তোমাতে আমাতে ২ পর্ব-০৬

0
656

#তোমাতে_আমাতে ২
লেখা আশিকা জামান
পর্ব ০৬

দশটায় ঘুম ভেঙ্গে প্রথমেই বুয়ার মুখে কথাটা শুনেই মাথাটা আরেকদফা চক্কর দিয়ে উঠে।
শাশুড়ি মাকে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখি।
কিছু সময় পর নিজেই শান্ত গলায় বললো,
” আদৃতা, তুমিতো জানো ছেলেটা একা একা কখনো খায় না। তুমি এটলিস্ট আমাকে ডাক দিতে পারতে। আমার পায়ের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে তাই রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি। কিন্তু তুমি যদি একটা ডাক দিতে আমি ঠিক উঠে যেতাম।”

এতোক্ষনে হুট করেই আমার মনে পড়ে যায়, ইমম বোধ হয় আমার উপর রাগ করে না খেয়ে চলে গেছে। প্রথমত ওর স্কলারশিপ পাওয়ার কথাটা শুনে আমি কোন ভালো রিএক্ট দেখাইনি এটা ওর জন্য যথেষ্ট অপমানজক। তারউপর কাথা মুড়ি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে ছিলাম এটা হয়তোবা ও নিতে পারেনি। কিন্তু আমার যে সত্যিই শরীর খারাপ ছিলো এটা এটলিস্ট ওকে জানানোর দরকার ছিলো। মাথাটা ভারী হয়ে উঠছে। তবুও মামনীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
” মা ও হয়তোবা বাহিরে খেয়ে নিয়েছে। আপনি প্লিজ ব্রেকফাস্ট করে নিন। নাহলে আবার আপনার শরীর খারাপ লাগবে। প্লিজ খেয়ে নিন আমি ওর সাথে কথা বলে নিচ্ছি।”
মামনী আমার কথায় ঠিকি খেয়ে নিলেও আমি ঠিক খেতে পারছিলাম না। কেমন যেন গা গুলিয়ে আসছিলো। আমি উঠে আসতেই বেসিনে গড়গড় করে বমি করে দিলাম। নাক মুখ দিয়ে বমি চলে আসায় গলা আর নক অসম্ভব রকমের জ্বলছিলো।
আমি প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই মামনী এসে ধরে ফেলে।
” আদৃতা এমন হুট করেই বমি করছিস কেনরে মা। কেমন লাগছেরে মা।”
আমি কোনরকমভাবে ধরা গলায় বললাম,
” মামনী, আমি ঘরে যাব। আমাকে একটু ধরে বিছানায় নিয়ে যান।”
মামনী আমাকে ধরে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে
নিজে আমার পাশে এসে বসলেন।
” আদৃতা, তোমার এত শরীর খারাপ তুমি আমাকে বললে নাতো। ”
” কি করে বলবো মামনী, কালকে পর্যন্ততো সব ঠিকি ছিলো। হুট করেই সকাল থেকেই এমন শরীর খারাপ। ”
“তোমার এমন শরীর খারাপ আর ইমন কিনা রাগ করে না খেয়ে চলে গেলো। এই অবস্থায় রেখে গেলো কি করে? উফ্ ছেলেটা যে আর কত ক্যায়ারলেস থাকবে?”
” মামনি, ওতো জানেইনা আমার শরীর খারাপ।”
” তুমি যে আমার কাছে স্বামীর দোষ গোপন করছো এ আমি বেশ বুঝতে পারছি।”
আমি নিশ্চুপ থাকলাম।
সারাদিন খুব অস্বস্তিতে কাটলো। আমি ইমনকে দুই / তিনবার ফোন করেছিলাম বেচারা ফোন তুলেনি।
বিকেলে ইমন আসার ঠিক আগমুহুর্তে
আমি কিচেনে গেলাম যদিও দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠছে। ফ্রিজ থেকে ম্যারিনেট করা চিকেন পিসগুলো বের করে একে একে কোটিং করে তেলে ছাড়তে লাগলাম। চিকেন ফ্রাই হয়ে আসছে আসছে এমন ভাব তখনি কলিং বেজ বাজলো। ইমন আসছে! ভাবতেই অন্যরকম সুখ সুখ ফিলিংস হচ্ছে। কিন্তু এগুলো না নামানো অব্দি আমি যেতে পারছি না। তখন মামনির প্রতি খুব রাগ হলো। সে তার বান্ধবীর সাথে কি এতো গল্প করছে যে কলিং বেলের শব্দও শুনতে পারছে না। এতোক্ষনে বেশ কয়েকবার বেল বেজে আবার থেমে গেছে। তাড়াহুড়ো করে নামাতে গিয়ে হাতে তেলের ছিটা লেগে ফোস্কা পড়ে গেলো। আমি জ্বালা ধরা হাতটা ওভাবেই ব্যাথা চেপে রেখে দরজা খোললাম। চোখ মুখ লাল করে ঘেমে নিয়ে একাকার হয়ে ইমন ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলো৷ শার্ট
পড়া অবস্থাতেও ওর শিরদাঁড়া বেয়ে দরদর করে বয়ে যাওয়া ঘাম আমার দৃষ্টি কিঞ্চিৎ মাত্র এড়ালো না।
অস্ফুটে সুরে গলা থেকে যেন অচেনা এক সুর বের হলো,
” ওভাবে দাঁড়িয়ে কেন?”।
” ভাবছি বাসায় ঢুকবো না চলে যাব।”
মাথাটা নিচু করে বললো।
” এ কেমন কথা। তোমার বাড়ি তোমার ঘর, তুমি ঢুকবে নাইবা কেন।”
” হ্যাঁ সেটাইতো৷ আমার বাড়ি আমার ঘর!
আমি সকাল ৭ টায় বাসা থেকে বের হইছি এখন বিকেল। তুমি জানতে না আমি এখন ফিরবো৷ শব্দ পাওনি আমিতো কলিং বেল ননস্টপ বাজিয়েছিলাম। আমার প্রতি কন্সেন্ট্রেশনের এত অভাব আমাকে হীনমন্যতায় ভোগায়৷ নিজের বাসায় নিজেকে এলিয়েন মনে হয়। বোঝো ব্যাপারটা তুমি? বোঝো?”
ইমনের হুট করে রেগে যাওয়া দেখে আমি একরকম থতমত খেয়ে যাই।
” ইমন আসলে আমি,….”
কথাটা আমাকে শেষ করতে দেয়না তার আগেই ও হনহন করে রুমে যেতে যেতে চেচিয়ে উঠে বললো,
” আমি কোন এক্সপ্লেনেশন চাইনি। নেভার এন্ড নেভার।”
আমি ওর পিছুপিছু রুমে ঢুকলাম।
ইমন শার্ট একটানে খুলে সোফার উপর ছুড়ে মারলো। হাতের জীনিস সব বিছানায় ছুড়ে মারতে লাগলো৷ আমাকে দেখেই আবার ওয়াশরুমে চলে গেলো।

আমি এতোক্ষন ঠাই বসে থাকলাম। ইমন তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আমার দিকে একটু তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। ওর চোখে তখন শীতল দৃষ্টি। আমি মুহুর্তের মাঝেই অজানা আশঙ্কায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
আমি জানিনা হঠাৎ কি হলো! উঠে গিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম।
” তুমি কি আমার উপর খুব রেগে আছো?”
আদুরে গলায় বললাম।

” না, রাগ করব কেন?” অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো।
” করেছো তো। এই যে,এখনো ভিষণ রেগে আছো।”
আমি ওর ডান গাল টা ধরে আমার দিকে ঘুরাতে ঘুরাতে বললাম।

” একবার বলেছি না রাগ করিনি।”

” তাহলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো। রাগ করোনি।”
” কি মুশকিল, এখন কি তুমি আমাকে জোর করে রাগ করতে বলছো?”
ইমন আমার হাত ছাড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে কথাটা বলেই খাটে শুয়ে পড়লো।
আমিও চুপটি করে ওর পাশে বসে পড়লাম।
” ইমন, প্লিজ টেবিলে চলো। এভাবে শুয়ে পড়লে কেন?”
” টায়ার্ড লাগছে ঘুমাবো।”
” কিন্তু তুমি তো এইসময় ঘুমাও না। ”
” তো কি? এখন থেকে ঘুমাবো। কোন সমস্যা?”
” হ্যাঁ সমস্যা।”
আমি টান দিয়ে ওকে তুলতে লাগলাম। ওর হাতের ধস্তাধস্তিতে আমার হাতের ফোস্কা গলে যায়। আমি ব্যাথায় উঁহু করে উঠি।
ইমনের চোখে ততক্ষণে আমার হাতের দিকে যায়। হাতটা ধরে বলে উঠে,
” আদি, এটা কখন হয়েছে?”
” তুমি, যখন দরজায় নক করছিলে তখন চিকেন ফ্রাই তাড়াহুড়ো করে তুলতে গিয়ে হাতে লেগে যায়।”

” তুমি তাড়াহুড়ো কেন করতে গেছো? দরকার পড়লে সারারাত দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তোমাকে আমি বলেছিনা, রান্নার সময় খুব সাবধানে আস্তে আস্তে কাজ করবে।
এখানে কিছু লাগিয়েছো?”
ওর চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট।
” না লাগানোর সময় কোথায়? এটা কোন ব্যাথাই না তার থেকে আপনার হাড়ির মুখ আমাকে দ্বিগুণ কষ্টে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
” ওহ্, আদি তুমি আমাকে জীবনেও শান্তি দিবেনা। ঠিক কি কি ভাবে কত প্রকারে আমাকে কষ্ট দেয়া যায় তা তোমার বেশ জানা হয়ে গেছে।”
ইমন ফ্রার্স্ট ট্রিট বক্স বের করে আমার হাতে বার্নল লাগিয়ে দিলো। তারপর হাতটা ধরে ছলছল চোখে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো৷ আমার বুকের ভেতরটা ছলাৎ ছলাৎ করে উঠলো।
তারপর এক হাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে ডাইনিং এ নিয়ে যায়। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেই কফি বানিয়ে আনে৷ সাথে ওর পছন্দের চিকেন ফ্রাই। ও খুব উৎসাহ নিয়ে খায় আমি খাওয়া বাদ দিয়ে তীব্র মনযোগে ওকে দেখতে থাকি।
” আদি, তুমি কি চাও আমার পেট খারাপ হোক? যেভাবে হা করে তাকিয়ে আছো? কি দেখছেন? ”
ওর কথা শুনে আমার সম্বতি ফিরে। ফিচেল হেসে আমিও খাওয়ায় মনোযোগ দেই।
খেতে খেতেই ইমন আমাকে জানায়। রাতে ওর ফ্রেন্ড নীরবের এংগেইজমেন্ট পার্টি আছে। নীরব বারবার করে বলে দিয়েছে আমি যেন ওর সাথে যাই। আমার এতোটাই শরীর খারাপ লাগছে কিন্তু ওকে না করতে পারলাম না। শুধু এই ভয়টাই হলো ও যদি আবার রেগে যায়।
মামনী আমাদের মামনীর কাছে ইমন কথাটা বললো উনিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। উনি জানতেন আমি অসুস্থ তবুও না করলেন না। উল্টো আমাকে ব্ল্যাক আর মেরুনের কম্বিনেশনের একটা রাজট্রিক্স শাড়ি বের করে দিলেন। শাড়িটা খুব সুন্দর প্রথম দেখাতেই প্রছন্দ হয়। কিন্তু এটা ক্যারি করতেই আমার আজকে বিরক্ত লাগছে। ইমন আজকে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে সাজার ইন্সট্রাকশন দিতে লাগলো। বেছে বেছে ভারী কানের দুলটাই পড়তে বললো। চুলগুলো আবার ছেড়েও দিতে বললো। হাতে মোটা মোটা বেঙ্গল আর একহাতে ঘড়ি পরে আমি রেডি হয়ে গেলাম। ইমন ব্ল্যাক কমপ্লিট পড়ে নিলো। মামনি পলকহীনভাবে তাকিয়ে সেদিন আশীর্বাদ করে দিলেন। একটুর জন্যে হলেও শারীরিক অসুস্থতাকে ভুলে খুশি হতে চাইলাম।
পার্টিতে অনেক মানুষের সাথে আমার আলাপ হলো। বেশ বড়সড় ভাবেই পার্টির অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে । নীরব ভাইয়ার পাশে লাজুক স্বভাবের অঙ্কিতাকে বেশ মানিয়েছে। আমি মুগ্ধ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সবাই আমাদের পার্ফেক্ট কাপল হিসেবে আখ্যায়িত করতে লাগলো। আমরা মুচকি হেসে ধন্যবাদটাই দিলাম। সাজানো গোছানো পার্টিতে ইমনের হাত ধরে হাটতে আমার মজাই লাগছিলো।
কিন্তু বিপত্তিটা বাজলো তখনি যখন খাবার সার্ভ করা হলো। খাবারের গন্ধ নাকে আসতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে গা গুলাতে লাগলো। আমি বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে চোখ মুখ শক্ত করে বমিভাব আটকাতে লাগলাম।
” আদি, হুয়াট’স হ্যাপেন্ড, খাচ্ছ না কেন? আর এরকম করে আছো কেন? সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে।”
আমি সামনের দিকে তাকাই, সবাই অদ্ভুত বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি মৃদুসুরে ইমনকে বললাম,
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
ইমন অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।
আমি ভয় পেয়ে জোর করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে মুখে খাবার তুলে নেই। কোন কিছু বুঝার আগেই দাঁড়িয়ে আমি সামনে থাকা টেবিলসহ বমি করে ভাসিয়ে দিতে লাগলাম।
সবাই ঘেন্নায় বিরক্তিতে উঠে যায়। পুরো পরিবেশটাই ভারী হয়ে উঠে।
” এরকম আনকালচারাল ওয়াইফ নিয়ে পার্টিতে না আসলেই হতো?”
এরকম কথা শোনার পর ইমন আমার হাত টানতে টানতে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
যাওয়ার আগেই আরো কিছু কথা অজান্তেই কানে ঢুকে যায়।
” কিরকম কান্ডজ্ঞানহীন মেয়ে, আরে বমি পাচ্ছে ওয়াশরুমে গেলেই পারতি। ”
” কি ইরিটেটিং আমার তিনদিনের খাওয়া চুকে গেলো। উফ্ কি কান্ড আমার মনে হতেই বমি পাচ্ছে।”
” কি অবস্থা পার্টিতে থাকার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেলো কোন কুক্ষনে যে এসেছিলাম।”
ইমন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই নীরবে ভাইয়া এসে দাঁড়ায়।
” ইমন, আমি খুব করে সরি। এখানে এসে ভাবি কে কটু কথা শুনতে হলো। সবার হয়ে আমি দুঃখিত।
প্লিজ এভাবে যাস না। ”
আমি ইমনের দিকে তাকায় ওর রক্ত হীম করা চাওনিতে তাকিয়ে আছে।
” নীরব, আমি দুঃখিত! তুই কেন সরি বলছিস। আমার ওয়াইফের জন্যই তোর সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট হয়ে গেলো৷ প্লিজ মনে কিছু রাখিস না আমি এখন থাকতে পারবোনা।”
ইমন আমাকে নিয়ে গাড়িতে বসলো। একটা কথাও বললো না৷ নিঃশ্বব্দে ড্রাইভ করে গেলো৷ মুহুর্তের মাঝেই শত আলোকবর্ষ দ্বৈরথ তৈরী হয়ে গেলো।
চলবে…