তোর নামের বৃষ্টি পর্ব-২৯

0
855

#তোর_নামের_বৃষ্টি
#পর্ব:২৯
জাবিন মাছুরা (লেখিকা)
,,
মেঘার কথা শুনে ত্বকির মা হেঁসে দিয়ে বলে উঠলো,

-আমি জানি, তুই যতোটা অবুঝের মতো থাকিস তুই ততোটা অবুঝ নস। সবকিছুই বুঝিস,,,, (ত্বকির মা)

-কিন্তু তোমার ছেলে তো বুঝে না। জান আম্মু তোমার ছেলে কালকে কি বলছে? (মেঘা)

মেঘার কথাই ত্বকির মা ভ্রু কুঁচকে মেঘার চোখ চোখ রেখে বলে উঠলো,

-কি বলেছে? (ত্বকি মা)

মেঘা দাঁতে দাঁতে চেপে উত্তর দিল,

-সে জাইমা আপুকে বলেছে, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। শুধু মাএ আমি ছোট বলে। তার ধারণা আমার সংসার করার বয়স হয় নি। (মেঘা)

মেঘার কথা শুনে ত্বকির মা অবাক হয়ে বলল,

-সত্যি, ডিভোর্সের কথা বলেছে।(ত্বকির মা)

-হ্যাঁ আম্মু। উনি আমাকে একটু ও ভালোবাসে না। আমাকে একটু বুঝে না। আমি তার সাথে আর কখনো কথা বলব না। এমনকি তার মুখ দর্শন ও করব না। (মেঘা)

মেঘার রাগ দেখে ত্বকির মা সান্ত্বনা শুরে বলতে লাগলেন,

-তুই কিন্তু ত্বকিকে ভুল বুঝছিস। এরকম করাটা একদম ঠিক হবে না। তুই ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছিস। (ত্বকির মা)

-না আম্মু আমি ভুল বুঝি নি। আম্মু আমি আর এই বাড়িতে থাকতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি উনার সামনে যেতে পারব না। (মেঘা)

-আচ্ছা ঠিক আছে। তোকে ত্বকির সামনে যেতে হবে। তুই বরং আজকে ত্বকির ইস্টাডি রুম টা গুছিয়ে ওখানে থাক। (ত্বকির মা)

অন্যদিকে,

সাদ এবং তিথির মাঝখানে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রুশা। আনন্দে সারারাত ঘুমোতে পারিনি সে। কালকের রাতটা ছিল রুশার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। পাঁচ বছরের ছোট মেয়েটা জীবনে প্রথম বাবা মায়ের ভালোবাসা পেয়েছে। একটা সন্তান সবসময়ই তার মায়ের সঙ্গে থাকতে চাই। বাবা মায়ের ভালোবাসা পেতে চায়। রুশার প্রচুর অভিমান ছিল সাদের উপর। সাদ কেন তাকে তার মা এনে দেয় না। কেন তার মাকে লুকিয়ে রেখেছে? ‘মা’ নামক তৃষ্ণায়, বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিল রুশা। তিথিকে মা হিসেবে পাওয়ার পর থেকে তার কষ্ট সব হাওয়াতে উড়ে গিয়েছিল। নতুন করে স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছিল রুশার ছোট মনে। তার সপ্ন ছিল বাবা মায়ের সাথে একই রুমে একই বিছানায় ঘুমানোর। রাতের অন্ধকারে তিথি এবং সাদের মাঝখানে শুয়ে রুপকথার গল্প শুনে ঘুমোনর। প্রবল ইচ্ছে ছিল, ঝড়ের দিনে বজ্র পাতের শব্দ শুনার সাথে সাথে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভয়কে দূর করবে।
আজ তার সপ্ন গুলো কিছুটা হলেও ব্যাস্তব রুপ ধারন করেছে।

এদিকে,

আম্মুর কথামতো মনের ভিতরে একরাশ সাহস নিয়ে ত্বকির স্টাডি রুমে এসেছি। পুরো ঘরটাতে বইয়ের রাজত্ব। দেখে মনে হচ্ছে বইয়ের শহর। এতগুলো বইয়ের মাঝে নিজেকে মেহমানের মতো লাগছে। ঘরটা অনেক গোছানো। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ঘরটাতে কোথাও গল্পের বই নেই। সব গুলো বই তার পড়াশোনার। ভেবেছিলাম এখানে বসে গল্পের বই পড়ব।

ঘরটার আশেপাশে দুই রাউন্ড দিলাম। চারপাশে পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে তার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। টেবিলের ড্রয়ারের দিকে চোখ যেতেই আমি আতকে উঠলাম। মনে পড়ে গেল কয়েকবছর আগের ঘটনা।
তখন আমি ক্লাস সেভেন এ পড়তাম। একদিন নানু অসুস্থ হওয়াতে আমারা এই বাড়িতে এসেছিলাম। সেই দিন শেষ বারের মতো এই রুমটাতে এসেছিলাম। তার পর আর কোনদিন ও এই রুমে আসার সাহস হয় নি। ভয় পাওয়ার মূল কারন ছিল সে। আমি তখন ওতো কিছু বুঝতাম না। সেদিন ভুল করে তার স্টাডি রুমে ঢুকে পড়েছিলাম। টেবিলের ড্রয়ার খুলা ছিল বিধায়, ভিতরে একটা ডাইরির দেখেছিলাম। ডাইরির লাল রঙের খুবই সুন্দর দেখতে তাই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ছোঁয়ে দেখতে। মনের ইচ্ছে রাখতে ডাইরিটা বের করে হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু খুলার আগের ত্বকি ভাইয়া আমার হাত থেকে ডাইরিটা কেড়ে নেন। ধমক দিয়ে বলে উঠেন,

-কোন সাহসে আমার ডাইরিতে হাত দিয়েছিস? বিয়াদপ মেয়ে। দিন দিন অভদ্র হয়ে যাচ্ছিস। আর কোনদিন যদি এই ঘরের আশেপাশে তোকে ঘুরতে দেখি, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। স্টুপিড, গেট আউট।

সেদিন তার তিক্ত কথাগুলো আমার ছোট মনে ব্যথা দিয়েছিল। তখন থেকেই তাকে দেখে আমি অনেক ভয় পাই। এরপর কোনদিনও ভয়ে লজ্জায় এই রুমটাতে আসা হয় নি।
,
আজ অধিকার আছে তার প্রতিটি জিনিস পত্রের উপর। তাই আজকে ভয় বা লজ্জা কোনোটাই পাব না। তার ওই লাল রঙের ডাইরিটা খুঁজে বের করব। দেখব কি এমন লিখা আছে ডাইরিটাতে। মনে হয় ডাইরিটা এই ড্রায়ারে রাখা আছে। ড্রায়াটা খুলার জন্য টান দিলাম। কিন্তু লক থাকার কারনে খুলল না। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখে দিল। সিদ্ধান্ত নিলাম যেকরেই হোক চাবি খুঁজে বের করব।

যে কথা সেই কাজ। পুরো রুম তন্যতন্য করে চাবি খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে একটা বইয়ের মাঝে চাবিটা পেয়ে গেলাম। সাথে সাথে চাবিটা দিয়ে ড্রায়ারের খুললাম।
আমার ধারণা সঠিক ছিল, তাই ভেতরে ডাইরিটা পেয়ে গেলাম। ডাইরির পাশে কতগুলো প্যাকেট দেখতে পেলাম। প্যাকেটের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ডাইরিটা বের করে টেবিলের উপরে রাখলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ডাইরির প্রথম পাতা উঠালাম।

প্রথম পাতা ফাঁকা কোন কিছুই লিখা নেই।
দ্বিতীয় পাতা উঠতেই তার নাম ঠিকানা পরিচয় লেখা দেখলাম। পরের পাতা উঠতেই আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আমি এতটাই অবাক হলাম যে, মনে হতে লাগলো ভূমিকম্প হচ্ছে। কারন উপরে আমার ছোট বেলার একটা ছবি। ছবিটা দেখে মনে হলো, তখন বোধহয় আমার বয়স ছয় মাস হবে। ছবিটার নিচে গুটিগুটি অক্ষারে লেখা,

আমার মিষ্টি বউয়ের প্রথম ছবি। আমি আজকে নিজে তুলেছি। তোকে বউ বলছি কেন তা আমি জানি না। তোকে তিথির মতো বোনের জায়গা আমি দিতে পারব না। তোর জন্য আমার মনে অনুভূতি আলাদা। জানিস মিষ্টি বউ, আজকেও তোকে চুমু খেয়েছি। ইশ, তুই কতো কিউট। একদম নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখাতে ইচ্ছে করে রে মিষ্টি বউ মেঘা।

কথাগুলো পড়েই আমার হাত পা কাঁপছে। বুকের ভিতর ধুপধুপ করছে। এমন কিছু আমি জীবনে ও আশা করতে পারি নি। আবার কয়েকটা পাতা পরে লিখা,

বউ, তুই তো দেখি আস্তে আস্তে বড়ো হয়ে যাচ্ছিস।অনেক দিন পর আজ তোকে দেখেছি। পড়াশোনার চাপে তোকে দেখতে যেতে সময় পাই না। বড্ড মিস করি তোকে। কবে যে তুই বড় হবি। আমাকে ভালোবাসবি।
,
শুভ জন্মদিন বউ। আজকে তোর দশ বছর পূর্ণ হয়েছে বউ। আমি অনেক খুশি তুই বড় হয়ে যাচ্ছিস। কালকে আমার মেডিক্যাল পরীক্ষা তাই তোর বার্থডেটে যেতে পারলাম না। আমাকে যে করেই হোক চান্স পেতে হবে। আম্মু বলেছে, চান্স পেলে তুই আমার হয়ে যাবি। তাই আমাকে তোকে পাওয়ার জন্য চান্স পেতে হবে। দোয়া করিস।

এগুলো কি লিখছে ত্বকি ভাইয়া। একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। মনের ভেতর একরাশ উৎসাহ নিয়ে পরের পেজ উঠালাম। যেখানে সুন্দর হ্যান্ড রাইটিন এ লিখা,

সময় পার হচ্ছে বউ। তুই বড় হচ্ছিস। হঠাৎ ফুপা যে, আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তা কখনো ভাবিনি। চিন্তা করিস না, তোর পাশে সবসময়ই আমি আছি।
দেখতে দেখতে তোর জীবনের চৌদ্দ বছর পার হয়ে গেল। এখন তোর উঠন্ত বয়স। শোন একটা কথা বলি তোকে, এই বয়সে তোর মনের মাঝে হাজার চিন্তা দেখা দিবে। দয়া করে এগুলোকে প্রাধান্য দিস নাহ।
,
ওই বউ, তুই আজকে শাড়ি পড়েছিস কেন? তুই কেন বুঝিস না মেঘা তোকে শাড়ি পড়া অবস্থা দেখলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। তুই কি আমাকে পাগল করতে চাস বউ?
,
জানিস বউ আজকে বাবার বিজনেস পাট্নারে মেয়ে জাইমা আমাকে প্রোপস করেছে। বলেছে আমাকে ছেড়া বাঁচতে পারবে না। মা বলছে, জাইমাকে বিয়ে করতে। ছোট বেলা থেকেই তো আমি তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আসছি। কিন্তু এখন তুই বল, তোর জায়গা আমি অন্য কাউকে কিভাবে দেব। জানিস, প্রথমে আমি ভাবতাম পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। শুধু মাএ একটা শব্দ। কিন্তু না, তুই বড়ো হচ্ছিস আর আমি বুঝতে পারছি ভালোবাসা কি জিনিস। তোকে একদিন না দেখে থাকতে পারি না। কষ্ট হয় খুব কষ্ট। তাই আমি এখন থেকে তোকে প্রতিদিন পড়াতে যাব। এতে তোর ও ভালো আমারও ভালো।
,
আমার বিজয়ের দিন যে, এত তাড়াতাড়ি আসবে তা আমি কখনোই ভাবতে পারি নি। আজ মা তার কথা রেখেছে। তোকে বউ হিসেবে উপহার দিয়েছে। তুই বড় মানুষের মতো আমাদের বাঁচিয়েছিস। আমি শুধু মাএ বাবার মুখের দিকে চেয়ে জাইমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। বাবা বলছিল জাইমাকে যদি বিয়ে না করি, তাহলে আমাদের অনেক বড় বিপদ হতে পারে। তুই যদি জাইমাকে পেগনেট হওয়ার কথখ না বলতি তাহলে হয়তো আমি নিজকে বাঁচতে পারতাম না। তোকে হারিয়ে ফেলতাম। তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
,
তুই তো এখন আমার বউ। তাহলে আমাকে দেখে এত ভয় পাস কেন? তুই কেন বুঝিস না আমি তো তোর ভালোর জন্যই তোকে বকি। আমি চাই না আমার অনুভূতি গুলো তুই বুঝতে পারিস। এতে তোর ছোট মনে বাজে প্রভাব পড়েবে। রাতের বেলা তোর কাছে চলে আসি কেন জানিস, কারন তোর ঘুমন্ত মুখ দেখলে নির্ঘাত আমি মরে যাব। এই নির্লজ্জ মনটা শুধু তোকে ছুঁয়ে দেখতে চাই। বল না কবে বড় হবি? আমি যে তোকে কাছে পেয়েও কাছে পাচ্ছি না। আর পারছি না অপেক্ষা করতে। সময় যেন থমকে গেছে। আমি অপেক্ষা আছি সেই দিনের যেদিন #তোর_নামের_বৃষ্টি বৃষ্টিতে নিজেকে বিলিয়ে দিব। বোধহয় আমার অপেক্ষা প্রহর শেষ হবে না।
আমি চাইলে তোকে নিজের করে নিতে পারি। কিন্তু না, আমি চাই তুই বড়ো হ। তোর মনে আমার জন্য অনুভূতি সৃষ্টি হক। তুই আমাকে ভালোবাবি। তোর ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষার থাকব সারাজীবন।।

ডাইরিটা পড়ে আমার বুকে ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে। ডাইরির প্রতিটি পাতা সাক্ষী দিচ্ছে যে, সে আমাকে কতটা ভালোবাসে। আমি এতোদিন নিজের অজান্তেই এই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। আসলেই মানুষটাকে আমি বুঝলাম না।

(চলবে)