তুমি আমি দুজনে পর্ব-১২+১৩

0
388

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ১২

-তুরা! কি হয়েছে কাদঁছো কেনো?

আহান ছুটে গিয়ে তুরার পাশে বসে বলে, তুরা রীতিমতো ছটফট করছে,আহান হাত বাড়িয়ে বেড সাইড ল্যাম্প টা জেলে দিলো। লাইটের আলোতে তুরার ভেজা ভেজা চোখ মুখ প্রথমে কুচকে নিলেও আহানকে দেখে আবারও কেঁদে বলে

-আ আমার বাবা,,আমার বাবা

আহান আরেকটু এগিয়ে যায় তুরার দিকে ওর হাত ধরে বললো

-কি হয়েছে তুরা, আমায় বলো কি হয়েছে, কোথায় তোমার বাবা

-আ আমার বাবা চলে গেলো,আমার বাবা আমায় ফেলে চলে গেলো, ওরা আমার বাবাকে নিয়ে গেলো,, আমাকে আমার বাবার কাছে নিয়ে চলুন নাহ,আমার বাবা ছাড়া তো আমার কেও নেই,

আহান বুঝতে পারলো তুরা ওর বাবাকে নিয়ে নিশ্চয় কোনো স্বপ্ন দেখেছে,,তুরাকে শান্ত করতে ওর হাত ধরে বললো

-তুরা, শোনো তোমার বাবাকে কেও নিয়ে যাচ্ছে নাহ, তুমি শান্ত হও

আহানের কোনো কথায় তুরার কানে যাচ্ছে নাহ, ও পাগলের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বিরবির করছে, হুট করে আহানের টি-শার্ট দু’হাতে খামচে ধরলো

-আ আমাকে আমার বাবার কাছে নিয়ে চলুন নাহ,, দিয়ে আসুন না আমায় বাবার কাছে। বাবা ছাড়া আমার কেও নেই, আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবো নাহ, আর কখনও আসবো না আপনার সামনে,আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আসুন, আমার খুব কষ্ট হয় বাবাকে ছাড়া, আমার বাবার মতো কেও নেই, চাচী আমায় খুব মারে, চাচাও পছন্দ করে না। আমি চলে যাবো, আমি বাবার কাছে যাবো, আমি আপনার পায়ে পরি আমায় নিয়ে চলুন,দয়া করুন আমার উপর

বলেই হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে,,আহানের কোনো কথায় তুরাকে শান্ত করতে পারছে নাহ। আচানক ই আহানের বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা শুরু হলো। মেয়েটার এমন বিধ্বস্ত চেহারা তার বক্ষস্থানে চড়াঘাত করছে,, এতটুকু মেয়ে মা বাবা হারিয়েছে,তার উপর চাচা চাচীর ব্যবহারেও এমন নির্মমতা?
আহানের ভীষণ কষ্ট হলো তুরার এহেন অবস্থা দেখে,,দুঃস্বপ্ন আর পেছনের কথা মনে পরে তুরার প্যানিক অ্যা’টাক এসেছে এটা আহান বুঝতে পারলো, ওকে এখন শান্ত করার দরকার, মেয়েটা যে কিছুতেই থামছে নাহ।
আহান কোনো দিক না পেয়ে তুরাকে ঝাপটে ধরে শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। তুরাও কান্নার দাপটে ভাবান্তরহীন হয়ে আহানের পিঠ দু’হাতে খামচে ধরে আহানের বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কাদঁতে থাকে। আহান কোনো রূপ বাক্য ব্যয় না করে পরম আবেশে তুরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
এমন আকস্মিকতায় আর উন্মাদনার প্রখরতায় আহানের এই ছোট্ট আদর যেনো এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় ঠান্ডা করে দিলো তুরাকে। দু’হাতে আরও ঝাপটে খামচে ধরে মিশে গেলো আহানের বুকের মাঝে।
বেশ কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলে তুরার কান্না দমে,, কান্না থেমে গেলেও খানিক বাদে বাদেই কেঁপে কেঁপে উঠছে তুরা, আহান আস্তে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তুরার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে ঘাড় কাত করে দেখলো তুরা ওর বুকের আবারও দু চোখ বুজে ঘুমিয়ে গেছে। ওকে আলতো ভাবে সরিয়ে দিতে নিলেই তুরা ঘুমের ঘোরেই ঝাপটে ধরলো আহানকে। উপায়ন্তর না পেয়ে আহান ওভাবেই ধরে রাখলো ।
আস্তে আস্তে তুরা ঘুমে আরও বিভোর হয়ে গেলো,,এক হাত এগিয়ে ল্যাম্প টা বন্ধ করে দিলো আহান,
ঘড়ির কাঁটায় একটা বেজে সাত মিনিট। আহান তুরাকে আর সরালো ও নাহ। কেনো জানি একদম ইচ্ছে করছে না মেয়েটাকে সরাতে, কেমন বাচ্চার মতো গুটিয়ে মিশে আছে আহানের বুকে, বুকের এক পাশ টা চোখের পানি নাকের পানিতে ভিজিয়ে ফেলেছে, অদ্ভুত ভাবে অত্যন্ত শুচিবাই স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও আহানের কোনো অসস্থি হলো নাহ। মেয়েটাকে আগলে রাখতেই তার ভাল্লাগছে।
নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর ঘড়ির কাটার খটখট শব্দ ছাড়াও আরেকটা শব্দ খুব তীক্ষ্ণ ভাবে বিধছে আহানের কানে,,তুরা আহানের বুকের ভেতরই মুখ গুঁজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে, যার শব্দ স্পষ্ট চড়াঘাত দিচ্ছে আহানের কর্ণকুহরে। ঘুমের ঘোরেই তুরা আহানের বুকে বাচ্চাদের মতো মুখ ঘষে দিলো। তড়িৎ গতিতে আহানের সারা বদনে যেনো তরঙ্গ খেলে গেলো, হৃদযন্ত্রের ছন্দময় ক্রীয়া টাও যেনো বিগড়ে গেলো, এলোমেলো অনুভূতির জোয়ারের আছড়ে পরার শব্দ স্পষ্ট আহানের ভেতর তোলপাড় তুলছে,,তুরা ঘুমে বুদ থাকলেও আহান তো পুরোপুরি জাগ্রত,সজ্ঞানে। পুরুষালি মনের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের প্রচন্ড বেগের আন্দোলন আহানকে প্রচুর অস্থির করে তুলছে। তবুও তুরার দু’হাতের ঝাপটে ধরা হাত টুকু আলগা করলো নাহ। ঘুমন্ত তুরার মুখটা অদ্ভুত নিষ্পাপ লাগছে আহানের কাছে,যেনো হুট করেই ভীষণ স্নিগ্ধতা ঢেলে পরলো মেয়েটির মুখ জুড়ে

★★★

সকালের রোদ চোখে মুখে উপচে পরতেই ঘুমন্ত অবস্থায় ই চোখ মুখ কুচকে এলো। বিরক্তিতে পাশ ফিরে শুতেই বিন্দু বিন্দু জলকণা ছিটকে পরলো তুরার চোখে মুখে, প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলতেই তুরার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো।
পরপর তিনবার পলক ঝাপটে আবারও তাকালো,,নাহ স্বপ্ন না ঠিক ই দেখছে সে, তুরার ঠিক সামনেই আহান ওর দিকে পিঠ করে কিছু একটা খুঁজছে, উপরে কালো রঙের শার্ট পরা থাকলেও নিচে একটা তোয়ালে ছাড়া কিছুই নেই,,পুরুষালি লোমশ পা পানিতে ভেজা, চুলের আগা থেকেও পানি টপকে পরছে,সারা গায়ের বিন্দু বিন্দু পানিকণা জমে আছে।
সদ্য গোসল করে বেরিয়েছে আহান,,এদিক ওদিক ঘুরে কিছু একটা খুঁজছে আর এক হাত দিয়ে চুলের পানি ঝাড়ছে,,, তুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে চেয়ে আছে আহানের দিকে, সারা গাল জুড়ে লাল টুকটুকে আভা ছড়িয়ে গেলেও অপলক চেয়ে রইলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চুল আচড়ানোর সময় একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তুরার দিকে তাকিয়ে আবারও তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া সরিয়ে নিজ কাজে মনোযোগ দিলো আহান,,কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও আলমারির সামনে গিয়ে তোলপাড় শুরু করলো।
তুরার ভ্রু কুচকে এলো এবার । সমস্যা কি এই লোকের? সকাল বেলা করে এমন তান্ডব শুরু করলো কেনো,,আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো সারা ঘরে জামা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে,তার ব্যাগের দিকে চোখ যেতেই দেখলো ব্যাগের ভেতরের জামা গুলোও লণ্ডভণ্ড করে এদিক ওদিক ফেলেছে।
এবার তুরার বেশ মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, সমস্যা কি এই লোকের, কালকেও তার জামা গুলোর যা তা করে ছিটিয়েছে,এবার তো আলমারিতেও রাখেনি তাও এভাবে ছিটিয়ে রাখার কোনো মানে হয়!
আহানের দিকে ফিরে তুরা কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহান ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়,যার ফলে দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।

-কি সমস্যা?

হাত দুটো কোমরে রেখে এক ভ্রু উচিয়ে প্রশ্ন করলো আহান

-আপনার সমস্যা কি?

তুরা উলটে প্রশ্ন করতেই আহান মুখের বিরক্তির ছাপ আরও গাঢ় করে বললো

-সকাল বেলা উঠেই চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো আমায়,,আবার আমায় ই বলছো কি সমস্যা?

আহানের কথায় তুরার চোখে মুখে ভীষণ বিরক্ত আর অবাকের রেশ পরে। সে কখন চোখ দিয়ে গিললো আজব! এই লোকটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি?

-এক তো সকাল বেলা উঠেই ঘরের অবস্থা গোয়ালঘর বানিয়েছেন, আবার বলছেন আমি চোখ দিয়ে গিলছি তাও আবার আপনার মতো জল্লাদকে?

শেষের কথাটা খানিক বিড়বিড়িয়েই বললো তুরা, আহান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে বললো

-আমার ঘর আমি গোয়ালঘর বানাই আর আস্তাবল তোমার কি তাতে?

-তা ঠিক৷ আপনি গোয়ালে থাকেন আর আস্তাবলে তাতে আমার কি, আপনি আমার জামা কাপড় কেনো ছিটিয়েছেন

আহান আবারও আলমারিতে হাত দিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললো

-একে তো আমার ব্ল্যাক প্যান্ট টা খুঁজে পাচ্ছিনা, তার উপর তোমার এসব পকপকানি শুনিয়ে আমার মাথা খারাপ করবা না একদম, তুমি এসে থেকেই আমার ঘরে একটা জিনিস ও ঠিকঠাক পাওয়া যায়না

-তো আপনার প্যান্ট খুঁজে পাচ্ছেন না তাতে আমার কি, আমার ব্যাগ কেনো ঘেটেছেন আপনি?

তুরার কথায় আহান ঘাড় ঘুরিয়ে বললো

-কারণ তোমাকে দিয়ে একদম বিশ্বাস নেই, তোমার ব্যাগেও ঢুকিয়ে রাখতে পারো।

আহানের এমন যুক্তিহীন কথা শুনে তুরার কপালের ভাজ আরও গাঢ় হলো। পাগল নাকি লোকটা? সে কেনো ওই হনুমান টার প্যান্ট নিতে যাবে। সে কি করবে প্যান্ট দিয়ে

-আজব তোহ! আপনার মাথার কয়টা তার কাটা আছে বলুন তো, আমি কেনো আপনার প্যান্ট নিবো। আমি কি প্যান্ট পরি?

আহান তুরার কথায় কান না দিয়ে আলমারি থেকে একটা কালো প্যান্ট বের করলো। এটাই তো কালো প্যান্ট! তাইলে এতক্ষণ কেনো শুধু শুধু তাকে এতগুলো কথা শোনালো? এক আঙুল উচিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুরার চোখ ডান পাশে পরে থাকা তার ব্যাগটার দিকে যেতেই মুখে লাগাম পরে যায়। ঝড়ের বেগে উঠে গিয়ে ব্যাগের কাছে গিয়ে নিচে পরে থাকা জিনিসটা তুলে নিলো ।
তুরাকে এভাবে ছুটে যেতে দেখে আহান ভ্রু কুচকে তাকায় ওর দিকে। তুরা আপাতত দু হাত পেছনে রেখে ফিক্সড একটা লুক দিয়ে চেয়ে আছে আহানের দিকে। এ পর্যায়ে আহানের বেশ সন্দেহ হলো! এই মেয়েকে দিয়ে এক চুল পরিমাণ বিশ্বাস নেই ওর। হাতের প্যান্ট টা খাটের উপর ফেলে এগিয়ে এসে বললো

-কি লুকাচ্ছো তুমি?

তুরা থতমত খেয়ে গেলো আহানের কথা শুনে, হতবুদ্ধির মতো ঘনঘন ঘাড় নাড়িয়ে বললো

-ক কই, কিছু না তো!

-তাহলে পেছনে হাত দিয়ে কি লুকাচ্ছো,দেখি?

-নাহ, আমিতো কিছুই লুকাচ্ছি নাহ, আর আপনার প্যান্ট তো পেয়েছেন, আমি নিশ্চয় আপনার প্যান্ট নেইনি

-এটা সেই প্যান্ট নয় যেটা আমি খুঁজছি। তুমি নিশ্চিত সেটাই লুকিয়ে রেখেছো, কই দেখি?

তুরা এবার তিন কদম পিছিয়ে গেলো, এ কোন গ্যাড়াকলে ফাঁসলো সে,এবার এই লোকটাকে কি করে বোঝাবে সে! আহান তুরার দিকে দু কদম এগিয়ে এসে বললো

-হাত সামনে আনো, কি লুকিয়ে রেখেছো তুমি?

তুরা ভয়ে আরও পিছিয়ে গেলো,পিছাতে পিছাতে একদম দেওয়ালের সাথে মিশে গেলো। আহান একদম তুরার কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো।

-লাস্ট বারের মতো বলছি, কি লুকাচ্ছো দেখাও

-কিছুই লুকাচ্ছিনা,আপনি সরে যান

-দেখাবে না?

-না!

ভয়ে মিনমিনিয়ে বললো তুরা, আহান এবার এক টান দিয়ে তুরাকে সরিয়ে এনে ওর হাত এনে সামনে ধরতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, তুরা লজ্জায় ঘাড় নামিয়ে রেখেছে, আহান একবার তুরার দিকে তাকাচ্ছে একবার তুরার হাতের দিকে।
খপ করে হাতটা ছেড়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো, তুরা লজ্জায় বিহ্বলিত হয়ে এক চুল নড়াচড়ার করার শক্তি হারিয়েছে। যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো।
জামা কাপড়ের সাথে তার ব্যাবহার্য অতি গোপনীয় জিনিসটাও ব্যাগের বাইরে পরে ছিলো। লাল রঙের ফিতা টা দেখেই সে ছুটে এসে সেটাই লুকাতে চেয়েছিলো। কিন্ত এই ব’জ্জাত লোকটা দেখেই ফেললো। লজ্জায় তুরার মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে, শেষে কি না এই দিন টাও তার দেখতে হলো! আহান বিছানার উপর থেকে প্যান্ট টা নিয়ে গটগট করে ওয়াসরুমের ভেতরে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো । তুরা কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে সেও বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। ব্যস অনেক হয়েছে! কিছুতেই আসবে না আর এইরকম হনুমান টার ঘরে,আস্তা বেশরম লোকটা,,ছি ছি ছি!! লজ্জায় তুরার নাক কান সব কাটা যাচ্ছে।।

______

ভার্সিটির সামনে এসে রিকশা টা দাড়াতেই তুরা নেমে ভাড়া টা দিয়ে এক হাতে ব্যাগ টা ধরে এগিয়ে আসলো। তখন ও ঘর থেকে বেরোনোর পর সোজা রাইমার ঘরে এসে গোসল করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরেছে, আজ সে একাই যাবে ভার্সিটিতে। ইমপর্ট্যান্ট ক্লাসের দোহাই দিয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পরেছে তুরা, কারণ সে ওই ব’জ্জাত লোকটার সামনে কিছুতেই পরতে চাইনা।
বাবা আজ সকাল সকাল অফিস যাওয়ার দরুন গাড়িতেও আসতে হয়নি তার। তাই নিশ্চিন্ত হয়ে ভার্সিটির ভেতরে পা রাখলো। খানিক এগিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে নির্দিষ্ট ক্লাসে ঢুকতেই নজরে আসলো কাঙ্ক্ষিত চেহারা দুটো। ঠোঁট প্রসারিত করে সামান্য হেসেই এগিয়ে গেলো তুরা।
ফারিহা আর সাদমান একসাথেই বসে আছে, এই কয়দিনে তিনজনে বেশ ভাব জমেছে, সাদমান পড়াশোনায় একটু বেশিই সিরিয়াস, তিনজনে তুলনামূলক সেই বেশি ভালো, ফারিহা সবসময় চিল মুডে থাকা মানুষ, আর তুরা মাঝামাঝি পর্যায়ে। এখনো সাদমান বইয়েই মুখ গুজে আছে, আর স্বভাব সুলভ ফারিহা নানারকম উদ্ভট কথা বলে তাকে বিরক্ত করছে। তুরা যেতেই ওকে দেখে ফারিহা বললো

-আরে ডিয়ার, তোমারই তো অপেক্ষা করছি, এসো এসো বস

তুরা হাস্যজ্বল চেহারা নিয়ে বসলো ফারিহার পাশে, সাদমান তুরাকে দেখে বই থেকে মুখ তুলে হাই বললো। তুরাই হেসে হ্যালো বললো।

-আজ এত তাড়াতাড়িই চলে আসলে যে?

ফারিহার কথা শুনে তুরা চুপ করেই থাকলো, সে যে কেনো আগে এসেছে সে ব্যাপার টা তো আর মুখে বলার মতো নাহ, তুরা নিরুত্তর থাকা অবস্থায় ই সাদমান বললো

-আহান স্যারের দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট করেছো তুরা?

-অল্প কিছু, পুরোটা শেষ হয়নি এখনো

সাদমান নাকের ডগায় এসে পরা চশমা টা এক আঙ্গুলের সাহায্য তুলে আবারও বললো

-কালকেই তো সাবমিট করতে হবে, কখন করবে তুমি?

তুরাকে উত্তর না দিতে দিতে পাশ থেকে ফারিহা বললো

-আরে থাম ভাই তোরা, কি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পরেছিস, আমিতো এখনো শুরুই করিনি

ফারিহার এমন কেয়ারলেস কথায় সাদমান প্রয়োজনের বেশি অবাক হয়ে বললো

-হ্যাহ? এখনো করোনি? স্যারকে কি সাবমিট করবে তাইলে?

-আজ রাতের মধ্যে করে ফেলবো ইয়ার

দায়সারা ভাব টা বজায় রেখেই বললো ফারিহা। তুরা কিছু বলতে নিবে তার আগেই ক্লাসে আগমন ঘটলো দ্যা মোস্ট ওয়ান্টেড চার্মিং লেকচারার ফর অল,,,ইরফান মাহমুদ আহান। সবাই দাঁড়িয়ে গুড মর্নিং জানালে তুরাও চুপচাপ উঠে দাড়ালো,, মুখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো আহানের সাথে তুরার, তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো, ইশ! কি লজ্জা,,এত লজ্জায় এর আগে কখনও পরেনি তুরা। আহান এক পলক চেয়ে অন্যদিকে মন না দিয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করলো।
পুরো এক ঘন্টা দশ মিনিট পর ক্লাসের ঘন্টা বাজলো, আহান সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরোতেই তুরা হাফ ছেড়ে বাচলো। ক্লাস চলাকালীন না চাইতেও বার কয়েক চোখাচোখি হয়েছিলো আহানের সাথে, লোকটার চেহারা দেখলেও তুরার এখন পাতালে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
এরপর আরও দুটো ক্লাস করে ব্রেক টাইম আসতেই ফারিহা আর তুরা নেমে এলো ক্লাস থেকে৷ সাদমান গেছে ডিপার্টমেন্ট হেড মানে আহানের কাছে তার স্টাডি রিলেটেড কিছু প্রশ্ন নিয়ে, ফারিহার ক্ষুধা লাগায় সে নিচে নেমে এসেছে তুরাকে নিয়ে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে,,তুরাকে খাবার আনতে দিয়ে ফারিহা গিয়ে বসলো ক্যাম্পাস ফিল্ডে। তুরা ক্যান্টিন থেকে স্যান্ডউইচ জুস, আর সসের প্যাকেট নিয়ে বেরোতে নিলেই আচানক কারো সাথে ধাক্কা লাগায় হাতের ট্রে ফসকে গিয়ে পরলো আগন্তুকের গায়ে,,ঘটনার আকস্মিকতায় তুরা হতবাক হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো সাদা শুভ্র শার্টের একদম মাঝ বরাবর বুকের বড় একটা জায়গা জুড়ে সস লেগে ভীষণ ভাজে ভাবে দাগ হয়ে গেছে। ভীষণ অপ্রস্তুত আর আতংকিত চেহারায় মাথাটা সামান্য উচু করে তাকাতেই চক্ষুগোচর হলো একদম অনাকাঙ্ক্ষিত শ্যামরাঙা মুখ খানা।
তুরা হতবাক হয়ে মিনমিনিয়ে বললো

-মাহিদ স্যার!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ১৩

প্রচন্ড অপ্রতিভ আর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে আছে তুরা,,তার সামনে দাঁড়িয়ে তারই ডিপার্ট্মেন্টের স্যার, যার শার্টে সস ফেলে বেশ অনেকক্ষানি স্থান জুড়ে দাগ করে ফেলেছে।
পথযচুত আর ক্লেশিত দৃষ্টিতে তুরা তাকালো মাহিদ স্যারের দিকে, আমতাআমতা করে বললো

-স স্যার,আপনি! ম মানে আমি এসব ইচ্ছে করে করিনি আম..

-ইটস ওকে, ডোন্ট প্যানিক

খুব সাবলীল স্বরের ভঙ্গিমা বজায় রেখেই উত্তর দিলো মাহিদ, তুরা বিমূঢ় হয়ে তাকালো মাহিদের চেহারায়,, নাহ কোনো রাগ বা বিরক্তির ছাপ নেই, এত বড় কান্ড করে ফেললো অথচ লোকটা একটু রাগ ও করলো না?

-স্যার আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, আমার সাবধানে চলা উচিত ছিল, আমার জন্য আপনার পোশাক নষ্ট হয়ে গেলো

-না না ঠিক আছে, মানুষ মাত্রই ভুল। তুমিতো আর ইচ্ছে করে করনি, সো ইটস অলরাইট

এই ব্যাপার টাকে মাহিদ স্যার এত সহজভাবে নিবেন তুরা ভাবতেই পারেনি,,তুরার মনে হলো লোকটা ভীষণ ভালো, এর জাগায় জল্লাদটা থাকলে নিশ্চয় এতক্ষণে পুরো ভার্সিটি মাথায় তুলতো ডিসগাস্টিং বলে।

-স্যার আপনার শার্ট টা পরিষ্কার করা উচিত, এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে আর দাগ উঠবে নাহ

তুরা একটা টিস্যু মাহিদের সামনে ধরে বললো। মাহিদ বরাবরের মতোই স্বাভাবিকভাবেই তুরার হাত থেকে টিস্যু টা নিয়ে স্মিত হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে পিছু ফিরে হাঁটা ধরলো ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে।

-কিরে, আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি আর তুই এখানে হা করে দাঁড়িয়ে আছিস?

পেছন থেকে ফারিহার কথা শুনে তুরা ওর দিকে ফিরে, বললো

-আর বলো না, অকাজ করে ফেলেছি একটা

-ফার্স্ট অফ অল, তোর এই তুমি টুমি মার্কা ফরমালিটি বাদ দেহ,তারপর বল কি হয়েছে

-আমি ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে বেরোচ্ছিলাম ই তখন হুট করেই মাহিদ স্যার সামনে আসলে উনার সাথে ধাক্কা লেগে সব সস উনার শার্টে লেগে গেছে

-কিহ,মাহিদ স্যার?

-হ্যাঁ

-কিছু বললো তোকে,বকেছে নাকি?

-আরে না না,উনি তো স্বাভাবিকভাবেই হেসে কথা বলে চলে গেলো, কিন্তু আমারই খারাপ লাগছে। বেচারার সাদা শার্ট টাতেই দাগ বসিয়ে ফেলেছি

তুরা মুখ টা ছোট করে অপরাধীর ন্যায় বললো। ফারিহা এগিয়ে এসে ওর এক গাল টিপে বললো

-ওলে বাবুলে,,থাক এত গিল্টনেস দেখাতে হবে নাহ, যা হওয়ার হয়েই তো গেছে তুই বরং সারের সাথে দেখা করে আরেকবার সরি বলে দিস

তুরা তাও অন্যমনস্ক হয়ে বললো

-হ্যাঁ আচ্ছা

-তোর আচ্ছা টাচ্ছা বাদ দে তোহ,আমার ক্ষুধা পেয়েছে, একবার তো মাহিদ স্যারের উপরেই পরলো খাবার,এবার আমার পেটে না পরলে আমি পাগল হয়ে যাবো

বলেই তুরাকে টেনে নিয়ে ক্যান্টিনের ভেতরে নিয়ে যায় ফারিহা,, খাবার খেয়ে ব্রেক শেষ হলে আরও দুটো ক্লাস করে বারোটার দিকে বের হয় ভার্সিটি থেকে। ফারিহা আর সাদমান কে বিদায় জানিয়ে তুরা বাড়ির দিকে হাটা ধরলো।
আজ বাড়ি থেকে পাঠানো গাড়ি আর ওই ব’জ্জাত লোক কোনটাই নেই, তাই আজ ইচ্ছে মতো ঘুরবে,, তুরা আনমনেই হেঁটে এসে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালো,, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও কোনো বাস আসার নাম নেই,, অপেক্ষার কাটা বিশ মিনিট পেরোতেই একটা বাসের দেখা পেলো , বাসটা এসে থামতেই তুরা কাধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলো। এভাবে একা লোকাল বাসে উঠার অভিজ্ঞতা তার নেই, সিড়িটাও কেমন উচু, হাত ফসকে পরলেই শেষ। তুরা মনে সাহস জুগিয়ে বাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডেল টা শক্ত করে ধরে উঠতে গেলে হাতের বন্ধন টা আলগা হয়ে পরে যেতে নিলেই বাসের ভেতর থেকেই একটা হাত চেপে ধরে তুরার হাত। এক টানে তুরাকে বাসের ভেতর টেনে নিতেই বাসটা আবারও চলা শুরু করলো।
তুরা দরজার সাথে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা হালকা পাতলা গড়নের অল্পবয়স্ক ছেলে, পরনে একটা প্যান্ট আর জার্সির মতো টি-শার্ট,, গলায় কিসব চেইন ও ঝুলানো। একটা হ্যাংলা মার্কা হাসি দিলো তুরার দিকে তাকিয়েই। এতে তুরার ভীষণ অসস্থি হলেও ছেলেটা যেহেতু ওকে সাহায্য করেছে সেই সুবাদে ওউ সামান্য হেসে এগিয়ে দাঁড়ালো। বাস ভর্তি লোকজন, একটা সিট ও ফাঁকা নেই,অগত্যা তুরাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হলো। তুরা দাঁড়িয়ে থাকলেও তার একদম পেছনে দাঁড়িয়ে সেই হ্যাংলা মার্কা ছেলেটা, একটু পরপর বাসের ঝাঁকুনিতে গায়ের মধ্যে ঢলে পরছে বারবার।এটা যে ইচ্ছে করেই করছে ছেলেটা তুরা বেশ ভালো মতোই বুঝতে পারছে৷ কিন্তু এগিয়ে যাবে কোথায় আশেপাশে লোকজন দিয়ে টইটম্বুর বাসটা, এক চিলতে পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখেনি। তবুও তুরা চেষ্টা করে এগিয়ে এসে দাড়ালো, অনেকক্ষানি এসে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনের তুরার স্টপ, এইটুকু পার হলেই বাঁচে, কিন্তু তুরার অসস্থি বাড়িয়ে ছেলেটা আবারও এগিয়ে এলো। তুরা মনে মনে দুয়া করছে যাতে রাস্তা টুকু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়,, ছেলেটা আরেকটু এগিয়ে এসে দাড়ালেই বাস জোরেশোরে ব্রেক কষে থামলো আর এটার সুযোগ নিয়ে বখাটে ছেলেটা আবারও তুরার গায়ে হেলে পরতে আসলে তুরাও কনুই দিয়ে এক গুতা দিয়ে ফেলে দিলো ছেলেটাকে,, ভরা বাসে লোকজনের গায়ের উপর গিয়ে ছেলেটা পরতেই গ্যাঞ্জাম শুরু হয়ে গেলো, আর তুরাও এই সুযোগে ভীড় ঠেলে বাস থেকে নেমে এসে দাঁড়ালো। নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটা আবারও চলা শুরু করলে তুরা যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো।
উফফ এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে আসছিলো মানুষের ভীড় আর অসস্থিতে, এবার যেনো প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো। আবারও হাসিহাসি মুখ করে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। বাসস্টপ থেকে দুই মিনিট হাটলেই বাড়ি। তাই নিশ্চিত হয়ে হাটতে নিলেই হুট করে ছোট্ট একটা বিড়ালছানা এসে পরলো তুরার পায়ের কাছে।
একেবারে বাচ্চা একটা বেড়াল, সাদা গায়ে মাথার কাছে লালচে ছোপ ছোপ দাগ,, ভীষণ মিষ্টি দেখতে বেড়াল টাকে কোলে তুলে নিলো তুরা। মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিতেই আহ্লাদিত হয়ে বাচ্চাটাও ‘মিও মিও’ করে উঠলো

-ইশ কি কিউট বাচ্চাটা!!

উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো তুরা, বিড়ালটাকে কোলে নিয়েই এদিক ওদিক তাকালো, এত ছোট বাচ্চা বিড়াল টা এখানে কোত্থেকে এলো?এখানে দুইটাই বাড়ি, রাস্তার ডান পাশের টা তাদের, আর অপরপাশের টা প্রতিবেশী লোকেদের,,ওদের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানে না তুরা। ছোট থেকেই বিড়াল ভীষণ পছন্দের তুরার, নিজের বাড়িতে থাকতেও কতগুলো পুষতো। বিড়ালের বাচ্চাটাকে পেয়ে সাত পাচ না ভেবেই ওটাকে কোলে করেই বাড়িতে এসে গেলো তুরা।
বাড়ির ফটক পেরিয়ে ঘরে ঢুকে কোনো দিক না তাকিয়ে তুরা সোজা সিড়ি বেয়ে উঠতে নিলে পেছন থেকে রাইমার ডাকে পা থামিয়ে দাড়ালো।

-কিরে তুরা, তোর হাতে ওইটা কি?

তুরা ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো, টেবিলে মিনু রুবি আর আমেনা খেতে বসেছে, রাইমা পাশের সোফাতে ফোন হাতে বসেই প্রশ্নটা করেছে।
তুরা এবার সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালো, রাইমার কথা শুনে উপস্থিত সকলেই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো তুরার দিকে,,তুরার হাতের বিড়ালটা দেখে মিনু মুখ কুচকে বললো

-এমা ছি ছি বউ,এইটাকে তুমি কোত্থেকে ধরে আনলা,আবার কোলেও করে রেখেছো?

ফুফুর কথা শুনে তুরা মুখটা আরও ছোট করে ফেললো, কাচুমাচু মুখ করে বললো

-এটাকে আমি ওই মোড়ের কাছেই পেয়েছি, রাস্তায় আমার পায়ের কাছে এসে কাঁদছিলো তাই আনলাম

-ওমা, বিড়ালছানা আবার কেঁদেছে? আর কাদঁলেই তুমি এসব পশুপাখি তুলে বাড়িতে নিয়ে আসবা

মিনু ফুফু বেশ বিরক্তি নিয়েই বললো কথাগুলো। তুরা ফুফুর হাবভাব দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার বিড়াল একেবারেই পছন্দ নাহ। তুরা এবার এগিয়ে গিয়ে রুবির কাছে দাঁড়িয়ে বললো

-আমি এটাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি, ওকে দেখে আমার ভীষণ মায়া হয়েছে, আমি কি ওকে এ বাড়িতে রাখতে পারবো না মা?

একদম ধিমি স্বরে মুখটা ছোট করে বললো তুরা, রুবি কোনো রকম উত্তর করার আগেই আবারও বললো

-আমি কথা দিচ্ছি ও কাওকে বিরক্ত করবে নাহ,সবসময় আমার কাছেই ঘরের এক কোণায় রেখে দেবো, তবুও রাখি না মা? আমার বিড়াল খুব ভাল্লাগে

বলেই শুকনো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। রুবি খাতুন তুরার এমন অসহায় করা মুখ দেখে হালকা কেশে বললো

-দেখো, তুমি যখন এত করেই বলছো আমি অনুমতি দিতে পারি, তবে বাকিরা যদি অমত করে তখন কিন্তু আমার কিছু করার থাকবে নাহ?

রুবির কথা শেষ করার আগেই তুরা হড়বড়িয়ে বললো

-আর কার অমত হবে মা, বাবাকে আমি সামলে নেবো, রাইমা আপুও কিছু বলবে না, আর দিদুন!

বলেই আমেনা খাতুনের কাছে গিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো

-ও দিদুন তুমিও আপত্তি করবে না বলো? দেখনা ও কত ছোট একদম বাচ্চা,ও কাওকে জ্বালাবে নাহ, তুমি মা কে বলনা তোমার কোনো আপত্তি নেই

তুরার এমন গড়গড় করে বলা কথায় আমেনা খাতুন কি বলবে ভেবে না পেয়ে রুবির দিকে তাকিয়ে বললো

-আ আচ্ছা ঠিকাছে, আমারও আপত্তি নেই, তবে দেখো কাওকে আ’চড়ে না নেই,

-ও আমি দেখে নেবো দিদুন ও কাওকে খা’মচি দিবে নাহ

-তুই না হয় ওকে দেখে নিলি,কিন্তু তোর উনিকে কে দেখবে?

রাইমার কথায় তুরা বিব্রত হয়ে বলে

-মানে?

-মানে আহানের বিড়ালের লোমে অ্যালার্জি আছে, ও বিড়াল এক প্রকার সহ্যই করতে পারেনা, ও যদি দেখে বিড়াল এনেছিস তাহলে আর নিস্তার নেই

রাইমার কথায় তুরার মুখাবয়ব যেনো ভীষণ অসহায়ত্ব ধারন করলো,,সবাইকে তো মানিয়ে নিলো সে,এবার কি করবে? আগে তো জানতো জল্লাদ লোকটার শুধু তাকে নিয়েই যত সমস্যা, এখন তো দেখছে এই বিড়াল টাও তার শত্রু। এখন কি হবে?

-এসব লোমশ জিনিস আমার ও পছন্দ নাহ,,এরা কখন কি খা’মচে দেয় আচরে দেয় ঠিক নেই। বাড়িঘর ও নোংরা করবে

মিনু ফুফুর কথায় তুরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো

-ও কাওকে জ্বালাবে না ফুফু আম্মা, আমি দেখে রাখবো, আর উনার আশেপাশেও যেতে দেবোনা, তবুও রাখি না প্লিজ? আর কখনও কোনো অনুরোধ করবো নাহ, এটাকে রাখতে দিন না

তুরার এমন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কথা বলা দেখে মিনু রুবির দিকে তাকিয়ে বললো

-খুঁজে একটা বউ এনেছিস রুবি! কিছুই বলাই যায়না বাবা, এমন চেহারা করলো যেনো আমরা ওর সাত রাজার ধন কেড়ে নিতে চেয়েছি। ওর চেহারা দেখে নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে।

বলে আবার তুরার দিকে ফিরে বললো

-হইছে, এবার ন্যাকা কান্না টা থামিয়ে ওটাকে একটা জাগায় রেখে হাত মুখ ধুতে আসো, সেই সকালে বেরিয়েছ এখনো তো খাবার নাম নেই। আবার বিড়াল ছানা পালবে, তুমি তো নিজেই একটা বাচ্চা।

মিনু ফুফুর ধমকে তুরা মিনমিনিয়ে বললো

-কিন্ত উনি যদি..

-তোমার উনিকেও আমরা বুঝে নেবো,এখন এমন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে শিগগির ফ্রেশ হয়ে আসো তো

তুরা ফুফুর কথা শুনে উপরে চুপ থাকলেও ভেতরে ভেতরে তার আনন্দে লুঙ্গি ডান্স করতে ইচ্ছে করছে,,ফুফু মানুষ টা একটু কড়াভাষী হলেও ভীষণ ভালো, তুরা তো পারছে না জড়িয়ে ধরে দুটো চুমু দিতে। ভেতরের ইচ্ছে ভেতরেই দমিয়ে রেখে শান্ত ভাবে উপরে উঠে ঘরে এলো। ঘরে আসতেই ব্যাগ টা নামিয়ে বেড়াল টাকে হাতে নিয়েই উড়াধুড়া লাফানো শুরু করলো,,তার আনন্দ ধরে কে এবার!
আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে বারান্দার দিকে যেতেই মুখটা চুপসে গেলো, জল্লাদ টা আসছে,এবার না জানি কি রকম হম্বিতম্বি শুরু করবে, লোকটা একেবারে অসহ্যকর, সব জিনিসেই জল্লাদপনা।
কালো রঙের শার্টের হাতাটা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা,, হাতের ব্যাগটা ঝুলিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভেতরেই ঢুকছে আহান, হঠাৎ পেছন থেকে আসা ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালো।

-আহান?

পেছন ঘুরে মাঝবয়েসী মোটাসোটা মহিলাকে দেখে সালাম দিলো আহান, ভদ্রমহিলা সালামের উত্তর দিয়ে এগিয়ে আসলো। বারান্দা থেকে তুরা এসব দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, নিজে খানিকটা সরে দাঁড়িয়ে তাদের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করলো

-তোমার সাথে একটা কথা ছিলো বাবা

মহিলার কথায়,আহান স্বভাবসুলভ ভদ্রতা বজায় রেখে বললো

-জ্বি বলুন?

-বাবা তুমিতো জানোই আমার ছোট ছেলেটার বিড়াল পোষার ভীষণ শখ,, আছেও ওর একটা বিড়াল। এইতো এক মাস আগেই দুটো বাচ্চা হয়েছে বেড়ালটার। কিন্তু সকাল থেকেই একটা বাচ্চা খুঁজে পাচ্ছিনা, আশেপাশে সব জাগায় দেখলাম। তোমাদের বাড়িতে কি গিয়েছে বিড়ালের বাচ্চাটা?

আহান পুরো কথাটা শুনে, খুব সাবলীলভাবেই বললো

-না তো,আমাদের বাড়িতে তো কোনো বিড়াল আসেনি। আর আসলেও তো মা অথবা আপি ফিরিয়ে দিয়ে আসতো। আমার ক্যাটস এ অ্যালার্জির কারণে বাড়িতে বিড়াল কেও রাখেনা

ভদ্রমহিলা আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে মুখটা চুপসে গেলেও আগের নমনীয়তা বজায় রেখেই বললো

-আচ্ছা ঠিকাছে, ছেলেটা আমার খুব কান্নাকাটি করছে তো তাই বাধ্য হয়েই খুঁজে বেরাচ্ছি। তুমি দেখলে একটু জানিও বাবা

আহানা মহিলার সাথে খানিক বাক্যব্যয় করেই বিদায় জানিয়ে আবারও বাড়ির ভেতরে হাটা ধরলো। পুরোটা কথা শুনেই তুরার চোখ কপালে উঠে গেলো, তার মানে বিড়ালটা ওই মহিলার বাচ্চার? এখন এটা তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে? কোলে থাকা বিড়ালটার দিকে একবার তাকালো তুরা, কি সুন্দর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে তার কোলে। নাহ..সে কিছুতেই এটা ফিরিয়ে দেবে নাহ!
তাইলে এখন কি করবে? ওই লোকটা দেখলেই তো বলে দেবে, এটাকে লুকাতে হবে! যা ভাবা তাই কাজ। তুরা বিড়ালটাকে হাতে নিয়েই এদিক ওদিক ছুটা শুরু করলো,,
বাথরুমের ভেতর? নাহ সেখানে তো এখনি এসেই যাবে,, তাইলে কোথায় বারান্দায়? নাহ সেখানে রাখলেও তো দেখে ফেলবে, কোথায় রাখা যায়! এদিক ওদিক ছুটে কোনো রাস্তা না পেয়ে বিড়াল শুদ্ধ খাটের নিচে ঢুকে পরলো তুরা।এখন এটাই একমাত্র জায়গা লুকানোর।

আহান গটগট করে ঘরে ঢুকেই হাতের ব্যাগটা টেবিলে রাখলো। ঘড়িটা খুলে রেখে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে খাটের উপর বসলো। আজ ভীষণ ক্লান্ত সে, দীর্ঘক্ষন ধরে পেপারস চেক করাই মাথা টাও কেমন ধরে আসছে, আপাতত গোসল করা প্রয়োজন। খাট থেকে উঠতে নিলেই পায়ের সাথে কিছু বাঁধলেই নিচে তাকায় আহান। নীল রঙের ওড়নার একাংশ বেরিয়ে আছে খাটের নিচ থেকে,, এই ওড়না এখানে আসলো কি করে? তার যতটুকু মনে আছে এই ওড়না টাই আজ মেয়েটা পরেছিলো,কিন্ত এটা খাটের নিচে কি করে আসলো। কি একটা মনে হতে আহান খাট থেকে নেমে ওড়না টা ধরে টান দিলো। কিন্তু পুরোপুরি না বের হওয়ায় আবারও টান দিতেই খাটের নিচ থেকে শুনতে পেলো

-এই জল্লাদটা আমার ওড়না কেনো টানছে আজব

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনেই আহানের কপালে ভীষণ কৌতুহলের ভাজ পরলো। হাটু মুড়ে বসে খাটের নিচে তাকাতেই দেখলো তুরা খাটের নিচেই এক কোণায় উপর হয়ে আছে,,

-তুমি! খাটের নিচে কি করছো তুমি??
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥