তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
3301

#তুমি_নামক_যন্ত্রণা
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৮(শেষ পর্ব)
আবির নিচে এসে এদিক ওদিক জান্নাতকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও দেখে না। একে ওকে জিজ্ঞেস করে জান্নাতের মতো কাউকে দেখেছে কিনা৷ কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারে না। আবিরের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নিজের উপর। তার চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে নিশিতার উপর। আজ এত বছর পর এসে ওর সাজানো সংসারটায় ঝামেলা পাকিয়ে দিল। আবির চাইলেও জান্নাতকে দোষারোপ করতে পারবে না। কোন স্ত্রীই চাইবে না তার স্বামীকে কারো সাথে ভাগাভাগি করতে। সেখানে আজ এভাবে আবিরকে দেখে জান্নাত হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছে। আবির সেটা হারে হারে বুঝতে পারছে৷ ও ক্ষমাপ্রার্থী জান্নাতের কাছে। আবির গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওর সব লোককে লাগিয়ে দেয় জান্নাতকে খুঁজতে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায়। কিন্তু জান্নাতকে কোথাও কেউ খুঁজে পায় না। আবির সব জায়গায় জান্নাতকে খুঁজেছে। হাসপাতাল, রাস্তাঘাট সব৷ জান্নাত যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। এ কেমন ধৈর্য্যের পরীক্ষায় পড়লো আবির। ওর প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। রাত ৯ টা বেজে গিয়েছে। জান্নাতের কোন খবর নেই। আবির গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বসে আছে। মহান আল্লাহকে শুধু মনে মনে ডাকছে। তিনি ছাড়া ওকে আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না। আবির গাড়ির সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে। আবির হকচকিয়ে দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানে দেয় আর বলে,

– হ্যালো জান্নাতকে পেয়েছো?
– জি স্যার, ম্যাম মাত্র বাসায় আসলেন।
– আল্লাহ। আমি এখনই আসছি। ও যেন আর কোথাও না যায়।
– ওকে স্যার। আমরা সবাই আছি।
– আচ্ছা।

আবির আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে আসে। বাড়ির ভিতর ঢুকে কোন রকম গাড়ি পার্ক করে হাসান আঙ্কেলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আবির তার কাছে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– আঙ্কেল জান্নাত কই? (অস্থির কণ্ঠে)
– বাগানে বসে আছে বাবা। তোমার দোলনাটায়।

আবির এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে খুব জোরে দৌড় দিয়ে বাগানের মাঝে চলে যায়। জান্নাতের সামনে এসে হাপাতে হাপাতে ওর দিকে তাকায়। দেখে জান্নাতের চোখগুলো ফুলে আছে। তারমানে অনেক কান্না করেছে ও। আবির আর কিছু না ভেবে জান্নাতকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,

– তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলে! এভাবে না বলে কোথায় ছিলে সারাদিন? আমি কত ভয় আর কষ্ট পেয়েছি তুমি জানো? আমার বুকটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। প্লিজ আমাকে মাফ করে দেও। আমি অনেক বড়ো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে। তুমি আমাকে যা খুশি শাস্তি দেও, কিন্তু প্লিজ নিজের কোন ক্ষতি করো না আমার কাছ থেকে দূরে চলে যেও না। তুমি ছাড়া আমার আর কোন আপনজন নেই। সত্যি বলছি।
~ আপনি কেন সরি বলছেন? আসলে আমি আমার জায়গাটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি কোন অধিকারে আপনার সাথে রাগ করলাম! আমি তো আগেই বলেছিলাম, আপনি হাজারটা মেয়ের সাথে থাকলেও আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আজ কেন জানি ওই মেয়েকে আপনার সাথে দেখে, ওর কথা শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।

আবির জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,

– কারণ তুমি আমার স্ত্রী। আর একজন স্ত্রী কখনোই এগুলো মানতে পারে না। তাতে সে যতই সেক্রিফাইস মাইন্ডের হোক না কেন৷
~ একটা কথা বলি?
– হাজারটা বলো।
~ আপনি আমার কাছে একজন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। আমি আজ আপনার সব কিছু জানতে চাই। আমাকে বলবেন?

আবির জান্নাতের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর বলে,

– ঠিক আছে। তুমি যা যা জানতে চাইবে আমি সব বলবো। তবে তার আগে রুমে চলো। তোমাকে এভাবে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সারাদিন না খাওয়া তুমি।
~ আচ্ছা চলেন।

আবির জান্নাতকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ওকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে ওর জন্য খাবার নিয়ে আসে। জান্নাত ভিজা চুল নিয়ে বের হয়ে দেখে, আবির খাবার নিয়ে বসে আছে। ওকে বের হতে দেখলে আবির দ্রুত ওর কাছে আসে। এসে বলে,

– তোমার চুল তো ভিজে। আসো শুকিয়ে দি। নাহলে ঠান্ডা লাগবে। আসো আসো।
~ আরে আমি পারবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
– তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো? (অসহায় ভাবে)
~ আচ্ছা নিন মুছে দিন৷

আবির জান্নাতকে নিয়ে আয়নার সামনে বসায়। তারপর ওর চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে শুকিয়ে দিতে থাকে। জান্নাত খেয়াল করে আবির খুব অস্থির হয়ে আছে ওকে নিয়ে। ওর চুল শুকালে সুন্দর করে আঁচড়ে দেয় আবির। তারপর জান্নাতকে দেখে বলে,

– এবার একদম পার্ফেক্ট লাগছে আমার বউটাকে।

জান্নাত কোন কিছু না বলে আবিরকে হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আর ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

~ প্লিজ শান্ত হন শান্ত হন৷ আমি ঠিক আছি।
– খুব পেয়েছিলাম আমি। বলো আর কখনো এভাবে আমাকে একা করে যাবে না। (শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অসহায় কণ্ঠে বলল)
~ না যাবো না৷ প্রমিজ।
– ভালবাসি তোমাকে। তুমি ছাড়া এই আমি একদম শুন্য। আমার চারকূলে একমাত্র তুমিই আছো। আর কেউ নেই।
~ জানি আমি। তাইতো ফিরে এসেছি।
– তোমাকে পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। সত্যি করে বলো তুমি কোথায় ছিলে?
~ আমাদের বাসার পিছনে যে ছোট পার্কটা ছিল সেখানে। অনেক ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা ছিল। ওদের সাথে খেলা করেছি এতক্ষণ।
– বাসার কাছে মানুষ রেখে আমার লোকেরা তোমাকে কোথায় কোথায় না খুঁজেছে কে জানে। যাই হোক এবার খাবে চলো।

আবির জান্নাতকে বসিয়ে নিজের হাতে খাবার মাখিয়ে বলে,

– হা করো।

জান্নাত মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। মানে ও খুব লজ্জা পাচ্ছে। আবির হাসি দিয়ে বলে,

– আহরে আমার লজ্জাবতীটা। লজ্জা পরে আগে একটু খেয়ে নেও।

জান্নাত লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে খাবার খায়। আবির খুব খুশি হয়ে ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। অর্ধেক খাওয়া হলে জান্নাত বলে,

~ এবার আমাকে দিন। আমিও আপনাকে খাইয়ে দিব৷ আপনিও তো সারাদিন না খাওয়া।
– আচ্ছা দেও। বউয়ের হাতে খাওয়ার আমার অনেক দিনের সখ।

জান্নাত মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আবিরের কাছ থেকে খাবার নিয়ে ওকে বাকিটুকু খাইয়ে দেয়। দুজন খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বেডে বসে। আবির বেডের সাথে হেলান দিয়ে জান্নাতকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,

– নেও এবার আমার ইন্টারভিউ শুরু কর।
~ হুম। আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো সব সত্যি উত্তর দিবেন বলেন?
– ঠিক আছে সত্যিই বলবো।
~ আচ্ছা। সবার আগে আমি আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। তারা কোথায়? কি হয়েছে তাদের সাথে আপনার? আমাকে সব বলেন।
– বলছি। আমার জীবনের গল্পটা আর দশটা ছেলের মতো হতে পারতো। কিন্তু আমার নির্মম ভাগ্যের জন্য তা হয় নি। আমার জন্মের পর টানা ৪/৫ বছর সব ঠিক ছিল। যতদূর আমার মনে আছে। আমার পাঁচ বছর হলে, বাবা-মার মাঝে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমার মা অনেক ধনী পরিবারের ছিল। বাবা অত ধনী ছিল না৷ সে তোমার মতোই খুব সাধারণ একজন ছিলেন। আর এটাই তার জীবনের আর আমার কাল হয়ে দাঁড়ায়। মায়ের পরিবার বাবাকে সবসময় কথা শোনাতো। সাথে মাও। অঢেল অর্থ সম্পদের ভারে মায়ের মধ্যে থেকে ভালবাসা হারিয়ে যায়। বাবাও জিদ ধরে সে অনেক টাকা ইনকাম করবে। তাই সেও বেড়িয়ে পড়ে টাকার খোঁজে। আর মা? সে তার লাইফ নিয়ে বিজি। পার্টি, ঘুরাঘুরি, শপিং আরও কত কি। এসব কিছুর মাঝে তোমার কি মনে হয় না একজন খুব একা? বলতে পারো সে একা মানুষটা কে?
~ আপনি। (চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল)
– হুম। পাঁচ বছরের ছোট্ট আবিরটা। তার বাবাও তাকে সময় দেয় না। তার মাও না। দুজন দুদিকে। ঠিক তখন হাসান আঙ্কেল আমার কাঁধে হাত রাখেন৷ যেখানে বাবা মার আঙুল ধরে সন্তান স্কুলে যায়, পড়া শিখে, সেখানে আমি অপরিচিত একজনকে ভরসা করে জীবনের অনেক প্রহর পাড় করি। সেই লোকটা আমার কষ্ট বুঝেছে। তাই কখনো বিয়ে না করে নিজের ছেলের মতো আমাকে বড়ো করেছে। বাবা যখন টাকার সন্ধান পায় সেও টাকার লোভে সব ভুলে যায়। দীর্ঘ ১০ টি বছর আমি আমার বাবাকে দেখিই নি। মা সপ্তাহে একদিন এসে টাকা দিয়ে চলে যেতেন হাসান আঙ্কেলের কাছে। সে কোন দিন এসে আমার সাথে খেলাও করেন নি। এরপর যখন বাবা অনেক টাকার মালিক হয়ে যায় তখন সে আরেকটা বিয়ে করে ফেলে মাকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। ফলাফল তাদের ডিভোর্স। এরপর তারা দুজন চিরতরে দুইদিকে চলে যায়। আমি যে তাদের সন্তান তারা হয়তো তা ভুলেই যায়। মাসে মাসে শুধু কোর্টের আদেশে কারিকারি টাকা দান করতেন। হাসান আঙ্কেল সৎ হওয়ায় সে আমার নামে সে টাকাগুলো জমা করে রাখেন৷ সময়ের স্রোতে ছোট্ট আবির অনেক বড়ো হয়ে যায়। হাসান আঙ্কেলে সুশিক্ষা আমাকে খারাপ পথে যেতে দেয় নি। তিনি আমাকে শুধু এটাই বলতেন, তোমাকে অনেক বড়ো হতে হবে৷ নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে নিজের জন্য। ভার্সিটি শেষ করার আগেই আমার জন্য জমানো টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করি। তখন আমার পাশে আমার ওই বন্ধুগুলো ছিল। ওদের নিয়ে আমার ব্যবসাটা আস্তে আস্তে অনেক বড়ো করতে থাকি। দীর্ঘ ১০ বছর লেগে যায় আমার এই পজিশনে আসতে। আজ দেশের টপ ক্লাস বিজনেসম্যান আমি। এই দীর্ঘ পথ চলায় যে মানুষগুলো আমার সাথে ছিল আমি এখনো তাদের আমার সাথে ধরে রেখেছি। ছুটে যেতে দেই নি। আমার আসল বাবা-মা এখনো আমার কথা মনে করে না। হয়তো জানেই না আমি মরে আছি নাকি বেঁচে। আর আমিও জানি না তারা কোথায় বা কেমন আছে। তাই তুমি যখন সেদিন সকালে বাবা মার কথা বললে আমার সব বিষাক্ত স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। তাই আমি এড়িয়ে যাই। খুব কষ্ট হয় জানো। খুব। (কাঁদো কণ্ঠে বলল)

আবিরের কথা শেষ হলে জান্নাত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। সত্যি বলতে কান্না করারই কথা। একটা সন্তান যদি এতটা কষ্ট নিয়ে বড়ো হয় তাহলে কান্না আসারই কথা। আবির জান্নাতকে স্বান্ত্বনা দিতে দিতে বলে,

– কাঁদে না বউজান আমার। তোমাকে আরেকটা সত্য কথা বলি। তুমি যেদিন আমার উপরে উঠে আমাকে তোমার সবটা বলো। আমি যখন জানতে পারি তুমিও আমার মতো সেইম কষ্টে আছো ঠিক তখনই আমি সিদ্ধান্ত নি, যত যাই হোক তোমাকে আমি সব কিছু থেকেই প্রোটেক্ট করবো ইনশাআল্লাহ। আর আমি তাইই করছি।
~ আমি ভাবতেও পারিনি আপনি মনের মধ্যে এতগুলো কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন। কিভাবে পারেন আপনি? আমি হলে ত ম…
– চুপ। একদম চুপ। আর কিছু শুনতে চাই না। এবার নিশিতার বিষয়টা ক্লিয়ার করি। রেস্টুরেন্টে তোমাকে যা বলেছি সবটাই সত্য। তবে একটা কথা বলিনি, সেটা হলো নিশিতার প্রতি আমি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ও যখন খারাপ প্রস্তাব করে ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মধ্যে ওকে নিয়ে যা ছিল সব ঘৃণায় পরিণত হয়। পরে জানতে এবং বুঝতে পারি, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই। নাহলে আমার অবস্থাও খুব খারাপ হতো। ও আমার জীবনটা শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দেখো আল্লাহ আমাকে বাচিঁয়েছে সবসময়ের মতো। আর আমাকে সবচেয়ে বড়ো প্রতিদান দিয়েছে, তোমাকে। তুমি নামন যন্ত্রণা। হাহা।

জান্নাত আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

~ আমাকে মাফ করে দিন৷ অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আপনাকে আজকে। আমি না জেনেই কি সব ভেবেছি আপনাকে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।
– বোকা একটা। চুপ করো তো। আমি শুধু তোমার ভালবাসা, তোমার স্পর্শ আর তোমার মায়াবী মুখখানায় হাসি দেখতে চাই আর কিছুই না৷

জান্নাত মুখ তুলে আবিরের দিকে তাকায়। আবির মুচকি একটা হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আবির কিছু বলতে যাবে তার আগেই জান্নাত ওকে থামিয়ে দেয় আবিরের ঠোঁটে আঙুল রেখে৷ তারপর ওর চোখদুটো মুছে দিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছে, অসম্ভব একটা মিষ্টি হাসি দেয় জান্নাত। আবির মুগ্ধ হয়ে যায় সেই হাসি দেখে৷ জান্নাত আস্তে আস্তে আবিরের কানের কাছে এসে বলে,

~ আমি আপনার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই। আজ আর কোন আপত্তি নেই আমার। আমার উপর আপনাকে সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিলাম। আর অপেক্ষা না।

আবির জান্নাতের কথা শুনে খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায়। ও জান্নাতকে সামনে এনে ওর গাল দুটো ধরে বলে,

– সত্যি বলছো?

জান্নাত হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় হ্যাঁ বলে। আবির জান্নাতের ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসির রেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আস্তে আস্তে ও জান্নাতের ঘোরে পড়ে যায়। ওর মিষ্টি গোলাপি ঠোঁটটা আবিরকে খুব টানছে। জান্নাত সেটা বুঝতে পেরে লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। আবির ওর সম্মতি পেলে আর একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে জান্নাতের ঠোঁটটাকে নিজের করে নেয়। আর আস্তে আস্তে ওরা নিজেদের একদম আপন করে নেয়৷ আবির এতদিন অপেক্ষা করে আজ জান্নাতকে একদম আপন করে নিয়েছে। সে সাথে ওদের দুজনের ভালবাসা পূর্ণতা পেয়েছে। আবির জান্নাতের আর জান্নাত আবিরের মাঝে হারিয়ে যায়। সেদিন রাতটা ওদের সুখের ভাগাভাগিতে কেটে যায়।

এরপর সময়ের স্রোতে প্রায় দু’মাস কেটে যায়। জান্নাতের ভাই এখন একদম সুস্থ। কিছু দিনের মধ্যেই ওকে রিলিজ করে দিবে৷ এদিকে আবির আর জান্নাতের ভালবাসা দিন দিন বেড়েই চলছে। একদিন সকালে আবির জান্নাতকে ডাক দেয় আর বলে,

– জান্নাত এদিকে এসো তো।

আবিরের ডাকে জান্নাত ওর কাছে আসে। আবির টেবিলের উপর কয়েকটা দলিল টাইপ কাগজ রেখে বলে,

– এগুলোতে সাইন করে দেও তো।
~ কিসের কাগজ এগুলো? (অবাক হয়ে)
– আরে আমাদের বিয়ে রেজিষ্ট্রেশনের কাগজ। নেও তাড়াতাড়ি সাইন দেও।
~ আচ্ছা আমাকে দেন আমি একটু পড়ে দেখি।
– জান্নাত! তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? (খুব অবাক হয়ে বলল)
~ আল্লাহ! কি মুশকিল। আচ্ছা আচ্ছা দেন সাইন দিচ্ছি।

আবির জান্নাতকে কাগজ গুলো পড়তে না দিয়ে ওকে দিয়ে সাইন করিয়ে ফেলে। সাইন শেষ হলে আবির হাসতে থাকে। জান্নাত অবাক হয়ে যায়। ও অবাক স্বরে বলে,

~ একি! এভাবে হাসছেন কেন? আমার কিন্তু ভয় করছে।
– এটা কিসের দলিল জানো?
~ কিসের?
– আমার এ যাবত সব সয়-সম্পত্তি, অর্থ মানে যেখানে যা আছে সব কিছুর দলিল এটা। আর একটু তুমি সাইন করাতে কি হলো জানো?
~ কি? (ভয়ে ভয়ে)
– আমার যা আছে সব তোমার নামে হয়ে গেল। সেদিন সকালে জামিলের সাথে আমি কথা বলছিলাম। আর এই সিদ্ধান্তটাই আমি নিয়েছিল। আমার শত্রুর অভাব নেই। জানি না কখন কি হয়ে যায়। আমার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ আর তোমাকে ভালবেসে আমার যা কিছু আছে সব তোমার নামে লিখে দিলাম। আজ থেকে আমার যা ছিল সব তোমার। কি খুশি তো?

জান্নাত মাথায় হাত দিয়ে বলে,

~ আল্লাহ… আপনি কি পাগল হয়েছেন? এটা কি করেছেন আপনি? এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিলেন? আর আমাকে যে সব দিয়ে দিলেন আমি আপনাকে কি দিয়েছি? কিছুই না। না আমি মানবো না। ছিড়ে ফেলেন এটা। অসম্ভব।

আবির দলিলটা সরিয়ে ফেলে জান্নাতের কাছ থেকে দূরে সরে বলে,

– উহুম, ভুল জান্নাত৷ আমার যত যা আছে তা দশ গুণ করলেও তুমি আমাকে যা দিবে তার সামনে নূন্যতম হবে। জানো সেটা কি?
~ কি?

আবির জান্নাতের কাছে এসে ওর পেটের উপর হাত রেখে বলে,

– আমাদের অনাগত সন্তান। ওর সামনে আমার এই অঢেল সম্পত্তি কিচ্ছুনা জান্নাত। আমি ওকে আমার মনের মতো করে বড়ো করবো। আমি আল্লাহর কাছে বলি, আল্লাহ যেন আমাকে ঠিক তোমার মতো একটা মেয়ে দেয়। তাহলে আমার কপালেও সত্যি সত্যি একটা জান্নাত থাকবে।
~ আমিন। কিন্তু আমি এত কিছু একা নিতে পারবো না। আপনি এটা কি করলেন?
– ঠিকই করেছি। আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে তাই করেছি। আর তোমার নামে থাকুক আর আমার নামে থাকুক। ওই কথা একই। আমার কাছে তুমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদ সম্পত্তি না।
~ আপনি সত্যিই একটা পাগল।
– হুম শুধু তোমার। তুমি নামক যন্ত্রণার। হাহা। (আবির ওকে জড়িয়ে ধরে)

জান্নাত আবিরের বুকে মাথা রেখে হাসে। আর আবির খুব খুশি হয়ে জান্নাতকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে থাকে। আজ ও অনেক খুশি। কারণ আবির জানে ও সঠিক কাজটাই করেছে। একজন বাবা হিসেবে ওর যা করা উচিত, ও তাই করেছে। আবির আর জান্নাত এখন শুধু অপেক্ষা করছে কখন ওদের সন্তানের মুখ দেখবে।

– সমাপ্ত।

—> এই গল্পটা লেখার পিছনে একটা বিশেষ কারণ আছে। আর সেটা হলো, একজন ছেলে একটা নিরীহ, অসহায় মেয়েকে পেয়ে তার সাথে খারাপ কিছু না করে বরং তার অগোছালো জীবনটা সুন্দর করে দিতে পারে। পুরো গল্পটা জুড়ে আমি সেটাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি, আবির আর জান্নাতকে দিয়ে। জানি না তা পেরেছি কিনা। তাই আমি চাই আপনারা কমেন্টে আমাকে সেটা জানাবেন। আর এও জানাবেন পুরো গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে আর কি কি শিখেছেন। আর একটা কথা, অনেকেই জিজ্ঞেস করবেন আমি এত তাড়াতাড়ি গল্পটা কেন শেষ করেছি? সত্যি বলতে আমি আমার গল্পের উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত গল্প চালিয়ে যাই। মানে গল্পের মেইন শিক্ষাটুকু আপনাদের কাছে পুরোপুরি না যাওয়া পর্যন্ত গল্পটা চলে। আর যখন সেটা আপনাদের কাছে পৌঁছে যায় এবং সে সাথে আমার উদ্দেশ্যটাও পূরণ হয়, তখন আমি গল্পের ইতি টানি। আমি সবসময়ই এমনটা করে থাকি। গল্প অনেক বড়ো করে হাজার হাজার লাইক কমেন্ট পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার গল্প লেখা না। মূলত একটা ছোট সুন্দর শিক্ষা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই গল্প লেখা। আশা করি সবার কাছে গল্পটা ভালো লেগেছে। আর এতটা সময় ধরে সাথে থাকার জন্য আমার প্রিয় সকল পাঠক/পাঠিকাদেরকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। এছাড়া খুব শিগগিরই নতুন গল্প আসছে সে পর্যন্ত সাথে থাকবেন। আর হ্যাঁ,
“ঈদ মুবারক” সবাইকে।

© আবির খান।