নিরব সে পর্ব-০৬

0
1357

৫ম পর্বের পর থেকেঃ-

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
৬ষ্ঠ পর্ব

–আপনি সিগারেট খান কেন?

বিছানায় শুয়ে এই প্রশ্ন করবে কি করবে না এটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল জিনিয়া। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। সে এই বাড়িতে আসার পর সর্বোচ্চ কথা ওয়াফিফের সাথে বলেছিল। তবুও এতটাও কাছাকাছি তারা নয় যে একেবারে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসবে। তবুও জিনিয়ার এই মানুষটাকে জানার ইচ্ছা প্রবল। এই মানুষটাকে তার প্রচুর ভালো লাগে। এমন মানুষ কি আসলেই হয়? তাকে কি সুন্দর মেনে নিল? এতটাও ভালো কি সত্যিই কেউ আছে পৃথিবীতে? থাকার কথা তো না হয়তো। জিনিয়া তাই এই মানুষটাকে সম্পূর্ণ জানতে চায়। কিন্তু তাকে জানতে হলে তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। যেটা জিনিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। জিনিয়া ওয়াফিফকে একটা প্রয়োজনীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে গেলেই ১০ বার ভাবে। ১০ বার ভাবার পরও হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না। সেখানে শুধুমাত্র কৌতূহলের বশেই যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে সেটা কি ঠিক হবে? জিনিয়া চায় না তার কোথায় কেউ আঘাত পায় এমনটা হোক। এই জন্য নিজে সব সময় চুপ থাকতেও রাজি। আর সেটা যদি ওয়াফিফ হয় তাহলে সে সারা দিন না কথা বলে থাকতে পারবে। তবু কোন প্রশ্ন করবে না।

চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে জিনিয়ার মাথায়। একেক সময় একেক টা। যতই সময় যাচ্ছে , তার চিন্তা ততই গভীর হচ্ছে। সে চাচ্ছে না এতো চিন্তা করতে। তবুও অনেক ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে তার মস্তিষ্কে। সে চাচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়ুক, যাতে আর ভাবনা না আসে। কিন্তু সে চেয়েও ঘুমাতে পারছে না। একজন হয়তো ঠিকই বলেছেন।
আমরা যখন অনেক করে চাই যে ঘুমিয়ে পড়ি, তখন ঘুম আসে না। আবার যখন চাই ঘুমাব না, তখন ঘুমের ঘোরে বেশি থাকে মানুষ। আবার অনেকে ঘুমানোর জন্য চিন্তার সাহায্য নেয়। কারো চিন্তায় ঘুম আসে না তো কেউ চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সেটা টেরই পায় না। বড়ই অদ্ভুত মানবদেহ ও তার কার্যাবলী !

জিনিয়া ঘুমানোর চেষ্টায় বিছানায় নিজের জায়গায় শুয়েই একেক বার একেক দিকে ঘুরছে। একবার ডান দিকে তো একবার বাম দিকে। তবু ঘুমের দূরদূরান্ত পর্যন্ত দেখা মেলে নি। পাশেই থাকা ওয়াফিফ কারো অনবরত নড়চড় থেকে আর ঘুমাতে না পেরে চোখ খুলে তাকায়। সে জিজ্ঞেস করে,

–জিনিয়া, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

–জ্বি, না।

–ঘুম আসছে না?

–হুম।

খুব ধীরেই বলল কথাটা। এতো ধীরে যেন ওয়াফিফ শুনতেই না পায়। তার খারাপ লাগছে এখন, সে কেন এতো নড়তে গেল? তার জন্য ওয়াফিফের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু ওয়াফিফ তার কথাটা শুনতে পেল। ওয়াফিফ জিনিয়াকে বলল,

–এখন ঘুমিয়ে পড়, কাল অনেক কাজ আছে। আর আমি তোমাকে সেদিন একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বলেছিলাম। তুমি দেও নি। কাল সকালে আবার দিও । ওটা বলা জরুরি। আর মনে না করিয়ে দিলে আবার ভুলে যাবো।

–এখনই বলুন।

–কেন?

–নাহলে আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়ার কথা আমারও মনে থাকবে না।

এইবারও কথাটা ধীরেই বলল জিনিয়া। কিন্তু রাত হওয়ায় ধীরে বলা কথাও ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে। তাই ওয়াফিফ জবাব দিল,

–আচ্চা, তোমার মনে করানোর দরকার নেই। আমিই বলব। এখন ঘুমিয়ে পড়। আর কোন কথা চিন্তা করো না। আর একটা কথা, তোমার কি সিগারেট সহ্য হয় না?

–না।

–ওকে। তাহলে আর তোমার সামনে সিগারেট বের করব না। তাছাড়া এটা বেবির জন্যও ঠিক হবে না। এটা নিয়ে আর চিন্তা করো না, ঘুমিয়ে পড়।

বলেই ওয়াফিফ চোখ বন্ধ করে ফেলল। জিনিয়া আবারো ধীরেই বলে উঠল,

–ওটা ছেড়ে দেওয়া যায় না?

জিনিয়া বলার পর থেকে ওয়াফিফ চুপ করে থাকল। কোন কথা বলল না। জিনিয়া ভাবল সে কেন বলতে গেল কথাটা। হয়তো ওয়াফিফ শুনে নি। ভালোই হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়লেই ভালো।

অনেকক্ষণ পর ওয়াফিফ বলে উঠল,

–আমি … আমি চেষ্টা করব ছেড়ে দেওয়ার। নাহলে বেবির সমস্যা হতে পারে।

জিনিয়া এই শুনে আর কিছু বলল না। শুধু মনে মনে ভাবল,

”আমি ওটা বেবির কথা ভেবে বলি নি, আপনাকেই বলেছিলাম , ডাক্তার সাহেব।”


সকালে আবার ওয়াফিফ জিনিয়ার আগেই উঠল। এটা ওর অভ্যাস। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাইরে হাঁটতে যাওয়া। কিন্তু এই কয়দিন বাইরে হাঁটতে যাওয়া হয় নি। সে গত কয়েক বছরের অভ্যাস যে ২ – ৩ দিনেই খেয়ে বসে আছে আর যেকোনো সময় হজমও করে ফেলতে পারে, ভালোই বুঝতে পারছে। সত্যিই মানুষের অলস হতে বেশি সময় লাগে না। আজকাল সকালে উঠতেও ইচ্ছা হয় না তার। তবে প্রায় অনেক পুরনো অভ্যাস হওয়ায় হয়তো সে না চাইতেও উঠে পড়ে। এই ২ দিনে ঘুম থেকে উঠে আবার জিনিয়াকে ডেকে বিছানায় শুয়ে পড়ার অভ্যাস ও গড়ে উঠছে তার। তাই সে দেরি না করে জিনিয়াকে ডেকে তুলল। জিনিয়া ফ্রেস হতে চলে গেলে সে আজ আর ঘুমাল না। গত রাতের কথা মনে পড়তেই সে বিছানায় সোজা হয়ে বসে রইল আর জিনিয়ার বের হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকল।

কিছু সময় পর জিনিয়া বের হলে সে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে। কিন্তু তার মুখ থেকে আর কথা বের হল না। জিনিয়াকে ভেজা চুলে খারাপ লাগছিল না। অন্যরকম অনুভূতি তার মনেও এসেছিল। যতই হোক, সে তো একজন পুরুষ। নিজের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ আনলেও কিছুটা হলেও তো অনুভূতি তার কথা না মেনে থাকবেই। কিছু মুহূর্তের জন্য তার অদ্ভুত সব ইচ্ছা জাগ্রত হলেও মুহূর্তেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনল সে। নিজের চিন্তা চেতনাকে এক পাশে সরিয়ে সে জিনিয়াকে বলে উঠল,

–আজ তোমার চেক আপের জন্য যাবো। বিকালে তৈরি থেক। আর যেরকম বলছি , সেরকম করবে , ঠিক আছে?

জিনিয়া মাথা নাড়িয়ে আবার তোয়ালে দিয়ে নিজের চুল মুছতে থাকল। ওয়াফিফ আবার বলে উঠল,

–আর তোমার প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট আমাকে দিয়ে দিও। ওটা আমি আমার কাছে রাখব। সঠিক সময় আসলে বাড়িতে জানাব যে তুমি প্রেগন্যান্ট, আর সেটা আমার বাচ্চা, ঠিক আছে?

এই কথা শুনে জিনিয়া চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। জিনিয়ার কি হল সেটা আর জানা নেই। তবে সে মুহূর্তে সে গিয়ে ওয়াফিফকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ওয়াফিফ জিনিয়ার অবস্থা বুঝতে পারল। তাই তাকে সরানোর চেষ্টা করল না। বরং সেখানেই বসে থাকল, আর জিনিয়াকেও নিজের দুহাত দিয়ে আগলে নিল। জিনিয়ার কাছে ওয়াফিফ এখন সম্পূর্ণ ভরসার একটি স্থল বলেই মনে হল। কিছুক্ষণ পর সে কি করেছে খেয়াল হতেই সরে দাঁড়াল। ার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ওয়াফিফ জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে সে কি বোঝাতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পেরে হাসিমুখে জবাব দিল,

–আর কিছু বলব না , এখন যেতে পারো।

ওয়াফিফের বলা দেরি, কিন্তু জিনিয়ার রুম থেকে বের হতে ১ সেকেন্ডও দেরি হয় নি। সে বারান্দায় তোয়ালে মেলে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ওয়াফিফ জিনিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। আর ভাবল, বউ জুটেছে একটা তার কপালে। মুখে একটা কথাও বলবে না। তার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে হবে সব। জিনিয়ার মনের কথা বুঝতে এখন থেকে তার বেশ পরিশ্রম করতে হবে।

ওয়াফিফ হাত মুখ ধুয়ে বাইরে হাঁটতে চলে গেল।


বিকালে ,
ওয়াফিফ আর জিনিয়া ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছে। ওয়াফিফ সামনে আর তার পিছনে জিনিয়া হেঁটে চলেছে। জিনিয়া হাঁটছে আর ভাবছে যে আজ ওয়াফিফ নিজের কাজ থেকে দুপুরে ফিরে আবার বিকালেই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। একটুও বিশ্রাম নেওয়ার সময় পেল না। দুপুর বলতে একপ্রকার বিকাল বলা যায়। ৩ টায় বাড়ি ফিরে আবার সব দ্রুত শেষ করে ৪ টায় বের হওয়া আর তার আগে আফিয়া রহমান কে রাজি করানো কম কথা নয়। জিনিয়া নিজের প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট ওয়াফিফকে সকালেই দিয়ে দিয়েছিল এটা ওয়াফিফ কোথায় রেখেছে সেটা ওয়াফিফ ছাড়া কেউ জানে না। তারপর আসলো দুপুরে মাকে রাজি করানো। ওয়াফিফ তার মাকে বলল, জিনিয়াকে নিয়ে একটু ঘুরে আসবে। আসার পর থেকেই সে বাড়িতে আসে। আশেপাশের পরিবেশ চিনে না। যদি কখনো দরকার পড়ে তাহলে কিভাবে কি করবে, সেজন্যই শুধু কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা একটু চিনিয়ে দিবে। কিংবা আজ একটু নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসবে। আফিয়া রহমান প্রথম দিকে একটু চিন্তা করলেও পরে তিনি রাজি হয়ে যান। অবশ্য তিনি জিনিয়ার উপর সন্তুষ্ট। ওয়াফিফের গাইডলাইন পেয়ে জিনিয়া ভালোই শাশুড়ির মন জয় করতে পেরেছে। আর তাই আফিয়া রহমান কে রাজি করাতে বেশি কষ্ট করতে হয় নি। কিন্তু তখন আবার জিনিয়া আফিয়া রহমানের আঁচল ধরে পিছনে লুকিয়ে পড়ে আর মাথা নিচু করে ডানে বামে ঘোরায়, যার অর্থ সে যাবে। সে মায়ের কাছে থাকবে। এতে করে আফিয়া রহমান আরও খুশি হয়ে নিজে থেকেই জিনিয়াকে পাঠিয়ে দেয়। সকালে ওয়াফিফ এটাই জিনিয়াকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তাতেই মা রাজি হয়ে যায়। সত্যিই ওয়াফিফ তার মাকে ভালোই চেনে।

এসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া একটু পেছনে পড়ে যায়। আর সে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াফিফ কে খুঁজতে থাকে। মানুষের ভিড় মোটামুটি পর্যায়ে আছে। ওয়াফিফ অনেকক্ষণ ধরে নিজের আশেপাশে জিনিয়ার অস্তিত্ব না পেয়ে জিনিয়া আদৌ তার সাথে আছে কি না সেটা দেখতে পিছনে তাকিয়ে দেখে জিনিয়া নেই। সে মাথা একটু উঁচু করে ভীরের মধ্যে জিনিয়াকে পেয়েও যায়। তারপর নিজে পিছনে গিয়ে জিনিয়ার হাত ধরে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে। জিনিয়া প্রথমে ভয় পেলেও পরে ফাঁকা জায়গায় আসার পর ওয়াফিফকে দেখে চুপ হয়ে যায়।

–কোথায় জাচ্ছিলে। সাথে সাথে চলতে পারো না। এখন আমি তোমার হাত ধরে হাঁটব। আর এতে কোন ‘না’ শুনব না। তুমিও ভালো বাচ্চার মতো আমার পিছন পিছন আসবে।

বলেই আর দেরি না করে জিনিয়া র হাত ধরে ওয়াফিফ ভীরের মধ্যে আবার চলা শুরু করে আর এক পর্যায়ে ঈক্তা রিকশায় উঠে যায়। রিকশায় ওঠার পরও সে জিনিয়াকে এক হাত দিয়ে ধরে রাখে। যাতে জিনিয়া পড়ে না যায়। ওয়াফিফের এই ছোট ছোট খেয়াল রাখা গুলো জিনিয়ার বেশ ভালো রাখছে।

”মানুষটা সত্যিই ভালো, অনেক ভালো।”

মনে মনে ভাবে জিনিয়া।


ডাক্তারের সাথে দেখা করে জিনিয়াকে নিয়ে সে নিজে যেই হাসপাতালে কাজ করে সেখানে নিয়ে আসে। শহরের ভেতরে কোন হাসপাতালে এখন ওয়াফিফ জিনিয়াকে দেখায় নি। আর যাকে দেখাল, তিনি হলেন ড. আফসানা রায়। তিনি ওয়াফিফের পরিচিত। তিনি জিনিয়ার চেক আপ করে ওয়াফিফ কে তার অবস্থা সম্পর্কে জানান আর পরে কবে আবার চেক আপের জন্য আসতে হবে সেটা বলে দেন। তারপর আবার রিকশায় করে ওয়াফিফ আর জিনিয়া ফিরে আসে ওয়াফিফের হাসপাতালে। ওয়াফিফ একটা বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে গত সাড়ে ৪ বছর ধরে। ওয়াফিফ জিনিয়ার রিপোর্ট নিজের কেবিনের একটা লকারে আটকে রেখে জিনিয়াকে নিজের কেবিন দেখায় আর ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে। একজন ইমারজেন্সি পেশেন্ট আসায়। তাকেই দেখতে চলে যায়। জিনিয়া বসে বসে বোর হচ্ছিল। তাই সে ওয়াফিফের কেবিনের টেবিলের কাছে যায় আর দেখতে থাকে। তার নজরে পড়ে ওয়াফিফের আইডি কার্ড। সেখানে দেখতে জিনিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

ওয়াফিফের বয়স ৩১ বছর। জিনিয়া নিজে হিসাব করে। তার বয়স ২৩ বছর। কয়েকদিন পর ২৪ হবে। আর ওয়াফিফের কয়েক মাস আগেই ৩১ হয়েছে। তার মানে ওয়াফিফ তার থেকে ৭ – ৮ বছরের বড়?

চলবে।

[রিচেক করি নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ধরিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ। হ্যাপী রিডিং]

Sadia Hq Sr.