তোমাকে চাইবো বলে পর্ব-০৫

0
591

#তোমাকে_চাইবো_বলে
পর্বঃ৫

খুব ভোরে শরীরে খুব গরম ভাপ লাগতেই জেগে গেলো মুনা।নড়তে গিয়ে টের পেলো সে নড়তে পারছেনা।কেউ একজন তার কাধে মুখ গুজে আছে।মুনা হকচকিয়ে গেলো। হাত দিয়ে নাদিব কে আস্তে ঠেলে সোজা করে শোয়ালো।একে ত নাদিবের খালি গা দেখে মুনার অদ্ভুত লাগছে,অন্যদিকে দেখলো খুব জ্বর।হঠাৎ মনে পড়লো রাতে তো নাদিব খালি গায়েই ছিলো, হয়তো জ্বরের ঘোরেই কাছে চলে এসেছে। সমস্ত চিন্তা সরিয়ে নিজেকে হালকা করে বেরিয়ে এলো বারান্দায়।মনে পড়ে গেলো কাল রাতে সে এখানেই ঘুমিয়ে গেছিলো। লোকটা কি ওকে আবারো কোলে করেই নিয়ে গেছিলো? লজ্জা হচ্ছে নিজের অজান্তেই।কিন্তু কেনো? লোকটা তো তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো কাল রাতেই।তবে কেন এসব মায়া দেখাতে আসে আবার।মুনা চুপ করে কিচেনে এসে চা বসালো।

শ্বাশুড়ি কে চা দিতে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন নাদিব কখন ফিরেছে?
“বেশি দেরি করেনি।
” তুই কি আমাকে বুঝাচ্ছিস মুনা?আমি জিজ্ঞেস করেই ছাড়বো আজ ওকে।
“থাক না মা।ভিজে আসায় জ্বর এসেছে দেখলাম।তুমি কিছু বলোনা আর। আমি ওষুধ বের করে দিয়ে যাবো,নাস্তা করলে তুমি খাইয়ে দিও।
” তুই কি আজ বের হবি?
“হ্যাঁ মা।এই কদিন ক্লাস মিস করা যাবেনা।
” আচ্ছা বেশ।তুই তাহলে রেডি হয়ে নে, গাড়ি নিয়ে যাস।
“গাড়ি লাগবেনা মা,এইটুকুই তো পথ।রিক্সায় যেতে আমার ভালোই লাগে। তুমি সুফিয়া আসলে রান্নাঘরে যেও,নিজে নিজে করোনা সব।আমি যাই

নাদিব ঘুমোচ্ছে,মুনা রেডি হয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখলো অনেক গরম গা।ওষুধ বের করে টেবিলের উপর ই রাখলো মুনা। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মনের ভেতর কতগুলো এলো মেলো চিন্তা ঘুরছে।গেটের সামনে রিক্সা থামতেই মুনা ভাড়া মিটিয়ে কিছুক্ষণ চারপাশে দেখলো।বারবার মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফলো করছে। কাউকে সন্দেহভাজন মনে না হওয়ায় সে ক্লাসে ডুকে গেলো।
..
রেবা বেগম গরম স্যুপ বানিয়ে ছেলের ঘরে এলেন।গা ছুয়ে দেখলেন জ্বর একটু কম।ডেকে তুলে নিজ হাতে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন।কিছু জিজ্ঞেস করবেন না ভেবেও বলেই ফেললেন,

‌”সারারাত কোথায় ছিলি তুই? কোথা থেকে এমন ডুবে চুবে এসে এখন জ্বর বাঁধালি।
“আসলে মা,হুট করেই আর্জেন্ট কল আসলো যে না বলেই যেতে হলো। আমাকে একটু মালেয়শিয়া যেতে হচ্ছে কদিনের জন্য।
“মানে,তুই না বললি একেবারেই আসবি,আবার কেনো যাবি।
“ওটা তো তখন তোমাকে শান্ত করতে বলেছিলাম।আমার ওখানকার প্রজেক্ট কমপ্লিট না করেই তো আসা লাগলো। এখন সে ব্যাপারেই যেতে হচ্ছে।কাল ওসব কাগজপত্র ঠিক করতেই লেট হয়ে গেলো, গাড়ি নিই নাই ব্যাস পুরো ভিজে সারা।
“মুনা জানে এসব? ও কি মত দিয়েছে?
“আর জানবে সে,আসা মাত্রই বকা শুরু, আমাকে সুযোগ ই দিলোনা কিছু বলতে।এখন বলবো বুঝিয়ে, কই তিনি?
“ওর ক্লাস আছে,চলে গেছে। তোর জন্য ওষুধ রেখে গেছে,খেয়ে শুয়ে থাক।

নাদিবের মন খারাপ হয়ে গেলো, জ্বর তো দেখেই গেছে,কোথায় একটু স্বামীর সেবা যত্ন করবে,কাছাকাছি থাকবে, তা না।আজ যেতে হবেই? পরক্ষণেই ভাবলো ঠিক ই করেছে, কাল রাতে আমি যা মুখ ফসকে বলেছি তার জন্য এটাই উচিত। মুড অফ করে শুয়ে পড়লো সে।হঠাত মনে পড়ে গেলো কাল রাতের ঘটনা গুলো। ভাবতেই নাদিবের ভালো লাগা আর ভয় দুটোই জড়ো হচ্ছে।এতকাছে এভাবে মুনাকে পাবে তা নাদিব ভাবেইনি। এর আগে যতবার ই জানা অজানায় মুনা ওকে স্পর্শ করেছে ততবারই নাদিব নিজেকে বাধ দিয়ে রেখেছিলো,কিন্তু কাল এতকাছে যাওয়ার লোভ সে সামলাতে পারেনি। জ্ঞানত বা অজ্ঞাতেই মুনা নিজেই ওকে টেনে নিয়োছিলো। কিন্তু মেয়েটা যদি ওকে এর জন্য জবাবদিহি করে,ওর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে নাদিব। এই এক চিন্তায় তার অশান্ত লাগছে।


মুনা ক্লাসে বসেও তার মন বাসায়, নাদিব কি করছে না করছে জ্বর নিয়ে জানতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু কল দিচ্ছেনা সে।এতবড় একটা কথা কাল নাদিব এত সহজে বলে ফেললো তাকে,এখন নিজেকে অতিথি অতিথি মনে হচ্ছে মুনার।মনে হচ্ছে হুট করেই একদিন নাদিব তাকে ছুটি দিয়ে দিবে।শুধু শুধু তবে মায়া বাড়ানো কেনো।যে যার মত থাকুক।
আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে মায়ের জন্য।কতদিন দেখেনি মাকে।এই মুহূর্তে মা ছাড়া আর কাউকেই আপন মনে হচ্ছেনা।মুনা সিদ্ধান্ত নিলো এখান থেকেই বাসে উঠে চলে যাবে মায়ের কাছে।যে ভাবা সেই কাজ,বেরিয়ে হাটা শুরু করলো। কিছুটা যেয়েই খেয়াল করলো পেছনে কেউ আছে যে তাকে ফলো করছে।তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। আবার কিছুদূর যেয়ে দেখলো। ভেতরে খচখচ করছে।কে ফলো করবে তাকে এখানে। মুনা আর না ভেবেই তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠলো। মায়ের কাছে গেলে যদি শান্তি পায় একটু।

১৫.
মেহেরনূর খাওয়া সেরে মাত্র উঠলেন।আচমকা মেয়েকে সামনে দেখে যেনো হতবাক হয়ে গেলেন।ভাবতেই পারছেনা সত্যিই মুনা এসেছে।মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন।মাকে শান্ত করতেই তিনি জামাইর কথা জিজ্ঞেস করলেন।মুনা কাচুমাচু হয়ে বললো সে ক্লাস করে ওখান থেকে এসেছে। মেহেরনূর নারাজ হলেন কিছুটা।বিয়ের পর প্রথম এভাবে না এলেও পারতো মেয়েটা।এদিকে মুনার হুট করেই মাথায় এলো সে তো বাসায় বলেনি এখানে আসবে।নাদিব করুক না করুক,শ্বাশুড়ি তো চিন্তা করবে।আসলেই ভুল হয়ে গেলো এভাবে আসা।একটা কল করবে এখনি শ্বাশুড়ি কে।
.

প্রায় দুটো বেজে গেছে,নাদিবের হালকা লাগছে অনেকটা।ফ্রেশ হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে আর বাসার গেটে উঁকি মারছে।মুনা তো অনেক আগেই আসার কথা।কল দিতেও ভয় লাগছে আজ।একটা সময় উপায়ান্তর না পেয়ে মাকেই জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার মা,তোমার আদরের বউ এখনো আসেনি যে আজ?
রেবা বেগম সুফিয়া ডেকে বললেন টেবিলে খাবার দিতে।তিনি নিজেও দেখলেন আজ দেরি হচ্ছে,ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন
“হয়তো কোনো কাজে ব্যাস্ত, তাই দেরি হচ্ছে।আয় খেতে বস।
তখনি তার ফোনে কল,
“কিরে মুনু,আজ এত দেরি হচ্ছে কেন তোর?
“আসলে মা,আমি তোমাকে না বলেই আমাদের বাড়ি চলে এসেছি।সরি মা টেনশনে রাখার জন্য।আসলে খুব বেশি মিস করছিলাম তো…
“আচ্ছা আচ্ছা,তা আমাকে একটা কল দিয়ে আগে বলবি তো পাগলি।তুই থাক আমি কাল সকালে নাদিব কে পাঠাবো।

ফোন রেখে কঠিন মুখে ছেলের দিকে তাকালেন,

মায়ের এমন চেহারা দেখে নাদিব ভয় পাচ্ছে,মুনা কি মাকে কিছু বলেছে তার ব্যাপারে। ছিঃ ব্যাপার টা কি লজ্জাজনক হবে তাহলে ভাবতেই বুক শুকিয়ে গেলো নাদিবের।
“এই ছেলে,কি সমস্যা তোর?
“মা..
“আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বারবার, তোদের মাঝে কি হয়েছে।কেউই কিছুই বুঝতে দিসনি।
“আমি আবার কি এমন করলাম..
“তুই কি এমন করেছিস যে মেয়েটা এভাবে ও বাড়ি চলে গেলো। একটা বার বলেও যায়নি।আচ্ছা আমি কি ওকে তোর ঘাড়ে তুলে দিয়েছি জোর করে?
“মানে কি মা।এসব কি বলো।
“আর কি বলার আছে আমার,খুব কষ্ট পাচ্ছে হয়তো মেয়েটা।তুই ওর সাথে নিশ্চয়ই ভালো নেই। আমি কাল রাতেই বুঝেছি,মেয়েটা না খেয়ে এ ঘর ও ঘর পায়চারি করেছিলো তোর জন্য।তুই ফোন পর্যন্ত দিসনি একবার। এখন মনে হচ্ছে আমি জোর করায় তুই বিয়ে করে ভুল করেছিস।
“মা প্লিজ,তুমি আমাকে জোর করোনি।আমিই রাজি হয়েছি নিজে।আমি বারবার চেয়েছি মুনাকে স্বাভাবিক করতে,জোর খাটাইনি। কারণ ভয় হয়,ও আদিব কে প্রচন্ড ভালোবাসতো মা।আমি বুঝেছি সেটা।এখন আমি যদি নিজের জন্য চাইতে যাই,ও যদি বলে বসে ও এখনো আদিব কে ভুলেনি।তখন?
“আমি এতসব বুঝিনা। ভালোবাসাও সময়ের সাথে সাথে সংজ্ঞা বদলায়। ও নিজে আমাকে বলেছে ও নিজেকে বদলাতে চায়।তুই ওকে কিভাবে মানাবি তুই জানিস।কাল ই যাবি তুই।

মায়ের কথায় কিছুটা স্বস্তি আর সাহস পেলো নাদিব।সে যে নিজেকে পাল্টাতে চেয়েছে তা নাদিব ও দেখেছে,কিন্তু হঠাৎ করেই কি যে হলো মুনার,ইরা কে নিয়ে গন্ডগোল পাকাচ্ছে।
নিজের সবকিছু মুনাকে বুঝিয়ে বলে সরি বলতেই হবে। সে কিজন্য চলে গেলো এভাবে জানতেই হবে।এর জন্য কি কাল রাতের কাছে যাওয়াই দায়ী? মুনা কি আমার সাথে নিরাপদবোধ করছেনা তবে? নাকি অন্যকিছু? জানতেই হবে আজ। সাহস করে বলতেই হবে নিজের ভালোলাগা,প্রেমে পড়ার কথা।তারপর যা হবার হোক।মুনা যদি এরপর ভুল বুঝে তাতেও সমস্যা নেই,সে আর মুনার সামনে আসবেনা।বাইরেই সেটেল হয়ে যাবে।মুনা থাকুক মায়ের কাছে।
..

রুমে এসে অদ্ভুত মিসিং হচ্ছে। মুনা নেই ভাবতেই রাগ হচ্ছে।অশান্তি হচ্ছে শুধু।নিজেকেই গালি দিচ্ছে,কেন সে কাল রাতে নিজেকে কন্ট্রোল করলো না একটু।মুনার কাছে যাওয়ার আগে মন হালকাই হবেনা। আর দেরি না করেই তখনি রেডি হয়ে নিলো নাদিব।গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পথে অনেক ফলমূল, মিস্টি নিলো।নতুন জামাই প্রথম যাচ্ছে তাও।মুনা ওকে দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটাই এখন মূল কথা।


মুনাদের অনেক বড় বাড়ি। ও আসতে না আসতেই চাচী জেঠীদের ভীড় জমে গেলো। সবাই মুনার ভাগ্যের প্রশংসা করে ব্যস্ত।জামাই আসেনি কেন জানতে চাইলে মেহেরনূর কথা ঘুরালেন,আরে জামাই তো রাতে আসবে,ব্যস্ত মানুষ। মুনার এসব লোকদেখানো খাতির অসহ্য লাগছে।সে রুমে যেতেই বাইরে থেকে ওর ভাইয়ের চেচামেচি। মিরান বাড়ির সদর দরজা থেকেই চেচাচ্ছে কি বলে যেনো। মুনা এগিয়ে এসেছে দেখার জন্য।ঘরের সিড়িতে পা রাখতেই থমকে দাড়ালো সে।সে কি সত্যিই দেখছে নাকি ভ্রম।

নাদিব মিরান কে হাতে নিয়ে হেসে হেসে আসছে।মিরানের চিৎকারে মেহেরনূর আর তার জা রা এগিয়ে এসে দেখেই অবাক। মেহেরনূর মেয়ে জামাইকে দেখে খুব খুশি হলেন,কলিজাটা বড় হয়ে গেলো তার।জা এদের সামনে বড়মুখ রইলো বেশ।নাদিব উঠোনে এসেই শ্বাশুড়িকে সালাম করে খোজ খবর নিলো।মেহের নূর মুনাকে বলল যা জামাইকে ঘরে নিয়ে যা।আমি নাস্তা বানাচ্ছি।

মুনা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। অবাক লাগছে, এই জ্বরের শরীর নিয়ে এখন ই চলে এলো কেনো? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি কোথাও,আর গেলেই বা তার কি। এরপরে ও মনের ভেতর একটা ভালো লাগা কাজ করছে নাদিব কে তৎক্ষনাৎ এখানে দেখে। মুনার চুপ করে থাকা দেখে নাদিব চুপসে গেলো। সিড়ির কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
” সত্যিই তাহলে একাই চলে এলে?
“মুনা লজ্জা পেয়ে গেলো।
আপনার জ্বর কেমন এখন?
“হাহা,সেই চিন্তা ও আছে তোমার?
“না থাকার কি আছে,আসুন ভেতরে।
নাদিব এসে সোফায় বসতেই মুনা পানি এনে দিলো।
নাদিব গ্লাস হাতে নিতেই দেখলো তার গা কাপছে,জ্বর আসছে আবার।লজ্জা লাগছে ভীষণ।কোনো মতে পানি টুকু খেতেই মুনা খেয়াল করলো। মুনা কাছে এসেই কপালে হাত চেপে ধরলো, চমকে উঠলো, এ তো ভীষণ জ্বর গায়ে।
ধমকে উঠলো মুনা,
“এই জ্বর নিয়ে এখনি কেন আসতে গেলেন? আমি কি হারাই গেছি নাকি?
“তুমি এভাবে কেন চলে আসলে মুনা? একটা কল ও দিলেনা। টেনশনে রাখতে খুব মজা লাগে?
“টেনশন এর কথা আপনি আর না বলেন।তাছাড়া আমি মাকে কল করেছিই।মা ছাড়া আর কেই বা আমার জন্য বসে থাকবে চিন্তা করতে।
নাদিব কিছু বলতে যেয়েও বললো না।জ্বরে,ক্ষোভে তার চোখ ছলছল করছে।মুনা আমি একটু শুবো।তোমার রুমটা দেখিয়ে দিবে?

মুনা নরম হয়ে গেলো, লোকটা এতদূর এসেছে এই জ্বর নিয়ে,এভাবে হার্ট করা উচিত হয়নি।নাদিব কে ধরলো মুনা,নিজের রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো।আপনি থাকুন আমি পানি নিয়ে আসছি।
মাকে বললো যাতে নাদিবের জন্য গরম কিছু বানায়।এক বালতি পানি নিয়ে নাদিবের মাথায় পানি দিচ্ছে মুনা।নাদিব কম্বল পেচিয়ে শুয়ে আছে হুশ নেই প্রায়।মুনা একটু পর পর গায়ে বুকে হাত দিয়ে দেখছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে,একাই বকছে তাই নিজের সাথে।
“আরো ভিজুন না এবার।সারারাত ওই মেয়েটার সাথে এখানে ওখানে আড্ডা মেরে ভিজে এসে এখন আমার কাছে কেন দৌড়ে এসেছন?তাকেই বলুন না এখন সেবা করতে।

“আমি ইরার সাথে ছিলাম না মুনা,সত্যি বলছি।
খুব ক্ষীণ স্বরে কাতর হয়ে আওয়াজ করলো নাদিব।মুনার দুচোখ ভিজে উঠলো সাথে সাথে।খুব মায়া হচ্ছে।
মুনা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় ছিলেন তবে?
কোনো সাড়া নেই আর।মুনা উঠে দেখলো নাদিব ঘুমিয়ে গেছে।মুনা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, কেন যেন বুকটা হালকা হয়ে গেলো। নাদিবের মাথা মুছিয়ে কম্বল ভালো করে চেপে মুনা বাইরে আসলো।

মুনার মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন,বেয়ানের কাছে লজ্জায় মাথা যাবে তার।আসা মাত্রই জামাইয়ের এমন জ্বর।মুনা মাকে চিন্তা করতে মানা করলো।অনেক্ষণ পর নাস্তা নিয়ে এলো মেয়েকে নিয়ে।জামাইয়ের মাথায় হাত বুলাতেই নাদিব চোখ মেললো।
“তুমি শুয়ে থাকো বাবা।জ্বর এখনো অনেক।গরম গরম নাস্তা খেয়ে তারপর একটু ঘুমাও।
“আপনাদের বিপদে ফেলে দিলাম তাইনা মা?
“ছি ছি,এসব কি কথা। চুপ করে উঠে বসে খেয়ে নাও।

মা চলে গেলে মুনা নাদিবকে ধরে বসালো। নাদিব মুনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,চুপচাপ মেয়েটা।নাদিবের দিকে নাস্তা বাড়িয়ে দিয়ে আবার কি ভেবে নিজেই চামুচে করে মুখে ধরলো। নাদিব অবাক হয়েই মুখে নিলো।একটা ও কথা নেই কারো মুখে।নাদিব ইচ্ছেকরেই চুপ আছে,কিছু বললে যদি এই আনন্দটুকু শেষ হয়ে যায়।
নাস্তা শেষ করে নাদিব কে বললো আপনি কি সকালে ওষুধ খাননি?
হ্যাঁ
“মিথ্যে বলবেন না একদম।তাহলে এখন এত জ্বর কিভাবে আসে।আমাকে জ্বালানো ছাড়া আর কি পারেন।
“আর কিছু না পারলেই বা ক্ষতি কি?
“চুপ করে শুয়ে থাকুন! আমি এখন আন্দাজে কি ওষুধ খাওয়াবো। সারারাত এবার কষ্ট পাবেন।
“সমস্যা নেই,এত টেনশন করোনা তো।একটু ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবো।তুমি কি একটু বসবে আমার কাছে?
মুনা কিছু না বলে নাদিব কে শুইয়ে দিয়ে বসে রইলো পাশে।নিজের অজান্তেই নাদিবের চুলে বিলি কাটছে,নাদিব ঘুমাচ্ছে। রাত হচ্ছে,নিজের অজান্তেই শাসনে রাখা মায়া প্রশ্রয় পাচ্ছে নাদিবকে ঘিরে। ইচ্ছে করলেই সে মায়া কাটানো যায়না।

১৬.
সারারাত একটু পর পর নাদিবের জ্বর আসছে যাচ্ছে।মুনার মা আর ভাই অনেকরাত অব্দি জেগে ছিলো এজন্য।তাদের ঘুমাতে পাঠিয়ে দুবার নাদিবের গা মুছিয়ে দিলো।মানুষ টা যদি সুস্থ থাকতো তাহলে কি ভাবতো এসব দেখে? বিয়ের প্রথম প্রথম খালি গায়ে সামনে আসার জন্য মুনা খুব বকতো।যদিও ভালোই লাগতো দেখতে।কথায় কথায় বউ বউ করে প্যারা দিতো।অথচ এখন সাধু পুরুষ সেজেছে,একবার ও ডাকেনা।
গত কাল রাতেও এই খালি বুকটাই মুনাকে আঁকড়ে ধরেছিলো।সচেতন অবস্থায় কি কখনো এমন করতো নাদিব? কই কখনো তো জড়িয়েও ধরলোনা অধিকারের দোহাই দিয়ে,ধরলে কি মানা করতে পারতো মুনা? ভেবেই হাসি পাচ্ছে মুনার। গা মুছিয়ে ঢেকে দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো মুনা।
পাশেই নাদিব শুয়ে আছে তাও মুনার ঘুম আসে না।একটু পর মুনা উঠে বসে কপালে বুকে হাত দিয়ে জ্বর দেখছে।বারবার নাদিবের নাকের কাছে হাত রাখছে। হুটহাট চুলে বিলি কেটে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।
কি অদ্ভুত এক পাগলামো। মুনার ভীষণ ভয় হচ্ছে।সে খেয়াল করলো সে কাঁদছে।এই মানুষ টাকে হারানোর ভয় তাকে আঁকড়ে ধরেছে।এই মানুষ টার একেকটা নিঃশ্বাসের শব্দ এই মুহুর্তে অনেক দামি তার কাছে।এই মানুষ টাকে সুস্থ হতেই হবে।এই মানুষ টা ছাড়া তার আর চলবেনা।
ভয়ে ভয়ে বসে থেকেই রাত পার করে দিলো সে।ভোর রাতের দিকে খাটে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেলো।খুব ভোরে নাদিব জেগে গেলো। সারারাত মরার মত ঘুমিয়েছে সে,জ্বর ছেড়েছে শেষের দিকে।
শরীর কিছুটা ঝিরঝিরে লাগছে তাই বাথরুমে যেতে উঠতেই দেখলো পাশে আবছা আলোয় মুনা।নাদিব প্রায় অচেতন থাকলেও শরীরের ইন্দ্রিয় অনুভূতি জাগ্রতই ছিলো। সে জানে মুনা সারারাত ঘুমায়নি। মুনার কাধের নিচে হাত দিয়ে শোয়াতেই মুনা বালিশ আঁকড়ে ঘুমাচ্ছে,নাদিব দেখে হাসছে। অন্ধকারে চোরের মতোন মুনার ক্লান্ত কপালে আদর দিয়ে নেমে গেলো নাদিব।

..
খুব ভোরেই মেহেরনূর উঠে জামাইয়ের জন্য নানান পিঠার আয়োজন শুরু করলেন।মুনা উঠে দেখলো নাদিব ঘুমাচ্ছে।নাদিবের কপালে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে মায়ের কাছে গেলো সে।নাদিব চোখ মেলে হাসছে মুনার কান্ড দেখে। উপরেই যত জারিজুরি, ভেতরে পুরাই একটা ভীতু আর মায়ার সাগর।কয়দিন আর এভাবে জারিজুরি দিয়ে চালাবেন ম্যাম।আজ তো রিস্ক নিয়েই নিবো নিজের জন্য।দেখি কি করেন।

নাস্তা শেষ করে রুমে আসতেই মুনা শাসিয়ে দিলো,
“শুনেন,আমি না আসা অব্দি কোথাও উঠবেন না কিন্তু।সারারাত জ্বরে কাতর ছিলেন।এখন রেস্ট নিন।
“না আসা মানে? কোথায় যাচ্ছো তুমি?
“আমার ক্লাস আছে,বেশি সময় লাগবেনা।
“আজ কি না গেলেই হয়না?
“না,তেমন হলে আপনাকে এভাবে এখানে রেখে যাওয়ার মত অভদ্রতা করতাম না।
“তাহলে আমি সাথে যাই? তুমি বের হওয়া অব্দি বাইরে গাড়িতে ওয়েট করবো।
“মুনা দাত কড়মড় করে বললো, ওই কি সমস্যা? সারারাত জ্বালাইছেন ওকে? এখন একদম ড্রাইবিং না।যা বললাম তা করুন, আমি মিরান কে বলবো আপনার সাথেই থাকতে।মা তো আছেই।
নাদিব মন ভার করলেও এমন শাসন তার অনেকদিন পর পাওয়া।মন্দ না আসলে।জীবনে এই মুহুর্তে মুনাকে ঘিরে সব ই প্রয়োজনীয় লাগছে।


ক্লাস শেষ করেই তড়িঘড়ি করছে রিক্সার জন্য।নাদিব নতুন ও বাড়িতে,তার উপর দুর্বল, একা কি করছে টেনশন হচ্ছে। গেটের বাইরে এসে দাড়াতেই পেছন থেকে মুনা বলে ডাক শুনলো। মুনা হকচকিয়ে পেছনে তাকালো।

এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, ড্রেসাপ,চেহারায় আভিজাত্যের চাপ।মুনা অবাক হলো এই লোক ওর নাম জানলো কিভাবে,কলেজের নতুন প্রফেসর না তো? তাহলেও নাম জানবে কিভাবে?
“কি ভাবছো আমি জানি,একটু কথা বলতে পারি আমরা?
“হ্যাঁ বলুন।
“এখানে না,রাস্তার ওপাশে কফিশপে যেতে পারি আমরা।
“মানে,কে আপনি,আর আমাকে এভাবে অফার করছেন কেন?
“সেটা বসলেই ক্লিয়ার করতে পারবো,প্লিজ চলো।
“সরি,আমার তাড়া আছে।যেতে হবে।
“আজ কি তোমার স্বামী আসেনি?
মুনা চমকে গেলো, এই লোক কি তবে ফলো করেছে ওকে।কিভাবে জানলো নাদিব এসেছে সেদিন।
“আপনি কি আমাকে ফলো করছেন কদিন? মতলব কি আপনার?
“হাহা, চিন্তা করোনা মেয়ে।তোমার সাথে আমার খুব জরুরী কথা ছিলো, তাই সুযোগ খুজছিলাম।
“আপনাকে তো চিনিই না।তাছাড়া আমার হাজবেন্ড অসুস্থ আজ,আমাকে যেতে হবে।
“কি হয়েছে নাদিবের? উদ্ধিগ্ন দেখালো লোকটাকে।
মুনা যেনো শক খেলো নাম শুনে।কথা না বাড়িয়ে কফিশপে বসতেই ভদ্রলোক দুটা কফির অর্ডার দিলেন।

“তারপর! আমি খুব খুশি হয়েছি তোমাকে নাদিবের সাথে দেখে। এটাই জীবন, নিজেকে মুভড অন করানো উচিত সবার ই।
“বুঝলাম না।
“কফিটা নাও,
“আপনি বলুন তো আমাকে কিভাবে চিনেন? আর নাদিব কেই বা।
“বলবো বলেই তোমাকে খুজেছি।তুমিই পারো হেল্প করতে আমাকে।
“প্লিজ আপনি এভাবে সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে আমাকে বলুন আপনি কে? কে আপনি?
“আদিব কে তুমি খুব ভালোবাসতে,তাইনা?

মুনার হাতের কফির মগ নড়ে উঠলো। মনে হলো কেউ বর্ষপুরোনো বন্ধ দরজায় জোরসে আঘাত করেছে।ভয় হচ্ছে মুনার।কে এই লোক।কিভাবেই বা আদিবের ব্যাপারে জানে।

“মুনা! আদিব আমাকে তোমাদের সম্পর্কের সব ই বলেছে,প্রচন্ড ভালোবাসার শক্তি দেখেছি আমি ওর মাঝে।আদিব ই আমাকে তোমার সব বলেছে।

মুনার সমস্ত শক্তি হারিয়ে গেছে,দু চোখ দিয়ে অবাধ্য জল বইছে।