলে, কিন্তু গত দু’ টো মাস মৃণালের বাবার প্রয়োজন পড়ে যাবে, তা কি সে জানতো? আচ্ছা আজকে এই যুবটি কি সে হতে পারে? তাহলে কি এসব কিছু উপর ওয়ালার ইচ্ছে? মার্জান ভাবতে পারলো না। সকালের ইন্টারভিউ এর কথা ভেবেই চলে গেলো ঘুমাতে। সকালের বৃষ্টিস্নাত মাথায় করে বেড়িয়ে যায় ও। গত রাতের বৃষ্টি এখন পর্যন্ত তান্ডব চালাছে। মার্জান প্রায় ভিজেই যাচ্ছে। এদিকে সময় নেই হাতে বেশি একটা। মৃণালকে শীপ্রার কাছে রেখেই কোনো রকম ছুটেছে। কিন্তু একটি অটো – রিক্সা কিছুই নেই। মার্জান এবার লিফট নিবার জন্য হাত বাড়ালো। একটি গাড়ি থেমেও গেলো। গাড়ির কাচ নামাতেই মার্জান বিনীত সুরে বলল,

” আমাকে একটু মেইন রোড পর্যন্ত লিফট দিতে পারবেন?”

জীবন মাথা নাড়িয়ে পিছনে বসতে ইশারা করলো। পিছনের দরজা খুলতেই ধক করে উঠলো মার্জানের বুক। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর….

চলবে,

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৬।

জীবন মাথা নাড়িয়ে পিছনে বসতে ইশারা করলো। পিছনের দরজা খুলতেই ধক করে উঠলো মার্জানের বুক বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর… হঠাৎ করেই চিরচেনা একটি সুদর্শন প্রতিছবি ভেসে উঠলো। দুরুদুরু বুকে উঠে বসলো গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করলো। পিনপতন নীরবতা। মার্জান আঁড় চোখে তাকালো পাশের অভিব্যক্তিহীন মানুষটির দিকে। যার শক্ত পোক্ত চোয়াল। পার্ফেক্ট জো লাইন। ফর্সা মুখের চাপা দাড়ি। লোকটি একটি ব্ল্যাক শার্ট পড়ে আছে। শার্টের তিনটে বোতাম খোলা, যার ফলে ধবধবে ফর্সা বুক দেখা যাচ্ছে। মার্জান ভ্রু কুচকালো। সপ্তপর্ণ শ্বাস লুকিয়ে ফেললো। কিছুটা হতাশ দেখালো ওঁকে। মার্জানের মা একবার বলেছিলো,

” যে ছেলেদের বুকে চুল হয়, তাদের অনেক মায়া দয়া থাকে। এরা অন্যের প্রতি খুব সহনশীল হয়।”

তাহলে কি এই ব্যক্তি দয়াহীন? মার্জান চোখ ফিরিয়ে নিলো। ব্যক্তিটি মনে হচ্ছে ঘুমুচ্ছে। ভাড়ী শ্বাস ফেলছে ওঁ। মার্জান আবার তাকালো দাম্ভিকপূর্ণ মুখপানে। গুরু-গম্ভীর দেখতে এই মানুষটি কেমন হতে পারে? আচ্ছা এই ব্যক্তিটি কি সত্যি ওই রাতের মানুষটি? চট করেই মাথায় কিছু আসতেই মার্জান ঝুঁকে পড়লো, যুবকটির দিকে।খুব কাছে চলে এলো ওঁ। যুবকেটির ঘনঘন পড়া শ্বাস-প্রশ্বাস মার্জান অনুভব করতে পারছে।মার্জানের শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলছে এর ফলে। নিজে শ্বাশালো মার্জান।নিজেকে তটস্থ করে, যুবকটির চুলের কাছে আসতেই থেমে গেলো ওঁ। দোনোমোনো করতে লাগলো। ব্যক্তিটির চুলে হাত দিতেই ব্রেক কসলো জীবন। পিছনের কান্ড সব টুকু দেখেছে জীবন সামনের মিরোরে। ঘুমন্ত হিংস্র পুশুর কবলে পড়তে কেন চাইছে এই মেয়েটি? ওঁর স্যার একবার বুঝতে পারলে একে বারে বাহিরে ছুঁড়ে ফেলবে। জীবন আহ্ ভরে নিলো। এদিকে ব্রেক কসার সাথে সাথেই মার্জান হেলে পড়েছিলো সামনের দিকে, আরেকটু হলেই মাথায় আঘাত পেতো ওঁ। ঠিক তখনি মার্জান নিজের কোমরে শক্ত একটি হাত অনুভব করলো। ভয়ে কলিজায় পানি শুকিয়ে যাবার অবস্থা । মার্জানের বুক ধকপক ধকপক করতে লাগলো। মার্জান ভয়ে যখন কুঁকড় যাচ্ছে, তখনি শুনতে পেলো একটি ঝংকার তোলা গম্ভীর বরফ কন্ঠ,

” ঠিক মতো বসো মিস। এত নরছো কেন?”

মার্জান থম মেরে গেলো। এই যুবকটি, এতক্ষণ কি সত্যি ঘুমুচ্ছিলো? মার্জান একে বারে সোজা হয়ে বসে পড়লো। মৃদুমন্দ কাপচ্ছে ওঁর শরীর। এর আগে অজ্ঞাত অবস্থায়, কখনো কোনো পুরুষের এত কাছে আসেনি মার্জান। যতটুকু এই যুবকের কাছে এসেছিলো। এখনো নাকের মাঝে লোকটির গায়ের ঘ্রাণ লাগছে। লোকটি আবারো আগের মতো বসে পড়েছে। ভাবহীন ভাবে, যেন পাশে ওঁর কেউ নেই, কিছুক্ষণ আগে কিছুই ঘটে নি। মার্জান আবারো আড় চোখে তাকালো। যুবকটি চোখ বুঁজে। কিন্তু মার্জানকে অবাক করে লোকটি হাক ছাড়লো,

” জীবন। ”

জীবন থেমে গেলো। গ্রীস্মের কথা বুঝে গেলো যেন। মার্জানকে অবাকতার শেষ চুড়ায় নিয়ে ফেললো এবার।

” ম্যাম আপনাকে এখানেই নামতে হবে!”

মার্জান আর কিছু বললো না। সোজাসাপ্টা নেমে পড়তেই। গাড়িটি ধুলো উড়িয়ে স্বা করে চলে গেলো। মার্জান চেয়ে রইলো গাড়িটির যাওয়ার পানে। গাড়িটি একেবারে উধাও হতেই মার্জান হাতের মুঠি খুললো। ছেলেটি ঝলমলে সিল্কি চুল মার্জানের হাতে। মার্জান ঠিকি নিজের কাজ করে নিয়েছিলো। ভেবেই বাঁকা হাসলো। এবার শুধু টেষ্ট করবার পালা। মার্জান কোনো খারাপ মতলব নিয়েতো আর এসব করেনি, মার্জান ওঁর ছেলের জন্যই করছে সব। মার্জান হাসলো এবার। কত কিছুই করতে হচ্ছে এই জীবন। মার্জান ফোনে টাইম দেখার জন্য ওপেন করলো। জ্বলজ্বল করে উঠলো মৃণালের মুখ। হ্যাঁ মার্জান ভুল কিছু করছে না, ভাগ্য নিজেই দাঁড় করিয়েছে ওই নাম অজানা ছেলেটির সামনে। মার্জান ফোন পার্সে ঢুকাতেই বেঁজে উঠলো ওঁর ফোন। মার্জান চেক করতেই ভেসে উঠলো…

“মৃণাল’স কলিং!”

ফোন তুলতেই মৃণালের আদুরে কন্ঠ শোনা গেলো,

“জান….মৃণাল মিসড ইউ।”

মার্জান আবেগী হয়ে পড়লো। রাস্তা ধারে হাটতে হাটতে বলল,

” আই মিসড ইউ টু বেবি!”

মৃণালের আবার কন্ঠ শোনা গেলো,

” জান.. তোমার ইন্টারভিউ কি হয়ে গেছে?”

“নাহ্ বেবি, আমি মাত্র আসলাম, সময় আছে আরো।”

“ওকে জান.. অ্যাল দ্যা বেস্ট…। মৃণাল ওয়েট করবে তোমার জন্য, জলদি এসো।”

” ওকে বেবি।”

বলেই ফোন কাঁটতে নিবে তখনি ওঁপাশ থেকে শীপ্রার কন্ঠে শোনা গেলো,

“মা যায়-নি এক ঘন্টা হয়নি অমনি মিস করা শুরু আর এখানে এত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখেও পাত্তা দিচ্ছ না!”

মৃণাল বলল,

” ও হো আন্টি, আপনি কত হিংসুটে। ”

শীপ্রা হা হয়ে গেলো। মার্জান এসব শুনে হাসতে হাসতে ফোন কেঁটে অফিসে ঢুকে পড়লো।তখনি আননোন নাম্বার থেকে একটি মেসেজ আসলো মার্জানের ফোনে,

“*ভোর রাতের আলোয় ফোঁটা বেলি ফুল তুমি,
সুবাস মাখা গন্ধরাজ, তোমার আলোয় হয় আলোকিত আমার ভুবনের আঁধারিয়া অম্বর। *

মান এল দ্যা বেস্ট”

মার্জানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো। হ্যাঁ এক এই ব্যক্তিটিই তো আছে, যে জানে মার্জানের মনের খবর।

এদিকে শীপ্রা আর মৃণালের বালিশ লড়াই চলছেই। লড়াইয়ের এক পর্যায় দু’জন হাপিয়ে গেলো। শীপ্রা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

” ছোট বোম আইসক্রিম খাবা?”

মৃণালের চোখ চকচক করে উঠলো। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াতেই শীপ্রা খুশি হয়ে ওঁকে নিয়ে চলল সামনের আইসক্রিমের দোকানে। শীপ্রা জিজ্ঞেস করলো মৃণালকে,

” কোন ফ্লেভারের টা খাবে?”

” ভ্যানিলা ফ্লেভার! ”

শীপ্রা অপরিচিত কন্ঠ শুনে মুখ কুঁচকে পিছনে ফিরলো। লম্বা, সৌম্যদর্শন একজন যুবক দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে যাচ্ছে। যার পরনে টি শার্ট আর কালো প্যান্ট, মাথা কালো হ্যাট। যার জন্য চুল গুলো দেখা যাচ্ছে না।

” লাভ তুমি! আবার… নো ওয়ে…!”

বলেই মৃণালের হাত চেপে ধরে উল্টো পথে হাটা ধরলো। লাভতো নাছর বান্দা। মৃণালের হাত চেপে ধরে ফেললো অন্য পাশে। শীপ্রা এতে দাঁড়িয়ে যায়। পিছনে না ফিরেই খেক করে উঠে,

” ছোট বোম, আমার মুড ঠিক নেই, পড়ে আইসক্রিম কিনে দিবো, এই অসভ্য লোক যাক আগে বাপ, এখনে দাঁড়াস না চল, আয়!”

বলেই টানতে লাগলো। এদিকে লাভ টানছে এদিকে শীপ্রা। বেচারা মৃণাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, একবার ওঁর আন্টি আরেকবার লাভ নামক উড়ে এসে জুড়ে বসা আঙ্কেলকে দেখে যাচ্ছে।

“ওহো আঙ্কেল, আন্টি তোমরা কি মৃণালের সুন্দর হাত ছিঁড়ে ফেলতে চাইছো? মৃণালের সুন্দর হাত ছিঁড়ে গেলে, মৃণালকে অসুন্দর লাগবে, তখন মৃণালকে তো কেউ ভালোবাসবে না।”

মৃণালের কথায় থম মেরে গেলো দু’জন। শীপ্রাও পিছনে ফিরলো এবার। লাভ তো মৃণালের কথায় ঘায়েল হয়ে গেছে। লাভ চট করেই তুলে ঘারের উপর বসিয়ে নিলো মৃণালকে। বলল,

” না-তো আমরা-তো খেলছিলাম মৃণালের সাথে। ”

” সত্যি? ”

লাভ মাথা নাড়ালো। এর পরেই শোনা গেলো শীপ্রার গলা। কিছুটা রাগ প্রকাশ পেলো তাতে,

” কি চাই তোমার লাভ, ওকে নামাউ, আমাদের দেড়ি হচ্ছে।”

লাভ ফুরফুরে কন্ঠে বলল,

” লাভকে তো লাভ চাই, আর কি চাই?”

শীপ্রা চোখ রাঙ্গাতেই, লাভ বাচ্চাদের মতো ছোট করে ফেললো মুখখানা। মৃণাল বলল তখন,

” লাভ আঙ্কেল আন্টির কাছে লাভ চাইছে? ওয়াও, এটাতো ভালো কথা, কিন্তু মনে হচ্ছে আন্টি লাভের লাভ চায় না।”

মৃণালের গাল টেনে বলল লাভ,

” চায় চায় মৃণাল, তবে মুখে বলে না। ”

মৃণাল ঠোঁট উল্টে ফেললো। বড়দের কিছু কথা ওঁর মাথায় ঢোকে না। এ কেমন কথা, মৃণালের তো যা চায় সব মুখ ফুঁটে বলে দেয়।

” কেন করছো আমায় ফোলো।”

“উত্তর তোমার জানা।”

শীপ্রা হতাশার শ্বাস ছাড়লো,

” তুমি জানো, আমি তোমার বয়সে ছয় মাসের বড়। সো এসব বাচ্চাদের মতো কান্ড কারখানা বন্ধ করে বাসায় যাও।”

লাভ এতক্ষণ হাসছিলো। এবার মুখের হাসি ঠুস করে উবে গেলো, গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” শীপ্রা আই রেইলি লাভ ইউ। কত বার আর ফিরাবে? বয়সে বড় হয়েছো বলে কি হয়েছে, দেখো আমি তোমার থেকে কত বড়? কে বলবে কার বয়স কত?বলো?”

লাভ একদম কাছে চলে আসতেই শীপ্রা ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলো। হঠাৎ করেই বুকের ভিতর তবলা বাজাবার মতো আওয়াজ হতে লাগলো। শীপ্রা দু’পা পিছিয়ে গেলো সাথে সাথে। ঘাড় থেকে মৃণালকে নামিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

” তোমার অযুক্তিযুক্ত কথা বার্তার কোনো ভীতি নেই লাভ। আমার পিছনে এসো না। আমার উত্তর কখনো বদলাবে না!”

ছলকে উঠলো পানি শীপ্রার চোখের কোনে। আজ একটি বছর যাবৎ শীপ্রাকে নানা ভাবে মানাতে চাইছে লাভ। নিজের ভালোবাসার কথা বহুবার বলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরাবরের মতো রিজেকশন মেনে নিয়ে পিছনে ফিরে চলে গেলো লাভ। তবে যে সে হেরে গেলো? তা না… শীপ্রা জানে এই ছেলে আবার আসবে, হয়তো নতুন কোনো বাহানায়?

শীপ্রা ঘরে ফিরে এলো। মৃণালকে খেলতে রেখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে সেখানেই বসে নিস্তব্ধ কাঁদতে লাগলো। লাভকে দূরে ঠেলতে ঠেলতে কবে যে নিজেও লাভের উপর অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছে, শীপ্রা জানেই না। তবে শীপ্রার অতীত-কি কখনো ওকে এগিয়ে যেতে দিবে? কখনো সেই কাল অন্ধকারের ভিতর থেকে রক্ষা পাবে শীপ্রা? পাবে কি কখনো এক ফোঁটা আলো? নাহ্ পারবে না।

গতিশীল পৃথিবীর বুকে সবাই চলমান.. কিন্তু যখন প্রাণ পাখি উড়ে যায় তখন সব থেমে যায়? বড় বড় দালানকোঠার আর কোনো ভীতি থাকে না। তবুও মানুষ ছুটে। সাফল্যতার চূড়ায় যাবে বলে। মার্জান এই উঁচু বিল্ডিং এর উপর দাঁড়িয়ে এসবি ভাবছিলো। তখনি একজন এসে বলল,

” ম্যাম এবার আপনার পালা!”

মার্জান মাথা নাড়ালো। ওঁর পরনে এই মুহুর্তে একটি সাদা ওয়েস্টার্ন গাউন। সুশ্রী মুখে হালকা মেকাপ। নিজেকে প্রদর্শন করেছে খুব সামান্য ভাবেই। কিন্তু এতটুকুনেই অসাধারণ লাগছে ওঁকে। মার্জান ক্যাটওয়াক করে জাজদের সামনে এলো। মার্জানের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে সবাই। মার্জান নিজের অডিশন খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করলো। বিমোহিত হয়ে গেলো সবাই। করতালিতে গুঞ্জন তুললো হল। মার্জানকে সানন্দে গ্রহণ করলো সবাই। মার্জান খুশিতে আত্মাহারা। প্রথম বারেই মেইন লিডের রোল পেয়ে গেছে মার্জান। অডিশন শেষ হতেই সায়ন, যিনি ডিরেক্টর উনি জানালেন, উনার মেয়ে হয়েছে বলে উনি একটি পার্টি দিয়েছেন যেখানে বড় বড় স্টার, ডিরেক্টর, প্রডিউসর সহ অনেকেই আসতে চলেছে উনি সকলকেই আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। ডিরেক্টরের কথা সকলেই খুশি হয়ে গেছে। মার্জান-ও আপত্তি করলো না তাতে। মার্জান ড্রেস চেঞ্জ করতে গেলো চেঞ্জিং রুমে, পার্টিতে যাবার জন্য কাপড় এখান থেকে নিতে বললেন সায়ন। মার্জান এখানে এসে পরিচয় হয় সোফিয়ার সাথে, মেয়েটি খ্রিষ্টান। তবে মার্জানকে ওঁর অনেক পছন্দ হয়েছে। সেই কখন থেকেই মার্জানের সাথে গল্প করেই চলেছে। সোফিয়া বলল,

“জানো তুমি আমার দেখা সব থেকে সুন্দর মেয়ে। সত্যি বলছি, সুপার স্টার রিয়ানাও ফেইল।”

মার্জান হাসছিলো এতক্ষণ। রিয়ানা নামটি কর্ণপাত হতেই হাত দু’টি থেমে গেলো মার্জানে। জিজ্ঞেস করলো ওঁ,

” সোফিয়া? আজ রিয়ানাও কি আসবে?”

“হ্যাঁ আসবে তো অবশ্যই, সায়ন স্যারের বন্ধু হচ্ছে ভাদ্র স্যার। দু’জনের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর রিয়ানা তো ভাদ্র স্যারে বাগদত্তা। সে তো আসবেই!”

মার্জান এবার বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রিয়ানা আর ভাদ্র শেষ পর্যন্ত এক হতে চলেছে? মার্জানের বুকে একটা চাপা কষ্ট অনুভব হলো। টগরের মুখখানি মনে পড়লো। আচ্ছা ওঁর মা এখন কেমন আছে? মার্জানকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে সোফিয়া হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো,

“কোথায় হারালে? চলো জলদি।”

মার্জান হেসে পার্স নিয়ে বেড়িয়ে এলো। মার্জান এখন ড্রাক রেড কালার গাউন পড়েছে। এক সাইডে চুল বেনুনী করে সামনে এনে রেখেছে। পার্টি হলের লাইটিং-এ মার্জানকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মার্জান সোফিয়া সায়ন আর ওঁর ওয়াইফকে শুভেচ্ছা জানালো। সায়নের মেয়েটি একদম পরির মতো দেখতে। মার্জানের সায়নের মেয়েটিকে দেখে মৃণালের কথা মনে পড়ে গেলো। মার্জান তাই সবাইকে “এক্সকিউজ মি ” বলে সাইডে সরে এলো। মৃণালের নাম্বারে কল দিতেই ওপাশ থেকে ফোন তুললো শীপ্রা ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

“মার্জান মৃণাল ঘুমিয়ে গেছে।”

“এতো জলদি! ”

” হ্যাঁ আজ অনেক মাস্তি করেছি যে আমরা। তাই ক্লান্ত হয়ে গেছি।”

মার্জান হাসলো। শীপ্রাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে ফোন কেটে দিলো। মৃণাল ওঁর জীবনে আছে বলেই নিজেকে কুব ভাগ্যবতী মনে করে মার্জান। মৃণাল আছে বলেই হয়তো এখনো শক্ত পক্ত।

“দিদুভাই ”

চিরচেনা একটি কন্ঠর স্বর ধাক্কা মার মার্জানের কানে। চকিতে পিছনে ফিরতেই দেখতে পেলো রিয়ানা আর সুরভীকে। দু’জনের মুখে কুটিল হাসি।

” ও মা এতো সত্যি আমাদের মার্জান, আমিতো ভেবেছিলাম, এতদিনে মরে পচে কংকাল হয়ে গেছিস, এখন দেখছি নাহ্ জবরদস্ত আছিস!”

মার্জানের চোখে মুখে ঘৃণা উপচে পড়ছে। এত বছর পর এই মানুষ গুলোর সাথে দেখা এমন ভাবে পাবে কে জানতো?

“দিদুভাই, ইউ নো হোয়াট… আ’ম প্রেগনেন্ট। ”

গর্বের সাথে বলল রিয়ানা। যেন পৃথিবীর সব থেকে বড় সুখ এইটাই রিয়ানার কাছে। শুধু রিয়ানা নয়, সব মায়ের ক্ষেত্রেই। কিন্তু রিয়ানার টা যেন আলাদা। সম্পূর্ণটাই বানোয়াট শুধু মার্জানকে দেখানোর জন্যই। মার্জান চুপ করে শুধুু গিলছে এদের কান্ড কারখানা। মার্জান চায় না, নিজের গন্তব্য নতুন কোনো বাঁধা। সময় সব সময় কথা বলে। কথায় আছে না,

“বৃক্ষ তোমার নাম কি?
-ফলে পরিচয়।”

ঠিক তেমনটি। রিয়ানা বা সুরভীর কারো কথাতেই প্রভাবিত হতে দেখা গেলো না মার্জানকে। তাই রিয়ানা যেচে পরেই বলল আবার,

” জিজ্ঞেস করবে না, কার বাচ্চা আমার পেটে?”

মার্জান এবারো চুপ। এত কোনো মাথা ব্যথা নেই মার্জানের। রিয়ানার বাচ্চা হোক, বিয়ে হোক, মারা যাক, যা ইচ্ছে করে করুক তা ওঁর কি? মার্জানকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিয়ানা নিজেই বলে দিলো,

” ভাদ্রের!”

মার্জান এ পর্যায় হো হো করে হেসে উঠলো। যেন মজার একটি ঘটনা ঘটে গেছে এই মুহুর্তে। মার্জানকে এভাবে হাসতে দেখে সুরভী ভাবলো এ বুঝি শোকে পাগল হয়ে গেছে। মাথা নষ্ট হয়ে গেছে বুঝি। কিন্তু ওঁদের কথা ভুল প্রমাণ করে মার্জান বলে উঠলো,

” আই নিউ ইট। রিয়ানা.. সত্যি.. সিলি গার্ল। ওই যা ছিলে তুমি তাই.. বরাবর আমার এঁটে খেতে তোমার বড্ড ভালো লাগে। ছোট বেলা থেকে সে যাই হোক, আমার কাপড় তোমার তা চাই, আমার খেলনা তোমার চাই, আমার পছন্দের খাবার পর্যন্ত তোমার চাই। ইনফেক্ট আমার এক্স বয় ফ্রেন্ডকেও তোমার চাই। বোরিং লাগে না? নিজের কোনো চয়েস বলে কিছু আছে কি? মনে তো হয় না রিয়ানা। এতো সব কিছুর এখানে গর্ব করছো! এতটুকু লজ্জা করছে না তোমার? সেইম ওন ইউ।”

রিয়ানা মার্জানের মুখ থেকে এই প্রথমবার নিজের সম্পর্কে এত কথা শুনতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কথার পৃষ্ঠে কি বলবে, কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। তবে মার্জানকে হয় দাঁতে নয় বাতে আঘাত করাই এবার ওঁর মেইন মোটিভে। সুরভী এসব শুনে গায়ে হাত তুলতে নিতেই রিয়ানা থামালো হেসে বলল,

” এত লাফিও না মার্জান, ভুলে যেও না, তোমার মা আমাদের কাছে, এখনো আমাদের খাচ্ছে আমাদের পড়ছে, আমাদের টাকায় চিকিৎসা হচ্ছে। আই থিংক বুঝতে পেরেছো কি বলছি?”

মার্জান চোখ বড় বড় করে চাইলো। ওঁর মা.. ওঁর মা বেঁচে আছে? নাকি এঁরা মিথ্যা বলছে? মার্জানের মনের ভিতর অনেক গুলো অনুভূতির মিশ্রণ এক সাথে ডানা মেললো। মার্জানকে তো জানানো হয়েছিলো, টগর আর নেই, তাহলে? মার্জানের কন্ঠ স্বর ভাড়ী হয়ে এলো। জোড়ালো কন্ঠে বলল,

” মা… মা বেঁচে আছে? তোমরা আমার সাথে মজা করছো নিশ্চয়ই? ”

সুরভী এবার মনখোলা হাসলো। যাই হোক মেয়েটিকে এবার ভাঙতে পারবে। দেখতে পারবে চোখের কোনের জল। বলল,

” হ্যাঁরে… পাগল ভাগ্নী আমার। তোর মা জীবিত থেকেও মৃত। জানিস মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম তাকে, কিন্তু কি হলো বল, আমার বাবাতো আবার বড্ড দয়ালু মানুষ, আবেগের বসে টগরের সম্পত্তি সব তোর নামে করে গেছে। যখন আমাদের সত্যিটা জানতে পারলো বুঝি পটল তুললো। ”

মার্জান মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো,

” দাদাজান মারা গেছে?”

সুরভী মাথা নাড়ালো। মার্জানের কাছে গিয়ে মাথা হাত বুলিয়ে দেবা ভঙ্গি করে মার্জানের চুলে এক গাছি টেনে ধরলো শক্ত করে। মার্জান ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো।সুরভী তখন হুমকি দিয়ে বলল,

“মরা কান্না বাসায় গিয়ে কাঁদিস। ফোন দিলে কাল সময় মতো চলে আসবি, নিজের মাকে নিয়ে যাস আর আমাদের সম্পত্তি আমাদের দিয়ে যাস।”

বলেই ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো মার্জানকে। মার্জান সেখানেই মাটিতে পড়ে গেলো। কতক্ষণ সময় সেভাবেই কেঁটে গেলো জানা নেই মার্জানে। মার্জান নিজেকে সামলালো। সব তো বিলীন হয়েছেই মার্জানের, ওইটুকুন সম্পত্তি দিয়ে কি করবে সে? মায়ের থেকে মূল্যবান আর কিছু আছে নাকি? মার্জান উঠে দাঁড়ালো। নিজের চোখের পানি নিজের হাতে কত বার মুছেছে হিসেব নেই । মার্জান নিজেকে ঠিক করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নিজেকে পরিপাটি করে মেসেজ করলো সোফিয়াকে, সে চলে যাচ্ছে বলে। এর পরেই বেড়িয়ে আসলো ওয়াশরুম থেকে। সোজাপথে যেতেই হেঁচকা টান খেলো মার্জান। কিছু বুঝবার আগেই কেউ একজন টেনে নিয়ে যতে লাগলো রেস্টুরেন্টের অন্য পাশটায়। একটি রুমের মাঝে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো নিচে। মার্জান উঠে বসবে, তখনি ভেসে এলো কিছু টুকরো কথা..,

” ব্রাদার্স এবার শুরু হবে আমাদের আসল পার্টি। নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য হুর-পরী।”

বলেই হাসলো লোকটি। মার্জান এক পলক এদের দেখলো সবাইকে। কতগুলো ছেলে-মেয়ে বসে আছে এখানে। এদের দেখেই মনে হচ্ছে উগ্রবাদী মানুষ সব। কিন্তু শেষে যাকে দেখলো.. মার্জান বিষম খেলো…

চলবে,