তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব-০৯

0
1781

#তুমি_আছো_মনের_গহীনে
#পর্ব-৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
কোনরকম তোয়ালা পেঁচিয়ে আরহাম ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে,নিজের ঘরে অপরিচিত মেয়েকে দেখে চমকে উঠে। খালি গাঁয়ে একটি পুরুষকে হঠাৎ বেড়োতে দেখে,মেহেভীন চিৎকার করে উঠে। মেহেভীনের এমন চিৎকারে আরহাম ভরকে উঠে। আরহাম ধরা গলায় বললো,
‘এই মেয়ে কে আপনি? আমার ঘরে দাড়িয়ে আছেন কেন? চিৎকার থামান। ‘
যেহুতু মেহেভীন আরহামের ছবি অনেকবারই দেখেছে, তাই সে দ্রুততার সাথে চিনে ফেললো আরহামকে। তার ঘরে হুট করে আগত হওয়া ব্যক্তিটি আর কেউ নয় আরিয়ানের ভাই আরহাম হাসান তালুকদার। যার মিথ্যে বউয়ের পরিচয়ে সে এখানে আছে। মেহেভীনের ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। আরিয়ানের কথা অনুযায়ী লোকটার তো এক মাস পরে আসার কথা।লোকটা আজকে কেন এলো? নানা প্রশ্ন মেহেভীনের মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে। আরহাম এইবার মেহেভীনের দিকে এগিয়ে এসে,বাজ খাই গলায় বললো,

”এই মেয়ে আপনি কি আমার কথা শুনতে পান না?
বোবা নাকি কানে শুনতে পান না? আপনার পরিচয় টা কী জানতে পারি?”

মেহেভীন একপলক আরহামের দিকে হাত দিয়ে নিজের চোখ-জোড়া বন্ধ করে ফেলে। তার কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে। আরহামের চুল থেকে টুপ টুপ পানি গড়িয়ে পড়েছে তার ফর্সা সুঠমদেহীতে। যা খুবই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এইভাবে একটি ছেলেকে খালে গায়ে দেখে মেহেভীনের বেশ লজ্জা লাগছে। আরহাম ভ্রু কুচকে বললো,

”এই মেয়ে চোখ বন্ধ করলেন কেন? ওপেন ইউর আইস। আগের আমার প্রশ্নের উত্তর দিন বলছি। ”

মেহেভীন নিজের আখিজোরা বন্ধ করেই বললো,

‘আমি কী আপনার মতো বেশরম নাকি? কীভাবে একটা অপরিচিত মেয়ের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘

‘এই মেয়ে আপনি কাকে বেশরম বলছেন?হাও ডেয়ার ইউ বিচ? আপনি প্রথমত আমার বেড রুমে এসে, আমারই ঘরে নক না করে বেশরমের মতো দাঁড়িয়ে আছেন আর আমাকেই বেশরম বলছেন?’

আরহাম মেহেভীনের চোখ থেকে হাত সরিয়ে, প্রশ্ন করে বল,

‘আমার দিকে তাঁকান এবং বলুন কে আপনি? আপনার আসল পরিচয় কী? আমি ভূল না হলে, আপনি কোন মেয়েরুপী চোর নয় তো? ‘

মেহেভীনের এইবার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাকে শেষমেষ এই বেশরম লোকটা চোর উপাধী দিয়ে দিলো। মেহেভীনের বর্তমানে সবথেকে বেশি রাগ উঠছে আরিয়ানের উপর। আরিয়ান আর কাউকে পালো না এইরকম বেশরম একটা লোকের মিথ্যে বউ তাকে বানিয়ে দিলো। আরহাম এইবার মেহেভীনের হাত ধরে, নিজের কাছে এনে,

‘হেই স্টুপিড গার্ল এন্সার মি ডেম ইট।’

মেহেভীন আর কিছু না ভেবে, আরহামের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। আরহাম ব্যাথায় ‘আউচ ‘করে উঠলে, মেহেভীন দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। আরহাম রাগে চিল্লিয়ে বলে,

”স্টুপিড গার্ল।’

আরহাম মেহেভীনের পিছনে দৌড়াতে গিয়েও দৌড়ায় না বরং আরহাম পুরনায় আবারো ওয়াশরুমে চলে যায়। এই মেয়েকে সে দেখে নিবে। তার হাতে কামড় দেওয়ার উচিৎ শিক্ষ সে দিবে।
আরহামের ঘর থেকে মেহেভীন দৌড়ে আরিয়ানের ঘরে চলে গেলো। উপর থেকে সবকিছুই দেখতে লাগলেন রাহেলা। তার ভাষ্যমতে,তার বড় ভাইজানরে দেইখা কী ভাবি এতোডাই চমকায় গেছে, যে সোজা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিছে।

আরিয়ান নিজের ঘরে বসে, ফেসবুকিং করছিলো। তখনি পিছন থেকে মেজেভীন ধাক্কা দিয়ে, আরিয়ানকে একপ্রকার খাট থেকেই ফেলে দেয়। আরিয়ান মেঝেতে বসে ,ব্যাথায় কুকড়ে গিয়ে বললো,

‘তোর আবার কি হলো বইন? এই রাতে তোর ধাক্কাধাক্কি খেলতে মন চাইলো নাকি? ‘

মেহেভীন চেচিয়ে বলে,

‘এইবার সব থেকে বড় ধাক্কা তো তুই পাবি। তুই জানিস কি হয়েছে,?’

‘কি?’

‘তোর বেশরম বড় ভাই বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে।’

‘কি বললি? ঠিক বুঝলাম না। ‘

‘বললাম আরহাম হাসান তালুকদার দেশে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে সে এখন তার ঘরে৷ ‘

আরিয়ান যেন কথাটি শুনে,একপ্রকার থম মেরে রইলো। তারপর শুকনো ঢুগ গিলে বললো,

”বইন রে, আমার মাথার উপর দিয়া সব যাচ্ছে। একটু ভালো করে বল। ”

মেহেভীন বসে, আরিয়ানকে সব খুলে বললো। সব শুনে আরিয়ানের মাথায় হাত। আরিয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

”এখন কী করব? ‘

‘সেইটা আমি কী করে জানবো?’

‘হু। তাও কথা,কিন্তু আমি কী করে বুঝবো বল? ভাই এক মাসের আগে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে। ‘

আরহাম একটা সাদা শার্টও টাওজার পড়ে, নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য মেয়েটাকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া। তখনি সেখানে তার মা ,রাহেলা ও রিনা উপস্হিত হয়। আরহামের মা তাকে দেখেই,তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘বাবা তুই এসেছিস? তুই নিশ্চই বউমার কথা শুনেই এসেছিস এতো তাড়াতাড়ি তাইনা? তুই যে প্রেম করতিস আমাকে বললি না কেন?
এমনকি তুই যে বিয়ে করেছিস আমাকে একটিবার বললে কি এমন হতো? বউমা শেষে অসহায় হয়ে এসে, আমাকে সবটা বললো। ‘

রিনা কাদুকাদু গলায় বললো,

”শুধুই কি বউমা? বউমার সাথে বাচ্ছাও আছে। আরহাম আমাকে তুমি এতোটাই অপছন্দ করো যে, সোজা বিয়েও করে ফেলল। এমনকি তোমার বউ প্রেগন্যান্ট। ”

আরহামের মাথার উপর দিয়ে সব যাচ্ছে। বউ? আবার তার মধ্যে বাচ্ছা আবার কোথা থেকে উদয় হলো? আরহাম যতটুকু জানে সে একজন অবিবাহিত মানুষ। রিলেশনে জড়ানোর মতো ভূল সে এখনো পর্যন্ত করেনি। তাহলে তার বউ-বাচ্ছা তার মধ্যে বউ কোথা থেকে এলো?

আরহামের ভাবনার মাঝেই, রাহেলা মুচকি হেঁসে বলে,

‘ভাইজান আপনার হাতে কিসের লাল দাগ? ‘

রাহেলার কথায়, আরহামের নজর তার হাতের দিকে যায়। যেখানে মেহেভীন তাকে কামড় দিয়েছিলো। আরহাম দাত কিড়মিড় করে বলে,

”এক বনের জন্তু কামড় দিয়ে দিয়েছে শান্তি?’।

আরহামের মা বলে,

”কি বলিস কি বাবা? কখন কীভাবে হলো দেখি দেখি। ‘

আরহামের মা তার ছেলের হাত দেখতে গেলে,পিছন থেকে আরিয়ান তার মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

‘মা তুমি ভাইয়ার সাথে এইখানে দাড়িয়ে কথা বলছো? এইদিকে ভাবি ভাইয়াকে খুঁজে যাচ্ছে। ‘

মেহেভীন আরিয়ানের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আরহামের আর বুঝতে বাকি রইলো না। এই মেয়েটাই সব নষ্টের গড়া। আরহাম একবার মেহেভীনের দিকে তাকালো আরেকবার আরিয়ানের দিকে তাকালো। আরহামের চাহনীতে ভয়ংকর রাগ ছিলো। যা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে আরিয়ান। আরহাম ঠিক করেছে সে এখনি কাউকে কিচ্ছু বলবে না বরং চুপ থাকবে। আরিয়ানের কাছে সবটা শুনতে হবে।

আরহামের মা বললেন,

”ওহ হ্যা আমার ছেলেটা কতদিন পর বাড়িতে আসলো। অথচ আমি এখানে দাড়িয়ে আছি। আমার কত কাজ পড়ে আছে। রাহেলা চল রান্নাঘরে। রিনা তুই ও চল। ”

রিনা কাদু কাদু মুখ নিয়ে চলে গেলো।

বর্তমানে মেহেভীন, আরহাম ও আরিয়ান আরহামের ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ান আরহামকে সব খুলে বলেছে কীভাবে মেহেভীন অসহায় হয়েই, এই বাড়িতে আরহামের মিথ্যে বউয়ের নাটক করতে বাধ্য হয়েছে। সবকিছু শুনে আরহাম কিছুক্ষন চুপ থাকে।মেয়েটার দিকে একপলক তাকায়। এই মেয়েটাকে সে চিনে না, তবুও মেয়েটির প্রতি আলাদা এক মায়া কাজ করে। মেয়েটি এই বয়সেই ভালোবেসে ঠকেছে। এইসময় মেয়েটির সত্যি খুব সাপোর্ট এর দরকার। কথাটি ভেবে আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

”ওকে আমিও এই মিথ্যে নাটক করার রাজি, বাট শুধুমাত্র কিছুদিনের জন্যে। বেবীটা তো কোন ভূল করেনি। অন্তত বেবীর জন্যে হলেও উনি এই বাড়িতে একবছর থাকতে পারেন। ‘

মেহেভীন এইবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

”আরিয়ান উনাকে বলে দে আমি শুধুমাত্র কয়েকটা দিন থাকবো। চাকরী টা হয়ে গেলে আর আমি থাকবো না।’

”আরিয়ান তোর এই স্টুপিড বন্ধুকে বলে দে দুনিয়াটা এতোটা সহজ না। যতটা সে ভাবে। এই ঢাকা শহরে প্রেগনেন্ট অবস্হায় একটা মেয়েকে একা কতটা স্ট্রাগেল করে থাকতে হয়, তার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই তার।’
কথাটি বলেই আরহাম রুম থেক বেড়িয়ে যায়।

মেহেভীন রাগে ফুসতে ফুসতে বললো,

”আরিয়ান তুই দেখলি? তোর এই বেশরম ভাই আমাকে স্টুপিড বললো?’

আরিয়ান হাত জোড় করে বললো,

”বইন এইবার অন্তত থাম। ভাই যে রাজি হইছে এইটাই অনেক। পরের টা পরে ভাবা যাবে। এখন আমাকে যেতে দে। কাল আমার হসপিটাল আছে। আমি যাই বরং। ‘

মেহেভীনকে কিছু বলতে না দিয়েই, আরিয়ান চলে যায়। মেহেভীন পড়েছে আরেক ঝালামায়। এই ঘরে ওই বেশরম লোকটার সাথে একই ঘরে কীভাবে থাকবে সে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই, আরহাম ঘরে একটি ছোট্ট বেডশিট নিয়ে আসে। তারপর স্টোর রুম থেকে ছোট্ট একটি খাট নিয়ে এসে, ঘরটায় সেট করে দেয়। মেহেভীন তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখছে। আরহাম বললো,

‘ তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট। তাই তুমি বলেই সন্মোধন করলাম। তুমি আমার বেডে ঘুমাতে পারো।
আমি এই ছোট বেডে ঘুমিয়ে পড়বো। এন্ড ডোন্ট ওয়ারি আমাদের রাতের দরজা খোলা থাকবে। আমি অতোটাও খারাপ নই এইসময় একটি মেয়ের সুযোগ নিবো। ‘

আরহামের কথা শুনে, নিজের অজান্তেই মেহেভীন খানিক্টা শান্তি পায়।লোকটাও আরিয়ানের মতো ভালো,হয়তো মেহেভীনের এই দুঃখের কথা শুনেই তাকে আশ্রয়টু্ুকু দিয়েছে তার রুমে। মেহেভীন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে খুব দ্রুতই চলে যাবে এই বাড়ি থেকে।

আরহাম মেহেভীনের সামনে তুড়ি বাজায়। মেহেভীন চমকে উঠে।

‘এই মেয়ে সারাদিন এতো কি ভাবো?’

‘আমার একটা নাম আছে। ‘

‘ওহ হ্যা। এরেভীন না কি নাম যেনো।’

‘আমার নাম মেহেভীন। ‘

মুখ বেকিয়ে বললো মেহেভীন। আরহাম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,

”সে যাই হোক। আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আর শুনো এই আরহাম হাসান তালুকদার কারো সাথে নিজের রুম শেয়ার করে না। আমি জাস্ট তোমার বেবীর জন্যে সেক্রিফাইজ করছি। অন্য কিছু না ওকে?’

আরহাম সোফায় বসে, ফোন টিপতে শুরু করলো। মেহেভীন মুখ বেকিয়ে ভাবতে লাগলো, ইসস আসছে। বেশরম লোক যেন মেহেভীন তার জন্যে কতকিছু ভেবে রাখে। সত্যি লোকটাকে মেহেভীনের পুরাই আজব লাগে।

[আমারও আজব লাগে 🙄ডাল মে কুচ কালা হে]

_________

সকাল সকাল অভ্র ব্রেকফাস্ট করার জন্যে বসে পড়ে। অভ্রের মা নিজের হাতে ছেলের জন্যে রান্না করে নিয়ে আসে। অভ্র তার মাকে বলে,

‘মা মায়রা তো আছেই। তুমি হঠাৎ করতে গেলে কেন?’

‘মায়রা এখন নতুন বউ। ওকে দিয়ে এখন কিছু করানো যায় নাকি? তাছাড়া মায়রার বাবা বেশ ভালো মানুষ। কাজের মানুষ রেখেছে এই বাড়ির জন্যে।’

অভ্র আর কিছু না ভেবে পুনরায় ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। মায়রা ছোট একটা স্কাট পড়ে, অভ্রের কাছে এসে বললো,

”অভ্র আমি রেডি। তুমি আমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবে না?’

”তুমি এইসব ড্রেস পড়ে বের হবে?’

অভ্রের প্রশ্নে মায়রা বললো,

‘কেন কোন সমস্যা? বিয়ের আগে তো এইসব ড্রেস ই পড়তাম। ‘

”আহা অভ্র। মেয়েটা পড়ছে পড়ুক না। ‘

অভ্র তার মায়ের কথা শুনে,চুপ হয়ে যায়। মায়রা অভ্রের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

”জানেন আন্টি। অভ্র না কেমন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন শুধু মুড অফ করে রাখে।’

‘কেন অভ্র? কি হয়েছে তোর?’

‘তেমন কিছুই না মা। অফিসে কাজের একটু প্রেশার। তাই আর কি। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। মায়রা চলো। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে। ‘

অভ্র কথাটি বলে, নিজের গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। মায়রাও অভ্রের পিছন পিছন যাওয়া শুরু করে দেয়।
অভ্রের মা পড়ে যায় চিন্তায়। ছেলের মতিগতি ঠিক লাগছে না। তিনি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছেন ছেলের মনে কী চলছে। যদি তার আন্দাজ ঠিক হয়, তাহলে সর্বনাশ!

চলবে কী?

[ভূল– ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]
[গল্পটা সম্পুর্ন কাল্পনিক]