নিরব সে পর্ব-০৭

0
1235

৬ষ্ঠ পর্বের পর থেকেঃ-

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
৭ম পর্ব

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে জিনিয়া ওয়াফিফের সাথে একবারও কথা বলে নি। আজ তার ভীষণ ইচ্ছা করছে ওয়াফিফের উপর রাগ করার। বিশেষ করে হাসপাতাল থেকে। তারা খুব দ্রুতই বাড়ি ফিরে এসেছিল। যাতে কেউ কোন প্রশ্ন না করতে পারে। তাছাড়া আফিয়া রহমান যেখানে নিজে অনুমতি দিয়েছেন, সেখানে কেউ কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেত না। তবুও সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। তাই দ্রুত ফিরে এসেছে। সেই যে হাসপাতাল থেকে বের হয়েছে, তখন থেকে ওয়াফিফের সাথে একটা কথাও বলে নি জিনিয়া। শুধু প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়েছে। এর বেশি কিছু না। রাস্তায় জিনিয়া যখন হাওয়াই মিঠাই এর দিকে অনেক সময়ের জন্য তাকিয়ে ছিল, তখন ওয়াফিফ তাকে সেটাও কিনে দিয়েছিল। কিন্তু তাও জিনিয়া কিছু বলে নি। রাতে খাবার টেবিলেও কিছু বলে নি। সবার সাথে সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিল। কিন্তু ওয়াফিফের সাথে কথাই বলছিল না। ওয়াফিফের বেশ অবাক লাগল। যেই জিনিয়া কি না শুধু তার সাথেই কথা বলত, সে আজ তার সাথে কথাই বলে নি। এক বাক্যও না। এতক্ষণে ৫ লাইন বলা মেয়ে ১ লাইনও বলে নি। কেন?

এদিকে জিনিয়া ভেবে যাচ্ছে, ওয়াফিফ নিশ্চয়ই হাসপাতালের ওই নার্সের প্রেমে পড়েছে। কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছিল লোকটা। কই? তার সাথে কথা বলার সময় তো বুড়ো এতো হাসে না। হাসি যেন তখন উপচে পড়ছিল। কি দরকার ছিল এতো হেসে কথা বলার। একটা ছেলের সাথে হাসুক, কাশুক, যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু একটা মেয়ের সাথে অতো হেসে কথা বলার কি দরকার? সামনে বউ, তাও সদ্য বিবাহিত নতুন বউ বসে আছে, আর উনি নার্সের সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন? রোগীর ব্যাপারে কথা বললে মুখে হাসি না থেকে মুখ গম্ভীর করে রাখত।

এসব চিন্তায় যখন এক দিক বিবেচনায় হচ্ছে, তেমনি অন্য দিকে জিনিয়া এটাও ভাবছে – ওয়াফিফের সাথে তো তার চেনা জানা শুধু কয়েকদিনের। কিন্তু এই কয়দিনেই কি সে এই অধিকার অরজন করেছে যে সে ওয়াফিফের উপর রাগ বা অভিমান করবে। এটা কি বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে না। নিজের চিন্তায় সে নিজেই উলঝে আছে। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক , সেটা নিজে বুঝতে পারছে না জিনিয়া। নিজে একটা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে, তো তার বিপরীত যুক্তিও সে নিজেই দাঁড় করাচ্ছে। নিজেই গুলিয়ে ফেলছে তার কি করা উচিত।


পরের দিন সে স্বাভাবিক ব্যবহারই করল ওয়াফিফের সাথে। তবে সেই আচরণে ছিল এক জড়তা, যেটা বুঝতে ওয়াফিফের দেরি হল না। সে শুধু সুযোগ খুঁজছে যে কি করে জিনিয়ার সাথে কথা বলবে, কিন্তু পাচ্ছে না। জিনিয়া সকাল থেকেই ওয়াফিফের কথা অনুযায়ী আফিয়া রহমানের সাথে থাকে। এছাড়া ভাবি সুফিয়াও আছেন। সুফিয়া আর জিনিয়ার মধ্যে ভালো বন্ধন তৈরি হয়েছে। যদিও জিনিয়া তেমন একটা কথা বলে না। অন্যদিকে সুফিয়া কথা বলায় ওস্তাদ। ভালোই মিলেছে দুজনের। সুফিয়া আর জিনিয়া একসাথে থাকলে সবসম্য সুফিয়াই কথা বলে। আর জিনিয়া মাঝে মধ্যে হা হু করে। মাথা নাড়ে। সুফিয়ার ক্ষেত্রেও ভালোই হয়েছে, সুফিয়ার কোন কথায় যদি ভুল ধরত তাহলে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হত এটা নিশ্চিত। কিনতি জিনিয়া চুপচাপ থাকা মেয়ে। সবার কথায় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলানো ওর স্বভাব। তাই ওর সাথে কেউ চেয়েও ঝগড়া করতে পারবে না। এ দিক থেকে সাংসারিক শান্তি বজায় থাকছে। এই নিয়েও বেশ খুশি আফিয়া রহমান। সুফিয়া বেশি কথা বললেও সে খুব মেনে চলে আফিয়া বেগমের তাই কোন চিন্তাই নেই তার। সুফিয়া ওয়াফিফের মেজ ভাই আফরান রহমানের স্ত্রী। তার থেকে ছোট বোন মিলা, ভাই আরিফ আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে মিনা। আফরান একটা কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করে। মিলা ভার্সিটির চতুর্থ বর্ষে। আরিফ ভার্সিটির ১ম বর্ষে আর আর মিনা দ্বাদশ শ্রেণীতে। এখানে আফরান আর সুফিয়া ছাড়া সবাই জিনিয়ার থেকে ছোট। কিন্তু জিনিয়ার তাও অবাক লাগে, ওয়াফিফের ছোট ভাই হয়েও আফরান এর বিয়ে আগে হয়েছে।

সকাল থেকে ওয়াফিফের বাড়িতে আরেক তোড়জোড় চলছে। জিনিয়া আর ওয়াফিফ দুজনে জিনিয়ার বাড়িতে যাবে। সাধারণত বিয়ের পর ৩ দিন ওয়াফিফের বাড়িতে থাকার পর ই জিনিয়া বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিতু ওয়াফিফ হাসপাতালের কাজে আটকে গিয়েছিল। আগের ছুতিও বাতিল করেছিল সে। এটার কারণ জিনিয়া নিজেই , কথা বলতে বলতেই জিনিয়া একদিন বলে উঠেছিল,

–আপনাকে কি আপনার চাকরি থেকে বহিস্কার করে দিয়েছে?

–না, কিন্তু এটা কেন মনে হল?

–আপনি এত দিন ধরে বাসায় আছেন কিন্তু আপনি একজন ডাক্তার।

–আমার কাজের কথা ভাবতে হবে না তোমার। ওটা তো মা ২ সপ্তাহের ছুটি নিতে বলেছিল তাই…

–২ সপ্তাহ?

–হুম।

–ওহ।

–সমস্যা নেই, আমি আবার কাল থেকে হাসপাতালে যাবো।

–কিন্তু এখনো তো ২ সপ্তাহ হয় নি। ১৪ দিন হতে তো এখনো দেরি আছে।

–কিন্তু আমি চিন্তায় আছি। আ তুমি জিজ্ঞেস করলে, এরপর অন্যরা জিজ্ঞেস করলে মান সম্মানের ১২ তা বাজবে, অনেক কথা শুনতে হবে। মনে করিয়ে দিয়ে ভালোই করেছ।

এর পর থেকে হাসপাতালে যাওয়া শুরু করে ঠিকই, কিন্তু মাঝে এক রোড এক্সিডেন্টে এক সাথে অনেক রোগী ভর্তি হয়, তাদের দেখতে গিয়েই অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওয়াফিফ। এর মাঝে জিনিয়ার বাড়িতে যাওয়ার কথা এক প্রকার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আর জিনিয়া নিজেও মুখ ফুটে কোন কথা বলার মেয়ে না। এদিকে আফিয়া রহমান ও কয়েকবার বলার কথা ভেবেও ভুলে গিয়েছিলেন। সেদিন জিনিয়ার বাবা ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করল তখনই ওদের খেয়াল হল আর ওরা সব দিক দেখে যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলল।

জিনিয়া যাওয়ার আগে শেষবারের মতো নিজের ব্যাগ চেক করতে উপরে এসেছিল। কিন্তু তখন জিনিয়া রুমে ঢোকার কিছু সময় পর ওয়াফিফ ও ঢুকে পড়ে আর বলে ওঠে,

–তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও জিনিয়া?

জিনিয়া ওয়াফিফের এমন হঠাৎ ডাকে চমকে ওঠে আর সোজা হয়ে দিয়ে পিছনে ঘোরে। কারণ ওর মাথায় এখনো আছে কে ওয়াফিফের ঘরের সামনে তালগাছ আছে আর সেখানে পিঠা কাকুর ভুত থাকে। আই দিনের বেলা হওয়া সত্ত্বেও ভয় পেয়ে যায়। ও হয়তো এই কথা ভুলেও যেত, কিন্তু মিলা আর মিনা সেদিন যখন মেনে নিল যে সত্যিই পিঠা কাকু আছে, তাহলে ভুত ও আছে। তাই এখনো সে সেই কথা মাথায় রেখেছে। আর ওয়াফিফের কণ্ঠও গম্ভীর ছিল, যার কারণে ওয়াফিফ কে সে আবার সেই ভত ভেবে বসে। ওয়াফিফ সাধারণত জিনিয়ার সাথে কথা বলার সময় অতটা সিরিয়াস ভাবে কথা কখনো বলে নি। দিনে দুপুরে ভুত আসার সম্ভাবনা না থাকলে যেকোনো কিছু হতে পারে। জিনিয়া ওয়াফিফ কে দেখে বলে উঠে,

-ওহ, আপনি।

–হ্যাঁ আমি। আর আমি বলছি, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?

এর উত্তরে জিনিয়া ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না জানাল। তারপর আবার নিজের লাগেজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওয়াফিফ জিনিয়ার এই কথা বিশ্বাস করল না। সে জিনিয়াকে আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। প্রথম দিকে জিনিয়া পাত্তা না দিলেও এখন বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। এক কথা কেন বারবার জিজ্ঞেস করছে ওয়াফিফ ? সে রেগেই বলে উঠল,

–আমাকে কেন এতো জিজ্ঞেস করছেন? যান না , হাসপাতালের ওই নার্সকে জিজ্ঞেস করুন। উনি বলে দিবেন সব।

জিনিয়ার পুরো কথা বলার পর খেয়াল হল যে সে কি বলেছে। সে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওয়াফিফ প্রথম দিকে কথাটা শুনে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারল যে কি হয়েছে। সে জিনিয়াকে আবার ডাকল। আগের বার রাগ হলেও এবার জিনিয়া লজ্জায় মুখ তুলল না, পিছনেও ঘুরল না। ওয়াফিফ জিনিয়ার ২ বাহু ধরে ওকে সামনে ঘোরাল আর ওকে বিছানায় বসাল। তারপর ওর দিকে ঝুকে বলে উঠল,

–তুমি কি জেলাস?

জিনিয়া সাথে সাথে মাথা ডানে বামে জোরে জোরে কয়েকবার নাড়াল। এটা দেখে ওয়াফিফ আবার হেসে ফেলল। ওয়াফিফের হাসির আওয়াজ শুনে জিনিয়া মাথা তুলতেই ওয়াফিফের হাসি মুখ দেখতে পেল। যেটা দেখে সে নিজেই সেখানে আটকে গেল। ওয়াফিফের হাসি মুখ তার কাছে বেশ ভালো লাগল। ওয়াফিফ ও জিনিয়ার এমন মুখ দেখে নিজের হাসি থামিয়ে বলল,

–কাল ওই নার্স তোমার সম্পর্কে কথা বলছিল আর অভিনন্দন জানাচ্ছিল, এর বেশি কিছু না। আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আর এই জন্য কাল থেকে তুমি আমার সাথে কথা বলছ না?

এই কথা শুনে জিনিয়া আবার মাথা নিচে নামিয়ে ফেলল। অয়াফিফ জিনিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠল,

–ঠিক আছে, আমি এরপর থেকে কোন মেয়ের সাথে কথা বলব না, বললে তোমার সামনে বলব। ঠিক আছে?

জিনিয়া এখন বেশ লজ্জা জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে। সে নিজের শাড়ির আঁচল একবার ঠিক করছে তো একবার নিজের কানের পিছনে চুল গুঁজে দিচ্ছে, যদিও মখের সামনে চুল ছিল না। তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। সে জবাব দেওয়ার মতো কোন কথা পেল না। ওয়াফিফ আবার বলে উঠল,

–এর পর থেকে মনে আমাকে নিয়ে কোন কথা বা সন্দেহ থাকলে আমাকে বলে ক্লিয়ার হয়ে নিবে। এভাবে মনে মনে কথার জাল বুনবে না। আর চিন্তা করবে না বেশি। ঠিক আছে? আরে কথা বলছ না কেন? জবাব দাও।

জিনিয়া কোনোমতে মাথা একবার নেড়ে বলল,

–হুম।

–এবার নিচে চল। তোমার লাগেজ আমি নিয়ে যাচ্ছি আর গাড়িতে অপেক্ষা করছি, মায়ের সাথে আর কারো সাথে কথা বলার থাকলে বলে আসো। বেশি দেরি কর না। রোদ বাড়ছে। রাস্তায় জ্যামে আটকে গেলে তোমার মাইগ্রেনের ব্যথাও বেড়ে যাবে। জলদি কর।

বলেই ওয়াফিফ বিছানা থেকে লাগেজ তুলে সেটা নিয়ে চলে যেতে লাগল। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে সে আবার বলে উঠল,

–তবে জিনিয়া, মাঝে মাঝে ঝগড়া করা সম্পর্কে বাঞ্ছনীয়, তোমাকে বেশ মানায় এতে। সম্পর্কও মজবুত হয়। তবে বেশিক্ষণ রাগ বা অভিমান নিয়ে থেকো না। আর আমি তো আছিই রাগ ভাঙাতে।

চলবে।

[রিচেক করি নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে আর ধরিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ]

Sadia Hq Sr.