তুই আমার কাব্য পর্ব-০৪

0
1661

#তুই_আমার_কাব্য 🍂
#Writer: Anha Ahmed 🍂
#Part : 04
.
🍁
.
বাহিরে হইচই। নবীন বরণের প্রস্তুতি চলছে। ছেলে মেয়েদের হাসি, আনন্দের শব্দে মুখরিত পরিবেশ। সকলের মাঝে উৎসবের আমেজ। এতো আনন্দঘন পরিবেশে এক কোণে কাল বৈশাখির ছায়া নেমে এসেছে। ঝড়ের আগে যেমন এক শান্ত পরিবেশ বিরাজ করে তেমনি ভার্সিটির একটি রুম তেমন থমথমে হয়ে আছে। টেবিলের সামনে একটি চেয়ারে বসে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জুতো আকড়ে ধরে আছে মেঘলা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বার বার ঢোক গিলছে। চোখমুখে ভয়ের মেঘ ছায়া নামিয়ে রেখেছে। পিছনে চেয়ার ধরে দাড়িয়ে আছে তনু। টেবিলের অপর পাশে আরেকটি চেয়ার পায়ের উপর পা তুলে হেলান দিয়ে রক্ত চক্ষু নিক্ষেপ করে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে কাব্য। পাশেই রাগে কটমট করে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে রাহি। তারই আশে পাশে দাড়িয়ে আছে ওর বাকি বন্ধুরা। সবার দৃষ্টি মেঘলার দিকে। আর মেঘলার দৃষ্টি মাটিতে। বুকের ভেতর কন্সট্রাক্টরের কাজ চলছে যেনো। হঠাৎই সামনে থেকে একটা গলার আওয়াজ এলো।

– কাব্য ভাই! এই যে আপনার জিনিস।

ছেলেটি একটা প্লেট কাব্যের সামনে টেবিলে রেখে দিলো। মেঘলা এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কাব্যের কথায় মাথা ওপরে তুললো,

– এইটা খাও।

সামনে তাকিনোর সাথে সাথে চোখ ছানাবড়া। সাথে সাথে ছলছল চোখে কাব্যের দিকে তাকালো। কাব্যের চোখ এখনো রক্তপূর্ণ। যেনো ছুঁলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে। কাব্যের চোয়াল মূহুর্তেই শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– তাকিয়ে থাকতে বলি নি। যেটা দেয়া হয়েছে সেটা খাও। ফাস্ট।

এক প্লেট কাঁচা মরিচ। প্লেটের দিকে তাকাতেই মেঘলার চোখে পানি আর আঁটকে থাকলো না। গাল গড়িয়ে ঝরে পরলো। যে কিনা সামন্য ঝালেই বাড়ি মাথায় করে সে কিনা কাঁচা মরিচ চাবিয়ে খাবে। ভাবতেই মেঘলার আত্মা কেঁপে উঠছে। কাঁপা কাঁপা গলায় কাব্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আ আমি ঝা ঝা ল খেতে পারি না। প্লিজ আমাকে এবারের মতো ক্ষ ক্ষমা করে দিন। আ আর হবে না প্রমিজ।

কাব্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাহি বলে ওঠে,

– ও লে লে বাচ্চা মেয়ে। তুমি ঝাল খেতে পারো না? কিন্তু নিজের ঝাঁঝ তো কম না। নেকা। যত্তসব থার্ড ক্লা..

পুরো কথা শেষ না হতেই কাব্য ধমকে থামিয়ে দেয়,

– শাট আপ, রুহি। আমি এখানে উপস্থিত আছি সেইটা কি ভুলে গেছিস? আর তুমি। তোমার চেহারা দেখতে আমরা এখানে বসে নেই। যেটা বলা হয়েছে সেটা কর। আর তুমি ঝাল খেতে পারো না। ইটস ওকে। তোমার কাছে তো সেকেন্ড একটা অপশনও আছে।

মেঘলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত কাঁপছে মেঘলার। কাঁপা কাঁপা হাতেই মরিচের দিকে হাত বাড়ালো। কেননা এছাড়া আর কোনো পথ নেই। সেকেন্ড অপশন ওর জন্য চয়েস করা অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়ে এইটাই খেতে হবে। মরিচ কেবল একবার মুখে দিয়েছে। ঝালে যেনো মাথা দিয়ে ধোয়া উড়ছে। মুখ চলছে না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছেই। মুখে যেনো কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঝালে শুসিয়ে শুসিয়ে টেবিলে রাখা পানির গ্লাস নিতে যাবে সাথে সাথে রাহি গ্লাস টেনে নিয়ে গেলো। মেঘলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পুরো তিনটে মরিচ খাওয়া শেষ হওয়ার পর কাব্য ওঠে দাঁড়িয়ে মরিচের প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দিলো। টেবিলের ওপর দুই হাতে ভর দিয়ে রেখে মেঘলকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– আশা করি এইটার প্রভাব দীর্ঘদিন থাকবে। নেক্সট টাইম থেকে এ ভুল দ্বিতীয় বার হবে না।

মেঘলার নাক চোখে যেনো রক্ত জমে আছে। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। এমনকি মাথা তুলেও তাকাচ্ছে না। মুখ পর্যন্ত লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। দুই হাত দিয়ে জামা খামছে ধরে রেখেছে। পেছনে তনুরও মুখ কাদো কাদো। মেঘলাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেনো ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে। আর এদিকে মেঘলার অবস্থা খুবই খারাপ। আর সকালের ঘটনার জন্য নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে নিজের।

।। ফ্লাসব্যাক ।।

সকালে ঘুম থেকে ওঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত তনুর সাথে নবীন বরণের প্লানিং করেছে। অবশ্য মেঘলা করেছে বললে ভুল হবে, সে শুধু শুনেছে। রাত সাগে এগারোটার সময় ভিডিও কল দিয়ে প্রায় একটা পর্যন্ত বক বক করেছে। যার ফলশ্রুতিতে ঘুম থেকে ওঠতে দেড়ি হয়ে যায়। না খেয়েই ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। ভার্সিটির ভেতর ডুকেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। উৎসব উৎসব পরিবেশ। মেঘলা হাতে ব্যাগ নিয়ে ঝুলাতে ঝুলাতে হাঁটছে। পাশে থেকে কিছু খারাপ মন্তব্য ভেসে এলো ওর কানে। ওগুলোকে অগ্রাহ্য করে হেঁটে চলে গেলো। হঠাৎই ওড়নায় টান লাগতে গলার ওড়না ধরে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। বুক ধরফর করা শুরু করলো। নির্ঘাত ওই বাজে ছেলেরা যারা ওকে দেখে খারাপ মন্তব্য করছিলো। ব্যাগের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে সামনে থেকে ঘুড়িয়ে ব্যাগ দিয়ে আঘাত করে। চোখ খুলতেই দেখে কাব্য চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। কানের পাশের পুরোটা লাল হয়ে আছে। মেঘলার কাব্যকে দেখে রাগ আরো ওঠে যায়। অতীতেরও কিছু ক্ষোভ আছে সেইটা একেবারে মিটিয়ে নিলো বকে,

– ইউউউ রাস্কেল। সভ্যতা বলে কোনো কিছুই কি নেই আপনার মধ্যে। ছিহ্! কালকে তো ওতো অপমান করলেন তারপরও কি শখ মেটে নি যে আজকে এতো নিচ কাজ করতে চলে এসেছেন? এতোটা জঘন্য একজন মানুষ এটা ভাবি নি। এরকম অশ্লীল কাআআআ

বাকিটুকু বলে আর কথা বলতে পারছে না মেঘলা। আর এদিকে কাব্য এতক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও মেঘলার চোখ অনুসরণ করে তাকাতেই বুঝতে পারলো কেনো মেঘলা তাকে এতোগুলো কথা শুনালো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই তাকিয়ে আছে। কাব্যের চোয়ালে শক্ত হয়ে এলো। আর মেঘলা একদম বোকা বনে গেলো। কারণ তার ওড়না পাশে থাকা ভ্যানের ওপর রাখা বাঁশের কিছু খন্ডের সাথে আঁটকে গেছে যা এতোক্ষণ রাগে অন্ধ থাকার কারণে দেখতে পায় নি। মেঘলা ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ভয়ে হাত কাঁপছে বলে সামান্য ওড়ানাটাই ছাড়াতে পারছে না। কাব্য মেঘলার কাছে এসে ওর হাতের বাহুতে জোড় করে চেপে ধরে ওকে টেনে ওখান থেকে নিয়ে গেলো। টান লেগে ওড়নাটা ছিড়ে কিছু অংশ ওখানেই থেকে গেলো। একটা ক্লাসে এনে কিছু বলার আগেই মেঘলা এক নাগারে বলতে শুরু করলো,

– সরি সরি সরি সরি সরি সরি ভাইয়া। আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আমি খেয়াল করি নি। আমি ভেবেছিলাম পাশে কিছু ছেলে বাজে কথা বলছিলো তারাই অসভ্যতা করছে। কিন্তু তাদের দেখি নি। তখন আপনাকে দেখে মনে হলো আ আ আপনি ই হয়তো…

কাব্য চিৎকার করে ওঠলো,

– আমি কি??? শোনো তোমার চেয়ে হাজার গুন সুন্দরী মেয়ে আমার পেছনে ঘুরে। আর তোমার মনে হয় তোমার মতো খ্যাত একটা বেহেনজিকে আমি টিজ করতে যাবো। তোমার দিকে কেউ তাকাবে সেই যোগ্যতা তোমার আছে? নিজেকে এতোটা সুন্দর মনে হয় তোমার? এই কাব্য তোমার ওড়না ধরবে সেই যোগ্যতা তোমার আছে?

কাব্যের কথা শুনে মেঘলা রেগে গিয়ে বলে ওঠে,

– মুখ সামলিয়ে কথা বলুন। আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে তাই বলে আপনি আমাকে অপমান করতে পারেন না।

কাব্য আবারো মেঘলার কাছে এসে আবারো বাহু চেপে ধরে রাগি গলায় বলে,

– ওহ্ রিয়েলি? অপমানে লাগছে? কিছুক্ষণ আগে যে তুমি আমাকে এতোগুলো লোকের সামনে বিনা অপরাধে অপমানে করলে?

মেঘলা অনুতপ্ত সুরে বলে,

– আমি তো সরি বললাম। ভুল তো স্বীকার করেছি। প্লিজ ক্ষমা করে দিন।

কাব্য হাত ছেড়ে আস্তে করে সরে গিয়ে নরম চোখে বলে,
– আচ্ছা ঠিক আছে। ক্ষমা চাইছো যখন তখন ক্ষমা করে দেবো তবে আমি যেভাবে বলবো সেভাবে ক্ষমা চাইলে।

প্রথমে মেঘলা খুশি হলেও পরক্ষণেই মুখ মলিন হয়ে গেলো। এরপর আমতা আমতা করে বলে,

– কি কিভাবে?

পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে পা ক্রস করে ব্রেঞ্চের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বলে,

– কান ধরে সবার সামনে। সবার সামনে যখন মেরেছো, বকেছো তখন ক্ষমাটাও সবার সামনে কান ধরে চাইবে।

মেঘলার মাথায় যেনো বাঁজ ভেঙ্গে পড়লো। বলে কি এ ছেলে? এতো বড় হয়ে এতো লোকের সামনে কিনা কান ধরে সরি বলতে হবে। মেঘলা চিৎকার করে বলে ওঠে,

– অসম্ভব। মামা বাড়ির আবাদার নাকি? বললেই হলো? কি পেয়েছেন কি আপনি হ্যা? নেতা না খ্যাতা বলেই যা খুশি করবেন? আমি তো বার বার ক্ষমা চাইছি।

মেঘলার চিৎকার আর কথা শুনে কাব্য আবার রেগে যায়। কিছু বলতে যাবে তখনই রাহি পেছন থেকে বলে ওঠে,

– ওকে! তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। তবে আমি যা বলবো তাই করবে আর হ্যা যা করতে বলবো তা এই রুমের ভেতরেই। জানবে না কেউ।

রাহির কথা শুনে মেঘলা কিছুটা খুশি খুশি হলেও একটা খটকা লাগলো। তারপরে আবার ভাবলো যাই হোক সবার সামনে তো যেতে হবে না। মান সম্মান তো বাঁচবে। তাই সে রাহির কথায় রাজি হয়ে গেলো। রাহি একটা ছেলেকে ডাক দিতেই কাব্য সেই ছেলেটিকে ডাক দিয়ে বলে,

– তুই না আমি বলবো। তুই মাঝখানে আসিস না। যতটুকু বলেছিস ওটুকুই ইনাফ।

তারপর ছেলেটিকে দুটো চেয়ার আনতে বলে মেঘলাকে একটায় বসিয়ে নিজে আরেকটায় বসে পড়ে। মাঝখানে টেবিল। রাহুল অনি দুজনে এসে একপাশে রাহি আর তুলি আরেকপাশে। তারপর ছেলেটিকে কাচা মরিচের প্লেট আনতে বলে যা শুনে রাহি মুচকি হেসে দেয়। আর এদিকে কাব্য যা বলবে তাই করতে হবে ভেবে মেঘলার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো কারণ ওর সম্পর্কে মেঘলার ধারণা কি তা অজানা নয়। ইতি মধ্যে তনুও মেঘলার খোজ করে চলে আসে।

বর্তমান 🍁

মেঘলা ঠাই বসে আছে। এখনো মুখ লাল। তনু পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। পুরো পানি টুকু খেযে নিলো এক ঢোকে। ওঠতে যাবে কিন্তু তখনই মাথা ঘুরে ওঠে সামান্য যার জন্য বসে পড়ে আবার। তনুও সামলে রাখতে পারলো না। তনুরও মাথা কাজ করছে না কি করবে। তখনই ক্লাসের পেছন দিয়ে একটা আইসক্রিম বিক্রেতা যাচ্ছিলো। এই সময়ে এখান দিয়ে আইসক্রিম। তনুর কিছুটা খটকা লাগলেও মেঘলার অবস্থা দেখে সেসব বাদ দিয়ে দ্রুত জানালা দিয়ে আইসক্রিমের লোকটাকে ডাক দেয়,

– এই যে মামা দাঁড়ান দাঁড়ান। একটা আইসক্রিম দিয়ে যান দ্রুত প্লিজ।

লোকটা বড় একটা বক্স বের করে দেয়। তনু অবাক হয়ে যায় এতো বড় বক্স এরকম ছোট ছোট ভ্যানে। যাই হোক দ্রুত ওটা নিয়ে মেঘলার কাছে নিয়ে গেলো। মেঘলা প্রায় অর্ধেক বক্স শেষ করে যেনো শান্ত হলো। খাওয়া শেষে তনুর মনে হলো টাকাই তো দেওয়া হয় নি।

– মেঘু তুই একটু বস, আমি টাকাটা দিয়ে আসি।

টাকাটা দিতে গিয়ে দেখে লোকটা নেই। তাই কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ফিরে আসে।

চলবে… ❤❤