তুমি আমি দুজনে পর্ব-২+৩

0
447

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
২+৩
পর্ব- ২

ধপ করে কিছু পরার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আহানের, চোখ খুলে তাকাতেই লাইটের কড়া আলোতে চোখ মুখ কুচকে এলো। নিজেকে ধাতস্ত করে উঠে বসতেই সামনে তাকিয়ে ভ্রু কুটি হয়ে এলো। ওর সামনেই তুরা উপুর হয়ে পরে আছে, কোনো নড়চড় নেই
আহান উঠে গিয়ে তুরার পাশে হাটু গেড়ে বসে বলে

-এই মেয়ে? তুমি এখানে কি করছো? আর এভাবে উপুড় হয়ে পরে আছো কেনো

ভারী আওয়াজ টাতে বুক কেঁপে উঠলো তুরার,হুট করে কিভাবে পরে গেলো বুঝতেই পারিনি, কোনো ভাবে উঠে মুখ কাচুমাচু করে গুটিয়ে বসে আহানের দিকে টিপটিপ করে তাকালো

-কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? তোমার সাহস কি করে হয় আবারও আমার ঘরে আসার?

এমন রূ’ঢ় ধ’মকে আরও গুটিয়ে গেলো তুরা,এমন গাম্ভীর্যতায় তুরার খুব অসস্থি হচ্ছে। তুরার এমন চুপ করে থাকায় আহানের রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো,এমনিতেই কাল থেকে মেজাজ টা বিগড়ে আছে, সারা রাত ঘুমাতে পারেনি,তাও এই মেয়েটার জন্যেই। এই মেয়ে কি কথা বলতে পারে নাহ?

-আর ইউ ডাম্ব? কথা বলতে পারো নাহ? যাস্ট গেট আউট ফ্রম হেয়ার!!

হুংকারের স্বরে তুরা আবারও কেঁপে উঠে, এই লোকটা এমন কেনো? তাকে তো কথা বলার সুযোগ ই দিচ্ছে নাহ, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে নাহ। পারা হুরো করে উঠতে নিলে জামায় টান লেগে ধপ করে পরলো একদম আহানের বুকের উপর। তুরার জান উড়ে গেছে! এবার কি হবে, লোকটা যেমন জ’ল্লাদ তাকে গি’লে না ফেলে,
ছিটকে সরে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো , আহান ওকে কড়া কিছু বলতে নিবে তখনই খেয়াল করলো হাঁটু গেড়ে সে মেয়েটার জামার উপর ই বসেছে তাই উঠতে গেলে পরে গেছে, তুরার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নেবে তখনই চোখ যায় ওর ঘাড়ের দিকে
জামার গলাটা অত্যাধিক বড় হওয়ায় কাধ বেয়ে নেমে গেছে, ফর্সা কাধে কালো রঙের তিলটা জ্বলজ্বল করছে। আহানকে এভাবে এক ধ্যানে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকাতেই আতঁকে ওঠে, এক হাতে খামচে ধরে ঘাড় বেয়ে পরর যাওয়া জামা। আহান তুরার এমন আ’তংকিত চেহারা দেখে ওকে কিছু বলতে নিলেই তুরা ধপ করে উঠে এক হাতে ব্যাগ নিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
তুরার যাওয়ার পানে হা করে চেয়ে থাকে আহান, কি হলো!

-শিট! আমি কেনো তাকাতে গেলাম ওভাবে, পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি, ডিসগাস্টিং

বলেই তোয়ালেটা হাতে নিয়ে গটগট করে হাঁটা ধরলো ওয়াসরুমের দিকে

~~

ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বুকে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো,,

-উফ বড় বাচা বেচেছি, জ’ল্লাদ লোকটার শকুন চোখ দেখলেই ভয়ে গায়ে কাটা দেয়।

সাত পাচ ভেবেই ব্যাগ থেকে কাপড় আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে যায়,সকালে গোসল করার অভ্যাস টা তার ছোট থেকেই,,সকালে গোসল করে তার বাবা তাকে নিজে তৈরি করে দিতো স্কুলের জন্য,
আগের কথা মনে হতেই তুরার চোখ ভরে আসে। মা তো জন্মের কয়েক বছর পরেই তাকে ছেড়ে চলে যায় না ফেরার দেশে, তারপর থেকে তার কাছে পুরো পরিবার টাই শুধু তার বাবা, ছোট থেকে তার বাবা কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি, মাথায় তুলে রেখেছে একমাত্র সন্তান তুরাকে, এক বছর আগে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে তার বাবা নামক ছায়া টাও মাথা থেকে সরে যায়,আপন বলতে এক চাচা আফ ফুফু ই ছিলো। তুরার ফুফু লন্ডনে থাকে পরিবার সমেত,,ভাইয়ের মৃত্যুর পর তুরাকে আর এখানে রাখতে চাইনি নিজের সাথেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু তুরাই যায়নি,,এই বাড়িটা জুড়ে তার আর তার বাবা স্মৃতি, এগুলো ছেড়ে যাওয়ার মতো পা’ষাণ সে হতে পারেনি,,, খুব স্বচ্ছলতায় তার জীবন কাটলেও বাবার মৃত্যুর মাস দুয়েক পর তা হয়ে ওঠে দূর্বিষহ,, যেই চাচার ভরসায় থেকে গেলো এখানে সেই চাচা তাকে মোটামুটি ভালোবাসলেও সে ছিলো চাচির দু চোক্ষের বি’ষ। বাড়ির সবরকম কাজ করানো, কড়া কথা শোনানো আর কোনো ভুল হলে অ’মানবিক অ’ত্যাচারে ভরে গেছিলো ছোট্ট তুরার জীবন।
এক বছর কষ্ট করে পড়াশোনা করলেও তার পরে আর তা ভাগ্যে জোটেনি, এইচএসসি তে গোল্ডেন পাওয়া সত্ত্বেও তার আর ভার্সিটিতে পড়া হয়নি, পরীক্ষার কয়েক দিনের মাথায় চাচি কোত্থেকে এক ছেলে যোগাড় করে আনে তুরার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য, লোকটাকে দেখেই তুরার গা গুলিয়ে এসেছিলো৷ কেমন বি’শ্রি চাহনি, আর অ’শ্লীল কথাবার্তা বলেছিলো তাকে দেখতে এসেই,একদিনের দেখায় তুরা তার চাচীকে হাজারো বিনতি করেছিলো যাতে বিয়েটা না দেয়,তবুও তার পাষাণ মন গলেনি।
কিন্ত উপওয়ালা হয়তো তুরার কথা রেখেছে, বিয়ের দিনই হঠাৎ পুলিশ এসে তার সেই লোককে ধরে নিয়ে যায় মার’পিট মেয়ে’বাজি আর জু’য়া খেলার দায়ে,
তুরা যেনো হাফ ছেড়ে বেচেছিলো,,
কিন্ত বিয়েতে আসা লোকের ভীড়ের মাঝে হঠাৎ একজন বলে ওঠে বিয়ে হবে, আর এখনই হবে৷ ইনসাফ আংকেল, লোকটাকে সে বছর খানেক আগে দেখেছিলো বাবার মৃত্যুর সময়,, বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলো, কিন্তু তার পরে আর কখনো দেখা হয়নি, উনি এক প্রকার বাধ্য করেন তার ছেলেকে এই বিয়েটা করতে,,,চাচীও তুরাকে ঘাড় থেকে নামাতে রাজি হয়ে যায় এক কথায়। আর তারপর থেকেই তো…ভারী এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তুরার ভেতর থেকে, এক অনাকাঙ্ক্ষিত,, ভরসাহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে,, আগে কি আছে তার জানা নেই।

গোসলে সেরে বেরিয়ে এসে দেখে বিছানা ফাঁকা,তার মানে রাইমা আপু উঠে গেছে? কিন্ত সে এখন কি করবে? নিচে যাবে? যদি আবারও ওই লোকটার সাথে দেখা হয়? চুপ করে বসে পরলো খাটের উপর, না সে কিছুতেই যাবে না বাইরে যতক্ষণ না ওই লোক বাড়ি থেকে বের হবে। কিন্তু তুরার এই ভাবনা টা হয়তো উপওয়ালার পছন্দ হলো না, সেই মুহূর্তে আগমন ঘটলো রাইমার

-তুরা? হয়ে গেছে তোমার?

মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকিয়ে হালকা হাসলো তুরা, রাইমা এগিয়ে এসে বললো

-তুমি ওয়াসরুমে দেখেই আমি নিচে গিয়েছিলাম, এখন চলো তো বাবা তোমায় ডাকছেন নিচে

বলেই তুরার হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে আসলো। তুরা মুখে কিছু না বললেও কাচুমাচু মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যদি আবারও লোকটার সামনে পরতে হয়?
নিচে ডাইনিং এ আসলেই তাকে দেখে ইনসাফ মাহবুব গাল প্রসারিত করে হেসে বললো

-তুরা,এদিক আই মা, বস।

এই লোকটার কথায় যেনো বাবার মতো স্নেহ পায় তুরা,,ভীষণ ভাল্লাগে। বাবার পরে এতো যত্ন করে কেও ভাবেনি তুরার কথা, তুরা বাধ্য মেয়ের মতো ইনসাফ মাহবুব এর কথা অনুযায়ী তার পাশের চেয়ার টাতে বসে।
ইনসাফ মাহবুব তুরার প্লেটে রুটি তুলে দিয়ে বলে

-আমিকি তোকে ভার্সিটি ভর্তি করিয়ে দেবো, পডবি?

এহেন কথা শুনে তুরা কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলো, আনন্দে আত্মহারা হয়ে বেশ জোরেই বললো

-সত্যিই বলছেন আংকেল?

-হ্যাঁ বলছি,কিন্ত একটা শর্তে

শর্তের কথা শুনে মুখ চুপসে গেলো তুরার, মিনমিনিয়ে বললো

-কি শর্ত?

-আহান আর রাইমার মতো তোকেও আমায় বাবা বলতে হবে

এহেন কথা সে শুনবে আশাও করেনি তুরা। নিজের অজান্তেই এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো তুরার গাল বেয়ে,তার বাবা মারা যাওয়ার পর আর কখনো বাবা ডাকার সৌভাগ্য হয়নি,নিজের আপন চাচাও তাকে এভাবে বলেনি।
তুরার এমন মলিন মুখ দেখে ইনসাফ তুরার মাথায় হাত রেখে বললেন

-মা রে, আমি জানি তোর মনের অবস্থা টা,, হয়তো তোর বাবার মতো বেস্ট বাবা হতে পারবো নাহ কিন্তু বেটার বাবা হওয়ার চেষ্টা করবো কিন্তু

তুরার এক গাল হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,খাওয়ার মাঝেই সিড়ির দিকে চোখ যেতেই খাবার আটকে যায় গলায়,খুক খুক করে কেশে এক গ্লাস পানি শেষ করে সামনে তাকায় তুরা
লম্বা চওড়া লোকটা একটা কালো জিন্স আর নেভি ব্লু শার্ট পরে,হাতা গোটাতে গোটাতে নামছে সিড়ি দিয়ে,, তুরা আহান কে দেখে খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

আহান নিঃশব্দে এসে বসে চেয়ারটাই, পাউরুটি জ্যাম লাগয়ে এক কামড় দিতেই তার বাবা প্রশ্ন করলো

-কোথায় যাচ্ছো?

-যেখানে যাই,ভার্সিটিতে

দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো আহান। ইনসাফ মাহবুব গলা খাকারি দিয়ে বললো

-তুরাকেও নিয়ে যাও

-হোয়াট!! এই মেয়েকে আমি কেনো নেবো আমার সাথে?

-ওকে তোমার ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবে তাই

-ইমপসিবল,এই মেয়েকে আমি কিছুতেই আমার ভার্সিটিতে ভর্তি করাবো নাহ

-কেনো ওকে নিয়ে কি সমস্যা তোমার, ও কি তোমার মাথায় চড়ে থাকবে? লাগবে না তোমাকে আমিই ভর্তি করিয়ে দেবো ওকে

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন ইনসাফ মাহবুব। আহান চোয়াল শক্ত করে বসে আছে, সব দোষ এই মেয়েটার,এই মেয়েটার জন্যেই তার বাবার সাথে এরকম ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। অগ্নিশর্মা হয়ে তুরারা দিকে তাকালো আহান
আহানের এমন চাহনি দেখে তুরা শুকনো ঢক গিললো, সামনের গ্লাস টা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে চেয়ার ছেড়ে দৌড় দিলো, এখানে আর এক মুহূর্ত নয়, এই জ’ল্লাদ লোকটা শেষে সব রাগ তার উপর ঝাড়বে। সিড়ি বেয়ে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে বড় বড় শ্বাস ফেললো

-উফ বড় বাচা বেচেছি, ওই লোকটা মানুষ না,কেমন রাক্ষসের মতো চেয়ে থাকে

বিকট শব্দে দরজা লাগানো তে কেঁপে উঠলো তুরা, পেছন ঘুরেই দেখে আহান তাকিয়ে আছে তার দিকে,,চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আজ আর নিস্তার নেই,, ঢক গিলে পিছাতে নিলেই আহান বিদ্যুতের বেগে এসে তুরাকে চে’পে ধরলো দেওয়ালের সাথে। শক্ত করে হাতটা চেপে ধরায় যন্ত্রণা’য় আর্তনা’দ করে ওঠে তুরা, এই লোকটার এমন রাগের কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না তুরা এক হাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৩

-তোমার জন্য, শুধু মাত্র তোমার জন্যেই এত ঝামেলা হচ্ছে, তোমায় আমি কিছুতেই ছাড়বো নাহ

তুরার হাত জোরে চে’পে ধরে রাখায় ব্যথায় চোখ মুখ খিচে আছে, চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো, তুরার এমন মুখটা দেখে হুট করেই আহানের বুকটা মুচড়ে উঠলো,, তুরার চোখের পানি দেখে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হলো, তুরার হাত টা ঝ’টকা দিয়ে ফেলে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো,,ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
তুরা এখনো ঠাই দাঁড়িয়ে আছে,, নিঃশব্দে নোনাজলে ভিজিয়ে যাচ্ছে কপোল খানা।
আহান বেশ অবাক হয়,মেয়েটা কি কথা বলতে পারে না? আবার পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেই,,সে কেনো ভাববে এই মেয়ে কে নিয়ে,, যা খুশি হোক।

-একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো,, তোমার আমার বিয়ের সম্পর্ক শুধু ওই কাগজে সই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এর বেশি কিছু কখনও আশা করো না আমার থেকে,, আর রইলো কথা ওই পেপারস এর,,সেটা থেকেও খুব দ্রুতই মুক্ত করে দেবো, তাই স্বামী টাইপ কোনো ব্যবহার আমার থেকে আশা করোনা

বলেই দরজা খুলে গটগট করে চলে গেলো আহান। আর তার যাওয়ার পানে অপলক চেয়ে রইলো তুরা। বিরতিহীনভাবে অশ্রুসিক্ত হলো সারা গাল,,আহানের তিক্ত কথা গুলোতে তুরার ছোট্ট মনটা কেঁপে উঠেছে, মনের গহীনে কাঠের ফ্রেমে জমাট রাখা অনুভূতি গুলোও দগ্ধ হচ্ছে,সে তো জানতো এমন কিছুই হবে তবুও বুকের ভেতর অজানা ব্যথায় ক্রমশ ভেতরটা ফেপে উঠছে,,বাস্তবতা যে তার জীবনে পাথরের মতোই অটুট আর শক্ত তা সে অনেক আগেই মেনে নিয়েছে, তবুও অজানা এক ব্যথায় তপ্ত হচ্ছে হৃদয়, হয়তো লোকটা তার স্বামী বলে!
সে মানুক আর না মানুক তুরা তো তার নামেই কবুল পরেছে,তাই হয়তো আকাশ সমান অসম্ভবতার মধ্যেও একটু আশা খুঁজেছিলো।
সন্তপর্ণে আখিযুগল মুছে নিলো ওড়নাটার আচঁলে, আহান চেপে ধরার তার ফর্সা কবজিতে লাল দাগ হয়ে পাঁচটা আঙুল বসে গেছে। হোক সেটা ঘৃণা করে,স্বামীর স্পর্শ তো,তুরা না হয় এ নিয়েই খুশি থাকলো। মলিন হেসে ওয়াসরুমে ঢুকে বার কয়েক পানির ঝাপটা মুখে দিয়ে বেরিয়ে এলো,, মাথাটা ধরেছে,আপাতত সব ভাবনা ছেড়ে একটু ঘুম দরকার।

~

মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুমটা হালকা হয়ে এলো তুরার,,

-তুরা? এই তুরা?

মেয়েলি কণ্ঠস্বরের ডাকে চোখ খুলে তাকালো তুরা,, মাথার উপর হাস্যজ্বল একটা মিষ্টি চেহারা দেখে উঠে বসলো ধপ করে, এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে বললো

-এখন কি বিকেল হয়ে গেছে আপু? আমি কি অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি?

তুরাকে এমন অস্থির হতে দেখে রাইমা গাল প্রসারিত করে হেসে বসলো ওর পাশে

-আরে ধুর পাগলি,দুপুর হয়েছে সবেমাত্র। মা গোসলে গেছে,আর দিদুন ঘরে শুয়ে আছে, তুই সেই সকালে ঘুমালি এখনো উঠার নাম নেই, আর আমি একা এতিমের মতো ঘুরছি। দেখি ওঠ তো শিগগির ফ্রেশ হয়ে আই,একসাথে খেতে বসবো দুজনে

রাইমার কথা শুনে তুরা মিষ্টি হেসে বলে,
-তুমি দুই মিনিট বসো আমি ফ্রেশ হয়ে এক্ষুনি আসছি।

বলেই চটপট বিছানা থেকে নেমে ওয়াসরুমের দিকে যায়, এই এক দিনের মাঝেই রাইমার সাথে ভীষণ ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তুরার,রাইমা ও তুরাকে ছোট বোনের মতোই ভালোবাসে,আর তুরা তো ছোট থেকেই চাইতো তার একটা বড় বোন থাক,সেটা পেয়ে যেনো ওর হাজার শুকরিয়া,,এতসব ঝড়ের মাঝেও যে ইনসাফ মাহবুবের মতো বাবার ছায়াতল, আর রাইমার মতো বোনের সঙ্গ পেলো এই বা কম কি!

ফ্রেশ হয়ে রাইমা আর তুরা দুজনে একসাথে নিচে নেমে এলো, ততক্ষণে রুবি খাতুন আর তার শাশুড়ী ও এসে পরেছে ডাইনিং এ,,তুরা গিয়ে এক কোণায় গুটিয়ে দাঁড়াতেই আমেনা খাতুন শক্ত গলায় ডাক দিলো তুরাকে

-এই যে মেয়ে,এদিকে আসো,সারাক্ষণ তো ছোট বাচ্চাদের মতো এক কোণায় জড়সড় হয়েই থাকো দেখছি

শক্ত গলায় তুরা খানিকটা ভড়কে যায়, রুবি খাতুন আর আমেনা খাতুন দুজনেই বেশ গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হয় তুরার,কারণ এসে থেকে এদের সাথে কথা খুব কমই হয়েছে, রুবি খাতুন গত রাতে তুরাকে কিছু বললেও আমেনা খাতুনের সাথে তার একদম কথা হয়নি।
চুপচাপ গিয়ে আমেনা খাতুনের পাশে দাড়াতেই বৃদ্ধা ইশারা করে পাশের চেয়ারটাই বসতে বললে তুরাও বাধ্য মেয়ের মতো বসে পরে।
রুবি খাতুন সবাইকে খাবার বেরে দিয়ে নিজেও খেতে বসে। খাওয়ার মাঝেই আমেনা খাতুন বলে উঠলো

-শোনো নাতবউ, ছেলে মানুষের মন আষাঢ়ে বেলার মতো, এই ভালো তো এই মেঘে কালো, ওদের কথায় ধরে বসে থাকলে চলবে নাহ, দাদুভাই যতই বলুক মানে না বিয়ে কিন্তু বিয়ে তো হয়েছেই,,আর এটা তো কোনো ছেলেখেলা নয় সে আজ এমন তো কাল ওমন।

বলে কিছুক্ষণ দম নিলো, তুরার মতো রাইমা আর রুবি খাতুন ও নিঃশব্দে শুনছে সবটা, খানিক থেমে আবারও বললো আমেনা খাতুন

-দাদুভাই ছোট থেকেই একটু রাগচটা আর জেদি, ওর উপর জোর করলেই ও আরও বেঁকে বসে। কিন্তু মন থেকে একেবারে খাটি সোনা আমার ভাই,, বাইরে যতই শক্ত হোক ভেতরে তার চেয়েও নরম। এমন হটকারিতায় হওয়া বিয়েতে রাগ দেখালেও একদিন ঠিকই মানবে। আর তার জন্য তোমাকেই সবটা করতে হবে।

আমেনা খাতুনের কথায় তুরা থমকে যায়,খাবার গলায় আটকে হিচঁকি উঠে গেছে।

-আরে আরে আস্তে ধীরে খাও বাবা

বলেই রুবি খাতুন পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো তুরা। দিদুনের কথা শুনে ওর হিচঁকি উঠে গেছে, লোকটার সাথে তিনবার দেখা হলো তিনবারই জল্লা’দপনা করেছে,সে আবার ওই লোকের কি করতে যাবে। দেখলেই কেমন করে তাকায় যেনো গি’লে খাবে তাকে। আরেকবার ঢক গিলে পাশে তাকাতেই তুরা দেখে আমেনা খাতুন জহুরি চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমেনা খাতুনের এমন দৃষ্টি দেখে তুরা শুকনো হাসে।

-হিচঁকি কাশি যা উঠার এখনই উঠিয়ে নাও। আমার দাদুভাইকে কিন্তু তোমারই হাত করতে হবে মেয়ে, আমাদের বংশে ছেলেদের একাধিক বার বিবাহ হয়না। আর এমন টুসটুসে একটা বউ থাকতে অন্য কথা ভাবার তো কোনো মানেই হয়না।

আমেনা খাতুনের কথা শুনে তুরার খাবার গলা পর্যন্তই থেমে গেছে,, সর্বনা’শ,,কি বলছে! রাইমা আর রুবি ঠোঁট টিপে হাসছে, আমেনা খাতুন কে তারে বেশ চেনে,উপর উপর গম্ভীর ভাব ধরে থাকলেও ভেতর ভেতরে বেশ রসিক, আর তুরাকে তার পছন্দ এটা তাদের আগে থেকেই জানা

-থাক না মা,ও ছোট ওকে আর এসব বলে কি লাভ! আপনার গুণধর নাতিকে বোঝালেও তো পারেন

রুবি খাতুন সামান্য কেশে বললেন। রাইমাও তার সাথে বললো
-ঠিকই তো দিদুন, ভাইকেও বলা উচিত। মানছি বিয়েটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই হয়েছে কিন্তু তা বলে তুরার তো কোনো দোষ নেই,যা হবার হয়ে গেছে এখন তো ওর ও উচিত কিছুটা মানিয়ে নেওয়া।

রাইমার কথায় ও উত্তর করলেন নাহ আমেনা বেগম৷ তুরার প্লেটে আরেক চামচ ভাত তুলে দিতে গেলেই তুরা মিনমিনিয়ে বললো

-আমি আর খেতে পারবো নাহ,আমাকে আর দিবেন না প্লিজ

-থামো মেয়ে, এইটুকু শরীর খাওয়া দাওয়া বেশি না করলে কিভাবে হবে। আর রাইমা আর আহানের মতো তুমিও আমায় দিদুন বলেই ডাকবে এটা যেনো আরেকবার বলতে না হয়।

তুরা সামান্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয়,কিন্তু এতগুলো খাবার কি করে খাবে, অসহায় দৃষ্টিতে রাইমার দিকে তাকাতেই রাইমা চোখ টিপে খেয়ে নিতে ইশারা করে, আর তো কিছু করারা নেই।

খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সকলে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলো, তুরার মনটা বেশ ভালো,, রুবি খাতুন আর আমেনা খাতুনকে যতটা গম্ভীর ভেবেছিলো ততটা নয়। তাদের সাথে কথা বলে বেশ হালকা লাগছে কেমন আপন আপন লাগে তাদের। ইনসাফ আংকেলকে বাবার মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকবার দেখলেও এই লোকগুলোর সাথে তার আগে চেনা জানা ছিলো নাহ।
রুবি খাতুনের মুখে শুনলো তার একমাত্র গুণধর জ’ল্লাদ ছেলেটি নাকি বিদেশে ছিলো দীর্ঘ সময় পড়াশোনার খাতিরে, বর্তমানে ভার্সিটির লেকচারার। আসলেই, ওই যে স্কুল কলেজে থাকতো নাহ গম্ভীর চরিত্রের কিছু খা’টাস,, একদম সেই ধাচের লোকটা। এতগুলো ভালো মানুষের মধ্যে ওই একটা মানুষ এমন গোমড়ামুখো কি করে হলো তুরা বুঝে পাই নাহ।

বিকেলের দিকটাই তুরাকে নিয়ে রাইমা বাগানের দিকটাই ঘুরছে, বাগান টা অসম্ভব সুন্দর, একটা বড় কাঠগোলাপের গাছ, মাঝারি আকৃতির একটা কৃষ্ণচূড়াও আছে, রাইমা আপু শখ করে লাগিয়েছিলো গাছ গুলো। বাগানের এক কোনায় কতগুলো সূর্যমুখীর গাছ, বেশ ফুল ফুটেছে। সূর্যমুখী তুরার ভীষণ পছন্দের, ওগুলো দেখেই ছুটে গেলো

-বাহ,কত সুন্দর ফুলগুলো! এগুলোও কি তুমিই লাগিয়েছো আপু?

হাসিহাসি মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলো তুরা। রাইমা এতক্ষণ তুরাকেই দেখছিলো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মেয়েটা যেনো আবারও প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে,, কাল থেকে কেমন মু’ষড়ে ছিলো মেয়েটা, এমন চাঁদ মুখের মেয়েটার মুখে বিষন্নতার ভার একদম মানায় নাহ।

-ও আপু বলো না

তুরার ডাকে হুস ফিরে রাইমার৷ এগিয়ে গিয়ে বলে

-নাহ,এগুলো আহান লাগিয়েছে,ওর সূর্যমুখী ফুল ভীষণ পছন্দ। এগুলো সব ও নিজে হাতে পরিচর্যা করে, বাগানের এদিকটাই কেও আসেনা। ওর ফুল কাওকেই ধরতে দেয়না

আহানের নাম শুনেই তুরার হাসি হাসি মুখ খানা চুপসে গেলো। ফুলগুলো তার ভীষণ পছন্দ হয়েছিলো,রাইমাকে বলে একটা নিয়ে ঘরে ফুলদানি তে রাখবে ভেবেছিলো,কিন্তু লোকটার নাম শুনে সে ইচ্ছে ঘুচে গেল।
বাগানে আরও কিছুক্ষণ থেকে ভেতর থেকে রুবির ডাক এলো।

-তুরা তোর ইচ্ছে করলে এখানে আরেকটু থাক। মা ডাকছে আমি শুনে আসি কেমন?

রাইমার কথায় কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো তুরা, রাইমা যেতেই এদিক ওদিক ঘুরে সূর্যমুখীর গাছ গুলো দেখতে লাগলো। উচ্চতায় একদম তার মাথার ও উপরে গাছ গুলো। আর কি সুন্দর! বিকেলের নরম আলোতে একদম চিকচিক করছে।
বাম পাশে চোখ যেতেই একটা পানির পাইপ নজরে এলো তুরার। ছুটে গিয়েই পাইপ টা হাতে তুলে নিলো।

-গাছগুলোর গোড়া বেশ শুকিয়ে গেছে, আজকে হয়তো কেও পানি দেয়নি

নিজে নিজেই বলে আশেপাশে তাকিয়ে মটরের সুইচ খুজতেই পেয়ে গেলো, এগিয়ে গিয়ে মটরের সুইচ টা চালু করতে পাইপ থেকে পানি বেরিয়ে চোখে মুখে উপচে পরলো তুরার। গায়ের উপরে কিছুটা ভিজে গেলেও বেশ মজা পেয়েছে। পাইপ টা হাতে ধরে ভীষণ প্রফুল্লচিত্তে এগিয়ে গিয়ে গাছ গুলোতে পানি দিতে লাগলো।

বাড়ির ফটকে এসে ব্রেক করলো গাড়িটা, দরজা খুলে বেরিয়েই দারোয়ানের হাতে চাবিটা ধরিয়ে পার্ক করতে বলে বড় বড় পা ফেলে ভেতরে এগিয়ে গেলো আহান। বাগানের দিকটা পেরোনোর সময় হুট করে বাম পাশে চোখ যেতেই দেখলো তার সূর্যমুখীর বাগানের ভেতর ছোট খাটো কিছু নড়াচড়া করছে,ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে এগিয়ে গেলো আহান।

-তুমি এখানে কি করছো?

গমগমে গলা শুনে হাত থেকে ভারি পাইপ টা ফসকে যেতে লাগলেই কোনো মতে সামলে ধরলো। পাইপ সহ তুরা ঘুরে দাঁড়ালে পানির ধারা গিয়ে পরলো আহানের উপর, গপগপ করে পানি ছিটে পরতে লাগলো আহানের সারা গায়ে

-হোয়াট রাবি’শশ!!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ