নিরব সে পর্ব-০৫

0
1980

৪র্থ পর্বের পর থেকেঃ-

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
৫ম পর্ব

–শুনুন।
এরপর বাকি কথা। জিনিয়ার কাছ থেকে এই ডাক ই শুনতে হচ্ছে ওয়াফিফকে। সে যে কাকে ”শুনুন” বলে ডাকছে সেটা দেখার জন্য বাকিরাও তার দিকে তাকায়। তাই প্রতিবার এমন হওয়ায় জিনিয়াও লজ্জায় লালে লাল হচ্ছে বার বার। জিনিয়া এই বাড়িতে সবার সাথে পরিচিত হলেও সবার সাথে এতোটা মিশে যায় নি যে নিজ থেকে সে কোন কথা বলবে। আর তাই সে এই বাড়িতে আসার পর থেকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার হলে ওয়াফিফকেই জিজ্ঞেস করে এসেছে। এমন কি সে আফিয়া রহমানের সাথেও এতো কথা বলে নি। কিছু করার হলে দেখে দেখে বুঝে নিয়েছে। কথা বললেও খুব কম। আর তাই সে এখনো বুঝতে পারছে না যে কি নামে ডাকলে শুধু ওয়াফিফ ওর দিকে তাকাবে। অন্যরা না। ওয়াফিফ ও কয়েকবার বলেছে তাকে নাম ধরে ডাকার জন্য।

ওয়াফিফ তখনই নিজের ঘর থেকে বাইরে চলে এসেছিল। কোলে দুইটা বাচ্চা। আর আশেপাশে বাচ্চার দল। কেউ কেউ ওয়াফিফের টিশার্ট খামচে ধরে ছিল। যেন ওয়াফিফ এই বাচ্চা টিমের লিডার। এভাবে দেখে সবাই হাসাহাসি করলেও এটা সত্য ওয়াফিফ এই পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলে। তাই ওকে সবাই যেমন ভয় পায়, তেমনি মেনেও চলে। ওয়াফিফের এক আলাদা সম্মান আছে এই বাড়িতে। নিজের ভাইবোন যেমন ওকে ভয় পায়, তেমনি ভাইবোনের বাচ্চারাও। কিংবা প্রতিবেশী বাচ্চারাও। তবে খুব ভালোও বাসে। আর ওয়াফিফ যেন সবার নেতা। হোক না এই বাচ্চা পার্টির ই নেতা। বাচ্চারা ওর পিছনে ঘুরে বেড়াত। প্রতিবেশী বাচ্চারা এমন বেশি করত। কারণ তাদের বাবা মা বলে দিয়েছেন –

”এই ভাইয়া ডাক্তার, সবসময় এর আশেপাশে থাকবে।”

বাচ্চারাও তাদের মাতার আদেশ মেনে নিয়েছে। কেউ এমনিই ঘুরে বেড়ায় পিছন পিছন তো কেউ টিশার্ট ধরে। ওয়াফিফেরও এইসবের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। জিনিয়া এদের মাঝে ওয়াফিফের সাথে কথা কি করে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। আগে তো তাও ঘরের মধ্যে ছিল, তখন যখন তখন ঢুকে কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে ওয়াফিফকে জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। এখন তার মনে হচ্ছে ওয়াফিফ ঘরে ছিল তখনই ভালো ছিল। একে তো ঘর ভর্তি মানুষ, তখন কার কি দরকার বা কার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে কেমন না সেসব সম্পর্কে ওয়াফিফকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। কিংবা এই বাড়ির কোথায় কি আছে সেটাই জিজ্ঞেস করতে ডাকতে পারছে না। আর সে যদি অন্য কাউকেও জিজ্ঞেস করে তাহলে ”নিজে থেকে এইটুকুও খুঁজে নিতে পারছ না তো সংসার সামলাবে কি করে?” এই কথা শোনার ভয় আছে। আর বেশি কথা বললে ”নতুন বউ বাচাল” এই কথা কেই বা না শুনিয়ে থাকে।

এর মাঝে একবার ওয়াফিফকে ডেকেছিল তার খাবার কোথায় দিবে বা কখন দিবে এই কথা জানতে। তখন বলেছিল,

–ডাক্তার সাহেব?

ওয়াফিফ এই কথা শুনে যখন জিনিয়ার দিকে তাকায়, তখন অবাক হয়েছিল শেষ পর্যন্ত মেয়েটা ”শুনুন” কথাটা ছাড়তে পেরেছিল। সে হাসিমুখেই জবাব দিয়েছিল।

–হ্যাঁ?

তবে ওয়াফিফের অবাক হওয়ার কারণ সাধারণত মেয়েরা বিয়ের পর শুরুতেই এই নামে ডাকতে পারে সেটা তার জানা ছিল না। অন্যদিকে জিনিয়া তো এই নামে ডেকেছে কারণ তার মা শিখিয়ে দিয়েছি স্বামীর নাম ধরে ডাকতে নেই। আর তিনি আরও বলেছিলে ”ওগো” ”হ্যাঁ গো” এইভাবে ডাকতে। সরাসরি বলেন নি। শুধু বলেছিলেন- আমি তোর বাবা কে যেই ভাবে ডাকি সেইভাবেই ডাকবি।

জিনিয়া শুধু মাথা নাড়িয়েছিল। এই ওগো হ্যাঁ গো করার চেষ্টা সে হাজারবার করেও মুখ থেকে বের করতে পারে নি। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে গ্রাস করেছিল। কান লাল হয়ে গরম হয়ে আসছিল। তাই ‘ডাক্তার সাহেব’ ডাকটাই তার কাছে বেশ সহজ মনে হয়েছিল। এটা বলা অপেক্ষাকৃত সহজ আর অন্যরাও কিছু মনে করবে না।


ওয়াফিফ নিজের ঘরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আর সাথে আছে চিরচেনা সাথী। সিগারেট। এটা খুব ভালো লাগে ওয়াফিফের। বিয়ে উপলক্ষ্যে সে এতদিন এই জিনিসটা থেকে দূরে ছিল। আজ বাড়িতে কোন মেহমান নেই। তাই তার এই সময়ে জ্বালাতন করার ও কেউ নেই। সিগারেট তার সাথী হয়েছে গত কয়েক বছরের। এখনও আছে। অন্তত মানুষগুলোর মতো ছেড়ে যায় না। শেষ হলেই আবার কিনে নিতে পারে। আর এইসব করে সে পরিবারের থেকে লুকিয়ে। নিজের সীমার মধ্যে থেকে। সে নিজে ডাক্তার। তবুও সিগারেট তার বন্ধু। সত্যিই পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত।

ওয়াফিফের পরিবারে বিশেষ করে তার বাবা মা সিগারেট সহ্য করতে পারেন না। তাই ওয়াফিফ লুকিয়ে ধূমপান করে। প্রথমদিকে কষ্ট হলেও এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে থাকা হয় না তাই কেউ ঠিক জানেই না যে ওয়াফিফ সিগারেট ব্যবহাত করে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে হাসপাতালে কাটায়। আর ফেরার পথে কোন এক ফাঁকা স্থানে এই সিগারেটের সাথে সময় কাটায়। বেশ ভালো কাটে এই সময় তার। সাথে থাকে সিগারেট আর কিছু স্মৃতি যেটা ভোলানোর জন্যই আফিয়া রহমান ওয়াফিফের বিয়ে দিয়েছেন।

তার সেই টানা টানা চোখ, লম্বা নাক আর পাতলা ঠোঁট, দেখলেই মনে হয় কত নাজুক। হালকা ছুঁয়ে দিলেও ক্ষত সৃষ্টি হবে। কত বছর দেখে নি তাকে ওয়াফিফ। তার ছবিও না। কোন যোগাযোগ রাখে নি। তবে যখন নিজেকে একেবারেই সামলাতে পারে না। তখন ১ টি বার দেখার জন্য ছুটে যায়। ঠিকানা জানা আছে। সে কোথায় থাকে সেটা জানে ওয়াফিফ। তার জন্য সে এতদিন বিয়ে করে নি। না, কোনো পিছুটান নেই। সে যাওয়ার আগে সব বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে ওয়াফিফকে। কিন্তু ওয়াফিফ এতদিন হয়তো নিজ ইচ্ছায় সেই বন্ধনে আটকে আছে। সম্পর্কের যেই জাল দিয়ে একেকটা স্বপ্ন বুনেছিল দুজনে মিলে, সেই জাল ছিঁড়ে দিয়েছে সে। ওয়াফিফ আর লাগাতে পারবে না চাইলেও। তবু সেই জাল ধরে রেখেছে সে। এই জালে কোন আশা নেই। সে ফিরে আসবে না। আছে হতাশা। কিন্তু সেই হতাশা নিয়েই আটকে আছি এতো বছর সে। কিছু তো ছিল। হোক সেটা হতাশা। কিন্তু তারী মা তাকে আটকে দিল।

ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। মায়ের নাটক দেখা এজন্যই সে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল।

এইতো গতকাল ঘরে আলোচনা চলছিল। সেটা বড়দের। গুরুজনরা জীবন নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ দিচ্ছিলেন। আফিয়া বেগম যেই না বলতে শুরু করেছেন,

–জীবন মানে …

তার কথা শেষ করতে না দিয়ে ওয়াফিফ অন্যপাশে বসে থেকেই বলে উঠে,

–জীবন মানে জি বাংলা।

এতে সব ভাইবোনেরা হেসে ওঠে। তবে ওয়াফিফের এই রাগের ও কারণ আছে। এই জি বাংলাই তো যত কিছুর মূল। না এরা সব মায়েদের ব্ল্যাকমেইলের উপায় বলে দিত, আর না তার বিয়ে দেওয়ার জন্য আফিয়া বেগম সেই পন্থা অবলম্বন করতেন। ওয়াফিফের তো এখনো বিশ্বাস হয় না তার বিয়েতে রাজি হওয়ার বিষয়টা নাটকীয় হয়েছে, যেটা সে সহ্য পর্যন্ত করতে পারে না। আর এইসব নাটক দেখে দেখ তার মা বেশি বুদ্ধিমতী হয়ে উঠেছেন।

ওয়াফিফ কখনই এটা চায় নি। কিন্তু মায়ের কথা আর ফেলতে পারে নি। নাহলে আরও কি না কি বলে মগজ ধোলাই করতেন সেটা ওয়াফিফ ভালোই জানে।

সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে নিজের চিন্তা ভাবনা উড়িয়ে দিতে দিতে তার খেয়াল নেই কখন ঘরে জিনিয়া প্রবেশ করেছে আর তার পাশে এসেও দাঁড়িয়েছে।

জিনিয়া ওয়াফিফকে না দেখতে পেয়ে ঘরে এসে এক উটকো গন্ধ পায়। যেটা নাকে ভেসে আসতেই তার গা গুলিয়ে আসতে চায়। তাই সে ওয়াফিফের ঘরের বারান্দায় চলে আসে তাজা বাতাসের আশায়। কিন্তু এখানে এসে দেখে সেই উটকো গন্ধের সৃষ্টিকারী আর কেউ না বরং ওয়াফিফ নিজেই। তখন সে ওয়াফিফকে ডাক দেয়।

–শুনুন।

জিনিয়ার ডাকে সে চিন্তা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। অনেক রাত হয়েছিল আর জিনিয়া মায়ের সাথেই ছিল বলে সে বারান্দায় এসেছিল। সে তার মাকে চিনে। জিনিয়াকে দিয়ে বেশি কাজ করাবেন না তিনি। তাই জিনিয়ার মায়ের সাথে থাকা নিয়ে বেশি ভাবে নি ওয়াফিফ। বাকি ভাই ভাবি আর বোনেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর বাবাও এই সময় ঘর থেকে বের হবে না দেখেই সে সিগারেট জ্বালিয়েছিল। কিন্তু জিনিয়ার কাছে এইভাবে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারে নি সে। সাধারণত সে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথেই একেবারে সিগারেট এর কাজ শেষ করে তারপর ভদ্র বাচ্চা হয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ায় আর মেহমানের চাপে এই কয়দিন একেবারে সিগারেট ধরে দেখা হয় নি। সেটাই ধরে দেখতে এসেছিল সে। ভেবেছিল জিনিয়া ফেরার আগেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই জিনিয়া চলে আসে। আবার জিনিয়া প্রেগন্যান্ট এই কথাটা মনে পড়তেই সে সিগারেট নিভিয়ে ফেলে। আর বলে,

–কিছু বলবে?

–আপনি সিগারেট খান?

–হ্যাঁ , মাঝে মাঝে। তবে বাসায় না। এই কয়দিন বাড়ির বাইরে বের হওয়া হয় না তাই আজ বাসায় এভাবে।

–ওহ।

ওয়াফিফ বিষয় ঘোরাতে বলে ওঠে,

–আচ্ছা জিনিয়া।

–জ্বি।

–তুমি আমাকে আবার ”শুনুন” বলে ডাকা শুরু করেছ? আমি তো তোমাকে বললাম আমার নাম ধরে ডাকতে। তুমি শুনুন বলে ডাকলে তোমার এই শুনুন এর উত্তরে কত মানুষ তোমার দিকে তাকাবে জানো? তার চেয়ে কত জন ছেলে তোমার দিকে তাকাবে? এটা কি ভালো?

–না।

–এটাই তো।

–তাহলে আমি আপনাকে কি বলে ডাকব?

–আমার নাম ধরে?

–না।

–কি না? পারবে না?

–না।

–তাহলে সেদিন ডাকলে না কি বলে যেন? হ্যাঁ, ডাক্তার সাহেব। এটা বলে ডেক। এছাড়া আমাদের বাড়ির কেউই ডাক্তার না। আমি তো জোর করে হয়েছিলাম। আর আমি সবার বড় দেখে আমাকে সবাই দেখত। ডাক্তার হতে গিয়ে অনেক পড়াশোনা করতে হয় এটা জানার পর আর কেউ ডাক্তার হতে চায় নি। তাই এই নামেই ডাকবে। ঠিক আছে?

–হুম।

–এখন যাও ঘুমিয়ে পড়।

জিনিয়া মাথা নেড়ে চলে গেল। ওয়াফিফ ও কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘুমাতে চলে গেল।

চলবে।

[রিচেক করি নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আর ধরিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ]
Sadia Hq Sr.