নিরব সে পর্ব-০৮

0
1440

৭ম পর্বের পর থেকেঃ-

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
৮ম পর্ব

পুরো রাস্তা জিনিয়া ওয়াফিফের সাথে কথা বলে নি। তার নিজের অনেক অনুভূতির সংমিশ্রণে কি প্রকাশ করবে তাই বুঝতে পারছিল না। সে কেন রাগ করল, কিংবা অভিমান করল নাকি কি সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আর এই ছোট্ট একটা কারণে সে ওয়াফিফের সাথে কথাও বলে নি ভাবতেই নিজের মাথায় নিজেই মারতে ইচ্ছে করছে। আবার ওয়াফিফ কি ভাবল তাকে নিয়ে সেটাও তার মাথায় ঘুর ঘুর করছে। কি করে সে সব সামলাবে, কি করবে কিংবা কি করে একসাথে থাকবে ওরা, এসব চিন্তা আরও বেশি মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । গাড়িতে বমি করার অভ্যাস তার নেই। কিন্তু আজ সেটাও করল। অবশ্য এই সময়ও ওয়াফিফই ওকে সামলিয়েছে। নিজের মাথা চেপে ধরতেই কারো চিন্তিত কণ্ঠ ভেসে এলো তার কানে,

–তুমি কি ঠিক আছো জিনিয়া?

জিনিয়া শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে সিটে বসে রইল। সামনের সিটে বসায় সূর্যের আলো ভালোই লাগছিল তার উপর। তাই ওয়াফিফ ওকে পিছনে বসিয়ে আবার গাড়ি চালানো শুরু করল। জিনিয়ার মাথা ব্যথা রোদের জন্য হচ্ছে না কি ওয়াফিফের চিন্তায় সেটা ভাবার পরও বুঝতে পারল না জিনিয়া। তাই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করাই শ্রেয় মনে করল সে। যদিও মাথা ব্যথা এবার রোদের কারণেই বেড়ে চলেছে আর তার কাছে আপাতত মাইগ্রেনের ব্যথার ওষুধ ও নেই। সেই শেষবার খেয়েছিল তার নিজের গায়ে হলুদের দিন। তারপর ওষুধের নতুন পাতাটা বাসায় রেখে এসেছিল। জিনিয়ার বাড়ি আর ওয়াফিফের বাড়ি বেশি দূর না আবার বেশি কাছেও না। তাই সে কিছু না করে বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতে থাকল।

ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল হয়তো। কিন্তু হঠাৎ চোখ খুলল জিনিয়া। কোন কারণ ছাড়াই। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর বেশ চেষ্টা করেছে সে। আর রাস্তায় জ্যাম বলে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। নিজের চোখ বন্ধ করে রাখতে রাখতে যেন চোখ ও ক্লান্ত। আর তাই চোখ খুলে ফেলল। এতক্ষণ চোখ বন্ধ রাখায় ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। কিন্তু সত্যিকারের ঘুম আসছে না। কিন্তু হঠাৎ চোখে পড়ল এক চেনা মুখ। সেই চেনা মুখ যেটা সে গায়ে হলুদের দিন দেখেছিল শেষ বার। তখন গাড়ি চলছিল। তাই দেখার স্থায়িত্বকাল খুবই কম ছিল। জিনিয়া গাড়ির পিছনের কাঁচ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু এবার আর দেখপা মিলল না জাবিরের। তাই সে সোজা হয়ে বসে। নিজের মাথায় হাত রাখল আর আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিজে ভুল দেখেছে এই ভেবে ঘুমানোর চেষ্টা করল। যদিও বাসায় পৌঁছাতে আর বেশি সময় লাগবে না।

–আচ্ছা, জান, তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?

–আমি? আর তোমাকে ভুলব? অসম্ভব। একদিন দেখবে তুমিই আমাকে ভুলে যাবে।

–আমি তো ভুলব না। কিন্তু দেখা যাক কে কাকে আগে ভুলে যায়। আমার তো ভোলা অসম্ভব।

–দেখব, কত দিন টিকে থাকে তোমার কথা।

–আর যদি তার আগেই আমি মারা…

–জাবির, প্লিজ, এমন কথা বল না। আমি সহ্য করতো পারব না। কেন জেনে শুনে আমাকে কষ্ট দেও। প্রতিবার। আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, আমার সামনে আর এরকম কথা বলবে না, তাও তুমি বার বার আমাকে এই কথা বলে আঘাত কর। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমার জীবনে আমার পরিবারের পর তুমি আছো। আর তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কেন বল? তুমি কি সত্যিই একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

বলতে বলতে চোখে পানি চলে এলো জিনিয়ার। জাবির ওকে পাশ থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

–জান জিনি, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না, তুমি একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছ। আমি তো জাস্ট কথার কথা বলছিলাম। এতো বছর ধরে আমরা একসাথে আছি, তাও বিশ্বাস হয় না তোমার? ওকে বাবা আর বলব না। এবার তো কান্না থামাও।

জিনিয়া তাও কেঁদেই চলেছে। আবির এবার একটু জোরেই বলে উঠল,

–জান, স্টপ ক্রায়িং। চুপ করো।

জাবিরের ধমক শুনে জিনিয়া চুপ হয়ে গেল। জাবিরী আবার বলল,

–এবার হাসো তো। একটু।

জাবিরের কথা বলার ধরণ শুনে জিনিয়া হেসে ফেলল। জাবির ওকে জড়িয়ে ধরেই বলে উঠল,

–সবসময় এভাবে হাসবে। জিনি?

–হুম।

–জিনি।

–হুম।

–জিনি


ঘুমের ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল জিনিয়া। সামনে তার ছোট ভাই জারিফ তাকে ‘জিনি’ ‘জিনি’ বলে ডেকেই চলেছে। আর সে এতক্ষণ স্বপ্নে দেখছিল জাবির তাকে ডাকছে। বুঝতে পারল এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। নিজের শহরে ফিরে আসার সাথে সাথেই স্মৃতি গুলো যে এতো তাড়াতাড়ি হানা দিবে, সে কল্পনাও করে নি। তবে যেই স্বপ্ন তা দেখছিল সেটা সত্য ছিল। একদিন কলেজ ক্যাম্পাসেরই ঘটনা। কিন্তু এখন সেটা স্বপ্ন। এখন চাইলেও তারা এক হতে পারতো না। জিনিয়া এখন আলাদা বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিল। আর তখনকার সময় আর এখনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।

–এই জিনি, বাড়িতে গিয়ে ঘুমা। গাড়িতে কি সারাদিন বসে থাকবে?

জারিফের ডাকে ঘোর কাটে জিনিয়ার। সে বাইরে বেরিয়ে এসে বাড়ির দিকে পা বাঁড়ায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাতে গেলে ওয়াফিফ বলে উঠে,

–আমি একবার বাজিয়েছি। এখনই দরজা খুলে দিবে।

এই শুনে আর বেল বাজায় নি। কিছু সময়ের মধ্যেই হাসি মুখে দরজা খুলে দেন জিনিয়ার মা। জিনিয়া তাকে দেখেই সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধর এটার মাকে। ওয়াফিফ ও সালাম দেয়। তিনি তাদের সালামের উত্তর দিয়ে ভেতরে আসতে বলেন। ওয়াফিফ লাগেজ নিয়ে ঢুকে পড়ে। জিনিয়া ঢুকে যেই না বসতে যাবে সোফায়, তার আগেই জারিফ সেখানে বসে পড়ে আর বলে,

–নে, বাড়ি এসেছিস, এবার আমার সেবা কর। পা টিপে দে জিনি।

জিনিয়া কে এই কথা বলে নিজের পা সামনে থাকা টেবিলের উপর উঠিয়ে দেয় জারিফ। জিনিয়া নিজের কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে বলে ওঠে,

–তবে রে জিরাফ।

–আমি জিরাফ না, আমি জারিফ।

প্রতিবাদী স্বরে বলে ওঠে জারিফ। জিনিয়ার এমন কাজে ওদিকে দাঁড়িয়েই হাসা শুরু করে দেয় ওয়াফিফ। বেচারাকে এখনো কেউ বসতে বলে নি। জিনিয়ার মা চুলায় খাবার বসিয়েছিলেন রান্না করতে, তাই ওয়াফিফকে ঘোরে ঢুকতে বলে আবার রান্না ঘরে চলে যায়। আর ওয়াফিফ লাগেজ নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। সে তখনও জিনিয়ার রুম কোথায় সেটা জানে না। জিনিয়া আর জারিফের কাজে জোরে হাসা শুরু করলে ওয়াফিফের হাসির শব্দে দুই ভাই বোন ওর দিকে তাকায়। মানুষটা বাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে আছে দেখে লজ্জা পেল দুজনেই। বাড়িতে নতুন ওয়াফিফ তাই জিনিইয়া ওকে বলে,

–আপনি আমার সাথে চলুন।

বলেই হাঁটা ধরে নিজের রুমের দিকে । ওয়াফিফ ও তার পিছনে লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু করে। পিছন থেকে সোফায় বসা জারিফ জোরে বলে ওঠে,

–দুলাভাই, আপনি এখনো আপুর পিছনে পিছনে চলেন? দাপত দেখিয়ে সামনে হাঁটবেন। ওই শুঁটকি কিছু বললে আমাকে বলবেন। আমি সোজা করে দেব জিনি আপুকে।

এটা শুনে জিনিয়ার রাগ সপ্তম আকাশে উঠে যায় যেন। সে কোন মতে ওয়াফিফকে নিজের রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বলে উঠে,

–আমি আসছি, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় জিনিয়া। এখন মূল কাজ জারিফ এর সাথে মারামারি করা। ওয়াফিফ জিনিয়ার এই চঞ্চল রুপ প্রথম দেখল। সে ভাবছে তার পরিবার যদি এই রুপ দেখে তাহলে নিশ্চিত ওই দিন ওয়াফিফের হাসপাতালে ৭ তা বেড বুক করে রাখতে হবে। তবে তার বেশ ভালোও লাগল। জিনিয়া একেবারেই চুপচাপ না।


এই কয়দিন ওয়াফিফ কে জিনিয়ার বাড়ি থেকে হাসপাতালে যেতে হবে। যদিও গাড়ি আছে নিজের । তাই চিন্তা কম। কিন্তু রাস্তাটা বেশ বড়। আর রোজ এভাবেই যেতে হবে। অনেক কষ্ট হবে ওয়াফিফের তাই ভাবছে জিনিয়া। আগেই ওয়াফিফ বিয়ে উপলক্ষ্যে ছুটি নিয়েছিল। বেশি দিন না হলেও এখন যদি আবার ছুটি নেয় সেটা কেমন দেখায়। তাছাড়া হাসপাতালে ডাক্তার কম পড়লে রোগীর সমস্যা হবে তাই ভেবে ওয়াফিফ আর ছুটি নেয় নি। জিনিয়ার বাড়ি থেকেই কাজ করবে সে। এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম দিকে জিনিয়ার বাবা মা অনেক মানা করলেও সে মানে নি। ডাক্তারদের কোন ছুটি নেই, এই মন্তব্যে সে আটকে আছে। জিনিয়া প্রথম দিকে ওয়াফিফের কথা ভাবলেও পরে ওয়াফিফের মতো করে ভাবার পর তার গর্ব হয়। ওয়াফিফ এর মতো মানুষ সে হয়তো আর দেখে নি। ওয়াফিফ এর প্রতি সম্মান আরও বেড়ে যায়। তখন সে নিজেই তার বাবা মা কে বুঝিয়েছে ওয়াফিফ এর কাজ নিয়ে আর ওরা রাজিও হয়ে যায়। জিনিয়ার পরিবার টা ছোট। বাবা মা আর দুই ভাইবোন। এইটটুকুই । তবে অন্য আত্মীয়রা অন্যান্য শহরে আলাদা থাকে। মাঝে মধ্যে তাদের সাথে দেখা অয়। বিশেষ কোন সময় ছাড়া আবার অনেকের দেখা মিলে না। এই ওদের ছোট পরিবার। ওয়াফিফ কে যে ওরা ১ সপ্তাহের আগে ছাড়ার চিন্তায় নেই – সেটাও স্পষ্ট। কিন্তু এর মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা।

নিজের ভাবনার বিভোর হয়ে খোলা মাঠে বসে ছিল জিনিয়া। এসব ভাবনারা তার মস্তিষ্কে জাল বুনে চলেছিল কথার। এই মাঠ তার বাসা থেকে কিছু দুরেই। ৪-৫ মিনিটের রাস্তা। এখানে বিকালে নিরিবিলি পরিবেশে বেশ ভালো লাগে জিনিয়ার। মাঠ টা বড় হওয়ায় অনেক মানুষ থাকলেও খোলামেলা মনে হয়। এখানে আগে অনেক সময় পার করত বসে থেকেই জিনিয়া। হঠাৎ এক আওয়াজে ঘোর কাটে তার।

–জিনি?

চলবে