তোমাতে আমাতে পর্ব-০১

0
2679

#তোমাতে_আমাতে
পর্ব-০১
লেখা আশিকা জামান

অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল আমাকে আর ইমনকে। একরকম জোড় করেই ইমনকে এই বিয়েতে রাজী করানো হয়েছিল। ইমনের যে এই বিয়েতে এক্টুকুও মত ছিলোনা সেটা আমি বিয়ের দিনই বুঝে ছিলাম। ওর ওই চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে আমি কেন জানি খুবই আহত হয়েছিলাম। জানিনা কেন যে এত খারাপ লেগেছিল। আমার দিক যে বিয়ের পূর্ন সম্মতি ছিলো তেমনটাও না। তবুও..
আমি নিজেকে আহামরি সুন্দরী বলবো না কিন্তু কোন অংশে খারাপ এটা কেউ বলতে পারবে না। যাই হোক আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। সাইন্স পড়া একদম হুলস্থুল অবস্থা। কোচিং, ক্লাস, টিউশন, পড়ার চাপ আমাকে একদম এলোমেলো বানিয়ে দিয়েছিল। নিজের দিকে তাকানোর সময় টুকুও পেতাম না। একদম টপ হওয়ার চিন্তায় মাথাটা ঘুরপাক খেতো।, স্বপ্নের ক্যারিয়ার হাতছানি দিয়ে ডাকতো ঠিক সেই সময় অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে ভাবা যায়….
ইমন তখন সবে ইন্টার্নি শুরু করলো ঠিক সেই সময় বিয়ে এটা মেনে নিতে ওর হয়তবা খুব কষ্ট হয়েছিল। আরোও কোন বিষয় এর মধ্যে থাকলেও হয়তবা থাকতেও পারে। যেহেতু, ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা, ফরসা, মেদবিহীন শরীর, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং চুলের স্টাইল, আবার ব্লু লেন্স ওয়ালা চশমা পড়া মেডিকেলে পড়ুয়া ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট। তবে ওর চোখের লেন্সটা অরজিনাল কিনা এটা নিয়ে আমি খুবি সন্দিহান। ভেবেছি পরে একসময় জিজ্ঞেস করে নেব। প্রথম দেখায় যাকে বলে একদম খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছি। তবে এরকম সুদর্শন ছেলের যে কোন জি এফ নেই এটা অবিশ্বাস্য। যাই হোক এটা নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই।
আর প্রথম দেখায় যে আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি এমনটায় নয়। ইমনের মনের ভাব বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না বললেই চলে তবে বুঝবার চেষ্টাটুকূও করলে করা যেত। তবে সেটাও আমার অসাধ্য ছিল। বেচারা তার বাবার কষ্টে নাকী বিয়ের কষ্টে জর্জরিত ছিলো সেটা আমার বোধগম্য নয়। ইমনের বাবা আর আমার বাবা ছেলেবেলার বন্ধু। আমরা ছোট থাকতেই তারা আমার আর ইমনের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। তবে সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। অবশ্য বিয়েটা হওয়ার কথা ছিলো আমার পড়াশোনাটা শেষ হওয়ার পর। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে যা হয় আর কি। ইমনের বাবা মানে আমার শ্বশুড় হঠাৎ করেই ক্যান্সার আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বন্দোবস্ত চলছে কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি বেকে বসলেন। একমাত্র ছেলের বিয়ে না দিয়ে তিনি বিদেশে যাবেননা। যদি আর ফিরে না আসেন তাই শেষ ইচ্ছাটা তিনি পুরণ করতে চান। এদিকে আমার ফ্যামিলিতে এতো ছোট বেলায় কারো বিয়েই হয়নি। আমার বড় বড় আরো বোনরা আছে তাদের রেখে আমার বিয়ে এটা মেনে নিতে আমার মাএর খুব কষ্ট হলেও বাবা বিষয়টা আমলে নিলেন না। তিনি তার ওয়াদা রক্ষায় সচেষ্ট থাকলেন তবে শর্ত এক্টায় আমার পড়াশোনা না শেষ হওয়া অব্দি আমি বাবার বাড়ীতেই থাকবো।
তাই তেমন কোন অনুষ্ঠান না হয়েই ঘরোয়াভাবে নিকট আত্নীয় যাদের না বললেই নেই তাদের উপস্থিতিতে আমার আর ইমনের বিয়ে হয়ে গেলো কিছুক্ষন আগে।
আমার চাচাতো ভাইয়ের বউ আর বোনেরা আমাকে কোনরকম ধরে বেধে আমার রুম মানে আজকে যেটাকে ফুলেল সাজে সাজিয়ে বাসর ঘর বানানো হয়েছে সেইখানে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে গেলো। আমার নিজের রুমে আসতে আজকে আমার আশ্চর্যজনকভাবে লজ্জা লাগছে। সেটা বুঝতে পেরে ভাবী আর বোনেরা মিলে আমার সাথে যা মজা করছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমার এই মূহূর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী হচ্ছে সদ্য বিয়ে হওয়া বউ।
কিছুক্ষনপর আমার বড় ভাই আহির যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে। ইমনকে আমার রুমে এনে পাশাপাশি খাটে বসতে বলে।
ইমন কিছুটা লজ্জাজনক ভঙ্গীতে ইতস্তত করে খাটের উপর বসে পড়লো তাও আবার আমার শাড়ীর উপরে। ওর এই লজ্জা পাওয়া দেখে সবাই হি হি করে হেসে উঠলো। আমার অসহ্য লাগছিলো । ধরনী তুমি দ্বিধা হও আমাকে পাতালে ঢুকিয়ে নাও।
ভাইয়া খুশিতে গদগদ হয়ে বললো
— আমার সুন্দরি বোনের সুন্দর বর। একদম পার্ফেক্ট ম্যাচিং। অনীশ ( আমার চাচাতো ভাই)এখন কয়েকটা ছবি তুলে দেতো।
অনীশ ভাইয়া ছবি তুললো আর বারবার বললো এইরকম এতো ডিস্টেন্স কেন আরেকটু কাছাকাছি বসো।
ইমনের বিহেভিয়ার দেখে মনে হলো ও এই অফারটার জন্যই এতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছিলো। বলা শেষ হতে যতক্ষন না দেরি হলো আমার গায়ের উপড়ে পড়তে ওর বেশীক্ষন লাগলোনা। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আমি ওর দিকে তাকালাম। একদফা চোখাচোখি হয়ে গেল। এইজোড়া বাউন চোখের সাথে ব্লু চোখের সন্ধিক্ষন হলো। আমি এক্সপ্রেশনে বোধই মুগ্ধতাই প্রকাশ পাচ্ছে বিরক্তির বদলে। হাসির রোলে আমার টনক নড়লো। একসময় আমি নিজেও শব্দ করে হেসে দিলাম পরে লজ্জা পেয়ে চুপসে গেলাম। তখনি সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো । ইমন বেচারিও এই প্রথম মুচকি হাসি দিয়ে দিলো। আমি বেশিক্ষন তাকালাম না কারণ ওর ওই হাসির প্রেমে পড়ার ইচ্ছা আপাতত আমার নেই। আমি নিশ্চুপ এমন ভাব ধরলাম যে আমি সদ্য জন্ম নেয়া শিশু।
ভাইয়া বরাবরি এত হাসি ঠাট্টা প্রছন্দ করে না তাই সবাইকে একটা ধমক দিয়ে চুপ করতে বললেন। তারপর সবাই একে একে আমাকে এই বাঘের গুহায় রেখে চলে যেতে লাগলো। অবশ্য গুহাটা আমারি কিন্তু বাঘটা যেন কিভাবে পথ ভুল করে এখানে ঢুকে পড়েছে। ভয়ে এই কাল শীতেও আমি ঘামতে লাগলাম। ওদিকে বেচারা এমনভাবে আমার গা ঘেষে আমার শাড়ীর উপর বসেছে যে আমি একটু পা সরিয়ে বসবো তারও উপায় নেই। আমার আবার এক যায়গায় অনেক্ষন বসে থাকলেই পা ঝি ঝি ধরে। ঠিক এখন সেই জীনিসটাই হতে হলো।কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। ওদিকে ইমনের সাথে আমার আজকেই প্রথম দেখা। এর আগে ছোটবেলায় দেখে থাকলেও থাকতে পারি তবে সেটা আমার মনে থাকার কথা না। তাই কিভাবে কি দিয়ে কথা শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না। এদিক যন্ত্রনায় আমি মূর্ছা যেতে লাগলাম। আর ওই ছেলেটা কেমন বেয়াদব সেইভাবেই ঠাই বসে আছে।
নাহ আর পারছি না।
আমি ইমনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে রণচণ্ডী রুপ ধারণ করে বললাম,
— আপনি কি বাকী রাতটা ঠিক এভাবেই বসে থাকবেন বলে ঠিক করে এসেছেন?
ইমন আমার দিকে বোকার মত তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
— মা মা… নে?
— মানে সরুন আমি এখান থেকে উঠবো?
ইমন ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে।ওখান থেকে সরে বসে।
(চলবে)