জোয়ার ভাটা পর্ব-৯+১০

0
319

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৯।

সকালের রমরমা পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটছে সবাই। কারো কাজের তাগিদ, কারো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির আবার কারো গন্তব্যহীন পথে। তেমনি মার্জাণ নিজেও ছুটছে নিজের গতিপথে। গত রাতের ঘটনার পরেও ওঁ আর শীপ্রার বাড়ি ফিরেনি। সত্যি বলতে নিজের জীর্ণশীর্ণ শরীরটা নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে নি আর। সব থেকে বড় প্রশ্ন কি জবাব দিতো তখন শীপ্রাকে? যদি জানতে চাইতো কি হয়েছির ওঁর সাথে?মার্জাণ তাই নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলো। মার্জাণ দুঃখ ভরা গভীর শ্বাস ফেললো। নিজের শরীরটা ওফশোল্ডার ড্রেসে জড়িয়ে নিলো। সাথে গলার মাঝে পড়া পাুচ আঙ্গুলের দাগ ঢাততেই ওড়না-টা পেঁচিয়ে নিলো মাফলারের মতো করে।মার্জাণ শীপ্রার বাড়ি চলে এলো। কলিং বেল চাপতেই চোখ ঢলতে ঢলতে দরজা খুলে দিলো মৃণাল। মাকে দেখে পায়ের সাথে লেপ্টে গেলো। ঘুম জোড়ানো মাখো মাখো কন্ঠে বলে উঠলো,

” জান, তুমি সত্যি এসেছো? কত মিস করেছি আমি জানো? আমি-তো ভেবেছি তুমি আর আসবেই না। মমি, তুমি কি আমার চেহারা দেখে এখন বোরিং হয়ে গেছো? তাই চলে গেছিলে?”

বাচ্চা ছেলেটার চাপা রাগ প্রকাশ পেলো প্রতিটিটি কথায়। মার্জান হাটু গেড়ে বসে পড়লো ছেলের সামনে। গুলুমুলু গালে হাত বুলিয়ে বলল মার্জান,

” ডিয়ার, এক মাত্র তুমিইতো আমার বাঁচার শেষ পথ। তুমি না থাকলে আমি কবেই হয়তো ভেঙ্গে গুরিয়ে যেতাম। তুমি আছে তাই মমি আছে তাই। একমাত্র তোমার কিউট চেহারা দেখেই আমার দিন পার করতে পারি। কখনো বোরিং হবো না।”

মৃণাল ছলছল চোখে মাকে জড়িয়ে ধরলো। পরম যত্নে ছেলেকে বাহুডোর শক্ত করে আবদ্ধ করে নিলো।

” লাভ ইউ জান।”

” লাভ ইউ টু ডিয়ার!”

মা আর ছেলের সময়টুকু ভঙ্গন হলো কারো জোড়ে দরজা লাগাবার শব্দ হতেই। মার্জান আর মৃণাল ছুঁটে গেলো, হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকা শীপ্রা ফুপাতে ফুপাতে মাটিতে বসে পড়লো। মার্জান সামলাতে লাগলো শীপ্রাকে.. কিন্তু শীপ্রা যেমন কাঁদছে, তেমন কাঁপছে। এক পর্যায় শীপ্রা হেলে পড়লো। মার্জান ভয়ে ঘাবড়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পর..

বাহিরে রোদ মরা দিন। গুমর গুমর মেঘের ডাক। ঝাঁকি ঝাঁকি পাখিরা আকাশে ডানা ঝাপটাচ্ছে। মার্জান বসে আছে শীপ্রার কাছে। শীপ্রার কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছিলো। ভাবনায় মগ্ন হয়ে চুমুক বসাচ্ছে পানির গ্লাসে। মার্জান এবার বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল। হাতের গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে কঠোর কন্ঠে বলে উঠলো মার্জান,

” শীপ্রা দেখ, আজ কথা ঘোরালে আমি আর জীবনেও তোর সাথে কথা বলবো না। আমি সত্যি জানতে চাইছি!”

শীপ্রা চুপ করে রইলো। মার্জান তাকিয়ে রইলো শীপ্রার মুর্ছানো মুখ পানে। মার্জান আর শীপ্রা একই কলেজে পড়তো। কিন্তু মার্জানের ঝামেলার জন্য মার্জানের দেশ ছাড়তে হয়, যার ফলে শীপ্রার সাথে কথা হলেও ওঁর জীবনে কি কি ঘটে গেছিলো মার্জান জানতো না। জানার মাঝে মার্জানকে বলেছিলো শীপ্রা,

” বাবা নেই আর, সৎ চাচার ঘাড়েই চাপতে হচ্ছে এবার।”

মার্জান তখন নিজেও করছিলো জীবন যুদ্ধ। মৃণাল তখন ওঁর পেটে সাত মাসের। যার জন্য কোনো কিছু করতে পারছিলো না ওঁ। শীপ্রা তখন খুব কষ্টেই চালাচ্ছিলো নিজের পড়শোনা।মার্জান আবার জিগ্যেস করলো,

“বলবি?”

শীপ্রার দু’চোখ ভর্তি জল চলে এলো। নাক টেনে টিস্যুতে নাক, চোখ মুছে বলতে শুরু করলো,

” এইচএসসি পরীক্ষার ছ’মাস বাকি তখন। বাবা মারা যাওয়ার পরেই চাচা-চাচীর সংসারে ঠাই হয় আমার আর ছোট বোন মিষ্টির। সংসারে সব সময় টান পোড়া দেখাতেন চাচি। তাই নিজেই স্টুডেন্ট পড়াতাম। যেন নিজের আর বোনের পড়াশোনার টাকাটা নিজে জোগাড় করতে পারি। ভালোই চলছিলো সব, মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের দিন কাটছিলো খুব সুন্দর ভাবে। কিন্তু পরীক্ষার ঠিক তিন মাস আগেই ঘটলো অঘটন। চাচা-চাচীর মাঝে তুলকালাম ঝগড়া। তাদের তর্কের এক পর্যায় আমাদেরও টানেন চাচি। চাচা-চাচির এক মাত্র ছেলে ছিল রাফি। রাফি ভাইয়া আমাকে সব সময় ছোট বোনের মতো ভাবতেন। ভাইয়া তখন ডাক্তারী পড়ছিলেন দেশের বাহিরে স্কলারশিপ নিয়ে। শেষ সেমিস্টার। স্কলারশিপ হলেও লাক্ষ টাকার প্রয়োজন খুব। চাচার সাথে তা নিয়েই ঝগড়া। কিন্তু চাচা মানা করে দিলেন। এত টাকা কোথা থেকে দিবেন? এদিকে চাচি আমার একরোখা। শুরু থেকেই আমাকে মোটা অঙ্কের বদলে বিয়ে দেয়ার পয়তরা করেছেন বহুবার, কিন্তু চাচার জন্য পারেন নি। তবে সেদিন রাতেই চাচি আমাকে জানিয়ে দিলেন,

” সংসারে থাকতে হলে ইনকাম করতেই হবে, নয়তো বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে তোমরা!”

সে-দিন প্রথমবার অনুভব করলাম আমার অস্তিত্ব কই? রাত ১২ টার সময়, এই মধ্য রাতে আমাদের আজ বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলে যাবার রাস্তা কই? আমি চাচির কথায় চুপ রইলাম। তার সব থোকে বড় কারণ হচ্ছে আমার বোন মিষ্টি। কিন্তু চাচি চুপ থাকার মানুষ নয়। উনার টাকায় খাচ্ছি, পড়ছি, আর কত কি! এবং-কি আমাদের মরে যাওয়া বাবা-মাকেও ছাড়লেন না। আমি মুখ বুঁজে আর সইতে পাড়লাম না। রাগে দুঃখ কান্নারত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম,

“তাহলে কি করতে হবে আমায় চাচি?”

চাচিকে এবার খুশি মনে হলো। কন্ঠে খুশির বহর ধরেই বলে উঠলেন,

” ঢাকা তোর জন্য কাজের ব্যবস্থা করেছেন, আমার দূর সম্পর্কের ফুপাতো ভাই। কাল সকাল সকালেই বেড়িয়ে যাবি, ওঁ নিজেই তোকে নিয়ে যাবে।”

মাথা নুইয়ে সম্মতি জানালাম। কিন্তু সেই সম্মতি আমার জীবন বদলে দিলো, পরিবর্তন করে দিলো পুরো আমিটাকে। ঢাকার প্রথম দিন। কোলাহলপূর্ণ গাজিপুরা… গার্মেন্টস কর্মীদের ভীড়। বুঝে গেলাম ওঁদের একজনের সঙ্গী হতে চলেছি। কিন্তু সেখানেই কি কাহিনি শেষ? নাহ্, বরং শুরু। প্রথম দিন আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয় এক মধ্যবয়স্ক আন্টির বাসায়। মজার বিষয় কি জানিস? ওই বাসায় মোট ৩০টি পরিবারের বসোবাস। কিন্তু কষ্ট সেখানে নয়, কষ্ট হচ্ছে আমার চাচির দূর সম্পর্কের ফুপাতো ভাইয়ের কথায়,

” শোনো মেয়ে, ভয় পাইবার কিচ্ছু নাই, এহন এমনেই থাকো কয়দিন, এর পরে একলা রুম নিয়া দিমু, আমারে আবার সবাই চিনে , কেউ কিছু বলবার সাহস পাইবো না। আর যদি বলে? বলে দিবা, আমি তোমার স্বামী। বুঝলা? এইখানে কিন্তু এমনি…তখন আমিও আসমু মাঝে মাঝে”

বলেই লোকটি বিশ্রী হাসলো। আমার সাড়া শরীর লোকটির কথায় হীম হয়ে গেলো। গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। বুড়ো ভাম বলে কি?লোকটির জন্য মন থেকে খারাপ, খারাপ অনুভূতি, ভয় কাজ করতে লাগলো। এত বড় শহরে, এই ব্যক্তিটি ছাড়া নিশ্চয়ই আর কেউ নেই আমার পরিচিত বলে? তাই কিছু বললাম না। আর যাই হোক আমার ছোট বোনটিতো সুখে থাকবে? ভেবেই সপ্তপর্ণ শ্বাস লুকিয়ে ফেললাম। পরেদিন জয়েনিং হলো। আমাকে বলা হলো হেল্পারের জন্য যেন বলি, কিন্তু ওঁরা আমাকে বললো,

” টাকা বেশি পাবেন আপু, যদি অপারেটরে কাজ করেন,!”

আমি তখন চিন্তা করলাম টাকার জন্য এসেছি, তাহলে কাজ যখন করবো? বেশি টাকার জন্য করি, আমি তখনো জানতাম না.. অপারেটর কি? আমি যাদের সাথে থাকতাম, ওঁরা যখন শুনলো? তখন কতই না বাহ্ বাহ্ দিলো, কিন্তু যখন কাজ করতে গেলাম জানতে পারি, অপারেটর মানে হচ্ছে যারা সুয়িং এর কাজ করে, কাপড় সেলাই করে। আমি হতাশ হলাম। কোথায় জম্ম নিয়েছিলাম সোনার চামচ মুখে নিয়ে? আর কোথায় আজ গার্মেন্টস্ কর্মী হয়ে গেলাম? ভাগ্যকে মেনে নিলাম। একমাস যেতেই চাচি তাগাদা দিলেন টাকার জন্য বেতন হাতে পেলাম তখন মাত্র ৮০০০ টাকা। চাচি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,

“টাকা না পাঠালে বোনের মুখে ভাত জুটবে না।”

আমার কান্নাগুলো দলাপাকিয়ে জমা হতে লাগলো কন্ঠনালিতে। এতটা অসহায় লাগলো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো মরে যাই। কিন্তু বোনের কথা ভেবে পারতাম না। টাকা হাতে পেয়েই নিজের জন্য ২৫০০ রেখে বাকিটাই পাঠাতাম চাচির কাছে। এতে চাচি বড্ড নারাজ। কিন্তু ২৪ ঘন্টার মাঝে ১৬ ঘন্টা কাজ করা আমার মতো মেয়ের জন্য ছিলো অসম্ভব। তবে ভাগ্যকে মেনে নিতেই শিখে ফেলেছিলাম । ওই সময় হঠাৎ চাচার এক এক্সিডেন্ট করে বসে, অনেক টাকার প্রয়োজন, এদিকে ভাইয়ারও পরীক্ষা। চাচি আমাকে আবার চাপ দিতে লাগলেন। আমি না পেরে আবারো মেনে নিলাম ওঁর কথা। জোয়ার_ভাটার মতো স্রোত কোথা থেকে কোথায় আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো, এবার ছিলো তাই দেখার পালা। একদিন অফিস থেকে বের হবার পর হঠাৎ চাচির ফুপাতো ভাই হাজির। বিশ্রী এক হাসি দিয়ে বলে উঠলেন,

” আহারে মাইডা, কত শুকাইয়া গেছে, গতরে এক ছটাক মাংস নাই। আমার যদি বউ বাচ্চা না থাকতো? আমিই বিয়া কইরালতাম তোমারে। থাউক সেইসব কথা। আহো আজ থাইকা তোমারে নতুন কামে নিয়া যামু, যেখানে টেকাই টেকা।”

লোকটিকে বরাবর এড়িয়ে চলতে যেয়েও পাড়তাম না আমি। এতটা চালাকচতুর-ও ছিলাম। বুঝতে পারিনি কি হচ্ছে আমার আশে-পাশে, কি হচ্ছে আমার সাথে। এদিকে আমার এইচএসসি পরীক্ষার ১৫ দিন বাকি। আমি লোকটিকে বলতেই লোকটি বলল,

” এখনের যে কাম এতে কোনো কষ্ট নাইকা। রাতের কাম, সকালে তুমি যা ইচ্ছে করবা। আর প্রতিদিনের টেহা প্রতিদিন। তুমি ১০ দিন কাম কইরা ১১ দিনের মাথায় পরীক্ষা দিবার যাইবা গা। এর পরে পরীক্ষা দিয়া আবার কাম শুরু করবা। ”

আমি এতে খুশি হলাম বলতে গেলে।একটি মেয়ের জীবনে পড়াশোনা খুব দরকার। অতন্ত্য নিজের জীবনের চালিকাশক্তির জন্য। আমি লোকটি সাথে সেদিন একটি বড় আলিশান হোটেলে আসি। যার একপাশে রেস্টুরেন্ট তো অন্যপাশে বার আর আবাসন। আমার কাজ ছিলো বারের লোকেদের এন্টারটেইনমেন্ট করা। আমি এসব শুনে বিস্মিত হই, চাচির ফুপাতে ভাইকে কাজ করবো না বলে বেড়িয়ে আসি। ঠিক তখনি চাচির ফোন আসে,

“তুই কি চাস? তোর বোনকে ওই বুড়োর সাথে বিয়ে দেই? বুঝে বল, তোর চাচাও এখন প্যারালাইজড। আমাকে আটকাতে পারবে না।”

আমি কান্না করে দেই মিনতির সুরে বলি,

” আমাকে আর যাই করতে বলো চাচি, এই নরকে যেতে বলো না!”

চাচি শুনলো না। হুমকি, ধমকি শুনে রাজি হতেই হলো। সেদিন প্রথম আমি আরেক দু’নিয়ার সাথে রুবারু হই। ভয়ংকর সেই মুহূর্তগুলো। ভয়ংকর সেই অনুভূতি। আমাকে রোজ রাতে এখানে এসে কাজ করতে হতো। কখনো পরপুরুষ স্পর্শ করলে শরীরে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হতো, নয়তো ওঁরা খুব মারতো। তবে আমার ভাগ্যটা যেন আরো খারাপ ছিলো। কাজের পাঁচ দিনের আমার সাক্ষাৎ হয়, তায়ানশাহ্ এর সাথে। যে-কিনা মাফিয়া পরিবার থেকে বিলং করে। পরিবারের এক মাত্র একরোখা, অভদ্র আর বেয়াদব ছেলে । ওঁর নজর প্রথম দিনেই পরে যায় আমার উপর । ওঁর নজরে আমি ছিলাম একজন প্রস্টিটিউট। বলেই এবার কেঁদে দিলো শীপ্রা অঝোরে। মার্জান ওঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শীপ্রা আগে বলতে লাগলো,
তায়ানশাহ্ প্রতিবার বারে এসেই আমাকে চাইতো। আমি প্রতিবার রিফিউজি করতাম উনার ডাক। একবার নেশা বুঁদ তায়নাশাহ্ আমার সাথে জোরজবরদস্তি করতে শুরু করলো বারের সকলের সামনেই। আমি না পেরে সকলের সামনে ঠাটিয়ে চর বসাই। আর সে-দিনিই ছিলো যেন আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল…সেদিনের পর কয়েদিন আর দেখা পায়নি লোকটির। কিন্তু আমার পরীক্ষার ঠিক আগের দিন আমি বাড়ি ফিরেছিলাম। চাচি আমার জমানো টাকা নিয়ে স্যাটিসফাইড। আমি ভেবেছিলাম এবার বুঝি জীবন খুব সুন্দর হবে আমার। কালো অতীত পিছনে ফেলে, ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আলোয় স্নান করবো। জড়িয়ে ধরবো। কিন্তু বলে না?

-অভাগী যেদিকে তাকায়, সাগর শুকিয়ে যায়?

আমার কঁপালটা ছিলো ঠিক তেমন। দেখতে দেখতে আমার এইচএসসি পরীক্ষার গুলো সমাপ্তি ঘটতেই হাসতে-খেলতে বাড়ি ফিরে এসেই শক্ড হয়ে যাই, সামনে অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখে। আমার পা দু’টো অসাড় হয়ে আসে। পুরো পৃথিবী যেন উল্টে পাল্টে যেতে থাকে… ঠিক তখনি,

চলবে,

#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১০।

-অভাগী যেদিকে তাকায়, সাগর শুকিয়ে যায়?

আমার কঁপালটা ছিলো ঠিক তেমন। দেখতে দেখতে আমার এইচএসসি পরীক্ষার গুলো সমাপ্তি ঘটতেই হাসতে-খেলতে বাড়ি ফিরে এসেই শক্ড হয়ে যাই, সামনে অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখে। আমার পা দু’টো অসাড় হয়ে আসে। পুরো পৃথিবী যেন উল্টে পাল্টে যেতে থাকে… ঠিক তখনি, গা হীম করা একটি গলা ছাড়ে,

” আজ থেকে তুমি আমার।”

সে’দিন আমার পুড়ো পৃথিবী উল্টে গেছিলো। শুরু হয়েছিলো বিষে ভরা জীবন। প্রতিনিয়ত আমাকে দগ্ধ হতে হতো ওই লোকের হাতে। শীপ্রা এবার নিজের পিঠের কাপড় সরালো। কেঁপে উঠলো মার্জান। সফেদ পিঠে মা,রের দাগ, বেল্টের বা,ড়ির দাগ, সিগারেটে পুড়িয়ে ছাই করার দাগ। মার্জানের চোখে পানি। বলল,

” তুই গেলি কেন? তোর চাচি আঁটকায়নি? আর তোর চাচা?”

শীপ্রা ম্লান হাসলো,

“কে আটকাবে? চাচী? যে নিজেই মোটা অঙ্কের টাকার বদলে নিজের মেয়ে বয়সী একটা মেয়েকে কারো দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করে? আর চাচা? উনি তো জিন্দালাশ তখন। আমার ছোট বোনটা মিষ্টি? ওঁর জন্যই সয়ে ছিলাম সব। নয়তো ওঁরা আমার বোনকেই হয়তো মেরে ফেলতো, নয়তো কোনো অন্ধ গলির রাতের পরি হতো। তাই মেনে নিলাম, বাধ্য হলাম রক্ষিতা হতে। ”

শীপ্রা চুপ রইলো। মার্জান আবার জিজ্ঞেস করলো,

” ওর বন্দী দশা থেকে বেড় হলি কিভাবে?”

শীপ্রা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,

” দু’বছরের কনট্রাক ছিলো আমাদের মাঝে। দু’বছর শেষে হতেই আমাদের সঙ্গ শেষ।”

মার্জান শীপ্রার মাথায় হাত বুলালো,

“তাহলে এখন ভয় পাচ্ছিস কেন শীপ্রা, যা ছিলো পাস্ট ছিলো। শেষ এবার এগিয়ে যা সামনে সব ভুলে।”

শীপ্রা কিছু বলল না। বাহিরে তাকিয়ে রইলো শুধু। কিন্তু মনে মনে আওড়ালো,

“জান.. তোকে কিভাবে বুঝাই? যে লোকের সাথে আমি দু’টো বছর কাটিয়েছি? লোকটা যে কত ডেঞ্জারাস। যদিও সে আমায় ছেঁড়ে দিয়েছিলো, তবে মনের কোনে ভয় হয়, লোকটি যদি হুট করেই আবার কখনো সামনে চলে আসে? যদি নিয়ে যায় আবারো সেই নরকে। নাহ্… কখনোই নাহ্..”

শীপ্রা চোখ বুঝে ফেললো। ভাবতে আর পারছে না। নাহ্ এবার ওঁকে ভুলতেই হবে, তায়ন শাহ্ নামক কেউ ছিলো, আছে সব মুছে ফেলতে হবে ওঁর জীবন থেকে।

মার্জান অনেকক্ষণ যাবত বসে রইলো শীপ্রা মুর্ছানো মুখপানের দিকে। মেয়েটি কত চঞ্চল ছিলো। আর আজ কত শান্ত একে বারে বিশ্বাল সাগরে মতো। মার্জান সপ্তপর্ণ শ্বাস লুকিয়ে ফেললো। ফোনের ছোট একটি বার্তায় ভাঙ্গলো মার্জানের ধ্যান।

“মার্জান ইউর টাইম টু স্টার্ট নাউ, নিচের এড্রেসে আধঘন্টার মাঝে চলে এসে, নয়তো আর মা পাবে না।”

মার্জান এবার উঠে বসলো হন্তদন্ত হয়ে। হাতের ফোনটি পার্সে রেখে বিদায় নিয়ে ছুটলো হসপিটালের ওই এড্রেসটিতে। মার্জানের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে এখন। মা… ওঁর মা’কে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে পাবে মার্জান। মার্জান দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পৌঁছালো হসপিটালের করিডোরে। কাঙ্ক্ষিত কেবিনটি পেয়ে ঢৃকে পরে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত সুরভী, রিয়ানা। সুরভী মার্জানকে দেখেই হেসে ফেললো,

” নট বেড বেবি? মা’য়ের জন্য এত টান? গুড গুড..!”

মার্জান ওঁদের কথায় পাত্তা দিলো না। কেবিনের চারপাশে চোখ বোলাতেই একটি কোনার বেডে পরে থাকতে দেখলো একটি নিথর দেহো। মার্জান ছুটে ওই বেডটার কাছে যেতেই একটি হাত ওঁকে আটকালো,

” আরে, এত জলদির কি আছে ডিয়ার, টগর চাইতো? তাঁর আগে, সাইন ইট।”

বলেই কাগজটি বাড়িয়ে দিলো মার্জানের কাছে। কিন্তু মার্জান ছটফট করছে নিজের মায়ের সাথে একপলক দেখা করবার জন্য। মার্জান বিনীত করলো,

” খালাজান, তুমি যা বলবে, সব শুনবো আমি। একবার একবার মাকে দেখতে দাও, স্পর্শ করতে দাও, আদর করতে দাও। তুমি যা চাইছো, সব দিবো। সব। প্লিজ!”

রিয়ানা বলে উঠলো,

” আমাদের বেকুব ভাবছো দিদুভাই, আমরা দেখতে দেই ওমনি তুমি লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে, এত সহজ? নো ওয়ে!”

মার্জানকে এবার বিচলিত লাগছে,

” রিয়ানা প্লিজ, একটি বার দেখতে…”

থেমে গেলো মার্জান কাদের কাছে বলছে এসব ওঁ? যাদের হৃদয় নামক কোনো অঙ্গই আল্লাহ দেয় নি, তাদের? মার্জান চট করে কাগজটি নিয়ে সাইন করে দিলো। চোখের জলটুকু মুছে বলল,

” আমার মা!”

সুরভী বাঁকা হাসলো,

“অবশ্যই।”

বলে হাতটি এগিয়ে যাবার রাস্তা দেখালো সুরভী। মার্জান নিশ্চল পায়ে হেটে গেলো নিজের মায়ের বিছানাটির কাছে। কিন্তু এ-কি? এখানে তো কেউ নেই! নেই কেউ। মার্জান এদিক ওদিক দেখতে দেখতে পিছনে ফিরলো। সুরভী হাসছে, হাসছে রিয়ানা। ওদের হাসির গুঞ্জন হচ্ছে পুরো ঘর ময়। মার্জান এবার বুঝতে পারলো নিজের বোকামি। নিজের উপর নিজেরই হাসি পাচ্ছে এবার।

” আ.. মা..র মা কই!”

জড়িয়ে আসা কন্ঠে কম্পন মার্জানের। সুরভী বলল,

” সেতো সেই কবেই মারা গেছে মার্জান। আমরা তো তোর সাথে একটু মজা করলাম। দেখ না তুই এখনো কতটা নাদান, এখনো আমাদের উপর ভরসা করে চলে এসেছিস! সো সেড!”

মার্জান রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এবার। পুরো পৃথিবী ধংস করে ফেলবে এমন মনোভাব নিয়ে তেড়ে গেলো সুরভীর কাছে। এতটা নিকৃষ্ট, এতটা? কবে থেকে হয়ে গেলো ওঁর খালাজান? সম্পত্তির লোভ বুঝি কোনো সম্পর্ক থেকে এত বড়? মার্জান সুরভীর গলা চেপে ধরলো। সুরভী বুড়ো হচ্ছে এখন। চামড়া ঢোলা হচ্ছে। মোটা হয়েছে কিছুটা। ওয়েস্টার্ণ ড্রেসেও বেখাপ্পা দেখাচ্ছে। সুরভী দম নিতে পারছে না। খুক খুক করে কেশেই যাচ্ছে। মার্জান আজ আর নিজের মাঝে নেই। মার্জানের সাথে যা যা করেছিলো সব কিছু মেনেই নিয়েছিলো। কিন্তু আজকের করা জঘন্য কাজটা একদম ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। রিয়ানা মার্জানের কাছে এলো চট জলদি। মার্জানকে সরাতে চেষ্টা করতে মার্জান এক ধাক্কা দিলো। রিয়ানা সঙ্গে সঙ্গে নিচে পড়ে গিয়ে কাতরাতে লাগলো।

” আমার.. আমার বাচ্চা। মা আমার বাচ্চা।”

মার্জানের এবার চমকে তাকালো রিয়ানার দিকে, নিজের রাগ আর ক্ষোভ নিষ্পাপ বাচ্চাটির যেন কিছু করে না বসে। মার্জান রিয়ানার দিকে তাকাতে হাত কিছুটা ঢিলা হতে এক ধাক্কা মারলো সুরভী। মার্জনের ধ্যান রিয়ানার দিকে থাকায় ব্যলেন্স রাখতে না পেরে পড়ে গেলো নিচে। ঠিক তখনি রিয়ানা উঠে পড়লো। মার্জান অবাক হয়ে গেলো। আবারো বোকা হয়ে গেলো মার্জান। ওঁ কিছু বুঝে উঠার আগেই সুরভীকে টেনে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো রিয়ানা। যেতে যেতে কেবিনের দরজা শক্ত করে বন্ধ করে দিলো। মার্জান হতভম্ব। নিজেকে সামলে দরজা ধাক্কাতে লাগলো সজোড়ে। পরক্ষণেই ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেলো পুরো কেবিন। রিয়ানা দূষিত গ্যাস ছেড়ে দিয়ে ছিলো ঘরটির ভিতরে। মার্জান কাশতে লাগলো। চোখের সামনে সব ঘোলা হতে লাগলো। ফুসফুস পর্যন্ত যেনো ধোঁয়া ভরে যেতে লাগলো মার্জানের। মার্জান এবার পাশে থাকা জানলাটা খোলার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কোনো ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। মার্জান এবার নেতিয়ে পড়লো। ধাম শব্দ পড়ে গেলো ফ্লোরে।

আকাশের বুকে শিশির তুলো উড়ছে। পাখিরাও গুনগুন করে গান গাইছে গাছ-গাছালি ঘেরে। মৃণাল হসপিটালের বানানো কিন্ডারগার্ডেনের দোলনায় একা একা বসে ঝুলছে। শীপ্রা আন্টি ওঁকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে চেকাপের জন্য। হয়তো রেজাল্ট ভালো না হলে ভর্তি হতে হবেই। হসপিটালে ভর্তি হলে ওঁর জানকে কে দেখবে? এই নিয়ে মৃণালের মন খারাপ। ঠিক তখনি দু’জন ব্যক্তির কন্ঠে তাকালো মৃণাল। ওখান থেকে একজন লোককে সে চিনে, রেস্টুরেন্টে দেখেছিলো মৃণাল। লোকটি অনেক হ্যান্ডসাম।

” মিঃ গ্রীষ্ম, আপনি আপনার ঔষধ ঠিক মতো যদি না নিন? তাহলে আপনার মাজানকে বলতে বাধ্য হবো আমি।”

ডাক্তার খুব ভয়ে ভয়ে কথাটুকু বলল। গ্রীষ্ম প্রত্যুত্তর বলল,

” মি: রমিজ, আপনিকি আমাকে থ্রেড করছেন? ইউ নো না… হো আই এম?”

ডাক্তারের কঁপালে ঘাম জমে গেলো বিন্দু বিন্দু,
” স্যার আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি, আপনি যদি আপনার ঔষধ কন্টিনিউ না করেন আপনার অবস্থা আরো গুরুতরো হতে শুরু করবে। ”

গ্রীষ্ম ঠান্ডা গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,
” তুমি আমাকে শিখাবে এখন?”

রমিজ চুপ হয়ে গেলো। ওঁদের দু’জনের কথোপকথনের মাঝে মিষ্টি বাচ্চা একটি কন্ঠ ভেসে এলো,

” আঙ্কেল, আপনি এত বড় হয়েও আপনার বুঝি ঔষধ খেতে ভয় লাগে? আমাকে দেখুন প্রতিদিন এত এত ঔষধ খাই, তবুও ভয় লাগে না।”

মৃণালের কন্ঠে থমথমে পরিবেশটা কেঁটে গেলো। ডাক্তার সুযোগ বুঝেই পালিয়ে গেলো। গ্রীষ্ম ওঁর সানগ্লাস চোখ থেকে সরিয়ে ফেললো। মৃণালকে দেখে ভ্রু-কুচকালো। গ্রীষ্মের বরাবরই বাচ্চাদের প্রতি একটু অনীহা কাজ করে। কিন্তু এই সুন্দর বাচ্চাটি দেখতে এতটা মায়াময় যে গ্রীষ্ম কিছু বলল না। উল্টো ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

” কেনো? তোমাকে এত ঔষধ কেনো খেতে হয়?”

মৃণাল ওঁর ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো,

” কারণ আমার লুকেমিয়া হয়েছে।”

বাচ্চা ছেলেটিকে হাসতে হাসতে নিজের কথা বলতে দেখে মন গলে গেলো গ্রীষ্মের। মৃণালকে কোলে তোলে নিলো ওঁ। কোলে নিতেই গ্রীষ্মের বুকের মাঝে আলদা এক মিশ্র অনুভূতি স্পর্শ করে গেলো। বাচ্চাটিকে ওঁর খুব আপন মনে হতে লাগলো। গ্রীষ্ম মৃণালকে নিয়ে দোলনায় বসে পড়লো। জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি এখানে কার সাথে এসেছেন? এঁকা কেনো?যদি হারিয়ে যান?”

মৃণাল হেসে বলল,

” ওহো আঙ্কেল আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি? যে হারিয়ে যাবো?”

গ্রীষ্ম মিটিমিটি হাসলো। আজকাল কার বাচ্চারা আর ছোট কই। বলল,

” হ্যাঁ তাউ ঠিক। কিন্তু আপনি এখানে এলেন কার সাথে?”

” শীপ্রা আন্টির সাথে।”

” আপনার আন্টি কই?”

“উনি তো রাফি আঙ্কেলের সাথে কথা বলছে।”

” আচ্ছা। তবে আপনার একা এখানে থাকা ঠিক না, আপনি আপনার আন্টির কাছে চলে যান।”

বলেই গ্রীষ্ম উঠে যেতে লাগলো। মৃণাল গ্রীষ্মের শার্টের এক অংশ চেপে ধরে বলে উঠলো,

” আঙ্কেল? আপনার কি কোনো গার্ল ফ্রেন্ড আছে? ”

গ্রীষ্ম ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলল,

” আপনি এটা কেনো জিজ্ঞেস করছেন?”

মৃণাল গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে বলল,

” আমি আমার মমির জন্য হাজবেন্ড খুঁজতেছি। আমার মমি অনেকককককক সুন্দর। আপনি-ও অনেক সুন্দর। একদম পার্ফেক্ট আমার মার জন্য। আপনি কি মমির ছবি দেখবেন?”

গ্রীষ্ম ভ্যাবলা কান্তর মতো চেয়ে রইলো। মৃণাল ততক্ষণে ওঁর মমি একটি ছবি ওঁর ফোন থেকে বের করে দেখালো গ্রীষ্মকে। উৎসুক চোখ দেখে গ্রীষ্ম কি বলবে? ভেবে পেলো না। কিন্তু যখনি চোখ গেলো ফোনের স্ক্রিনে, জ্বলজ্বল করা ছবিটি দেখে গ্রীষ্ম ঠোঁট বাঁকালো। মেয়েটি কি কোনো রকম ট্রিক্স খেলছে ওঁর সাথে? কাল পর্যন্ত যে বলছিলো, সে ভুলে ওঁর সামনে চলে এসেছিলো? আর আজ এই ছেলে ওঁর জন্য হাসবেন্ড খুঁজছে? লাইক সিরিয়াসলি।

এদিকে মার্জানের চোখ বুঁজে আসার আগেই কেউ দরজা ভেঙে ঢুকলো ভিতরো, আগুন্তকঃ এর ঠোঁট নড়ছে। ঝাপসা ঝাপসা দেখছে ওঁ। একে বারে জ্ঞান হারাবার সময় শুনলো শুধু,

“মান।”

চলবে,