তোমাকে চাইবো বলে পর্ব-০২

0
659

গল্পঃ “তোমাকে চাইবো বলে”
পর্ব-২

নাদিব কিচেনে যেতেই লক্ষ্য করলো আদিবের ঘরে আলো জ্বালা।নাদিব দ্রুত পায়ে সেদিকে গেলো, পুরো ঘরের এ কি অবস্থা।আর মুনা,সে নিচে পড়ে আছে। নাদিব দুবার নাম ধরে ডাকলো,পরে গালে হাত দিয়ে দেখলো মেয়েটা প্রায় অচেতন।অপ্রস্তুত হয়ে কিছু না ভেবেই মুনাকে কোলে তুলে নিলো সে।শাড়ীর আঁচল মেঝেতে লুটাচ্ছে,চোখের নিচের কাজল লেপ্টে দাগ হয়ে আছে।মাথাটা নাদিবের বুকের সাথে সেটে আছে। এ এক অদ্ভুত প্রথম অনুভূতি নাদিবের,প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নাদিবের।কি পাচ্ছে মেয়েটা এসব করে।
মুনাকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অনেক্ষণ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নাদিব।বিষন্নতায় নীল হয়ে আছে যেনো মুখটা।আবার জেদ চেপে বসলো তার,রুম থেকে বেরিয়ে আদিবের ঘরের সমস্ত স্মৃতিতে চোঁখ বুলিয়ে রুমের তালা মেরে দিয়ে এলো।এসব যদি রেবা বেগম দেখেন তবে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন।মুনাকেও কিছুটা শাসন করতে হবে এবার,এভাবে আর চলতে পারেনা। জীবনকে একটা চান্স দিতেই হয়। এটা মুনার বোঝা উচিত এবার।
……….
৪.
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো মুনার,চোঁখ মেলেই এক অপরিচিত বিছানার স্বাদ অনুভব করলো।অভ্যেসবশত বালিশের পাশে ফোন হাতড়াতেই চমকে উঠলো মুনা।এতবড় বিছানার আরেকপ্রান্তে নাদিব শুয়েছে,তার গালে হাত লাগতেই মুনা উঠে নিজেকে সামলে নিলো। সাধারণত গল্প সিনেমায় দেখেছে মুনা,এরকম সম্পর্কগুলোতে কত ন্যাকামো,একজন খাটে,একজন সোফায় ঘুমায়।অথচ এই ছেলেটা দিব্যি সংকোচের মাথা খেয়ে সাবলীল ভাবেই ঘুমাচ্ছে, মুনার কিঞ্চিৎ হাসি পেলো।

ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই রেবা বেগমের পরিচিত ডাক।মুনার মন হালকা হয়ে গেলো নিমেষেই।
_ কিরে মুনু!এত সকালে উঠে এলি যে মা?
> এমনিই মা।ঘুম ভেঙে গেলো যে।তুমি কি করছো বলো এত সকালে? বলেই মুনা কিচেনে ডুকলো।
রেবা বেগম পরোটা ভাজতে ভাজতে হাসছেন,
_ এই যে,চা বসালাম। নাদিব কে তো জানিস না তুই,চোঁখ খুলতেই তার চায়ের ধোয়া উঠা চাই বুঝলি।
> তাই বলে তুমি এত ভোরে কিচেনে ডুকে যাবা নাকি,সুফিয়া কি আসেনি আজ?
_ সুফিয়া? ওর হাতের চা খাবে নাদিব? তবেই হলো।
শুনেই মুনা মজা নেয়ার জন্য বললো,
> ওহ আচ্ছা,দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা চা টা বুঝি তুমিই বানাও? আজ তবে আমিই বানাচ্ছি, দেখি কে না খায়।
এই বলেই চা বানাতে লেগে গেলো মুনা।

রেবা বেগম হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন।এই মেয়ের সাথে ওনার সম্পর্ক টা বউ শ্বাশুড়ি কম,বান্ধবী বেশি। সেই প্রথম দেখে আসার পর থেকেই মুনার জন্য আলাদা টান তার।সব কিছু মুনাকে শেয়ার করা,ফোনে এত এত কথা বলা,আড্ডা,মজা, শপিং,একসাথে মুনার ক্যাম্পাসে ঘুরে আসা সহ এ ক মাসে সব ই করেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে মুনা নিজেই অবাক হয়ে যায়, তার দ্বিগুন বয়সী এক মহিলা কিভাবে তার সাথে এত কম্ফোর্ট ফিল করেন।হয়তো দীর্ঘদিনের একাকিত্বের পর কাউকে মনের মত পেলেই মানুষ এমন আপন করে নেয়। এসব ভাবতে ভাবতেই রেবা বেগমের দুচোখ ভরে আসলো।

এতবড় বাড়িতে মানুষ বলতে তারা তিনজন।এখন কিছু অতিথি থাকলেও সন্ধ্যার পর সবাই চলে যাবে।সুফিয়া সারাদিনের কাজ সেরে নিজের বাড়ি চলে যায়।রেবা বেগম এখন একা নয়,মুনা আর নাদিব তার আশেপাশে থাকবে সারাক্ষণ ভাবতেই ভালো লাগে তার।

চা বানিয়ে সবাইকে দিতে যেতেই রেবা বেগম মানা করলেন।
_ শুন, এত ফর্মালিটি করতে হবেনা তোর।এসব আমি দেখবো।তুই আগে দুজনের জন্য চা নাস্তা নিয়ে ঘরে যা।নাদিব উঠে যাবে এবার।
> তুমিই যাও না।আমি এখানে সবার সাথে একটু বসি?
_ বাব্বা,এত মুরুব্বি সাজতে হবেনা।যা বলছি তা করো,যাও।আর শুন, ও না উঠলে একটু ডেকে দিস।
মুনা দ্বিধায় পড়ে গেলো। কি বলে ডাকবে সে? একটা অপরিচিত ব্যক্তিত্ব,যার সম্মুখে দাড়াতে হলে হাজারটা ক্ষত জেগে উঠে,তাকে কি ডাকা যায়?
মুনা ট্রে হাতে রুমে এলো।দেখলো নাদিব বাথরুমে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো মুনা।এসব ডাকাডাকির সম্মোধন বিব্রতকর এখন।

নাদিব একটা টাওয়াল পরে ভেজা চুলে বেরিয়ে এলো। মুনা শব্দ শুনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো, তার চেয়েও বেশি অবাক হলো নাদিবের নির্বিকার ভঙ্গি দেখে।কি সাবলীল ভাবে একটা হাসি দিয়ে মর্নিং জানালো মুনাকে।তারপর নিজের ঘরে হেটে হেটে নিজের টিশার্ট প্যান্ট খুঁজে নিলো।মুনা এমন বিস্মিত হচ্ছে যে বেরিয়ে যাওয়া উচিত কিনা তাও ভুলে গেলো।নাদিব গুনগুন করতে করতেই মুনার পেছনে বসে জামা প্যান্ট পরে নিলো।এ কি মানুষ না ভিন গ্রহের এলিয়েন বুঝলোনা মুনা।লজ্জাসরমের বালাই নাই।বাইরে থেকে থেকে কি সব কিছুর মাথা খেয়েছে নাকি।

_ হাহা,কিচ্ছুর মাথা খাইনি ম্যাম।আমি এসবে অভ্যস্ত,এবার আপনাকেও আমার এসব দেখতে অভ্যস্থ হওয়া উচিত। মুনার সামনে এসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতেই বললো নাদিব।
মুনা আবার অবাক হলো,আপনি কি মাইন্ড রিডার?
_ উহু,কিন্তু আপনার চেহারায় এমন ম্যাপ হয়ে আছে যে অনুমান করেছি কি ভাবতে পারেন। বাই দ্যা ওয়ে,চা ঠান্ডা হয়ে গেছে।কাল থেকে চা এনেই ডাক দিবেন।
> আমি কেন আনতে যাবো,আজ মা পাঠালো বলেই এনেছি।মুনা রাগের স্বরে বললো।কি পেয়েছে এই লোক,নিজ মর্জিমাফিক চলবে নাকি সব।
_ আমি মা ছাড়া কারো হাতে চা খাইনা সকালে।এখন বউ হয়েছে তার দায়িত্ব এটা,মায়ের ছুটি।আর হ্যাঁ শুনুন,আমি চায়ে এক চামচ চিনি খাই।

হঠাৎ মুনার মনভার হয়ে গেলো। সকাল থেকে সব স্বাভাবিক ছিলো।আদিব দু চামচ চিনি খেতো চায়ে,এটা শুনে শুনে মুখস্ত মুনার।আজ সে দুই চামচ দিয়েই বানিয়েছে।অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
নাদিব আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো এতক্ষণের তার চাঞ্চল্যে বিরক্ত হয়ে উঠা মুখে এবার মেঘ জমেছে। এই মেঘ কখন কাটবে নাদিব জানেনা,তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেয়া যাবেনা।
চায়ের কাপ রেখে নাদিব বললো, শুনুন,বাইরে মেহমান অনেক।এই চেহারা নিয়ে বেরুবেন নাকি একটু সাজগোজ করবেন?
মুনা এবার রেগেই গেলো,
> এই,কি পেয়েছেন আপনি? সেই তখন থেকেই নিজ মর্জি চালাচ্ছেন,আমার এই চেহারা আগে দেখেননি? সাজতে হবে কেন? এই চেহারায় চললে চলবে নয় রাস্তা মাপেন।
ভীষণ রেগে গেছে মুনা,শ্যামবর্ণ মুখটা লাল হয়ে গেছে।নাদিব মজা পাচ্ছে,মুনা নিজেই জানেনা ও কত কি বলে ফেলছে,কথার মাঝে কেমন একটা অধিকারবোধের গন্ধ পাচ্ছে নাদিব।এই অধিকারবোধ যত তাড়াতাড়ি জন্মাবে তত তাড়াতাড়িই তারা দুজনে স্বাভাবিক সম্পর্কে অন্তত একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আসতে পারবে।

৫.
সারাদিনের ব্যস্ততার জন্য মুনা নিজের জন্য আর সময় পায়নি।সন্ধ্যার পর নিজের রুমে বসে বসে গয়না খুলতে খুলতে ভাবছে সারাদিনের কথা।সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মুনার মায়ের কথা।যাবার আগে মুনাকে জড়িয়ে ধরে শুধু একটা কথাই বললেন,
‌_ ছেলেটাকে অন্তত খুশি রাখিস মুনা। ভীষণ আপন করে নিতে পারে ছেলেটা, মনে রাখিস মা,তোর একান্ত ব্যক্তিগত বলতে এখন নাদিব ই আছে।আর কেউ নেই।
মাথার ভেতর এক কথাটাই ঘুরছে,একান্ত ব্যক্তিগত! আর কেউ নেই তার মত। কিন্তু কেউ একজন তো ছিলোই,ব্যক্তিগত তো সেও ছিলো,থাকলো না কেন সে?
মুনার বেশ ভালো লেগেছে আজ নাদিব কে,যতই চঞ্চল হোক,মুনার মা আর ভাইকে নিজের মত করে যত্ন করেছে।যেনো কতদিনের পরিচিত। মুনাদের পক্ষের আত্মীয়রা সবাই বলাবলি করছিলো,মুনার মায়ের ভাগ্য ভালো। জামাই হয়েছে দশজনের একজন।
মুনার ভাই মিরান তো নাদিব ভাইয়া বলতে অন্তপ্রাণ একদিনেই। দুজন মিলে সারাক্ষণ এটা ওটার প্লান করেই যাচ্ছে আর আড়চোখে নাদিব মুনাকে দেখছে। সকালে নাদিব যাওয়ার পর মুনা জেদ ধরেই খুব সাজেনি।হোক সে শ্যামবর্ণা, তাই বলে কি সুন্দর না? এতই যদি সুন্দরী দরকার তো আমাকেই কেন বিয়ে করলো।
মুনা যখন বের হলো তখন নাদিব পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে এদিক সেদিক কাজকর্ম দেখছিলো।হঠাৎ চোঁখ পড়লো মুনা আসছে মায়ের সাথে।একটা জামদানী শাড়ি ছিমছাম শরীরে পরিপাটি বসে আছে,বড় একটা খোপায় কিছু ফুল দেয়া,সিম্পল সাজের মুখ, আয়ত চোঁখে দেবীর মত টানা কাজল,শ্যামবর্ণে যেনো এক মায়া ফুটে আছে।নাদিব তাকাতেই মুনা মুখ ফিরিয়ে নিলো।
মুনার মুখে হাসি ফুটলো ভেবেই। তখনি নাদিব ঘরে এলো। পাঞ্জাবির বাটন খুলতে খুলতে বললো,
_ কি ব্যাপার একা একা হাসার কারণ কি?
মুনা গয়না বাক্সে রাখয়ায় ব্যস্ত হয়ে বললো,
> হাসতেও বারণ? ইচ্ছে হলো বলে।
_ হুম,এরকম সারাক্ষণ ই হাসবেন,যাতে বাড়িটা প্রাণ ফিরে পায়। আর হ্যাঁ, বেলিফুল পাওয়া যায়নি বলে আনা হয়নি।নেক্সট টাইম হবে।

> তার মানে গোলাপ গুলো আপনি পাঠিয়েছেন?
হুম
> বেলিফুলের কথা তো বলিনি আমি,কিভাবে জানলেন?
_ বড্ড বেশি কথা বলেন,এসিটা ছাড়ুন তো
মুনা ভাবুক হয়ে ফিরে তাকাতেই,
> উফফ,আপনি আবারো খালি গায়ে।কি হচ্ছে এসব?
নাদিব নিজের জিম করা বডি আর বুকের দিকে তাকিয়ে বললো মজার সুরে , কেনো,আমায় কি খালি গায়ে দেখতে বিশ্রি?
> তা হবে কেন,আপনি তো মাশাল্লাহ সালমান খান কে ফেল করবেন।কিন্তু নায়ক সাজার জন্য যার তার সামনে কেনো এভাবে উদাম হয়ে যান? যান টিশার্ট পড়ুন এক্ষুনি।
_ পারবো না।ভীষণ টায়ার্ড বলে নাদিব চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো, মুখে বালিশ গুজে বললো,এই যে ম্যাম,আমি যার তার সামনে শরীর দেখাই না।বউ কে দেখাইছি শুধু,বউকে।ওকে?

মুনা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। লোকটা এমন কেন।যা মুখে আসে বলে দেয়,দেখে মনে হয় গম্ভীর কিন্তু কাজে মোটেই না। আর এভাবে বারবার বউ বউ করার মতলব কি? অধিকার চাচ্ছে নাকি? মুনা শাড়ি হাতে বাথরুমে চলে গেলো। এত সহজে কি পারবে মুনা তার সাথে মানিয়ে নিতে সম্পর্ক টা।

নাদিব বালিশ সরিয়ে গম্ভীর হয়ে ভাবছে,মুনার উপর এভাবে প্রভাব বিস্তার না করলে সে আরো গুমরে থাকবে।বরং এভাবেই চলুক। অধিকার চায়না সে,কিন্তু সম্পর্কের জট খুলতে চায়।একটা বন্ধুত্ব চায় যা মুনাকে স্বাভাবিক সম্পর্কে আগ্রহী করবে। দায়িত্ববোধ থেকে নয়, টান থেকে দাম্পত্য শুরু হোক।

গোসল সেরে বারান্দায় যেয়ে বসলো মুনা।বারবার মনে পড়ছে কাল রাতে কি হলো সেসব।কেমন পাগলামি করে বসলো আচমকা আদিবের ঘরে।নাদিব বা মা কি ভাবলো?
চারপাশ কেমন কোলাহলমুক্ত।এমন নির্জনতা বড় বেশি ছোয়াছে।যাকে তাকে চেপে বসে,তার চেয়ে বরং মায়ের কাছে যাওয়া যাক ভেবে উঠতে লাগলো তখনি নাদিব এলো।
_ নিন কফি
আপনি বানিয়েছেন?
_ হুম,
এ সময় কফি আমার প্রিয়।
_ জানি
কিভাবে?
– ঠান্ডা হচ্ছে, খান
আচ্ছা একটা কথা বলি?
_ হু
কাল ওইঘর থেকে কে আনলো আমাকে?
_ কে আনতে পারে?
বলুন না
_ আমিই
মা খুব কষ্ট পেয়েছে?
_ তো? আপনিও তো কষ্টে আছেন
আসলে…
_ মা জানেন না কিছুই। কষ্ট টা আপনার একার নয়,আমি সাতাশ বছরের লক্ষ লক্ষ মুহূর্তে ঘেরা সম্পর্ক হারিয়েছি।আমার ভাই হারিয়েছে।যাকগে, আমি তালা বন্ধ করেছি রুমে,আশা করি ও ঘরে আর যাবেন না।
মুনা চুপচাপ

– আমি আর আদিব পিঠাপিঠি ভাই।সবাই ভাবতো জমজ।আমাদের অভ্যেস,রুচি,স্বভাব প্রায়ই মিলতো না।মা এজন্য বিপাকে পড়তেন। এ উত্তরে গেলে আমি দক্ষিনে। ও গম্ভীর আমি চঞ্চল।এতসবের মাঝেও দুইভাইয়ের মাঝে একটা প্রেম ছিলো, এমন কোনো সিক্রেট নেই যা একে অন্যের জানিনা। আমাদের সম্পর্ক টা এমন গাড় হলো বাবা নিখোঁজ হবার পর।যখন অনেকবছর পর্যন্ত আমরা বাবাকে আর পাইনি।বাবা ফ্রান্স থেকে ফিরেন নি আর। মা একসময় সব আশা ছেড়ে আমাদের দুইভাইকে মানুষ করতে সদা শক্তপোক্ত সাজতেন।আমরা সবই বুঝতাম কিন্তু। ভেতর ভেতরে মায়ের ভীষণ অভিমান,কষ্ট। আমরা ছেলেরা ক্যারিয়ারে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, মায়ের পাশে থাকা আর হয়নি। আদিব একদিন জেদ ধরলো সেও ফ্রান্সে যাবে,বাবাকে হয়তো ফিরে পাবে এই আশা তার।মায়ের সেদিন সমস্ত অগ্নিরূপ দেখেছিলাম দুজনে।এত বছরের সমস্ত ক্ষোভ মা আমাদের উপর ঝাড়লেন।তার একটাই ভয়,আমাদের না হারিয়ে ফেলে,আমরাও যদি না ফিরি? কি অদ্ভুত নরম মন মায়েদের তাইনা মুনা?

এক নাগাড়ে এসব বলে বাইরে তাকিয়ে রইলো নাদিব।মুনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাদিবের দিকে,নাদিবের দু চোঁখ জ্বলছে তারার মতন। মুনা খেয়াল করলো এই প্রথম নাদিব মুনা বলে ডাকলো। খুব সাধারণ উচ্চারণ কিন্তু বিশেষ কিছু ছিলো যা মুনার ভেতর ভয় ধরিয়ে দিলো।

মুনা ভাবতে লাগলো, আসলেই তো,কষ্ট তো ওর একার না।ও চার মাসের সম্পর্ক হারিয়ে মনে হচ্ছে জীবন এর গতিই হারিয়ে ফেলেছে,মনে হচ্ছে এ জীবনে আবার কাউকে ভালোবেসে এত আপন করতেই পারবেনা,হয়তো মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।কিন্তু এই মানুষ টার সাথে তো আদিবের সাতাশ বছরের সম্পর্ক। বলতে গেলে তারা একই দেহ একই মন।তাহলে সে মানুষ টা কিভাবে বুঝাচ্ছে নিজেকে?
কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙে মুনা বললো,
তারপর কি হলো?
নাদিব কফির মগ নামিয়ে আবার বলতে লাগলো,
_ তারপর ছেলের জেদের কাছে মা হার মানতে বাধ্য হলো,আমি তখন ভার্সিটিতে পড়ি।অনেক ঝামেলা পেরিয়ে আদিব যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। আমি বেশ খুশিই ছিলাম,ও গেলে আমাকেও নিয়ে যাবে এই ভেবে।কিন্তু মায়ের আর কান্না শেষ হয়না।একদিন আদিব চলেও গেলো। ঠিকমতো কাজকর্ম ও করতে লাগলো। ফ্রি হলেই আমাকে আর মাকে কল করে জ্বালাতো। সারাদিন কি করলো,কি খেলো,কি দেখলো সব আমাকে তিল তিল করে না শুনালে ওর যেনো স্বস্তিই মিলতোনা।দুইভাই রাতভর প্রেমিক প্রেমিকার মত চ্যাটিং এ আড্ডা দিতাম।
বলতে বলতেই হেসে ফেললো নাদিব।

মুনা তাকিয়ে রইলো সেই উজ্জ্বল মুখের দিকে।খোচাখোচা দাড়ির ভেতর পাতলা দুই ঠোটে হাসি টা যেনো কেউ যত্নে মাখিয়ে রেখেছে।এ-ই অন্ধকারেও যে কেউই এই মুখের মায়ায় জড়িয়ে যাবে।মুনা নিজেকে সামলে নিলো।

> মা এসব আমাকে বলেনি কখনো, অথচ সব ই শেয়ার করেন।
_ মা কাউকেই তার অভিমান বুঝতে দেয়না।আমাদের যখন বারো তেরো বছর,তখন ই বুঝতে পারি বাবা আমাদের সাথে নেই।মা নিজেকে বিধবা বলে পরিচয় দিতেন।আমরাও বেশ মানিয়ে নিয়েছি সব,কখনো মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেসের সাহস হয়নি।কারণ মা ছিলেন ই তেমন গম্ভীর ব্যক্তিত্বের।
> মা ভীষণ ভালো আর একাকিত্বে ভুগেন।এটা বুঝেছি সেদিন ই,যেদিন থেকে মা আমার সাথে ঘুরতে যেতেন,বাসায় ডেকে আড্ডা দিতেন,ওনাকে তুমি বলে বলতে বলতেন, সব শেয়ার করতেন।ছেলের বউ এর সাথে কজন এমন করে?

_ হু,জানি।আমি যখন হঠাৎ করে স্কলারশিপ নিয়ে চলে যাই,তখন থেকে মা ভীষণ একা।সময় দিতে পারতাম না তেমন ফোনেও।আদিব তখন সময় দিতো।আর তখনি মা আদিবের জন্য পাত্রী খুজছিলেন,হয়তো বা নিজের জন্য ও কাউকে।আর আপনাকে পেয়েও গেলেন।

> মুনা লজ্জা পেলো কিছুটা। আসলে আমিও ভাবিনি প্রথমবারের দেখাতেই আমাকে ওনার ভালো লেগে যাবে। আমি তো দেখতেও বেশ সুন্দরী না,তার উপর ফ্যামিলিতে বাবা নেই।

নাদিব মুনার দিকে তাকালো,একদিকে তাদের মিল আছে,দুজনেই বাবা হারা। কফির মগ হাতে নিয়ে রুমে আসার সময় নাদিব বললো, আপনি কিন্তু অসুন্দরী না,বরং একটু বেশিই মায়াবী।

মুনা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো, নাদিব মায়ের ঘরে চলে গেলো। মুনা গ্রিল ধরে রাতের আকাশ দেখতে লাগলো। আজ ওদের বিয়ের দ্বিতীয় রাত।কত অদ্ভুত ভাবে কেটে যাচ্ছে।যতটাও খারাপ কাটবে ভেবেছে ততটা খারাপ নয়।প্রকৃতি অবস্থার সাথে সব মানিয়ে নিতে যোগ্য করে তুলে।একা একা থেকে মাথার ভেতর যেখানে শুধু আদিব ঘুরতো,সেখানে এখন আরো দুটো মানুষ ঘুরছে,মা আর নাদিব।সারাক্ষণ যে মানুষ টা চোখের সামনে ঘুরে তার অস্তিত্ব তত বেশিই প্রভাব ফেলে। অস্বাভাবিক না। মুনাও চায় সব স্বাভাবিক করতে, নাদিবের সাথে ফ্রেন্ডলি হতে,মন টা কে হালকা রাখতে।তার এখনো পড়াশুনা বাকি,কিছু করতে হবে মা আর ভাইয়ের জন্য। তার শ্বাশুড়ি এতে বাধা দিবেনা কখনোই,সে জানে।

শ্বাশুড়ির রুমে যেতে দেখলো তিনি কাপড় গুছাচ্ছেন।মুনা ডাকলো,
মা
হু,আয়
> এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি,কই পরতে তো দেখিইনি তোমাকে।
_ হু,দেখার জন্য তো এসে বসে ছিলি তুই।
> হিহি,কম ও আসিনি।
_ আমি নিজের গা সামলে চলতে পারিনা আবার শাড়ি। এখন তুই এসেছিস,তুই একদিন একটা করে আমাকে পরে দেখাবি,বুঝলি।
> আমি?
কে পরবে শাড়ী,এই মহিলা? নাদিব ফোন টিপতে টিপতে ডুকেই চ্যাতিয়ে দিলো।
_ হ্যা পড়বে,কি হইছে তাতে শুনি?
এসব ওনারে দিয়া হবেনা মা,বাদ দাও।মায়ের বিছানাতেই শুয়ে পড়লো নাদিব।
মুনার গা জ্বলছে এবার, এই ছেলে ওরে মহিলা বললো কেন,ও কি মহিলাদের মত?
_ বাবু,তুই কি ওরে বাচ্চা ভাবিস,ও সব পারে।
_ হ্যাঁ তা তো দেখলাম,আজ তিনজন মিলে শাড়ি পরাইছিলো,সে খবর রাখো?
নাদিবের কথা শুনে বউ শ্বাশুড়ি হা হয়ে গেলো।
> ওই আপনি কিভাবে জানেন এসব?
_ ওইতো,তখন রুমে যেতে চাইলাম তখনি দেখলাম।
> দেখলে মা,তোমার ছেলে কেমন চোর?
_ হাহাহা,তোরা দুইজন যা রুমে গিয়া চুলাচুলি কর,আমি ঘুমাবো এবার।
_ আসো ঘুমাই,চুল গুলা টেনে দাও তো মা।
_ মাইর চিনস? মুনা একা ভয় পাবে,যা উঠ এবার।
_ আমার চুল গুলা…
_ বউকে বলতে পারিস না।যা তো মুনা ওরে নিয়া যা।

মা ছেলের কান্ড দেখে মুনার ই হাসি পাচ্ছে, তোমার ছেলে তোমার কাছেই থাক।আমি ওসব ভয় টয় পাইনা।হেসে চলে গেলো মুনা।

রেবা বেগম নাদিবের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, মেয়েটাকে আঘাত করে কথা বলিস না বাবু।বড্ড ভাঙাচুরা মন আগে থেকেই।বুঝতে দেয়না কাউকে,গুমরে থাকে।
_ ঠিক তোমার মতই,তাইনা মা?
ছেলের এমন কথায় রেবা বেগম অপ্রস্তুত প্রায়।যে ক্ষতগুলা তিনি যত্নে লুকিয়ে গেছেন এত বছর,তা এই শেষ বয়সে ছেলেকে বুঝতে দিতে চান না তিনি।

৬.
রুমে এসে মুনা শুয়ে পড়লো নাদিব আসার আগেই।নয়তো পরে ঘুম ই আসবেনা।যতই বিয়ে হয়ে যাক,সংকোচ লাগে।নাদিব এসে ভাবলো মুনা ঘুমিয়ে গেছে,আলমিরা থেকে নতুন কাঁথা বের করে মুনার গায়ে তুলে দিলো।মুনা স্তব্ধ হয়ে রইলো।

নাদিব লাইট অফ করে অন্য পাশে যেয়ে ইয়ারফোন গুজে শুয়ে পড়লো। মুনা সব টের পাচ্ছে,আর ভাবছে নাদিব ওকে কেনো বিয়ে করতে রাজি হলো? তার নিজস্ব পছন্দ কেমন মুনা জানেনা। শুধুই কি মায়ের কথা শুনতেই রাজি হয়ে গেলো? মুনার প্রতি কি তার দুর্বলতা তৈরি হবে কখনো? একসাথে থাকলে তো অচেনা মানুষ এর প্রতিও মায়া জন্মে যায়,সেখানে দৈহিক কাম জাগা তো স্বাভাবিক ই।কিন্তু সেটা তো ভালোবাসা না।
বিয়েটা করেছে যেহেতু সেটা জেনে বুঝেই করেছে নাদিব,সংসার করার জন্যই করেছে।জীবন তো সিনেমা নয় যে বিয়েটা হালকাভাবে নিবে।মুনাও জানে,একদিন নাদিবের কাছে ধরা দিতে হবে,এটাই উচিত,সব শুরু করা আবার। অন্য আট দশটা এরেঞ্জ মেরেজ হলে মুনা নিজেই প্রথম দিন থেকে সব মেনে নিতো হয়তো, কিন্তু এখন তো সব ধোয়াশা,সংকোচ,মনের ভেতর আরেকজনের অস্তিত্ব।এভাবে কি কাউকে মেনে নেয়ার মানে হয়। মুনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো,সবার আগে নাদিবের দিকটা ক্লিয়ার হতে হবে।তারপর নতুন করে শুরুর কথা,আদৌ চেষ্টা করে সফল হবে কিনা জানেনা মুনা।
.

প্রায় মাঝরাত, বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি,কাচের জানলা ভেদ করে সেই চুরমার শব্দ ভেতরে তেমন আসেনা।হঠাৎ করেই মুনার ফোন বেজে উঠলো। মুহুর্তেই মুনার ঘুম ভেঙে যায়,সে উঠে বসে তটস্থ হয়ে ফোন রিসিভ করতেই পরিচিত সীম অফিস থেকে কল। মুনার আচমকা হুশ ফিরে,কিসের জন্য সে এমন মরিয়া হচ্ছিলো, এসময় আর কেউই কল করবেনা কোনোদিন।কক্ষনো না। মুনার বুকটা শূণ্য হয়ে গেলো, হাটুতে মুখ গুজেই ফোপাঁতে শুরু করলো। তার খেয়াল নেই পাশে একজন আছে।
আচমকা নাদিব টের পেলো কেউ কাঁদছে।পাশ ফিরে ফোনের আলো ফেলতেই অবাক।সে তো কিছুই করেনি,মুনা কেন কাদছে তবে?

উঠে বসে মুনাকে ডাকলো,কি হয়েছে জানতে চাইলো।মুনার কান্না বেড়েই চললো, নাদিব বুঝতে পেরেছে কি হচ্ছে।ওকে থামাতে মুনার বাহুতে হাত রেখে তাকাতে বললো।
মুনা ক্রমশ কান্নার গতি বাড়াচ্ছে।নাদিবের প্রচন্ড খারাপ লাগছে এবার,রাগের মাথায় ধমকে উঠলো মুনা বলে।
মুনা ভয় পেয়ে তাকিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো নাদিবের বুকে।বুকফাটা কান্নার সাথে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাইলো নাদিব কে।যেনো নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারলেই বাঁচে।নাদিব অবাক বিস্ময়ে বসেই রইলো, কি হলো মেয়েটার।মুনার শরীর কাপুনি দিচ্ছে, নখগুলো গেঁথে যাচ্ছে নাদিবের পিঠে,সাথে নাড়িয়ে দিচ্ছে নাদিবের ধৈর্যকে।
মুনার প্রতিটা হার্টবিট নাদিবের বুকে ধাক্কা খাচ্ছে,এ এক অসহ্যকর অবস্থা,বেশিক্ষণ সামলে রাখা যায়না শরীরের শিরা উপশিরা।নাদিব চাইছে মুনা ছেড়ে দিক এবার,কিন্তু মেয়েটা ফুপিয়েই যাচ্ছে।নাদিব আর পারলোনা,দুহাতে চেপে ধরলো মুনাকে শক্ত করে,মুনার চুলে নাদিবের মুখ ডুবে আছে,বুকের ভেতরটা যেনো কেমন হচ্ছে,কান্না পেয়ে গেলো নাদিবের। এক হাতে মুনার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে অন্য হতে মুনাকে আগলে নিলো।কেন এমন হচ্ছে নাদিব বুঝতে পারছেনা,সে কি ভালোবাসে মুনাকে? কিন্তু কিভাবে,কখন হলো এসব ভেবেই নাদিব দিশেহারা।

নাদিব আনমনেই প্রশ্ন করলো,
_কি হয়েছে মুনা? মিসিং হচ্ছে?
মুনা মুখটা ফোপাঁতে ফোপাঁতে একটু তুলে নাদিবকে ফোন দেখালো,একটা..একটা কল এসে…
_কল?…
_ আমি কি করবো আর,আমি তো চাই সব ভুলে থাকতে, নতুন করে বাঁচতে,আমি যে পারছিনা আর এভাবে।
মুনার আর্তনাদ নাদিবের বুকে লাগছে,মেয়েটা স্বাভাবিক হতে চাইছে,কিন্তু পারছেনা।
_ আচ্ছা চুপ এবার,চুপ।
নাদিব মুনার মাথাটা বুকে টেনে নিলো আবার।
এভাবে কেদোনা প্লিজ, তুমি এমন করলে মাকে কে বুঝাবে মুনা? আর আমি? আমিও তো কষ্ট পাচ্ছি।

বেশ অনেক্ষণ পর মুনা শান্ত হলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতেই লজ্জা হচ্ছে মুনার,কেন নিজেকে সামলাতে পারেনা সে,রাগ হচ্ছে নিজের উপর।
মুনা শান্ত হতেই নাদিব বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো,
_পানি খাবে?
হু
_আচ্ছা বসো,আমি লাইট অন করি।
_প্লিজ লাইট অফ থাকুক না,চোঁখ জ্বালা হচ্ছে।
নাদিব বুঝতে পারলো মুনার সংকোচ হচ্ছে,সে অন্ধকারেই পানির বোতল এনে দিলো।

সকাল থেকেই নাদিবের মন ফুরফুরে। মনের ভেতর কোথাও যেনো একটা ভালো লাগা,ভালো থাকার রেশ ছড়াচ্ছে।এক আধটু মুনা কে দেখলেই বুকের ভেতর খচ করে উঠেছে। এটা কখন থেকে শুরু হয়েছে নাদিব জানেনা,কিন্তু মন্দ লাগছেনা।

….
চলবে…

লেখাঃ Mehtarin A Hiya