তোমাতেই আমি পর্বঃ০৬

0
1850

তোমাতেই_আমি
#পর্ব_০৬
#Tabassum_Kotha

— কোন সাহসে তুই আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রেখেছিস। তোর ওই কলঙ্কিত মুখ দেখার আগে আমি মরে যাওয়া পছন্দ করবো।

— ছিঃ ভাইয়া তুমি এসব কি বলছো। আমি কি তোমার এতোটাই পর হয়ে গেছি?

— তোর ওই অভিশপ্ত মুখ দিয়ে আমাকে ভাইয়া ডাকবি না। আমার ছোট বোন নয় বছর আগেই মারা গেছে।

— ওভাবে বলো না ভাইয়া। তোমার মুখ থেকে নিজের জন্য এসব কথা মানতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

— ভাইয়া! কে তোর ভাইয়া? তুই তো আমার জন্য সেদিনই মরে গেছিস যেদিন বাবাকে মেরে ফেলেছিস। এখন তুই আমার চোখে শুধুই একটা খুনি।

— কি বললে বাবা!!!

— তুই এতোটা স্বার্থপর হয়ে যাবি এটা আমি ভাবতেও পারি নি। রাস্তার একটা ছেলের জন্য তুই বাবাকে মেরে ফেলবি,, আগে জানলে নিজ হাতে তোকে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।

— বাবা আর নেই!!!

— নেই বাবা। তুই মেরেছিস বাবাকে। তোর পাগলামি কেড়ে নিয়েছে বাবার জীবন। সবার সামনে অপমানিত হতে হয়েছে, কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিতে হয়েছে তোর জন্য। বিয়ের দিন প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছিস। বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়েছিস। একটাবার ভাবিস নি তোর এই কাজে আমাদের কতোটা অপমানিত হতে হবে।

— ভাইয়া আমি অঙ্কুর কে ভালোবাসতাম। তুমি তো জানতে ওকে ছাড়া অন্যকাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

— ভালোবাসা! তোর ভালোবাসা আমার বাবার জীবন কেঁড়ে নিয়েছে। আমাদের মান সম্মাণ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।

— এভাবে বলো না ভাইয়া আমি তোমাদের ক্ষতি চাই নি। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি। আমি বুঝতে পারি নি বাবার কিছু হয়ে যাবে। (কাঁদতে কাঁদতে)

— তুই নিজের দিকটা তো ভালোই বুঝেছিলি। সেই পরিণতিই আজ পর্যন্ত আমরা ভোগ করছি। তুই আমার বাবার খুনি অনু। তোর বিয়ের দিন আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। বাবার শোকে শোকে মাও বছর ঘুরতেই মারা যান। সেটার জন্যও তুই দায়ী। তোর জন্য আমাকে এতিম হতে হয়েছে।

— কি বলছো ভাইয়া মা!!

— হ্যাঁ। তোর মতো চরিত্রহীনকে পেটে ধরার শাস্তি পেয়েছে মা। এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। তোর মতো কুলাঙ্গার সন্তান যেনো আল্লাহ আর কাউকে না দেয়।

— ভাইয়া আমি তোমার পায়ে পরছি এগুলো বলো না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটাবার আমাকে বুকে টেনে নেও ভাইয়া। আমার অপরাধ ক্ষমা করে দাও। বাবা মা মারা গেছে আমার জন্য। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।

— তুই আমাকে ভাইয়া বলবি না। আমার জন্য তুই মরে গেছিস অনেক আগে। যেই সংসারের মোহে তুই আমার সংসার পুড়িয়ে দিয়েছিস সেই সংসার তোর কখনও সুখের হবে না। নিজের বাবা মার হত্যার দায় মাথায় নিয়ে তুই কখনও শান্তি পাবি না।

কথাগুলো বলে অনুর ভাইয়া অনু আর অর্ণবকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সেই বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সারা রাস্তা অনু আঁচলে মুখ গুঁজে কান্না করে। আপন ভাইয়ের কাছে থেকে এতোটা অপমান এতো ঘৃণা পেতে হবে অনু স্বপ্নেও ভাবে নি। অপমান টা মুখ বুজে গিলে নিলেও বাবা-মার হত্যার অপবাদটা যেনো কিছুতেই অনু মানতে পারছে না। অর্ণব বারবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে তার মামার এই ব্যবহারের কারণ কি। মায়ের কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও বিষন্ন মনে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর কি মনে করে অনু অর্ণবকে বুকে জরিয়ে নিলো। প্রাণভরে আদর করে দিলো অর্ণবকে। কপালে গালে অজস্র চুমু খেলো।

— বাবা অর্ণ! তোর মা তোকে অনেক ভালোবাসে বাবা। মা কে কখনও ভুল বোঝো না। মা যা করেছে তার জন্য মা কে ক্ষমা করে দিও। বাবার মনে কখনও কষ্ট দিও না। কখনও কারো মন ভেঙো না। সবাইকে সুখে রাখবে সবসময়। নিজের যত্ন নেবে কথা দাও।

— আম্মু তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?

— না বাবা। আম্মু সবসময় তোমার সাথে আছে। আম্মু তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

কথাগুলো বলে অনু আবারও অর্ণবকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।

বাড়িতে পৌঁছে নিজেকে এক ঘরে বন্দী করে নেয় অনু। অর্ণব অনেকবার দরজায় ধাক্কা দিলেও অনু দরজা খুলে না। এক সময় ক্লান্ত হয়ে অর্ণব ফিরে আসে নিজের ঘরে। জন্মদিনের যেই আমেজটা সকালে ছিল দুঃখ এসে সেটা মাটি করে দেয়। একরাশ মন খারাপ নিয়ে অর্ণব ঘুমিয়ে পরে। প্রায় দুইঘন্টা পর বাবার চিত্কারে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পরে অর্ণব। এতোটা জোরে সে কখনও তার বাবাকে চিত্কার করতে শুনে নি। ভয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে বাবা মায়ের ঘরে আগাতেই থমকে যায় অর্ণবের পা। তার মা যে কি না কিছুক্ষণ আগেই তাকে আদর করছিল সেই মা গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে।

অর্ণবের পৃথিবী যেনো সেই মুহূর্তেই থমকে যায়। আট বছরের একটা বাচ্চার জন্য তার মায়ের লাশ এইভাবে দেখা কতোটা ভয়ানক কতোটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা স্বাভাবিক কোনো মানুষের পক্ষে বোঝা দায়।

অঙ্কুর অনুর লাশ ধরে কান্নাকাটি করছে, লাশ নামানোর জন্য সার্ভেন্ট রা সব ছুটাছুটি করছে কিন্তু অর্ণব দরজার বাইরে এখনও মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। অর্ণবকে দেখে বুঝা মুশকিল যে মারা গেছে সে তার মা নাকি অন্য কেউ।

অনুর দাফন কাফন শেষে অঙ্কুর একটা চিঠি খুঁজে পায় অনুর ঘরে। চিঠিটা খুলতেই অঙ্কুর হতভম্ব হয়ে যায়। চিঠিতে সেদিন অনুর বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর কি কি হয়েছে সেই ঘটনা বর্ণনা করা ছিল। তার সাথে লেখা ছিল অনুর অনুশোচনা। অনু তার ভাইয়ের বলা কথাগুলোতে এতোটাই প্রভাবিত ছিল যে সে নিশ্চিত ছিল তার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য সে নিজে দায়ী ছিল। ভাইয়ের তিরষ্কার, বাবা মায়ের মৃত্যর দায়ভার সবকিছু মিলিয়ে নিজের জীবনকে অভিশাপ মনে হয়েছিল অনুর কাছে। স্বামী-সন্তানের উর্ধ্বে রেখেছিল তার অনুশোচনাকে। তাই তো অপরাধবোধের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।

অনুর বিরহ অঙ্কুরকে ভিতর থেকে শেষ করে দেয়। নিজের কষ্ট ভুলার জন্য অঙ্কুর নিজেকে কাজে ব্যস্ত করে নেয়। সারাদিন বাইরে থাকা, অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা যেনো অঙ্কুরের জীবনের একটা নিয়ম হয়ে যায়। অঙ্কুর ব্যস্ততার মাধ্যমে তার বিরহ ভুলে থাকলেও অর্ণবের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অনুর মৃত্যুর পর অর্ণব সম্পূর্ণরূপে একা পরে যায়। সারাক্ষণ একা থাকা, কারো সাথে কথা না বলা না খেয়ে থাকাই ছিল অর্ণবের কাজ। বাবা মায়ের আদরের ছেলেটি অনাদরেই বড় হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে অর্ণব মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরে। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরে। অঙ্কুর নিজের কষ্টে এতোটা মশগুল হয়ে যায় যে সে অর্ণবের একাকিত্বটা দেখতে ব্যর্থ হয়।

অর্ণব মনে মনে তার মায়ের আত্মহত্যার জন্য তার মামাকেই দায়ী করে। সময়ের সাথে সাথে এটা তার মনে চরম ঘৃণার সৃষ্টি করে। অর্ণবের শিশু মন এই আঘাত টা নিতে না পেরে মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পরে। স্কুলে অন্য বাচ্চাদের সাথে মারামারি করা তার স্বভাব হয়ে দাড়ায়। বারবার অর্ণবের স্কুল থেকে আসা কমপ্লেইনে বিরক্ত হয়ে অঙ্কুর তাকে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়। সদ্য মায়ের মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না পারা ছোট বাচ্চাটা এভাবে বোর্ডিং স্কুলে যাওয়াতে আরও একা পরে যায়। বাইরে থেকে অর্ণব সবসময় পারফেক্ট হলেও তার ভিতরের অবস্থা টা শোচনীয়। ছোট বেলার ক্রাইসিসের জন্য হঠাত রাগ, অস্থিরতা, ডিপ্রেশনে ভোগতে থাকে।

অনু মারা যাওয়ার পর অর্ণব আর অঙ্কুরের সম্পর্কে ফাটল ধরে। কিন্তু সেই সম্পর্কটা অর্ণবের দিকে দিয়ে একদমই শেষ হয়ে যায় যখন অঙ্কুর তার অফিসের এক স্টাফকে বিয়ে করে নেয়। অর্ণব তার বাবার জীবনে তার মায়ের জায়গায় অন্য কারো আসাটা মেনে নিতে পারে নি কোনো ভাবেই। বাবা ছেলের মধ্যে যোগাযোগ কমতে কমতে একসময় এমন হয় যে অর্ণব তার বাবাকে বাবা বলেও ডাকে না।














সিগারেটে শেষ টান দিয়ে শেষাংশটা নিচে ফেলে দিয়ে উঠে পরলো অর্ণব। ভোর হয়ে গেছে। নতুন সকালের উদয় হয়েছে।চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। দুই প্যাকেটের মতো সিগারেটের শেষাংশ নিচে পরে আছে। অতীতে বিচরণ করেই রাত পার হয়েছে অর্ণবের। সন্ধ্যায় মীরার প্রতি যেই রাগটা ছিল সেটা অনেকটাই কমে গেছে। যদিও অর্ণব মীরাকে ওই পরিস্থিতিতে মেনে নিতে পারছে না। তবুও ভালোবাসার হাতে সে দায়বদ্ধ।

মীরাকে যেই ঘরে বন্ধ করেছিল কাল রাতে সেই ঘরে গিয়ে দরজা খুলে দিলো অর্ণব। মেঝেতে এলোমেলো ভাবে পরে আছে মীরা। প্রথমে অর্ণব ভেবেছিল হয়তো মীরা ঘুমিয়ে আছে কিন্তু কিছুক্ষণ মীরাকে ঝাকিয়েও সাড়া না পেলে অর্ণব বুঝতে পারে মীরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মীরাকে এই অবস্থায় দেখে অর্ণবের হার্ট বিট বেড়ে যায়। মুহূর্তেই মীরাকে হারিয়ে ফেলার ভয় অর্ণবের মনে ভর করে। ছোটবেলায় তার মা কে হারিয়েছে এখন সে মীরাকে হারাতে চায় না কিছুতেই। অর্ণব আর এক মিনিট সময় নষ্ট না করে মীরাকে কোলে তুলে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

চলবে..