তোমাকে চাইবো বলে পর্ব-০১

0
1135

গল্পঃ “তোমাকে চাইবো বলে”

পর্ব- ১

১.
আমার হাত ধরে এই মুহূর্তে যেই ভদ্রমহিলা বসে আছেন আশান্বিত চোঁখে,ওনাকে অগাহ্য করার ক্ষমতা আমার কোনোকালেই হবে না।গত ক মাসে সেটা আমি বুঝেছি ওনার আন্তরিকতা আর ভালোবাসা দেখে।সম্পর্কে উনি আমার হবু শ্বাশুড়ি, অথবা কেউই নন এখন।সবকিছু খুব জটিলতায় এসে গেছে,অথচ পিছু হাঁটার উপায় নেই।
নিশ্চুপ মনে এসব ভাবতে ভাবতেই দু চোঁখ আবার ঝাপ্সা হয়ে এলো মুনার। কি করা উচিত,কি করলে নিজের স্বস্তি মিলবে,এই মানুষ গুলোর মুখে হাসি ফুঁটবে এসব মাথায় ঘুরছে মুনার।

রেবা বেগম মুনার হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো,
_দেখ মা,আমি তোকে আগেও ছেলের বউ করে নিতে চাইনি,এখনো চাইনা।আমি তো প্রথম দিন ই তোকে মেয়ে বলে ডেকেছি।তুই আমার কাছেই থাকবি এটা কেন ভাবছিস না একবার?

মুনা শূন্য দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।রুমভর্তি নিস্তব্ধতা। মুনার মা, ছোটভাই টা উৎসাহী চোঁখে দাঁড়িয়ে। ওদের দিকে চোঁখ পড়তেই মুনার কলিজাটা মুছঁড়ে উঠলো। জীবনে এই দুটো মুখ ওর সবথেকে প্রিয়।অথচ এখনো ওদের জন্য কিছুই করা হলোনা। উল্টো এক ঝড় এসে সব কেমন যেনো শ্রান্ত করে রেখে চলে গেলো। সে আর নেই,কোথাও নেই,কোথাও থাকবেনা ভুল করেও, মনে হতেই মুনা হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিলো।সবার সামনে থেকে উঠে চলে গেলো মুনা,সময় যেনো পুরো রুমটাতে থমকে গেলো হঠাৎ করেই।

নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে ঠিক কতক্ষণ চিৎকার করে কেঁদেছে মুনা জানেনা।হুশ হতেই বেরিয়ে দেখে মায়ের দু চোঁখ লাল,রেবা বেগম চলে গেছেন।বাইরে গাড়ি নেই।
মুনার মা মেহেরনূর অসহায় ভঙিতে বললেন,

_উনি তো সেই কথাই দিয়ে গেলেন রে মা।ওনার সম্মান রাখতে এবার রাজি হয়ে যা,আর কত নিজেকে যন্ত্রনা দিবি ভাগ্যের দোষ দিয়ে? আমাদের কথাটা কে ভাববে বল তাহলে? তুই এই বিয়েতে আর না করিস না মুনা,আমি আর সহ্য করতে পারছিনা তোর এই মুখ।বলেই কেঁদে দিলেন তিনি।

বেলকনিতে বসলে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়।এই আকাশের নিচেই জীবনের হিসেব নিকেশের অবাধ পরিসর।হাটুতে মুখ গুজে মুনা তার সাথে কয়েকমাসের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া সমস্ত পেয়ে হারানোর হিসেব কষছে।
কোথা থেকে শুরু করবে সে? আদিব থেকে? নাকি আদিব কে পাওয়ার আগের জীবন নিয়ে? নাকি বর্তমান নিয়ে? অথবা চারদিন পরের শুরু হওয়া আগামী নিয়ে?

এইতো ছয় মাস মাত্র,তার আগেও মুনার টানাপোড়ন এর সংগ্রামী জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছিলো।পড়াশুনার পাট চুকিয়ে একটা চাকরি করে কিভাবে পরিবারের হাল ধরবে তা ভেবেই অস্থির হয়ে পড়েছিলো।বাবাহীন পরিবারের সে যে একমাত্র ভরসা।বিয়েশাদির ঝামেলা,বা প্রেম কিছুতেই তার আগ্রহ জাগেনি এতদিনে একবার ও। স্বপ্ন দেখা কেমন হয় তাও সে ভুলে গেছে বাবার মৃত্যুর পর।মাস্টার্স এ ভর্তি হবার পর ই বিপত্তি ঘটলো।

মেহেরনূর আর কোনোভাবেই মেয়েকে ঘরে রাখবেননা।এমনিতেই কুড়ি পার হলেই মেয়েদের বিয়ের জন্য নানা অসুবিধে হয়,তার উপর এই মেয়েকে কে বুঝাবে তার বাবা নেই,খুব যে সুন্দরী সে তাও তো না,এরপর আরো বয়স বাড়লে ভালো ঘর,বর কিছুই জুটবেনা। মুনার মায়ের চিন্তা শুধু মুনার বিয়ে নিয়েই।এবার ওকে রাজি হতেই হবে।
ইদানীং মুনার মামারা নানা পাত্রের সন্ধান আনা শুরু করেছে তার অগোচরে। মুনা কিছুটা টের পেয়েও চুপ মেরে থাকছে,কারণ ওর মতের বাইরে কেউই যাবেনা এটুক ভরসা তার আছে।এর মাঝেই এক রাতে মুনার মা চায়ের কাপ হাতে মুনার রুমে এসে এ কথা সে কথা বলেই যাচ্ছেন।মুনা বইয়ের পাতা উল্টাতে যেয়ে ঠিক ই বুঝছে তিনি পরিবেশ হালকা করতে চাচ্ছেন।মুনা মুচকি হেসে বললো,
_কিছু তো বলবা,বলেই ফেলো এবার।

মেহেরনূর এর মুখটা বেশ উজ্জ্বল এবার।উচ্ছাসে ভরপুর মুখে তিনি রেবা বেগমের গল্প জুড়ে দিলেন।বিধবা রেবা বেগমের দুই ছেলে,বড়ছেলে এখন ফ্রান্সে আছেন।তার কোনো মেয়ে নেই।বড় ছেলে আদিব পড়া শেষ করে আরো আগেই সেখানে ব্যাবসা করছে,আর ছোটজন এর পড়াশুনার জন্য বছরখানেক হলো স্কলারশিপ নিয়ে মালেয়েশিয়াতে আছে। সংসারে কোনো ঝামেলা নেই,শিক্ষিত ফ্যামিলি,ঠিক যেমন টা মুনা চায়।ছেলে হিসেবে আদিবের প্রশংসায় ডুবে গেছেন মেহেরনূর। আদিবের জন্যই মুনার মামা মুনার কথা বলেছেন।
“তুই একবার তাদের সাথে কথা বলে দেখ মা,ভালো লাগলেই আমরা কথা আগাবো।তুই একটা সুযোগ দে শুধু এবার।

মুনা এক দৃষ্টিতে মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে কি ভেবে যেনো সায় দিলো।
_তা কবে আসছেন তারা?
“তারা আর কে,শুধু রেবা আপাই আসবেন।ছেলে তো আসবে চারমাস পর,এর মাঝে উনিই চয়েজ করে রাখবেন ছেলের জন্য।তুই ভয় পাস্না,উনি খুব ভদ্র আর ভালো মনের মানুষ। দেখলেই বুঝবি।
বই গুছাতে গুছাতে মুনা বললো,
–বাব্বা,তোমার রেবা আপার পছন্দ তার ছেলের পুষাবে তো মা?

“পুষাবেনা মানে,দুই ছেলেকে উনি নিজের মনের মত করে মানুষ করেছে।
_ না মানে শুনলেই তো ফ্রান্সে থাকে,এতবড় ফ্যামিলির ছেলে,কি দেখে তোমার এই বদচুরুত মেয়েকে পছন্দ করবে ভেবেছো? এটা বলেই আড়চোঁখে মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে হেসে দিলো মুনা।

” তুই কিরে মুনা,আগে থেকেই কেনো বেশি বলিস।আল্লাহ আছেন,যার কপালে যে থাকে সে আসবেই।চিন্তিত মুখেই বের হলেন মেহেরনূর।

মুনার বেশ মজা হচ্ছিলো কেন জানি।একে তো এই প্রথমবার সে কারো সামনে যাবে,তাও আবার ছেলের মায়ের পছন্দের উপর ডিপেন্ড করছে সব। এটাকে নাহয় একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই নিলো এবার।

২.
যেদিন রেবা বেগম চলে এলেন ঠিক তার চারদিন পর ই আজ মুনার বিয়েটা হচ্ছে।একি দিন ক্ষণ,একই বাড়ি, একই পরিকল্পনায়,একই বর‍যাত্রী এসেছে।শুধু বর ই একই নেই। বরের জায়গাটা জুড়ে আছে তার ই ছোটভাই নাদিব।
চারদিকে এত এত আলোকসজ্জা,এত কোলাহল,এত স্বপ্নের বাস্তবিক ছড়াছড়ি,অথচ এর মূল কর্তাই নেই আজ।আদিব নেই।সে নেই কোথাও,তার জায়গাটা কত অনায়াসেই আরেকজন দখল করে বসে আছে।কেউ কখনো জানতেই পারবেনা কত শত প্লানিং ছিলো এই একটা দিন কে ঘিরে আদিবের।আজ আদিব নেই,স্বার্থপরের মত পালিয়েছে আদিব। বিছানার চাদর খামছে ধরে গুটিসুটি মেরে বসে নিরবে কাঁদছে মুনা। ভারী গহনার আড়ালে এ কান্নার মর্মাথ লোকচক্ষু কখনোই বুঝবেনা।

বিয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে রেবা বেগম মুনাকে নাদিবের ঘরে বসালেন। নিজের এক গোছা চাবি তখনি মুনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন আজ থেকে এই ছোট্ট মা ছেলের সংসার টা তোকে দিলাম।যেটুক অবশিষ্ট আছে আমার,সেটুক তোর কাছেই সপে দিলাম।আমার যে নাদিব ছাড়া কেউই রইলোনা রে,তুই ও যদি চলে যেতি তবে আমি কি নিয়ে থাকতাম বল,তাই স্বার্থপরের মত তোকে নিজের জন্য নিয়ে এলাম। আর কত বল? এবার অন্তত নিজেকে স্বাভাবিক কর মা। নাদিব কখনো তোকে কষ্ট পেতে দিবেনা দেখিস।আমার ছেলে আমি তো জানি।

মুনা জলশূন্য নয়নে শুধু তাকিয়েই রইলো। জীবনের কত হিসেব ই তো এখনো গোলমিল।এটুক দিয়েই নাহয় শুরু টা হলো।

এই বাসাটা মুনার পরিচিত।রেবা বেগম প্রায় ই মুনাকে নিজের কাছে আনতেন সেই সুবাধে মুনার সব চেনা।বিশেষ করে আদিবের ঘর। নিজের মত করেই সাজিয়েছিলো মুনা।এই ঘরটা বড্ড অচেনা লাগছে তার।যে মানুষ টার সাথে অমিমাংসীত সম্পর্কে জড়ালো সেই মানুষ টাও খুব বেশি চেনা নয়।প্রায় সমবয়সী দুই ভাই তাঁরা।তবুও সে কি মুনাকে বউ হিসেবে ভেবেছিলো কখনো, বা কখনো আপন করে নেয়ার কথা? তার কি কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ ছিলোনা? কিছুই তো জানেনা তার সম্পর্কে মুনা।এক কি দুইবার শুধু দেবর সম্পর্কে ফোনে কথা বলা।ব্যাস।এই মানুষ টা কে মেনে না নেয়ার উপযুক্ত কোনো কারণ নেই।তার সাথে সংসার শুরু করতেও বাধা নেই।কিন্তু মন? তাকে তো দু মাসেও বুঝাতেই পারলোনা মুনা যে আদিব ছিলো ই না,আদিব নেই,সে একটা মায়া ছিলো।আর এই মানুষ টা,তার দিকটা? এভাবেও কি জীবন শুরু হয়,এমন কি চেয়েছিলো মুনা স্বপ্নেও।কি অদ্ভুত জীবন!

নাদিব রুমে ঢুকে প্রথমেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো,মুনা ঠিক একি ভাবে বসে আছে নিজের মতই।নাদিব চেঞ্জ করে বেরিয়ে সহজ গলায় ই বললো,
> যান ফ্রেশ হয়ে নিন।এভাবে বসে থাকলে আরো অস্বস্তি লাগবে আপনার।আমার রুম টা বেশ ছোটই তাইনা?

মুনা মুখ তুলে তাকালো,এই প্রথম সরাসরি নাদিব কে দেখা।লম্বা,প্রশস্ত দেহ,ফর্সা রঙ এর উপর ব্লু টিশার্ট পড়া যেনো একটা মায়া জড়ানো। হুট করে দেখেই মনে হবে বুঝি আদিব হাসছে।
মুনা তাকিয়েই রইলো, নাদিব আবার হালকা হেসে বললো,
> কি হলো, রাত হচ্ছে তো,ফ্রেশ হয়ে নিন,তারপর আড্ডা দিবো।

মুনা অবাক হলো,এত সাবলীল ভাবে নাদিব কথা বলছে কিভাবে। মুনা নেমে এসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।তার এসব কিছুই মন কাড়ছে না।এই ছেলেটার সামনে তাকে দিন রাত থাকতে হবে ভাবতেই গা হীম হয়ে যাচ্ছে।কেনো এমন হবে,কেনো নাদিবের মুখের দিকে তাকালেই সে আদিব এর ছায়া দেখতে পাচ্ছে।একটা ক্ষত কেন বারবার জেগে উঠবে প্রতিদিন ই।এর থেকে মুক্তি নেই মুনার।

একটা হালকা শাড়ী পড়ে বের হলো মুনা।দু চোঁখে যেনো পদ্ম ফুটেছে। নাদিব হাতে একটা প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকতেই চোঁখে পড়লো তার,মুনা কেদেঁছে আবার। সদ্য ভেজা গোলাপ পাপড়ির মতই লাগছে মুনাকে।এই মেয়েটাকে দেখলে নাদিব অবাক হয়ে যায়,কত কি চলছে তার ভেতর।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নাদিব ই বলে উঠলো,
>আসুন খেয়ে নিন এবার।
_ আমার ইচ্ছে করছেনা।মাথা ধরেছে,এখন খেলে বমি হবে।
> মাইগ্রেইন নিশ্চয়?
_ হুম
> তাহলে বরং অল্প খেয়ে নিন,আমি ওষুধ দিচ্ছি তারপর।
– আমি যে সে ওষুধ খাইনা।
> যেটা খান সেটাই এনে দিচ্ছি।
মুনার ইচ্ছে হলো জানতে,ওষুধ এর কথা নাদিব কিভাবে জানে,পরক্ষণেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।
_ বললাম তো ইচ্ছে নেই,আমার ঘুম দরকার একটু।
> অবশ্যই ঘুমাবেন,কিন্তু ওষুধ খেয়ে তারপর। বেশি কথা পছন্দ না আমার,বেশি বুঝাতেও পারিনা।আমি কিন্তু আদিবের মত সহ্যবান নই।

একটু রুঢভাবে কথাগুলা বললো নাদিব।আদিবের নাম শুনেই মুনার দুচোঁখ জ্বলে উঠলো তা নাদিবের চোঁখ এড়ায়নি।
_ আপনি আদিব হওয়ার চেষ্টা ও করবেন না।আমি চাইনা সে আমার আশেপাশে থাক।
খুব ক্ষোভের সাথেই নাক ফুলিয়ে বলে ফেললো মুনা।নাদিব ব্যাপারটা দেখে মজা পাচ্ছে আর ভাবছে,পাশে না থাকলেও মনে ঠিকি থাকা হয়ে যায়।

> আচ্ছা তাহলে তো চুকেই গেলো,আমি দিব্যি আমার মতোই থাকছি,আমায় নিয়ে কোনো অভিযোগ শুনবো না কিন্তু।
_ থাকুন আপনার মতই।আমার সমস্যা নেই।
> বেশ খেয়ে নিন, আমি মাকে বলে চা বানিয়ে দিচ্ছি,ভালো লাগবে।
_ ওনাকে কেনো এখন জাগাচ্ছেন।আমি বানিয়ে নিবো পরে।
> আচ্ছা,খেয়ে নিন,আমি ওষুধ খুঁজে আনি।

সবকিছুই যেনো আগের মতই,স্বাভাবিক।যেনো কোথাও কিছুই ঘটেনি দুমাস আগে।শুধু কি মুনাই পারছেনা মানতে তাহলে।একটা মানুষ কে যখন রন্দ্রে রন্দ্রে জানা হয়ে যায়,তার অভ্যেস নিজের ভেতর তৈরি হয়ে যায়,তাকে প্রবলভাবে ভালোবেসে ফেলা যায়,তাকে ছাড়া তখন দুনিয়ার বাকি সব ফিকে লাগে।

মুনা কিচেনে ঢুকতে যেয়ে দেখলো নাদিব বাইরের বারান্দায় আনমনে বাইরে তাকিয়ে।মুনা ঠিক ই বুঝলো,এই দুইটা মানুষ তার সামনেই যত স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালায়,ভেতর ভেতরে তারা আরো বেশিই ভাঙাচুরা।

৩.
কিচেনের ডানপাশ দিয়ে তাকালেই সেই চেনা ঘর,সব স্বপ্ন,স্মৃতি ওইঘরেই আজ গুমরে মরছে।মুনা হুট করেই সে ঘরে পা বাড়ালো।বাতি জ্বালিয়ে বিহ্ববলের মতই চারপাশে চোঁখ বুলালো।এক অদ্ভুত মাদকতা ছেয়ে আছে সারাঘরে।দেয়ালজুড়ে আদিবের হাসিমাখা ছবি, সব মুনাই সাজিয়েছিলো।বারবার চোঁখ ঝাপ্সা হয়ে আসছে।নিজেকে মানানো যাচ্ছেনা,হাউমাউ করে মুনা কান্না শুরু করলো।হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারছে এদিক ওদিক।নিজেকে আর কতভাবে বুঝাবে সে।কাঁদতে কাঁদতে সেই ঘরের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লো মুনা।

নাদিব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।বাইরের যত আলোকসজ্জা বাহারি বাতির খেলা সব ই তো লোক দেখানো। কে ভেবেছিলো এভাবেই তাকে সব ছেড়ে হুট করে দেশে ফিরতে হবে।আর এই বিয়ে? আদৌ কি মনে হচ্ছে সে কতবড় দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে,মুনার কথা ভেবে। মুনার ব্যাপারে নাদিব গত দু মাসে প্রচুর জানার চেষ্টা করেছে যতভাবে সম্ভব।সরাসরি কথা বলেনি কখনো আদিব যাওয়ার পর।এর আগে দুইবার ফোনে কথা হলেও তা শুধু ফর্মালিটি।অথচ কে জানতো ঘটনা এভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে তিনটা মানুষ কে নিয়ে।

আজ আদিব কে বড্ড মিস করছে নাদিব।দুই ভাই ছিলো বন্ধুর চেয়ে বেশি।এই যে মুনার ব্যাপারে যত যা জানে সে,সব আদিবের মুখে এতএত শুনেছে যে মুখস্ত হয়ে গেছে তার।মুনার রুচি,অভ্যেস,রাগ,জেদ,শখ, স্বভাব সব কিছুই আদিব এর থেকে জানা।নাদিব প্রায় ই আদিব কে ক্ষেপাতো,ভাই তুই তো দেখি হবু বউয়ের প্রেমে ডুবে আছিস এখনি, সবাই কি এমন করে রে বিয়ের আগে?
আদিব তখন গালভর্তি হেসে বলতো,
“শুন সবাই করে কিনা তা তো জানিনা।কিন্তু আমি করছি।কারণ আমার মুনা সবথেকে আলাদা।

নাদিবের গাল বেয়ে পানি পড়ছে,সে কাঁদছে।অথচ দিনের আলোয় তাকে এত হাসি খুশি দেখাতে হয় যাতে রেবা বেগম নতুন করে ভেঙে না পড়েন।আর এখন মুনার দায়িত্ব তার উপর,মেয়েটা কি কখনো ওকে ভরসা করতে পারবে, নতুন করে ভালোবাসতে পারবে,নাকি অন্য আট দশটা মন ভাঙা প্রেমিকার মতন লোক দেখানো সুখী সেজে স্ত্রীর অধিকার দিয়ে দেবে। দিলেও কি নাদিব নিতে পারবে এত সহজেই? বাইরে থাকাকালীন সেভাবে কাউকে পছন্দ করেনি সে।আদিবের গল্প শুনে প্রায় ই ভাবতো সেও মায়ের পছন্দেই বিয়ে করে এভাবে প্রেম করবে। অথচ সব ই ঠিক হলো শুধু ভিন্ন নিয়মে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।

বাইরের নিস্তব্ধতা এমন চেপে বসেছে যে মুনা ঘরে একা খেয়াল ই নেই।নাদিব স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো মুনা এখনো আসেনি কিচেন থেকে।অজস্র ফুলে সাজানো একটা বাসর কেমন অদ্ভুত শূণ্যতায় ডুবে আছে।

নাদিব কিচেনে যেতেই লক্ষ্য করলো আদিবের ঘরে আলো জ্বালা।নাদিব দ্রুত পায়ে সেদিকে গেলো, পুরো ঘরের এ কি অবস্থা।আর মুনা,সে নিচে পড়ে আছে। নাদিব দুবার নাম ধরে ডাকলো,পরে গালে হাত দিয়ে দেখলো মেয়েটা প্রায় অচেতন।

……
চলবে….