তোমার প্রণয় নগরে পর্ব-১+২

0
1047

তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

(সূচনা পর্ব )

— “আরসাল ভাইয়া আমার সাথে জোরজবরদস্তি করার চেষ্টা করেছে।এই দেখো আমার জামাটাও ছিঁড়ে ফেলেছে !”

এতটুকু বলে শব্দ করে কেঁদে উঠল কিশোরী সায়রা।কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে উৎসব মুখর পরিবেশটা শুনশান শোকে রূপান্তরিত হলো। সবার হাস্যউজ্জ্বল মুখশ্রীতে মুহূর্তে গম্ভীরতা এঁটে এলো ।সবার নজর সায়রার দিকে।ফর্সা মুখশ্রীতে রক্তিমা আভা ছেয়ে । নাকের ডগা লাল টকটকে।অঝোর কান্নায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ছুঁতে যেন রক্ত ঝরা শুরু হবে।সাথে সাথে মুনতাহা খানম সায়রা কে জড়িয়ে ধরে। ডান হাতের হাতার দিকে তাকাতে আহনাফ খাঁন লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে নিলো ।সায়রার জামা বাহু থেকে অনেকটা ছিঁড়ে গেছে।আহনাফ খাঁন ক্রোধে চোখ মুখ শক্ত করে থমথমে বসে রইল।একমাত্র ছেলে আরসাল থেকে কখনো এমন কিছু আশা করেননি তিনি।সায়রা আহনাফ খাঁনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহির আহমেদের বড় মেয়ে।আহনাফ খাঁনের কোন মেয়ে নেই ,সায়রা তার মেয়ের থেকে কোন অংশে কম নয়। ছেলের এমন নিম্ন কাজকে কিছুতে মেনে নিতে পারছেনা আহনাফ সাহেব । বরাবর- ই আরসাল আহনাফ খাঁনের গর্ব ! পরম স্নেহের সন্তান।কিন্তু আরসাল এমন কিছুও করতে পারে, তা উনার ধারণার বাহিরে ছিল।ততক্ষণে আরসাল দোতালার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে।চোখমুখ থমথমে চুল কাপড় এলোমেলো অগোছালো। কিছু বলতে উদ্যত হবে আরসাল ,তার পূর্বে আহনাফ খাঁন সজোরে আরসালের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ।আরসাল থতমত খেয়ে যায়।কিছুতে ্যেন বিস্ময় কাটছে না তার।হল রুম জুড়ে শোরগোল বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি।সব দেখে সায়রা ভয়ে মুনতাহার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। আহনাফ খাঁন দ্বিতীয়বার হাত উঁচু করতে।সায়রার মা সিন্থিয়া এসে বাঁধা দেয়। আহনাফ খাঁন তখনো ক্রোধে থরথর কাঁপছে।গলা উঁচিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল ,

— “ছাড়ো ভাবি! আজ ওর সব পুরুষত্ব বের করবো । সায়রা আমার নিজের মেয়ের থেকে কোন অংশে কম নাকি? ওর সাহস হলো কি করে সায়রার সাথে এসব করার ? ”

আরসালের দিকে আবারো তেড়ে আসতে মাহির আহমেদ বাঁধ সাজল ।বন্ধুকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে নত স্বরে বলল,

— “শান্ত হ! তোর এতো উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়! শরীর খারাপ করবে”

— “শান্ত হবো? ওর সায়রাকে এতোই যখন পছন্দ ছিল ,তাহলে একবার বাড়িতে জানাল না কেন? এমন জঘন্য কাজ কেন করল।মেয়েটা এখনো কিশোরী ,মাত্র পনের বছর বয়স । দুনিয়া দারির হাবভাব কোনকিছু তার বোধগম্য নয়।বাচ্চা মেয়ে্র সাথে এমনটা কি করে করতে পারল? ওর বিবেক বুদ্ধি কি মরে গেছে? ”

বাজখাঁই চিৎকার করে আহনাফ খাঁন বলে উঠল।বাড়িতে হৈচৈ বিশ্রী এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।সায়রার বাবা মা শান্ত থাকলেও তার চাচারা ভীষণ রাগান্বিত।আদরের ভাতিজীর সাথে এমন আচরণ? কোন দিন মেনে নিবে না । ভীষণ ক্ষিপ্ত তারা।আরসালের ফুপু চাচারাও কম নয় ,এমন ঘটনার কথা শোনার পরও তারা আরসালকে সাঁই দিচ্ছে। পরিস্থিতি ধীরেধীরে প্রতিকূলের দিকে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সায়রার বাবা মা আরসালের বিরুদ্ধে টু শব্দ পর্যন্ত করেনি।বরং উনারা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত ।পরিস্থিতি অনুকূলে আনার চেষ্টায় সবার সামনে আহনাফ খাঁন জোরগলায় ঘোষণা জানালো “এই রাতেই আরসাল সায়রার এংগেজমেন্ট হবে।আরসাল দেশে ফিরলে সায়রা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের বিয়ে! ”
আহনাফ খাঁনের এমন ঘোষণায় সবাই চুপ ।সেই সাথে ভীষণরকম অবাকও বটে ।সব থেকে বেশি অবাক সায়রা নিজে। কিছুতে তার বিস্ময় কাটছেনা যেন। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
কি থেকে কি হচ্ছে এসব!
ছোট থেকে আরসালকে সায়রার ভীষণরকম অপছন্দ ।এর পেছনে অবশ্য কারণ অনেক।কিন্তু মুখ্যকারণ হলো আরসালকে সায়রার মা ভীষণ আদর করে।যা সায়রার মোটেও পছন্দ না।আরসাল সায়রার সম্পর্ক অনেকটা সাপ বেজীর ন্যায় ।
আরসাল সায়রাকে ছোট থেকে কড়া শাসনে রেখেছে।কখনো কোন স্বাধীনতা দেয়নি ।এমনকি বন্ধুবান্ধব বাছাইকরণটাও আরসালের পছন্দ অনুযায়ী হতো।সায়রার ভীষণ রাগ হতো। এতো কিসের অধিকারবোধ তার?
এতো অধিকারবোধ ,এতো শাসনে সায়রা হাঁপিয়ে উঠে।মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে আরসালকে তার মোটেও পছন্দ না। ভীষণ অসহ্য লাগে। আরসাল আগামীকাল চারবছরের জন্য কানাডায় পড়াশোনার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।সেই সুবাদে বাড়িতে ছোটখাটো একটা গেটটুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে।সায়রা ভেবেছিল এই বুঝি তার মুক্তি মিলবে ।আরসাল নামক আপদটা তার ঘাড় থেকে নামবে। সে মুক্ত পাখির মত খোলা আকাশে ডানা মেলবে।কিন্তু কে জানত এমন অঘটন ঘটবে?
বাড়ির আর কেউ না জানুক সায়রা তো জানে আরসালের উপর যেই অন্যায় আরোপ লাগানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ।সব সময়ের মত আজও আরসাল সায়রার সাপ বেজীর লড়াই চলছিল।এমন সময় লোডশেডিং হয়।চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে যায়।ছোট থেকে সায়রার অন্ধকারে ফোবিয়া।সামান্য অন্ধকারে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।এই ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটায় সায়রা বিচলিত হয়ে পড়ে।চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।আরসাল সায়রাকে সামলানোর জন্য এগিয়ে আসতে।সায়রা ভয়ে দূরে সরে যেতে নেয়।এক সময় দুজনের ধস্তাধস্তির ভেতর সায়রার জামার হাতা ছিঁড়ে যায়।ততক্ষণাত বিদ্যুৎ চলে আসে।পুরো ঘর আলোয় ভরে যায়।এসব কিছু আরসালের কারসাজি ধরে নিলো সায়রা।সায়রাকে ভয় দেখানোর জন্য সে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে।আরসালের নালিশ করতে বড় বাবার (আরসালের বাবা) কাছে চলে যায়।কিন্তু কে জানত সায়রার বলা দু’বাক্য তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে! সত্যিটা বলতে যেয়েও থেমে যায় সায়রা।
তার কিশোর সরল মনে গভীর ভয় ডুকে গেছে।এখন সবাই সত্যি জানলে তাকেই ঝেঁকে ধরবে।মায়ের কড়া বকুনি শুনতে হবে।তাই আর ঘাটলো না।চুপ করে থাকাটা শ্রেয় মনে করল সায়রা।

এসব কিছুর মাঝে থম মেরে থাকে আরসাল।সে ভীষণরকম হতভম্ব।কেউ একবার তার মতামত জানার প্রয়োজনবোধ করল না? কি হয়েছিল কেউ একটিবার জিজ্ঞাস করল না?
তিক্ত এক অভিমান নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে রইল।
সেই রাতে সায়রা আরসালের এংগেজমেন্ট হলো।আংটি পড়ানোর সময় একবারের জন্যও আরসাল সায়রার দিকে তাকাল না।সারাক্ষণ চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল।আংটিটাও বেশ জোর খাটিয়ে রাগ জেদ নিয়ে পড়াল।আংটি পড়ানোর সময় সায়রার হাতে আরসালের নখের গাঢ় আঁচর পড়ল। চাপা আর্তনাদ করে উঠল সায়রা ,কিন্তু এতে আরসালের বিন্দু পরিমাণ ধ্যান নেই।আংটি পড়িয়ে সোজাসুজি উঠে যায়।রাগ অপমান শরীরে সুঁইয়ের মত বিঁধছে তার।পুরো দুনিয়া বিষের ন্যায় মনে হচ্ছে।এতো অপমান! এতো ঘৃণা! আগে কোনদিন হয়নি তার। সেই রাতে নিজের ঘর থেকে আর বের হলো না আরসাল।সারারাত প্রচণ্ড ভাংচুর করল।ভাংচুরের শব্দ পাশের রুমে থাকা সায়রার কান অবধি ঠিক পৌঁছিয়েছে।সায়রা বেশ বুঝল।রুমের কোন কিছু আর আস্ত অবশিষ্ট নেই।সবকিছু ভাঙাচুরা অর্ধাংশ!
জড়সড় হয়ে কোনরকম নির্ঘুম ভীতিকর রাত পাড় করল সায়রা।ফজরের আজান পড়তে আরসাল ব্যাগপত্র গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ।যদিও ফ্লাইট বিকেলে ,সে ভোর সকালে বিনাবাক্যে বাড়ি থেকে বিদায় নিলো।যাওয়ার আগে অবশ্য একবার মায়ের রুমে এসেছিল । মাকে সালাম করে সায়রার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।ঐ দৃষ্টিতে কি ছিল! রাগ? জেদ? ঘৃণা? নাকি বিরাট কোন প্রলয়ের আগমন বার্তা!

ভালোবাসা ঠিক ততক্ষণি মধুর সুন্দর যতক্ষণ তা ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকে।যখনি সেই ভালোবাসা ঘৃণা প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হয় তখনি বিনাশকারী প্রলয় নামে!

চলবে কি?

তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- 2

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

শুক্রবার।আজ অফিস নেই সিন্থিয়ার।অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ ভোরে ঘুম ভেঙেছে।ফজরের নামায আদায় করে বারান্দার গাছ গুলোকে পানি দিয়ে।নাস্তার কাজে হাত লাগিয়েছে সিন্থিয়া।ছুটির দিনে ভোর সকালে উঠা নিয়ে মাহির আহমেদের হাজারো অভিযোগ আপত্তি ।স্ত্রীর বিরুদ্ধে একরাশ অভিমান জুড়ে বলেন,”তোমার কি আরাম করতে ভালো লাগেনা? সাপ্তাহে একটাই তো ছুটির দিন, সেদিনও তোমার হাজার কাজ! ”
স্বামীর এহেন কথায় সিন্থিয়া কিঞ্চিত হেসে জবাব দেয়,”আমি খেয়ে বসে আরাম করলে এই সংসার চলবে কি করে? ”
এমন নয় পরিবারে প্রচণ্ড অভাব,অভাব মিটাতে সিন্থিয়া চাকরি করছে।স্বামীর ইনকাম যথেষ্ট ভালো ,ছোটখাটো ব্যবসা আছে।চাকরি করার সিদ্ধান্তটা সিন্থিয়ার একান্তই নিজের। ভাগ্য কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় বলা মুশকিল।তাই প্রত্যেক মহিলাকে নিজ যোগ্যতায় সাভলম্বী হওয়া উচিত।
পুরো বাড়ি জুড়ে শুনশান নীরবতা ।সোনালি রোদের আলোয় স্নিগ্ধ এক সকাল।দূর থেকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ঘরের দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে, সাড়া বাড়ি জুড়ে কিচিরমিচির শব্দ গুনগুন করছে। শুনতে অবশ্য বেশ লাগছে সিন্থিয়ার।ছেলেমেয়েরা এখনো উঠেনি।মাহির নামায আদায় করে আবারো ঘুমিয়েছে।শাশুড়ির শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।তাই বিশ্রাম নিচ্ছেন।ছোট ননদের মেয়ে আরমিন সকাল সকাল বেরিয়েছে।কি জানো জরুরী কাজ পড়েছে তার।ফিরে নাস্তা করবে বলে গেছে।ভারী মিষ্টি মেয়ে।সায়রা থেকে বছর খানেক বড়। বাবা মা পরলোক গমন করেছে অনেক বছর ,সেই থেকে আরমিন মামা মামীর কাছে থাকে ।আরমিনকে সিন্থিয়ার বেশ পছন্দ,বেশ নম্রভদ্র গোছানো স্বভাবের মেয়ে।

বেলা দশটা।সূর্য মাথার উপর , এখনো ঘুম ভাঙেনি সায়রার।বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।মেয়ে মানুষ এতবেলা অবধি ঘুমানো সিন্থিয়ার মোটেও পছন্দ নয়।তৃতীয়বারের মত আরমিনকে দিয়ে সায়রাকে ডাকতে পাঠিয়েছে। মনে মনে ভেবে রাখল এবার সায়রা না জাগলে তিনি নিজে যাবেন। কড়া করে কয়েকটা কথা শুনাবে সায়রাকে।
আরমিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিছানার পাশে এসে বসলো।কোমল স্বরে সায়রাকে ডেকে বলল,

–“উঠ সায়রা! আর কত ঘুমাবি? দুপুর হলো প্রায় ।”

ঘুমঘুম পিটপিট দৃষ্টি মেলে আরমিনের দিকে তাকাল সায়রা।আরমিনের ঠোঁটের কোনে বিস্তৃত হাসি।সায়রা কাঁদো কাঁদো মুখ করে ভাঙা স্বরে বলল,

— ‘আর একটু ঘুমাতে দেও না আপু! প্রমিজ আর পাঁচ মিনিট ।”

— “সায়রু! অনেক বেলা হয়েছে।মামী এবার খুন্তি নিয়ে আসবে।সেটা কি ভালো হবে ? ”

মায়ের কথা শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসে সায়রা।এলোমেলো চুল ,ফোলা ফোলা চোখ।ভয়াত্ব মুখ। তা দেখে আরমিন মুখ টিপে হাসলো। নিজ মনে সায়রা বিড়বিড় করে বলল,

— “শান্তি নাই ! কোথাও শান্তি নাই।ঘুমিয়েও শান্তি নাই! ”

কথাটা বেশ জোরে বলল, যা দারজা দাঁড়িয়ে থাকা সিন্থিয়ার কান অবধি ঠিক পৌঁছাল।আরমিনের ফিরতে দেরী হওয়ায় তিনি নিজে সায়রাকে ডাকতে এসেছিলেন।সায়রার কথায় ভ্রু কুঁচকে চাইল।তীক্ষ্ণ চাহনি । ভারী গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল ,

–“দায়িত্বজ্ঞান তো কিছুই নেই।সারাদিন ঘুম আর মোবাইল টিপানো।বেলা কয়টা বাজে সেদিকে খেয়াল আছে? যা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে ঝটপট তৈরি হয়ে নে।আজ আরসালদের বাসায় যেতে হবে!
ছেলেটা এক সপ্তাহ হলো কানাডা থেকে দেশে ফিরেছে। এখনো বাড়ি ফিরেনি।কোথায় আছে কে জানে।”

সিন্থিয়ার শেষের কথায় মমতা ভারী চিন্তার ছাপ। ভীষণ বিরক্ত হলো সায়রা।কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,

— “আমি ঐ বাড়িতে যাবো না।”

–“কেন যাবি না? অন্যসময় তো দিনরাত ঐ বাড়িতে পরে থাকিস ,আজ বিপদের দিনে যাবি না কেন? ”

— “আমাকেই কেন যেতে হবে? তাছাড়া ঐ বাড়িতে আরসাল ভাই্যের ফুপু চাচীরা এসেছে, উনাদের গা জ্বালান কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমি যাবো না। ”

সায়রা নাকচ স্বরে বলল। মেয়ের কথায় রাগ হলো সিন্থিয়ার।ঝাঁঝালো গলায় বলল,

— “কর্মের ফল প্রত্যেক মানুষকেই পেতে হয় সায়রা।এসব তোর কর্মের ফল।”

বিস্ফোরিত নয়নে মায়ের দিকে তাকাল সায়রা।এতে সিন্থিয়ার মুখশ্রীর কঠিন্যত্ব বিন্দু পরিমাণ কমলো না।বরং বাড়ল।মা মেয়ের তর্কাতর্কি দেখে অনেক আগে রুম ছেড়েছে আরমিন।সিন্থিয়া রাশভারী আওয়াজ তুলে বলল,

— “দুনিয়াতে আর কেউ জানুক না জানুক আমি আর তোর বাবা জানি ,সেদিন রাতে আরসালের কোন দোষ ছিল না।ছেলেটার উপর মিথ্যা আরোপ লাগানো হয়েছে।আমাদের নিজের মেয়েকে বেশ ভালো ভাবে জানা আছে।আর আরসালকেও।তুই আমার প্রথম সন্তান।কিন্তু আরসাল থেকে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেছি।এই দুনিয়াতে আমার আর তোর বাবার পর ,যদি তোর কোন ভরসার হাত থাকে! তা হলো আরসাল।ও কোন দিন এমন কিছু করতে পারেনা।যেই ছেলে ছোট থেকে তোর সব প্রয়োজনের খেয়াল রেখেছে ,রক্ষা করেছে আগলে রেখেছে ,সে এমন কাজ করবে তা আমি মানি না ,মানব না।আর যাই হোক “রক্ষক কখনো ভক্ষক হয় না! ”
তুই যেমন আমার মেয়ে আরসালও আমার কাছে তোর থেকে কোন অংশে কম নয়।সেদিন সবার সামনে শুধু চুপ ছিলাম তোর সম্মানের কথা ভেবে,পরিস্থিতির দিকে চেয়ে।সেদিন যদি সবাই সত্যিটা জানত তোকে উল্টো দোষারোপ করত।আরসালের ফুপু চাচীরা কখনো তা সহজ ভাবে নিতো না ,উল্টো তোর উপর চরিত্রহীনার আরোপ লাগাত ।নিজের মেয়ের সম্মানের স্বার্থে চুপ ছিলাম।জানি তোর মনে কোন কুমতলব ছিল না।যা হয়েছে তোর বোকামি আর ছেলেমানুষির জন্য।তুই নিজেও তখন অবুঝ।কথাগুলা তুই সরল মনে বললেও তা ধ্বংসলীলার জন্য যথেষ্ট ছিল। তোর এই ছেলেমানুষির জন্য, আরসালকে বড় মূল্য দিতে হয়েছে।তাদের বাবা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে।”

অনুতপ্ত হয়ে মাথা নুয়িয়ে নিলো সায়রা।আঁখি পল্লব অনুতাপের জলে ভারী । সেই সাথে মায়ের কঠিন কথা গুলো বুকে যেয়ে বিঁধছে ।যদিও আজ নতুন নয় ,এই চারবছরে চারহাজার বার এসব কথা শুনেছে সায়রা।বাবা কখনো কিছু না বললেও ,প্রত্যেকদিন মায়ের এই তিক্ত বুলি শুনে নতুন করে অনুতাপের ঘা গুলো তাজা হ্যে উঠে।এই চারবছর আরসাল দেশ ছাড়লেও সায়রার স্বস্তি মিলেনি। মাঝেমাঝে সায়রার প্রচণ্ড রাগ হয়।হিংসা হয় আরসালের উপর । নিজের মেয়ের থেকে বেশি ,ঐ মানুষটাকে এতো ভালোবাসে কেন তার মা ? শুধু এই কারণটার জন্য আরসালকে আরো বেশি অপছন্দ সায়রার।সিন্থিয়া ,সেই অনেক আগে বেরিয়ে গেছে।আরো কিছুক্ষণ বিছানায় ভাবনাচিন্তায় বিভোর থাকে সায়রা।বেশ কিছুক্ষণ পর তিক্ত অনুভূতি নিয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।

.

বর্ষার দিন।এই রোদ এই মেঘ! আকাশ ঘোলাটে ,চারিদিক অন্ধকার।ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে সায়রা বেরিয়ে পড়ল।গন্তব্য বড় বাবার বাড়ি।খুব একটা দূর নয় ,রাস্তার এপাড় আর ওপাড় ।দু’বাড়ির মাঝবরাবর গলির চিকণ সরু রাস্তা।যা শুধু রিক্সা আর প্রাইভেট কারের জন্য উপযোগী।ঐ বাড়িতে ঢুকতে সায়রা থেমে যায়,অদ্ভুত এক অনুভূতি ,কেমন জানো নীরব থমথমে পরিবেশ।বাড়ি ভর্তি লোকজন তবুও অদ্ভুত এক নিস্তেজ গুমট আবহাওয়া। সকলের মুখে শোকের ছায়া।হুহু কান্নার আওয়াজ।কয়েক কদম ভিতরে যেতে, সায়রার চোখ আটকায় বড় মায়ের কান্না ভেজা মুখখানায় ।গোল গাল পুষ্ট মুখখানা এ কদিনে একদম নেতিয়ে পড়েছে।আহ! বুকটা নাড়া দিয়ে উঠল সায়রার।বড় মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হলো।সায়রাকে দেখে মুনতাহা খানম আরো কান্নায় ভেঙে পড়ল।যথাসম্ভব বড় মাকে শান্ত করার চেষ্টা করল সায়রা।মুনতাহা খানমের আবদার সায়রা কখনোই ফেলতে পারেনা ,আজ উনার আবদারে রাতটা এখানে থাকা।মুনতাহা খানমের দৃঢ় বিশ্বাস ,আজ ছেলে বাড়ি ফিরবে ।ছেলে বাড়ি ফিরে ঘরে বউকে দেখলে শান্ত হবে,ক্ষান্ত ভাবে সবটা বুঝবে।সেই ভাবনা নিয়ে সায়রাকে এখানে আটকানো ।কিন্তু তিনি কি আর জানতেন? উনার ছেলে আর আগের মত নেই!

রাত গভীর।ঘড়ির কাটা ঠিকঠিক তিনের দিকে। গুটিসুটি মেরে বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে সায়রা। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি।আচমকা সায়রার মুখের উপর এক ঝাপ পানি পড়ল। এমন অকস্মাৎ কাণ্ডে ধরফরিয়ে উঠে বসে সায়রা।নিশ্বাস ভারী ,বুকটা দ্রুত বেগে উঠানামা করছে।খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল।পানির উৎস খুঁজতে ,সামনে তাকাতে আঁতকে উঠল সায়রা ।চোখ স্বাভাবিকের থেকে আরো বেশি বড় হয়ে গেল।শরীর থরথর কাঁপছে। সামনে সুঠাম দেহের সুদর্শন দাঁড়িয়ে।মানুষটার ফর্সা মুখশ্রীতে রক্তিমা আভা ছেয়ে।ক্রুদ্ধ চোখ জোড়া থেকে যেন আগুনের ফুল্কি বের হচ্ছে।চোয়াল শক্ত ,রাগে দাঁত কিলবিল করছে। শুকনো ঢোক গিলল সায়রা ,ফিসফিস স্বরে বিরবির করল,

–“আরসাল ভাই! ”

আরসাল ঝাঁঝালো স্বরে আওড়াল ,

— ” পাঁচ সেকেন্ড! জাস্ট পাঁচ সেকেন্ডে রুম খালি চাই।গেট লস্ট! ”

আরসালের ধমকে কেঁপে উঠে সায়রা।পিটপিট নয়ন মেলে আরসালের দিকে তাকিয়ে আছে।ঘুমের রেশ তখনো পুরোপুরি ছাড়েনি।কিছু বুঝে উঠার আগে আরসাল সায়রার বাহু টেনে দাঁড় করায়।দরজার অবধি টেনে আনে। ঘর থেকে বের করে মুখের উপর শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।আরসালের এমন অতর্কিত কাণ্ডে সায়রা থম মেরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।বিস্ময় কিছুতেই যেন কাটছে না তার।মিনিট দুএকের ব্যবধানে দরজা আবার খুলল।অপর পাশ থেকে সায়রার মুখের উপর ওড়না ছুঁড়ে মারল । তারপর কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবারো শব্দ করে সায়রার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।
সায়রা স্থব্দ! হুশ ফিরল অনেকটা সময় নিয়ে। “তবে কি এতোক্ষণ তার গায়ে ওড়না ছিলো না ? ”
তড়বড় করে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিলো সায়রা।

চলবে……..

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।