তুমি আমি দুজনে পর্ব-৩২+৩৩

0
346

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৩২

ভীষণ ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তুরার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল আহান, তুরা ভয়ার্ত চেহারায় একবার সে পানে চেয়ে খাট থেকে নেমে যেতে লাগলেই আহান ঝড়ের বেগে এসে ঝাপটে ধরল তুরাকে,বিছানায় ফেলে আগের চেয়েও দ্বিগুণ জোরে চেপে ধরল তুরার দুবাহু। দৃঢ় বন্ধনের চাপে তুরা ব্যথায় মৃদু শব্দ করার আগেই ক্ষিপ্ত নজরের চোখটা খুব কাছে এলো, যাতে স্পষ্ট দাম্ভিক্যের আভাস, তীক্ষ্ণ চাহনি তুরাতে আবদ্ধ রেখেই বলল

-বউগিরি দেখানোর খুব তো শখ, কথায় কথায় আমাকে ইগনোর করা শিখেছ, আবার আমাকে পরপুরুষ বলে অন্য ঘরেও থাকার দুঃসাহস ও করেছ, বেশ তবে এবার আমিও স্বামীগিরি ফলাব

বলেই তুরার হাতে চেপে রাখা হাতের পুরুষালি আঙুল তুরার আঙুলের মাঝে দিয়ে চেপে ধরল, দৃঢ় হলো আরও হাতের বন্ধন, তুরার শরীরের উপর ভার ছেড়ে দিলো আহান, সমুদ্রের ন্যায় উথাল পাথাল ঘন নিঃশ্বাস আরও কাছাকাছি থেকে আছড়ে পরছে তুরার সারা মুখে। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চাইলো তুরা আহানের দিকে, লোকটা কি বলছে! স্বামীগিরি ফলাবে মানে?!
তুরার ভাবনাকে ছেদ করে আহান রাশভারি কণ্ঠে হীম হাওয়ার মতো শীতলতা ছড়িয়ে বলল

-বউ না তুমি আমার?তাহলে আমিতো তোমারই স্বামী,তাই পশুধু তোমার সাথে ঘুমাবই নাহ আজ আরও অনেক কিছুই করব যা প্রত্যেক স্বামীরাই করে তার বউয়ের সাথে,সো আর ইউ রেডি ফর ইট তুরা রাণী?

চোখে মুখে বিস্ময় আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো তুরার,বুকের ভেতর ধুকপুকানির ছন্দময় ক্রীয়া টার বেপরোয়াতা প্রচন্ড ভীত আর শঙ্কিত করে তুললো তুরাকে, হাতে এতো জোরে চেপে ধরেছে যে সরাতেও পারছে না আহানকে। নিজের শরীরের উপরে পুরুষালি স্পর্শের এতটা নৈকট্য তুরার অর্ধেক শক্তি খুইয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক ঢোক গিলল।
আহান চোখে উপহাস আর ঠোঁটে রহস্যময়ী বাঁকা হাসি দিয়ে বলল

-আমি কাছে আসলেই তো মিইয়ে যাও, ধরলে তো খুঁজেই পাওয়া যায়না, আমি স্বামীত্ব ফলালে সহ্য করতে পারবে?

চোখ খুলে তাকালো তুরা, আহান তার শরীর তার স্পর্শ আর নিখুঁত দৃষ্টি সবটাই তার নিকটে,ভীষণ নিকটে। অপলক চাইল তুরা আহানের গহীন দৃষ্টিতে, যেনো উপরে দেখানো অভিমান কপট রাগ সবটা চিড়ে ভেতরের অনুভূতি গুলো বেরিয়ে আসতে চাইলো। তবুও নিজেকে সংযত করে অন্যদিকে চাইল। নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল

-ছাড়ুন আমাকে

-চোখ এদিকে ফেরাও, আমার চোখের দিকে তাকাও

আহানের কথায় ও তুরা হেলদোল করল না, ঠাঁই অন্যদিকে চেয়েই থাকল। আহান ভ্রুকুটি করে তুরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হাতের ভাজ থেকে আঙুল ছাড়িয়ে তুরার থুতনিতে রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল

-আমার পুরো কথাটা তুমি, না শুনেই ওভাবে চলে এলে,আর এখনো রাগ করে আছ, আমি বলতাম তুমি আমার ওয়াইফ তার আগেই চলে এসেছ তুমি

তুরার প্রতিক্রিয়াহীন নিস্তেজ চোখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল, উপহাস করে বলল

-আমাকে তো আপনিই বলেছিলেন যাতে বিয়ের কথাটা কেও না জানতে পারে তাইলে আপনি কেনো পলি ম্যাডামকে বলতেন যে আমি আপনার বউ? এ কথা আপনি আমায় বিশ্বাস করতে বলছেন?

তুরার তাচ্ছিল্য ভরা কথায় আহান খানিকটা ভড়কে গেলো, ভাবাবেগে বিব্রত হয়ে গেলো। যেনো জড়তায় আটকে গেলো শব্দ। আহানের অপ্রস্তুত চাহনিটা তুরার দৃষ্টিগোচর হলো নাহ, অবজ্ঞা সূচক হাসি দিয়ে বলল

-থাক, আপনাকে কিছু এক্সপ্লেইন করতে হবে না। আমি কে যে আমায় কৈফিয়ত দিতে হবে। ওই যে বললাম দয়া করে রেখেছেন নিজের ঘরে। আমায় যে বউ হিসেবে মানেন না এ কথাটা কম হলেও আমার মাথায় গেঁথে দেওয়ার মতো বারবার বলেছেন। তাই না আমি আর বউ হতে চাই আর নাইবা কোনো অধিকার বা স্বীকৃতি চাই

কাঠ কাঠ গলায় বলা তুরার কঠিন শব্দগুলো আহান নিঃশব্দে কোনো প্রতিক্রিয়াহীন শুনে নিজের ভার সরিয়ে নিলো। হাতের ভাজ খানিকটা আলগা করে বলল

-তুমি কি চাও বা না চাও সেসব আমি জানতে চাইনা। রাতে তুমি অন্য কোথাও ঘুমাতে পারবে নাহ৷ যদি আমাকে পরপুরুষই মনে হয় তবে পরপুরুষের সাথে থাকার মতো পাপ টাই তোমায় করতে হবে।

নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর আহানের, তুরাকে ছেড়ে ওর গা ঘেঁষে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পরল। এ পর্যায়ে তুরার ভীষণ রাগ হলো,এমন কেনো লোকটা? চটে গিয়ে বলল

-কেনো শুনব আমি আপনার কথা, মানব না

ঘাড় কাত করে তাকাল তুরার দিকে, আবারও স্কুলের পেট মোটা হেডমাস্টারের মতো কপালে ভাজ গাঢ় করে তুরাকে কাঠখোট্টা ভাষায় বলল

-কারণ আমি তোমার হাসব্যান্ড, আর এটা ওয়ার্ণিং আমার, না মানলে কি করে মানিয়ে নিতে হয় তা আমি বেশ ভালো মতই জানি।

বলে তুরাকে উত্তর করার সুযোগ না দিয়েই আবারও বলল

-ব্যাপারটা যেরকম ভাবছ আদও তেমন নাহ।এখনো বাচ্চা আছ তাই আবেগে পরে হুটহাট বাঁদরামি করবে এটাই তোমার স্বভাব। কিন্তু যা করবে আমার সীমানার মাঝেই,এর বাইরে নাহ। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও, আমার সব আচরণ ধরে বসে থাকতে হবে নাহ। নিজেকে স্ট্রং করো। আমি চাই তুমি আমার না নিজের পরিচয় গড়ে তোলো। তোমার বাবা তোমাকে যেমন করে দেখতে চেয়েছিলেন ঠিক তেমন হও। বউ হওয়ার সময় এখনো অনেক আছে।আমি যদি এখনি স্বামীত্ব দেখাই তাহলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে নাহ। আমি ঠিক কি চাই,আমার কে হও তুমি এটা আমি খুব ভালো মতোই জানি। তাই আবারও বলছি সেসব নিয়ে তোমাকে বেশি ভাবতে হবে নাহ। এবার চুপচাপ ঘুমাও, নাকি চাচ্ছ আমি স্বামিগিরি ফলাই?

সবটা কথা তুরা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও শেষের কথাটা শুনে তুরার কান গরম হয়ে গেলো, একটা মানুষ কতটা বেয়াক্কেল হলে এধরণের কথা বলতে পারে

-অসভ্য একটা

-অসভ্য কেমন,কতখানি, আর ঠিক কতটা এটা সময় হলেই বুঝে যাবে নাও স্লিপ

তুরার ফিসফিসিয়ে বলা কথাটাও আহান শুনে আবারও দায়সারা উত্তর দিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পরল। মাথার ভেতর সবটা কেমন গুলিয়ে গেছে তুরার, লোকটা আদও কি বোঝাতে চাই? গভীর ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে কখন তুরা ঘুমে বুদ হয়ে গেলো টের ও পাইনি

~

সকালের রোদ চোখে পরতেই চোখ মুখ ধরে এলো। টিপটিপ করে নেত্রদ্বয় খুলে তাকাল তুরা। আধবোজা চোখেই নড়চড় করতে গেলেই নিজেকে শক্ত কোনো বন্ধনে আবিষ্কার করল, চোখ দু’টো সম্পূর্ণ প্রসারিত করে তাকাতেই আহানের ঘুমন্ত চেহারা টা দেখতেই অধরে অদ্ভুত হাসির রেখা বয়ে গেলো।
লোকটা ঘুমের মাঝেই দু’হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে তুরার, এতটা শক্ত করে ধরেছে যেনো ছাড়লেই পালিয়ে যাবে। আনমনেই হেসে মাথার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিলো তুরা। কি করে বুঝাবে সে কেনো এতটা মান অভিমান হয় তার। কেনো ছোট ছোট আচরণেও এতটা বুক ভার হয়ে আসে তুরার। স্বামী নামক গম্ভীর মানুষটাকে সে তো একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছে। লোকটার গোমড়া করে রাখা মুখ, গমগমে গলার ধমক সবটা সহ্য হলেও তার পাশে অন্যকাওকে বা তার ছোট ছোট আচরণ ও তাকে ভীষণ পীড়া দেয় আজকাল।
ঘুমের মাঝেও কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল আহান, তুরা আহানের হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলেও পারল না দৃঢ় হাতের বন্ধন আলগা করতে। ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতেই নড়েচড়ে উঠে বসল আহান, ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল

-এত উতপাত করো কেনো বলোতো, উঠে দু মিনিট ও কি স্থির থাকা যায় না? এক তো রাতভর আমাকে জ্বালিয়ে মারো আবার এখন একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবে না

বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে তুরা কটমট করে বলল

-তো আপনি আমাকে কেনো ধরেছেন,এভাবে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরলে তো উতপাত করবই,আপনি নিজের বালিশ ছেড়ে আমার জাগায় এসেছেন কেনো?

-ওহ তাই? আর নিজে যে সারারাত আমার গায়ে হাত পা তুলে ছোড়াছুড়ি করো তার বেলায়! তাকিয়ে দেখো তো কার জাগায় কে আছে

আহানের কথামতো নিজের অবস্থান দেখেই তুরার মুখটা চুপসে গেলো, তার মাথার নিচের বালিশ ফ্লোরে গড়াগড়ি করছে,সে নিজেই বরং আহানের বালিশে শুয়ে ছিলো, বেচারা জায়গা না পেয়ে বালিশের নিচে একটুখানি জাগায় শুয়ে ছিলো। দোষটা নিজের জেনেও তুরা খটমট বাক্যে বলল

-আমি আপনার জাগায় যায়নি আপনি ইচ্ছে করে এমনটা করেছেন। আর মাঝখানের বালিশ কই হ্যাঁ আপনি ওটা সরিয়েছেন বলেই তো

-আমি সরিয়েছি? বাহ, রোজ রাতে ইচ্ছে করে আমার গায়ের মধ্যে সরে এসে আবার আমারই দোষ দিচ্ছ। রাতভর আমার ফায়দা নিয়ে আবার সকাল হলে আমার উপরই দোষ চাপিয়ে দেবে, বাহ ইন্টারেস্টিং প্রক্রিয়া তো!

লোকটা আসলেই ব’জ্জাত। একেবারে ব’জ্জাতের ব’জ্জাত এর সাথে মুখ লাগানো মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। তুরা চুপচাপ মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ওর যাওয়ার পানে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ওয়াসরুমে ঢুকে গেলো আহান।

সকালের নাস্তা শেষ করে মা দিদুনকে বিদায় জানিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে তুরা, আপাতত রিকশার অপেক্ষা করছে। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও রিকশা পাচ্ছে না। এবার দূর থেকে একটা রিকশা আসতে দেখে তুরার মুখে হাসি ফুটে উঠল তবে রিকশার আগেই সফেদ কার গাড়িটা সামনে এসে দাঁড়াতেই ভ্রু জড়ো হলো।

-গাড়িতে ওঠো

-দরকার নেই

তুরার এমন শান্ত ভঙ্গিমায় প্রত্যাখ্যান করায় আহান বেশ চমকিত হলো। তুরার এমন কঠোর ভাবে বেশ অবাক হলেও প্রকাশ করল না আহান,আবারও আগের স্বরেই বলল

-গাড়িতে উঠতে বলেছি

-বললাম তো লাগবে না,আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না আপনাকে

বলেই কাছে এগিয়ে আসা রিকশা টাকে থামিয়ে উঠে বসল। রিকশা টা এগোতেই আহান রাগে স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাত ঝামটা দিলো। মেয়েটার ইগনোরেন্স একেবারেই সহ্য হচ্ছে নাহ ওর, আর এটা জেনেই আরও বেশি ইগনোর করছে ওকে।
‘ড্যাম ইট’ বলেই আবারও গাড়ি টেনে বেরিয়ে গেলো।

~

-পেত্নীর দলগুলো এভাবে কেনো তাকায় বল তো

ফারিহার প্রশ্নে তুরা কলম থামিয়ে সামনের বেঞ্চিতে তাকাল,, রিফা অরিন আর মারিয়া নামের মেয়েগুলো ওর দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে বারবার। মেয়েগুলোর সমস্যা কি তুরা আদও ভেবে পাই না। সেদিন থেকে পিছে পরে আছে

-আমার কি মনে হয় জানিস, দুলাভাই স্যারকে তোর সাথে দেখে ওদের খুব জ্বলে তাই এমন করছে। তুই উনার বউ জানলে যে কি করবে

-চুপ, কিসব বলছিস। কেও শুনবে তো

-শুনুক। ওই পেত্নী গুলো বেশি করে শুনুক যে তুই দুলাভাই স্যারের বউ

চোখ কুচকে তাকাল তুরা ফারিহার দিকে। মেয়েটা ভিষণ ভাবলেশহীন। এসে থেকেই অরিন রিফা কেমন ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল তুরার দিকে। তুরা বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করলেও অসবে গা করেনি

-ইয়ার চুপ কর দুজন। মাহিদ স্যার দেখছে

পেছন থেকে সাদমানের কথায় তুরা আর ফারিহা সরে বসল। মাহিদ স্যারের খুব ইম্পর্ট্যান্ট লেকচার চলছে তার মাঝে দুজন গল্প করছে দেখলে ঠাস করে রুম থেকে বের করে দেবে। লোকটা হাসি খুশি স্বভাবের হলেও রেগে গেলে আর তাকানো যায়না।
মাহিদ হেঁটে হেঁটে লেকচার দিচ্ছে আর তুরার দিকে তাকাচ্ছে, রহস্যময়ী ভাবে চাইলেও চোখে মুখে কেমন খুশির আভাস। যা সকলের অগোচরেই রেখেছে।
.
ক্লাস শেষে ফারিহার সাথে বেরচ্ছিলো তুরা। সাদমান ওদের সামনেই হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে এগোচ্ছিল দুজন। সিড়ির দিয়ে নামার সময় হুট করেই পেছন থেকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা লাগলেই তাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পরে গেলো সিড়ির উপর। আকস্মিক ঘটনার অপ্রস্তুততায় সাদমান ফারিহা দুজনই বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। তুরাকে পরতে দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে নিলেও শুরু হাতের ব্যাগ টাই ধরতে পেরেছে। ছুটে গিয়ে তুরাকে এক হাতে ধরে তুলে দাঁড় করাল

-তুই ঠিক আছিস তুরা। কোথায় লেগেছে দেখি?

ব্যতিব্যস্ত করে বলল ফারিহা,সাদমানের হাতে তুরার ব্যাগটা ধরিয়ে তুরার গায়ের ময়লা ঝেড়ে দিতে লাগল। কনুই এর ব্যথায় অসহনীয় জ্বলন শুরু হয়েছে তুরার,হুট করে কি হলো এখনো বুঝতে পারছে নাহ। তবে হাঁটু আর কনুইয়ে লেগেছে বেশ জোরেই

-তুমি পরলে কি করে তুরা। পা ফসকালো কিভাবে

সাদমানের প্রশ্নে তুরা নিজের বিব্রতি ছাড়িয়ে উত্তর করতে পারল না৷ সে তো নিজেও বুঝতে পারছে নাহ।

-মনে হলো পেছন থেকে কেও ধাক্কা দিয়েছে

ধীরে সুস্থে বলে সিড়ির উপরের দিকে তাকাতেই তুরার জড়ো হওয়া ভ্রু প্রসারিত হয়ে গেলো। এবার ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার। ফারিহা তুরার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেই চোখ মুখ শক্ত করে এগোতে নিতেই তুরা হাত ধরে আটকে দিলো। চোখের ইশারায় নিষেধ করে বলল

-নিচে চল

ক্লাস শেষে সবাই একসাথেই নামছিল। সবার মাঝে তুরার এভাবে মুখ থুবড়ে পরায় বেশ চমকিত হয়ে চেয়ে ছিল সবাই, কিন্ত বাকি সকলের মাঝ থেকে একদম উপরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের মুখের শয়তানি হাসি দেখে আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে কাজটা নিশ্চিন্তে ওদেরই

-আমাকে আটকালি কেনো তুই। বুঝিয়ে দিতাম আজ ওদের ধাক্কা কাকে বলে। তিনতালার উপর থেকে পশ্চাত দেশে এমন লাত্থি দিয়ে ফেলব যে শাকচুন্নির মতো চিল্লানোর সুযোগ টাও পাবে না ফেচুন্নির দল

কিটমিটিয়ে বলল ফারিহা, তখন তুরা না আটকালে গিয়ে মুখের উপর বসাতো তিনটাকেই। এই রিফা অরিন আর মারিয়া তিনজনকেই ওর এমনিতেই সহ্য হয়না তার উপর কত্ত বড় সাহস হয় যে তুরাকে ধাক্কা দিলো

-তুমি আর যাই বলো,ওদের এভাবে মোটেও ছাড় দেওয়া যায়না। কি করে পারল ওরা তোমাকে ধাক্কা দিতে

তুলাতে স্যাভলন লাগিয়ে বলল সাদমান। ওর হাত থেকে তুলা টা নিয়ে ফারিহা তুরার কনুইয়ে লাগাতেই কেঁপে উঠল তুরা। কনুইয়ের চামড়া ছিলে টকটকে লাল স্তর বেরিয়ে গেছে, তাতে ক্যামিক্যালের ছোঁয়া লাগটেই টনটনে জাগায় জ্বালাপোড়া ধরল।

-অনেক খানি লেগেছে, এতে হবে নাহ৷ ডক্টরের কাছে চলো

সাদমানকে থামিয়ে দিয়ে তুরা ব্যস্ত স্বরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল

-আরে না না তেমন কিছুই হয়নি। ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই

-ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই মানে। তুই এভাবে ফিরবি কি করে

-আরে চিন্তা করিস নাহ, আমি যেতে পারব।এইটুকুই লেগেছে তো শুধু, আর তেমন হলে বাড়ি গিয়ে আমি নাহয় ওষুধ লাগিয়ে নিব

-আমার তো তোকে একদম বিশ্বাস হচ্ছে না, দুলাভাই স্যার কোথায়? উনাকে বল তোকে নিয়ে যেতে

-এই না না,,এসব দেখলে আমার পিঠ ফা’টাবে ওই লোক। প্লিজ না,আমার কথা বিশ্বাস কর আমি চোখ ছুঁয়ে বলছি বাড়ি গিয়ে ওষুধ লাগাব

ফারিহা কিছুক্ষণ আড়চোখে চেয়ে বলল
-সিউর?

-পাক্কা!

-আচ্ছা চল

বলে তিনজন মিলে বেরিয়ে গেইটে আসল। তুরাকে রিকশা ঠিক করে দিয়ে সাদমান আর ফারিহাও চলে গেলো। রিকশা ঠিক করলেও ওতে উঠে বসতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে, তখন পরে গিয়ে কনুই এর সাথে হাঁটুতেও বেশ জোরে লেগেছে। কিন্তু ওরা অনেক ব্যস্ত হয়ে পরবে বলেই জানায়নি। কিন্তু এখন একটু বেশিই অসুবিধা হচ্ছে মনে হয়

-সুইটি?

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তুরা পিছু ফিরে তাকাতেই সিফাতের হাস্যজ্বল চেহারায় কৌতুহলের ছাপ দেখতে পেলো। তুরা সিফাতকে দেখে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ও এগিয়ে এসে বলল

-কি হয়েছে তুরা, তুমি পরে গেছিলে? কি করে হলো এসব। তোমাদের ক্লাসের দিকেই যাচ্ছিলাম কয়েকজনের কথা শুনে যা বুঝলাম তুমি নাকি সিড়ি থেকে পরে গেছ?

বলেই তুরার কাছে এগিয়ে আসল। তুরা সিফাতকে ব্যস্ত হতে না করে সাবলীল স্বরেই বলল

-হ্যাঁ পা ফসকে গেছিল একটু। তেমন কিছু না

-কোথাও লেগেছে তোমার?

-না না আমি ঠিক আছি, আপনাকে ধন্যবাদ

সিফাতের যেনো বিশ্বাস হলো না তুরার কথা তবুও ভাবনা ছেড়ে তুরার আশেপাশে তাকিয়ে বলল

-তুমি একাই যাচ্ছ? আমিও তোমার বাড়ির রাস্তা ধরেই যাব,আমার সাথেই চলো

-না না ঠিকাছে, আমি রিকশা করেই যেতে পারব

-আমি থাকতে তুমি রিকশা নিয়ে কেনো যাবে। অ্যাট লিস্ট ভাবির দেবর হিসেবে এটুকু তো আমার দ্বায়িত্ব। প্লিজ ডোন্ট সেই নো!

বলেই তুরাকে নিয়ে গাড়ির সামনে গেলো। তুরাও আর তেমন অমত করেনি। সিফাতের গাড়িতে করেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে তুরা বলল

-ভেতরে আসুন না, আপনাকে দেখলে খুশি হবে সবাই

-আসব তো, তবে আজ না সুইটি আজ কাজ আছে একটা

সৌজন্য সূচক বলেছিল তুরা, সিফাত মানা করায় দ্বিতীয় বার পুনরাবৃত্তি করল নাহ। গাড়ি থেকে বেরিয়ে বলল

-থ্যাংকিউ

-মাই প্লেজার

বুকে হাত দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে বলল সিফাত। পরক্ষণে নিজেই হেসে দিলো এরূপ কাজে। তুরাও সামান্য হেসে সিফাতকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির ভেতর আসলে বসার ঘরে ঢুকতেই থমকে গেলো। প্রচন্ড বিহ্বলতায় পা দুটো আর এগোচ্ছে না যেনো। ক্রমেই চোখ দু’টো ভরে এলো সামনের ব্যক্তিটাকে দেখে, কাকে দেখছে সে? এত বছর পর! আনন্দে আবেগে তুরার চোখের পানিধারা টুপটাপ করে ঝরে পরল। হাতের ব্যাগ টা ছিটকে ফেলে এক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সামনে থাকা ব্যক্তিকে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৩৩

ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বিস্ময়। কিছুক্ষণ আগেই আসা একদম অচেনা অজানা ব্যক্তিটাকে তুরার এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো এসে জড়িয়ে ধরায় সকলে বিহ্বলতার চূড়ান্তে।
মাত্র কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন ভদ্রমহিলা, তাকে বসতে দিয়ে পরিচয় জানবার সময়ই তুরা ঢুকল ঘরে,কোনো দিন না দেখা এই ভদ্রমহিলা তুরার কি হন? হাজারো কৌতুহলে কপালে গভীর ভাঁজ পরল রুবি খাতুন সহ সেখানে উপস্থিত আমেনা আর চুমকির ও
তুরার মুখটা তুলে দু’হাতের আঁজলে নিয়ে কপালে গালে পরম মমতায় চুম্বন করে বলল

-তুরা মা আমার,কেমন আছিস।কত দিন পরে তোর মুখ খানা দেখলাম মা! তুই আমাকে ক্ষমা করে দে মা,তোর পাপী মামনীকে ক্ষমা করে দে,আমি জানি আমি আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। এতগুলো দিন তোকে একা থাকতে হয়েছে। না জানি কিভাবে পার করেছিস তুই এত কষ্টের দিন গুলো একা

তুরা নিজের গালে রাখা দুহাতের উপর নিজের দুহাত আদরের সহিত রেখে বলল

-এভাবে বলোনা মামনী। তোমার কোনো দোষ নেই,তুমি কেনো এভাবে বলছ? আর আমিতো ভালো আছি

তবুও মমতাময়ীর মন যেনো খ্যান্ত হলো না, দুহাত তুলে তুরার হাত,মুখ, গাল ধরে হাত বুলিয়ে দিলো কপালে আরও একবার চুম্বন করে বলল

-রাজিয়াকে কতবার ফোন করেছি তোর সাথে কথা বলার জন্য ফোন ই ধরে না মাস দুই বাদে যদিও ধরে বলে তুই বাড়িতে নেই,ঘুরে বেড়াচ্ছিস নাহ তো আরও কত কি, আমার শুরু থেকেই বিশ্বাস হয়নি ওর কথা। তারপর খোঁজ লাগিয়ে জানতে পারলাম তুই ও বাড়িতে থাকিস ই না আর এ দেশে এসে আমি জানতে পারলাম তোর বিয়ে হয়ে গেছে!

পুরো কথা স্বাভাবিক ভাবে বললেই শেষের কথাটিতে যেনো একরাশ বিস্ময় আফসোস প্রকাশ পেলো। বিয়ের কথাটি শুনে তুরার মুখটাও শুকিয়ে এলো। মাথা ঝুকিয়ে নিলো

-হ্যাঁ তুরার বিয়ে হয়েছে মাস দুয়েক,আর এটাই ওর শ্বশুড়বাড়ি

সাবলীল স্বরে নারীকণ্ঠের উত্তরে ঘুরে তাকাল তুরার ফুফু, যদিও তিনি জানতেন এটা তুরার শ্বশুড়বাড়ি তবুও তার বুক ভরা হতাশা আর বিস্ময়। ভাইয়ের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কত শত স্বপ্ন ছিল। আর তাকেই কিনা বিয়ে দিয়ে দিলো তাও কাওকে কিছু না জানিয়েই?

-আমি তহমিনা । তুরার বড় ফুফু

চোখের পানি শাড়ির আঁচলে মুছে বলল তিনি। রুবি খাতুন এগিয়ে এসে নরম হাতে ধরল তহমিনার হাত, মমতাময়ী মনের উৎকণ্ঠা ব্যকুলতা সবটাই তিনি বোঝেন, তাই উনার এমন অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক যে নয় সেটা সেও মানের। সুমিষ্ট স্বরে বললেন

-আপা, আমার সাথে আসুন। বসুন তো এখানে। এতটা ব্যতিব্যস্ত হবেন না তো।আপনি কান্নাকাটি করলে তুরার কেমন লাগবে বলুন তো। ও তো বাচ্চা মেয়ে

তহমিনার মনে প্রশান্তির মেঘ ভেসে উঠল যেনো। রুবি খাতুনের নম্রভাষি শান্তনায় তার মনক্ষুন্নতা কমে এলো। মানুষটির সভ্যতা দেখে মনে হচ্ছে না তুরা কোনো অসুবিধায় আছে এখানে। রুবি খাতুন গ্লাস ভর্তি পানি এগিয়ে দিলেন তহমিনার সামনে। তহমিনা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে গ্লাসটা রাখলে, আমেনা বেগম বললেন

-দেখো তুরার আর আমার দাদুভাইয়ের বিয়েটা যে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তা নিশ্চয় তুমি জানো? তোমার ছোট ভাই ইমতিয়াজ আর তার স্ত্রী রাজিয়া তুরার বিয়ে একটা লম্পট, বেয়ারা, রাস্তার ছেলের সাথে ঠিক করেছিল যাকে বিয়ের দিনই পুলিশ গ্রেফতার করেছে জু’য়া আর মেয়েবা’জির কারণে, তাই মান সম্মান বাঁচাতে ইনসাফ বাধ্য হয়ে তুরার সাথে দাদুভাইয়ের বিয়েটা দিয়েছে

বলে খানিকটা থেমে,কণ্ঠের খাদ ভীষণ শীতল স্থির করে মৃদু স্বরে বলল

-আর বিয়েটা বাধ্য হয়ে দিলেও এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো, ইনসাফ আর তোফায়েল যে একে অপরকে কথা দিয়েছিল সেটা নিশ্চয় মনে আছে তোমার?

এ পর্যায়ে কপালের অজস্র ভাঁজ টান হলো তহমিনার, চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল,যেনো কিছু একটা দুষ্কর মনে পরেছে, যা তার চিন্তার ভাঁজ কর্পূরের মতো উবিয়ে দিলো।
কিন্তু এ পর্যায়ে তুরার চোখে মুখে উপচে এলো কৌতুহলের ইন্ধন। কিসের কথা বলছে দিদুন? তার বাবা আর ইনসাফ কি কথা দিয়েছিল?

-আপা, আমিও তুরার মায়ের মতই। শাশুড়ি হয়েছি বলে কি ওকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতে পারব না বলুন? বিয়েটা ওদের জন্যে আর পরিস্থিতি সাপেক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আমরা তো জানি পুরোটাই।

তহমিনা নিজের মনে উপচে পরা চিন্তার জোয়ার সামাল দিয়ে বলল

-রাজিয়া আর ইমতিয়াজের ভরসায় রেখে গেলাম ওকে,আর ওরাই কি না তুরাকে একটা অ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছিল? রক্ষক ই যদি ভক্ষক হয় তবে আর কি ই বা বলার থাকতে পারে। টাকা আর সম্পত্তির লোভে যে ওরা সন্তান সমতুল্য তুরার সাথেও এমনটা করবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবিনি

চুমকি এসে চা নাস্তার ট্রে সামনে রেখে সরে গেলো৷ তহমিনা তুরার দিকে চেয়ে বললেন

-তুরা মা তুই কেনো আমাকে বলিস নি? এত বড় অন্যায় টা তুই কি করে মেনে নিচ্ছিলি এসব। তোর বাবার টাকায় খেয়ে পরে তোর উপরেই এত বড় অন্যায় করার দুঃসাহস ওদের?

তুরা এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসল তহমিনার সামনে দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলল

-মামনী! তুমি এতটা অস্থির কেনো হচ্ছ বলোতো? এখন তো এসে গেছ তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে, আর তুমি ছিলে না তো কি হয়েছে বাবা আর তোমাদের দোয়ায় আমিতো একটা পরিবার পেয়েছি, বাবা মা বোন দিদুন সব পেয়েছি যারা আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই তো, নাহলে এতো সৌভাগ্য আমি কোথায় পেতাম বলো তো।

তুরার শান্তসুলভ কথায় তহমিনার মনের অস্থিরতা প্রশান্ত হয়ে গেলো। রুবি আমেনা গাল প্রসারিত করে হাসল। তুরা আবারও বলল

-আর ফুফা কেমন আছে সেটা বলোতো? তুমি এসে থেকে আমাকে নিয়েই কেঁদে যাচ্ছ, দেখছ না দিব্যি আছি আমি। ফুফা কেমন আছে? ইয়াজ ভাই কোথায় তুমি একা এসেছ?

ইয়াজের নাম করে মুখ ছোট করে ফেলল তুরা, তুরার একদমে করা প্রশ্নে তহমিনা মুচকি হেসে বললেন

-তোর ফুফার জন্যেই তো আমি আসতে পারিনি দেশে, এই কতগুলো মাস যে কি অবস্থার মধ্যে ছিলাম তা আমরা বাদে কেও যানে নাহ। দিনদিন তোর ফুফার অসুস্থতা এতো বেড়ে যাচ্ছিল সে না যাওয়া সত্ত্বেও জোর করে হসপিটাল নিয়ে যাই। ডক্টর চেকাপ করে জানায় তার হার্টে ছিদ্র দেখা গেছে এবং যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে হবে। তার অপারেশন, সেবা,সুস্থতা নিয়ে এতগুলো মাস চোখের পলকে কেটে গেছে যে বাইরের কিছুর খোঁজ খবর ই রাখতে পারিনি

-ফুফা এখন কেমন আছে মামনী, উনিও কি এসেছেন?

-না রে মা, উনি আসেননি। তবে সৃষ্টিকর্তার অশেষ ক্রিপা উনি এখন সুস্থ, অফিস ব্যবসা সামলে আসার সময় করে উঠতে পারেনি

-আর ইয়াজ ভাই কোথায় মামনী? ইয়াজ ভাইকে আমার মনে পরে যানো? শেষ কবে দেখেছি সেটাই মনে নাই,আমিতো ভাইয়ার চেহারাটাও ভুলে গেছি

শেষের কথাটা বলে মুখ ছোট করে নিলো তুরা, ইয়াজ তার ফুফাতো ভাই। ছোট বেলায় ইয়াজ নামটা তার অসম্ভব প্রিয় ছিলো। সারাদিন তার পিছু পিছুই ঘুরত তুরা, আর ইয়াজ তুরাকে নিয়ে পাগল। নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু যেনো। কিন্তু তহমিনা বিদেশে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে আসে ইয়াজের সাথে,বড় হওয়ার সাথে সাথে তো তুরা ভুলে গেছে সাত বছর আগে দেখা ইয়াজের চেহারাটা।

-সেটা এখনি বলব নাহ, তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে কিন্তু তুরা

তহমিনার কথায় তুরা কপাল জড়ো করে তাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে বলল

-সারপ্রাইজ? কেমন সারপ্রাইজ মামনী!

-হেয়ার ইজ ইউর সারপ্রাইজ মাই ডল!

চেনা জানা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তুরা ফট করে ঘুরে দাঁড়াল, সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির হাস্যজ্বল চেহারা দেখে তুরা প্রচন্ড চমকপ্রদ ভাবে তাকাল। এটা কি দেখছে সে? তার সামনে তো,,ইনি এখানে?

-মাহিদ স্যার,আপনি?

অস্ফুটস্বরে বলল তুরা, তার ঠিক সামনে বরাবর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে নীল রঙের শার্ট পরিহিত সুদর্শন চেহারার লোকটা, যার চোখে মুখে উপচে পরা রহস্যময়ী হাসি তুরার মাথাটা আরও গুলিয়ে দিচ্ছে, বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকাল তহমিনার দিকে, তার চোখে মুখে চিকচিক করছে হাসির ফালি। গাল প্রসারিত করে বলল

-ইয়াজ ভাই ইয়াজ ভাই করে এতটা পাগল ছিলি,অথচ তাকে এত কাছ থেকে দেখেও একবারের জন্য মনে করতে পারলি না?

কথার সাথে রসিকতা মিশ্রিত স্বরে বলল তহমিনা। তুরা ছলছল আঁখিতে তাকাল মাহিদের দিকে, এই জন্যেই! এই জন্যেই তার বারবার মনে হতো মাহিদের হাসিটা তার খুব চেনা,মাহিদের চেহারাটা তার খুব দেখা কিন্ত সাত বছর আগের দেখা চেহারা টা কিছুতেই মনে করতে পারছিল নাহ। গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি আর চোখের চশমাতে যেনো চেহারাটা পুরোদমে পালটে গেছে। তুরা তাকিয়ে থাকতেই মাহিদ এগিয়ে আসল কয়েক কদম, চোখ ভর্তি উৎফুল্লতা আর কন্ঠে কপট অভিমান জুড়ে দিয়ে বলল

-এতবার আমাকে দেখেও চিনতে পারলি নাহ? নিজের ইয়াজ ভাইকে এতটা ভুলে গেছিস তুই?

মাহিদের কথা শেষ করবার মুহূর্ত না পেরতেই তুরা এক ছুটে গিয়ে ঝাপটে ধরল মাহিদকে, দু’হাতে শক্ত করে ধরে সশব্দে কেঁদে দিল। মাহিদ এক হাতে তুরাকে আগলে আরেক হাত তুরার মাথায় রেখে আলতো ভাবে বুলিয়ে দিয়ে বলল

-আরে বাবা, এভাবে কাঁদলে হয়? তুই কি এখনো বাচ্চা আছিস যে একটা কিছু না হতেই ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে দিবি বল তো?

বলে তুরার মুখ তুলে দু’হাতে ধরে বলল

-আমার ডল তো অনেক স্ট্রং, তাই না? এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি ছিচকাঁদুনে বলব তোকে

মাহিদের কথায় তুরা হাসার পরিবর্তে আরও জোরে কেঁদে উঠল,আবারও মাহিদকে ঝাপটে ধরে বলল

-তুমি আগে কেনো আমাকে বললে না ইয়াজ ভাই,আমি নাহয় তোমাকে চিনতে পারিনি তুমি কি করে চুপ থাকলে। তোমার কি একবারও আমার কথা মনে হয়নি? নিজের ডলকে এভাবে ভুলে গেলে? আমি আর তোমার সাথে কখনো কথা বলব না ভাই

তুরার বাচ্চাদের মতো বিলাপ করে কান্না দেখে মাহিদ হাহা করে হেসে উঠে বলল

-নিজেই এসে গায়ের সাথে চিপকে নিজের আবার ‘আমি তোমার সাথে কথা বলব না’ বলার অভ্যাস টা তোর গেলো না তাই না রে?

মাহিদের খোঁচা দেওয়া কথা শুনে তুরা ওকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। তহমিনার দিকে তাকিয়ে বলল

-তোমার ছেলেকে চলে যেতে বলো মামনী, কোনো ববহুরূপীর সাথে আমি কথা বলতে চাইনা

তুরার গাল ফুলানো দেখে তহমিনা হেসে দিয়ে বলল

-আরে তুই যেমন ওকে এত বছর পরে দেখছিস ওউ তো তোকে তত বছর পরেই দেখছে, আর ও কিন্তু আগে চিনেছে তোকে। তোর খোঁজ তো আমি ওর মাধ্যমেই পেয়েছি

তবুও খ্যান্ত হলো না তুরার মন ঠাঁই গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, মাহিদ মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলল

-এভাবে গাল ফুলানো বন্ধ কর৷ আমারই দোষ প্রত্যেকবার সিডরের মতো ধুপধাপ কোত্থেকে এসে ধাক্কা মুক্কা দেওয়া মেয়েটা যে তুই ছাড়া আর কেও হতেই পারেনা এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।

মাহিদের কথায় তুরা চোখ ছোট ছোট করে নিয়ে বলল

-আমারও আগেই বোঝা উচিত ছিলো যে আমার ধাক্কা মুক্কা খাওয়ার জন্য প্রত্যেকবার উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকটা তুমি ছাড়া কেও হতে পারেনা ইয়াজ ভাই

তুরার আর ইয়াজের কথায় উপস্থিত সকলে হেসে উঠল। তুরা উপরে রাগ দেখালেও ভেতরে তার প্রশান্তিতে ভরে গেলো,কত দিন ঠিক কত মাস পর তার এতটা আনন্দ লাগল বলার মতো নাহ। এই বাড়ির সকলের মতো অমায়িক মানুষ গুলো পাওয়ার পর নিজের ভাই আর ফুফুকে পেয়ে যেনো ওর আনন্দের ষোলো কলা পূর্ণ হলো এবার, আর কিচ্ছু চাইনা তার, এই মানুষ গুলো সারাটা সময় তার পাশে থাকুক,সাথে থাকুক। আর কিচ্ছুটি চাইনা তার

••••

মুখ ভরা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে তুরা, অভিব্যক্তিটা ঠিক চুরি করে ধরা পরার মতন। দুই হাত জড়ো করে কচলে যাচ্ছে রীতিমতো। আর টিপটিপ করে দরজার দিকে তাকাচ্ছে একটু পরপর, মনে মনে আল্লাহর নামের ঝড় বইয়ে দিচ্ছে ‘ইয়া খোদা, এ যাত্রা বাঁচিয়ে দাও, আমি দুইদিন কোনো ইতিরামি করব নাহ’

-তোমার উলটা পালটা চিন্তাভাবনা বন্ধ হলে আমাকে বলো এসব কি করে হলো

তবুও মুখটা আসামীর মতো করে রেখেছে তুরা। যেটার ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো। তুরা কোনো ভাবেই চাইনি আহান তার পরে যাওয়ার ঘটনা টা যানুক। তবুও ভার্সিটির কে বা কাদের মাধ্যমে ব্যাপার টা উনার কানেও চলে গেছে। তুরা বুঝল না ভার্সিটিতে নিত্যদিন হওয়া এতসব ঘটনা রেখে মাস্টার টার কানে ওর পরে যাওয়ার খবর টা কে দিলো!

-উত্তর দিচ্ছ না কেনো ষ্টুপিড!

মৃদু ধমকে তুরা বিব্রত হয়ে তাকাল। সে কি বলবে পরে গেছিল সব তো জানেই লোকটা। তুরা ভালো করেই জানত সব দোষ ওর উপর চাপিয়ে ওকেই শ’খানেক কথা শোনাবে তাই তো বলতে চাইনি

-পরে গেছি এতে আমার কি দোষ আমিতো ইচ্ছে করে পরিনি। পরে যাওয়া তো আমার হাতে ছিলো না

-পরে যাওয়া তোমার হাতে ছিলো না কিন্তু আমাকে জানানো টা তো তোমার হাতে ছিলো। সব জাগায় নিজে পাকনামি করার বাজে অভ্যাস আছে তোমার। কি মনে করো তুমি কারো চিন্তা হয়না? আমি যে তোমার জন্যে ভার্সিটির পেছনে ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে ছিলাম সে খেয়াল হলো না তোমার? চলে আসবে তো অন্তত আমাকে জানিয়ে তো আসতে পারতে না কি?

এ পর্যায়ে এসে তুরা নিশ্চুপ রইল। দোষটা তারই,আহান বলেছিল তাকে আজ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাই ক্লাস শেষ করে যেনো দেরি না করে, তুরাকে বাড়িতে রেখেই সে কাজে যাবে। কিন্তু তুরা আহানকে ইগনোর করতে গিয়ে ইচ্ছে করেই যায়নি
আহান তুরার উত্তরহীনা চেহারাতে এক বার দৃষ্টিপাত করে সরে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্স টা বের করে খাটের উপর রাখল তুরার হাত ধরে ঠাস করে খাটের উপর বসাল
তুরাও ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করেই বসে রইল। দোষটা যেহেতু তার এক্ষেত্রে তার চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয়। আহান স্যাভলনে তুলা ভিজিয়ে তুরার হাতটা আলতো ভাবে ধরে ভীষণ সাবধানি হাতে আস্তে আস্তে ছোঁয়াল কনুইয়ের ক্ষতটাতে
কড়া ক্যামিক্যালের স্পর্শে জ্বলন ধরতেই চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিলো তুরা, আহান তুরার কুচকে যাওয়া মুখটা লক্ষ্য করেই নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ফুঁ দিতে লাগল। আস্তেধীরে স্যাভলন চেপে তার উপর অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিলো। তুরা অপলক চেয়ে আছে আহানের দিকে, এই যে তুরার ব্যাথায় আহানের কপালে চিন্তার প্রগাঢ় ভাঁজ পরে, বারবার ভীত হয় তুরার আঘাতে এতে তুরার ভীষণ ভালো লাগে, আঘাত লাগাতে যদি সুপুরুষের মুখে নিজের জন্য চিন্তা উদ্বিগ্নতার ছাপ দেখনার সৌভাগ্য হয় তবে এমন আঘাত আবার লাগুক,বারবার লাগুক।
ভাবতেই আনমনে হেসে উঠল তুরা। আহান চোখ তুলে তাকাতেই গম্ভীর গলায় বলল

-এভাবে শুধু শুধু হাসছ কেনো তুমি

-কই না হাসছি না তো

তুরা হাসি থামিয়ে ভাবহীন চেহারা করে বললে আহান ভ্রুকুটি করে বলল

-আমাকে কি তোমার অন্ধ মনে হয়, নাকি পাগল কোনটা?

-এমা ছি ছি, আপনাকে আমি কেনোই বা অন্ধ বা পাগল মনে করব, আপনি হলেন দ্য গ্রেট মাস্টার মশাই, আপনাকে পাগল ভাবার মতো দুঃসাহস আমি স্বপ্নেও করিনা।

তুরা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল আহানের দিকে চেয়ে, চোখে মুখে বিস্ময় আর গুরুতর ভঙ্গি ধরে রেখেছে, আহান তুরার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে দেখল।আবারও মেয়েটা নাটক শুরু করল, কিন্তু এসব আবার কেমন ভাষা!

-মাস্টার মশাই?কি বললে তুমি? মাস্টার মশাই কাকে বলছ তুমি

ধমকে উঠে দাঁড়িয়ে পরল আহান, তুরা মুখটা অসহায়ের মতো করে বলল

-আপনাকে, আপনি ছাড়া কাকে বলব। আপনি হলেন দ্যা গ্রেট মাস্টার মশাই

-সাট আপ, যাস্ট সাট আপ! আরেকবার যাদি এই ডিসগাস্টিং ওয়ার্ড টা ইউস করেছ তাহলে আজ তোমার একদিন কি আমার

তুরা উঠে দাঁড়িয়ে আহানের হাত ধরে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল

-শান্ত হন,আপনি শান্ত হন মাস্টার মশাই। এভাবে রেগে গেলে প্রেসার হাই হয়ে যাবে তো

আহানের মেজাজ সপ্ত আসমানে চড়ে যাচ্ছে, এই ওয়ার্ড টাকে সে রীতিমতো ঘৃণা করে, মাস্টার মশাই!? তাকে কি দেখতে টাকলা পেট মোটা স্কুলের মাস্টার মনে হয় যে এসব নাম বলবে। এই মেয়েটা যে তাকে ইচ্ছে করে হেনস্তা করছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কাল থেকে শুরু করেছে মেয়েটা, এক তো তাকে ইগনোর করছে তার উপর এধরণের বিরক্তিকর কথা বার্তা।এর সামনেই থাকা যাবে নাহ

-স্টুপিড, বাঁদর কোথাকার

চোখ রাঙিয়ে বলেই গটগট করে বারান্দার দিকে গেলো আহান। তুরা ওর দিকে চেয়ে মুখে হাত চেপে হাসল। ঘড়িতে প্রায় রাত এগারোটা। ফুফু আর মাহিদ বিকেলেই চলে গেছে, ইনসাফ বা আহান কারো সাথেই দেখা হয়নি তাদের। রুবি আমেনা বেশ কয়েকবার বললেও মাহিদের কোনো কাজ থাকায় তারা থাকেনি।তাই আর জোর করেনি কেও, তবে ফুফু আর মাহিদের কথাটা আহান একেবারেই জানে নাহ। বেশ রাত করে ফিরেছে আজ সে, আহান বাড়ি ফেরার আগেই সকলে ঘরে ঢুকে পরেছে। তাই আর জানানো হয়নি। তুরা তো একটা কথায় বারবার ভাবছে যে আহান যখন যানতে পারবে মাহিদ তুরারই ভাই তখন তার প্রতিক্রিয়া টা কেমন হবে!

ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানা ঠিক করে শুতে গেলে দেখল আহান এখনো ঘরে আসেনি। এর মাঝেই হুট করে কারেন্ট চলে গেলো। তুরা বিছানাই বসতেই থমকে গেল, এভাবে কারেন্ট তো যাই না,আজ হঠাৎ কি হলো? অন্ধকারে তুরার জান বের হওয়ার উপক্রম। কোনো মতে উঠে হাতরে হাতরে বারান্দায় এসে আহানকে ডাকল

-শুনুন? আপনি কোথায়?

তবুও কোনো উত্তর পেলো নাহ। তুরার ভীষণ রাগ হলো এই লোকটাকে ভালো করে ডাকলে কিছুতেই উত্তর দিতে চাইনা। অসহ্য!

-আপনি কথা বলছেন নাহ কেনো? আমার ভয় করে অন্ধকারে!

হুট করেই তুরাকে বারান্দার রেলিঙের সাথে চেপে ধরলো আহান, অন্ধকারে এমন আকস্মিক আক্রমণে তুরা প্রথমে চমকে গেলেও আহানের স্পর্শে শান্ত বনে যায়।
আহান নিঃশব্দে কোনো কথা ছাড়ায় চেপে ধরে রেখেছে ওকে, প্রগাঢ় নিঃশ্বাস তুরার ঘাড়ে মুখে উপচে পরছে ক্রমান্বয়ে।

-ছ’ছাড়ুন আমাকে

কণ্ঠে মৃদু কম্পন ধরে বলল তুরা। কিন্ত আহান ছাড়ার পরিবর্তে আরও জোরে চেপে ধরল। শরীরের কাছে আরও ঘেঁষে দাঁড়াল।

-আ আমাকে ছাড়ুন,এমন কেনো করছেন

-খুব তো ইগনোর করছিলে আমায় কাল থেকে, খুব শখ না আমার থেকে দূরে থাকার? এবার থাকো অন্ধকারে সারারাত আমার সাথে চিপকে,এক চুল নড়ছি না আমি
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥