নিষিদ্ধ বরণ পর্ব-১৬+১৭

0
225

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৬)

মাহদী শান্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও থাকতে পারছে না। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসছে। নাকের পাটা ফুলছে ঘন ঘন। শ্বাস ছাড়ছে ভারী ভারী। ঘামে ভেজা শার্টটা আরও ভিজে উঠছে। অস্থির হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বারান্দার এপার থেকে ওপারে যেতে মন ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” কাপড় ইস্ত্রী করতে দিয়েছে, বাবা। বিকেলে খালামনি দিয়ে যাবে। ”

মুহূর্তেই মাহদীর মাথা গরম হয়ে গেল। মেজাজ সাত আসমান পার হলো বুঝি! এই নিয়ে চার বার ও ঘরে পাঠাল মনকে। প্রথম বার জানাল, কাপড় পাউডার দিয়ে ভিজিয়েছে। পরের বার বলল, ধুচ্ছে। তারপরের বার রোদে শুকাতে দিয়েছে। আর এখন বলছে ইস্ত্রী করতে দিয়েছে। কেন? সে কি একবারও বলেছে কাপড় ধুয়ে দিতে? আবার ইস্ত্রী করতে? যেখানে শাশুড়িকেই এসব কাজ থেকে দূরে রেখেছিল মাহদী। সেখানে নিহিতার হস্তক্ষেপ একদম পছন্দ হচ্ছে না তার। বরঞ্চ বাড়াবাড়ি ঠেকছে। অসহ্যও!

এদিকে ঢাকায় ফেরত যাওয়ার আগে একবার শিহাবের সাথে দেখা করার কথাও ছিল মাহদীর। দুপুরের নামাজ শেষ করে রওনা দিবে ভেবেছিল। এখন তো মনে হচ্ছে নামাজটাও পড়া হবে না। মাহদী গা থেকে শার্ট খুলতে উদ্যত হলো। আর কতক্ষণ নোনাজলে শরীর ডুবিয়ে রাখবে? শার্টের উপরের দিকে বোতাম খুলতে খুলতে নিচে আসতে থেমে যায় আচমকা। কী ভেবে সরাসরি দৃষ্টি রাখে অদূরে বড় বাড়িটির মূল দরজায়। খুব একটা স্পষ্ট না হলেও তার মনে হলো পর্দা নড়ছে। কেউ যেন ছুটে পালাল! নিমিষেই মুখের ভাব বদলে গেল মাহদীর। কপালের চামড়ায় দীর্ঘ ও গভীর ভাঁজ পড়ে। পাশ দিয়ে মন ছুটে যেতে নিলে হাত ধরে ফেলল। চাপা গলায় বলল,
” রুমে যাও। ”

মন বাবার দিকে তাকাল। চাহনি বলছে, বাবার কথাটি মানতে চাচ্ছে না সে। ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। খালামনির কাছে থাকতে তার খুব ভালো লাগে। কী মিষ্টি করে কথা বলে! কত আদর করে! ছুটাছুটি খেলা খেলে। আবার মায়ের গল্পও বলে। যেগুলো বাবা তাকে বলেনি। খালামনি বলেছে, এই গল্পগুলো শুধুমাত্র সেই জানে। আর কেউ না।

মাহদী চিন্তা জগৎ থেকে ফিরে ছেলেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। নাক দিয়ে বুকে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
” অনেক ছুটেছ। এবার গোসল করতে হবে। ”

মন হাসির চোটে কিছু বলতেই পারল না। বাবা যখন বিছানায় নামিয়ে গেঞ্জি খুলছে তখন বলল,
” আজ খালামনির কাছে গোসল করি, বাবা? ”

মাহদী কোনো ভাবনায় না গিয়ে বলল,
” না। ”
” কেন? ”

মাহদী চুপ থেকে বলল,
” তুমি বড় হয়েছ তাই। ”
” বড় হলে খালামনির কাছে গোসল করা যায় না? ”
” না। ”
” কিন্তু খালামনি যে বলল, গোসল করিয়ে দিবে। ”

মাহদী আবারও চুপ হয়ে গেল। সেই সময় কারও পায়ের শব্দ ভেসে এলো। মাহদী বুঝতে বুঝতে পায়ের আওয়াজটি তার নিকটে চলে এসেছে। সে ঘাড় ঘোরাতে চোখ পড়ল একদম নিহিতার মুখে। অন্য সময়ের মতো ওড়নার এক প্রান্ত মুখে চাপা দেওয়া নেই। মাহদী ছিটকে এক কদম পাশে সরে গেল। নিহিতা অপ্রস্তুত হলো। পরক্ষণে মিষ্টি হাসল। হাতের প্যাকেটটা মাহদীর দিকে বাড়িয়ে স্বাভাবির স্বরে বলল,
” গোসল করে এটা পরে নিবেন। ”

প্যাকেটটার দিকে সন্দেহ দৃষ্টি মাহদীর। ভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কী এটা? ”
” পাঞ্জাবি। একদম নতুন। আপনার পছন্দ হবে। ”
” কী করে বুঝলে আমার পছন্দ হবে? নিজের পছন্দের উপর এত বিশ্বাস? ”
” আমার পছন্দের উপর নয়। ”
” তাহলে? ”
” আপনার পছন্দের উপর। আমি জানি কালো রঙ আপনার খুব প্রিয়। ”

মাহদী বিস্মিত হলো। চিন্তায় পড়ল। পাঞ্জাবিটা নিবে কী নিবে না দ্বিধায় ভুগছে। দ্বিধান্বিত অবস্থায় দরজার দিকে হেঁটে আসলে নিহিতা বলল,
” রেখে যাচ্ছি, পরে নিয়েন। বিকেলের আগে অন্য কাপড় পাচ্ছেন না। নামাজ পড়বেন তো নাকি? ”

মাহদী থামল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বারান্দায় নেমে আসল। চেয়ারটাতে বসতে ক্লান্ত ভাব ছড়িয়ে পড়ল তনু-মনে। মনকে নিয়ে নিহিতা উঠোনে নামতে মাহদীর টনক পড়ল। আপনমনে প্রশ্ন করল, ‘ তার উপহার গ্রহণ করার জন্যই কি এত কিছু করল? নাহলে ধোয়া কাপড় আবার ধুতে যাবে কেন? তার মধ্যে পরার জন্য একটি কাপড়ও রাখেনি। নিহিতা এত বোকা? ‘

মাহদী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। রুমে ফেরত যেতে নিলে মোয়াজ্জিনের সুমধুর ডাক কর্নগহ্বর দিয়ে মন ও মস্তিষ্ক ছুঁয়ে দিল। সাথে সাথে উঠোনে নেমে আসল। বড় বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে ডাকল,
” মা? ”

আসমা রহমান ভেতরে রান্নাঘরের কাজ করছিলেন। মেয়ে জামাইয়ের ডাক শুনতে পাননি। খবর নিয়ে গেলেন রিন্টুর মা। হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে দ্রুতপদে ছুটে আসেন। শাশুড়িকে দেখে মাহদী বলল,
” বাবার একটা পাঞ্জাবি দেওয়া যাবে? ”

আসমা রহমান কারণ জানতে চাইলেন না। কাঠের আলমারিতে ভাঁজ করে তুলে রাখা একটা নতুন পাঞ্জাবি এনে দিলেন।
___________
মনকে নিয়ে নামাজে যাওয়ার আগে নিহিতার দেওয়া পাঞ্জাবিটা মনের হাতে দিয়ে বলল,
” এটা খালামনিকে দিয়ে আসো। নানিকে বলে আসবে, আমরা এক চাচ্চুর বাড়িতে যাচ্ছি। ফিরতে বিকেল হবে। ”

মন আদেশ পেয়েই দৌড়ে চলে গেল। ফিরে এলো মিনিটের মধ্যেই। ছেলেকে নিয়ে গেইট পার হয়ে রাস্তায় পা রাখে মাহদী। ঢিলে হওয়া পাঞ্জাবির পকেটে হাত রেখে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতের ট্রেনেই ঢাকা ফিরবে। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মন খারাপ করা মেয়েটিকে সে আর মন খারাপ করাতে চায় না। মেয়েটিকে যে নায়রা খুব ভালোবাসত!

___________
” সকালে গেলে হতো না, বাবা? ”

আসমা রহমানের অনুরোধে মাহদী হালকা হাসল। তার হাত থেকে চামচ নিয়ে তরকারির বাটি থেকে একটু ঝোল তুলে নিল নিজ পাতে। ভাত মেখে মনের মুখে দিতে দিতে বলল,
” চিন্তা করবেন না, মা। রাতে সফর করা অভ্যাস আছে আমার। ”

আসমা রহমান অনুরোধের স্বরটা গাঢ় করতে চাইলে মাহদী দ্রুত বলল,
” আপনার হাতের মোয়া মনের খুব পছন্দ হয়েছে। বানানো আছে কি? তাহলে ওর জন্য…”
” হ্যাঁ, আছে তো। তোমরা খাও, আমি এখনই বোয়ামে ভরে দিচ্ছি। ”

আসমা রহমান তড়িঘড়িতে চলে গেলে মাহদী চৌকস হাসল। বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে। এভাবে অনুরোধ রক্ষা করতে গেলে এ বাড়ি ছাড়া হবে না তার। যদিও সে বুঝতে পারছে মেয়ের অভাবটা তাদের দিয়ে পূরণ করতে চাচ্ছে। তবুও কিছু করার নেই। তাকে যে যেতেই হবে। যত দ্রুত সম্ভব।

খাওয়া পর্ব শেষ করতে আসমা রহমান মোয়া ভর্তি বোয়াম নিয়ে আসলেন। সাথে আরও কিছু শুকনো খাবার ও ফলফলাদি। মাহদী ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সহজমনে সব কিছু গ্রহণ করল। এরশাদ রহমান এলেন তারও কয়েক মিনিট পর। হাতভর্তি শপিং ব্যাগ। বিছানায় রেখে একগাল হেসে বললেন,
” দুই দিন বলেছ বলে যে দুই দিন থাকবে বুঝতে পারিনি। তাহলে এগুলো আরও আগে কিনে আনতাম। এখন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সব ঠিকঠাক…”

শ্বশুর কথা শেষ করার আগেই সামনে থেকে জড়িয়ে ধরল মাহদী। চাপা গলায় বলল,
” নায়রা নেই কিন্তু তার সাজানো সংসারটা এখনও আছে। একবারটি আসবেন তো? ”

এরশাদ রহমানের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। মন ভারাক্রান্ত হলো। বুকের কোথাও একটা চিনচিন ব্যথা উঠল। মাহদী আরেকটু গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” সে জীবিত থাকতে ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি। এখনও কি পারব না, বাবা। ”

এরশাদ রহমান কাঁপা হাত রাখল মাহদীর পিঠে। ছলছল চোখে বলল,
” আসব। অবশ্যই আসব। খুব শীঘ্রই। ”

মাহদী খুশি হলো। কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল। শ্বশুরকে ছেড়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস গলায় বলল,
” নায়রা আপনার গায়ের রঙ পায়নি কিন্তু গন্ধটা পেয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি নায়রাকে….”

মাহদী কথাটা শেষ করতে পারল না। লজ্জায় চিবুক লাল হলেও সেই প্রথম দিনের মতো বলল,
” আজকালকার ছেলেরা বাবার সাথে মিশে বন্ধুর মতো। মেয়ে পটানো থেকে শুরু করে কোথায়, কিভাবে, কয়টা চুমু খাবে এ সকল পরিকল্পনা করে হাতে মদ ভর্তি গ্লাস নিয়ে। আমি ভালো দেখে বউয়ের কথা বলেছি। তাও আপনার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ”

এরশাদ রহমান আগের চেয়েও বেশি লজ্জা পেলেন। বিব্রত হলেন। অস্বস্তি কাটাতে বললেন,
” আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ”

তিনি পর্দা ঠেলে বেরিয়ে যেতে মাহদী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে খেয়াল করল দরজার ওপাশে একটি নারী ছায়া। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে মনের চুলে আঙুল ডুবাল মাহদী। চুল ঠিকঠাক করে বলল,
” খালামনির থেকে দোয়া নিয়ে আসো। ”

মন খুশিমনে বেরিয়ে গেল। দরজার পাশে খেয়াল না করে উঠোনে নামতে গেলে নিহিতা পেছন থেকে জড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। নিজেদের বারান্দায় পৌঁছে নামিয়ে দেয়। ধার ঘেষে বসে বলল,
” সত্যি চলে যাচ্ছ, ছোট আব্বু? ”

মন উত্তর দেওয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” মিথ্যামিথ্যি যাওয়া যায়, খালামনি? ”

নিহিতা হালকা হাসল। মনের কান টেনে বলল,
” দুষ্টুমি হচ্ছে? ”

মনও হাসল। নিহিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভার কণ্ঠে বলল,
” তোকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। আরও কয় দিন থেকে যা না। ”
” বাবাকে বলো। বাবা থাকলে আমিও থাকব। ”
” তোর বাবা আমার কথা শুনবে না। ”
” শুনবে। আমার বাবা খুব ভালো। ”

নিহিতা আর কথা প্যাঁচাল না। সরাসরি বলল,
” তুই গিয়ে বল। ”
” কী বলব? ”
” আরও কয়েক দিন থাকতে। ”
” আমি বললে থাকবে? ”
” হ্যাঁ, তুই তো বললি তোর বাবা খুব ভালো। তোর আবদার ফেলতে পারবে না। আর যদি রাজি না হয় কান্নাকাটি করবি। ”
” এমনি এমনি কাঁদব? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিন্তু আমার যে কান্না পাচ্ছে না, খালামনি। ”
” জোর করে কাঁদবি। তোর বাবা তোকে খুব ভালোবাসে। কাঁদতেও হবে না। কাঁদার ভান করলেই রাজি হয়ে যাবে। ”

মন নিহিতার দিকে তাকাল। অসন্তুষ্টের চাহনি! বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি বাবাকে ধোঁকা দিতে পারব না। ”

কথাটা বলে মন হাঁটা ধরে। বাবার কাছে ছুটে যাওয়ার আগে হাত ধরে ফেলে নিহিতা। মন ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে নিহিতা শক্ত করে চেপে ধরে। হঠাৎ কী যে হলো! মনকে ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে ফেলে দিল। উপর থেকে গড়িয়ে একটা ভাঙা ইটে মনের মাথা বাড়ি খেলে নিহিতা গগন বিদারী চিৎকার করে উঠল। ভয়ে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

নিহিতার চিৎকার শুনে মাহদী রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আসমা রহমান পেছনে। এরশাদ রহমান গেটের বাইরে রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলছিলেন। তিনিও দ্রুত কদমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। উঠোনের মাঝামাঝিতে পৌঁছাতে মাহদীর গলা পেল,
” মন? আমার বাবা? চোখ খোল। ”

মন চোখ খুলতে গিয়েও পারল না। কপালের রক্ত গড়িয়ে চোখের পাতা ছুঁতে জ্ঞান হারাল।

আসমা রহমান নাতির কাছে বসে উদ্বিগ্নচিত্তে মেয়ের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” ও পড়ল কিভাবে? ”

নিহিতা দুর্বল গলায় বলল,
” জানি না। ”

মাহদী ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের জন্যে ছুটলে এরশাদ রহমান সঙ্গী হলেন। আসমা রহমান গেট পর্যন্ত এগিয়ে থেমে গেলেন। রিকশাটা দূরে মিলিয়ে গেলে মেয়ের কাছে এসে বললেন,
” মন তো তোর সাথেই ছিল। ”

নিহিতা ভয়ে ভয়ে বলল,
” আমি একটু ভেতরে গেছিলাম। তারপর বাইরে এসে দেখি..”

নিহিতা আর কিছু বলতে পারল না। বারান্দার মেঝেতে ভার ছেড়ে বসে পরনের জামাটা খামচে ধরল। নাভি শ্বাস তুলে নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘ এত বড় মিথ্যে কিভাবে বললি, নিহিতা? ‘

চলবে

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৭)

মনকে আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করার পর ছেলেকে দেখার সুযোগ পেল মাহদী। ভয়ে, আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় তার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে যেন! মৃতপ্রায় শরীরটা সামনে এগিয়ে নেওয়ার শক্তিতুকুও নেই বুঝি! হাত-পায়ের অসাড়তা কাটাতে সময় নিয়ে ফেলল কয়েক সেকেন্ড। পা দুটো জোরপূর্বক টেনে নিয়ে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়াল। মনের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে চোখ পড়তে তার বুকটা আরও একবার কেঁপে উঠল। আত্মা ফাটা ভয়ংকর চিৎকারটা ভেতরে চাপা দিয়ে তীরবেগে ছুটে যায় কলিজার টুকরার নিকট। কপালে, চোখে, গালে, হাতে অজস্র চুমু খেতে খেতে কেঁদে ফেলে। কান্না-বিজড়িত গলায় বলল,
” আমার বাবাটা! আমার প্রাণটা! আমার আত্মাটা! ”

মন ঘুমিয়ে থাকায় বাবার উষ্ণ ভালোবাসায় সাড়া দিতে পারে না। কান্না দেখতে পায় না। চোখ মুছে দিয়ে আদুরে কথা বলে না। মাহদীর রাত ফুরাল ছেলের হাত ধরে বসে থেকে। এরশাদ রহমান নাতিকে এক ঝলক দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। ফোন করে মনের বর্তমান অবস্থা জানানো হলেও স্ত্রী স্বচক্ষে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। কান্নাকাটি জুড়ে দেওয়ায় তিনি আর না করতে পারলেন না। এদিকে মাহদীর আচরণও ভালো ঠেকছে না। ছেলের কাছ থেকে নড়বে তো দূর চোখের দৃষ্টি পর্যন্ত অন্য দিকে নিচ্ছে না। ছেলেটা পাগল হয়ে গেল না তো!

_________
মনের ঘুম ভাঙল পরের দিন সকালে। চোখ মেলে ঠোঁট নেড়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকল,
” বাবা! ”

মাহদী চমকে কেঁপে উঠল। চোখের পাতা পড়ল। ভীত মুখখানায় হাসি ফুটল। দুশ্চিন্তা ভুলে মিষ্টি করে বলল,
” শুভ সকাল। বাবাটার ঘুম কেমন হলো? ”

মন সাথে সাথে উত্তর দিল না। চারপাশে চোখ বুলাল। ভীষণ উৎসুকে বলল,
” এটা কি আমাদের নতুন বাসা? ”

মাহদীও এক পলকে চারপাশটা দেখে নিল। মৃদু হেসে ছেলের মুখের দিকে ঝুকে বলল,
” না, বাবা। এটা হসপিটাল। ”

মন এর আগে হাসপাতাল দেখেনি। তাই আগ্রহ নিয়ে আরও একবার চারপাশটা দেখল। শুয়ে থেকে আরাম পাচ্ছিল না দেখে উঠতে চাইল। তার আগেই মাহদী বলল,
” উঠে না, বাবা। মাথায় ব্যথা করবে। ”
” কেন? ”

এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছে না মাহদী। সে কি কাল রাতের ঘটনা খুলে বলবে? নাকি লুকিয়ে রাখবে? তন্মধ্যে ডাক্তারের আগমন ঘটল। মনের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
” কাল খুব দুষ্টুমি করেছিলে যে তাই। ”

মন ডাক্তারকে চিনতে পারল না। কৌতূহল চোখ দুটো তার মুখ ছেড়ে আটকাল গলায় প্যাঁচিয়ে থাকা স্টেথোস্কোপে। সেখানে চোখ রেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
” এই আংকেলটা কে, বাবা? ”

মাহদীর উত্তর দিতে হলো না। ডাক্তার মনের দিকে হ্যাণ্ডশেক ভঙ্গিতে ডান হাত বাড়িয়ে বলল,
” আমি ড. আমিদ। ”

মন একবার বাবার দিকে তাকাল। পরক্ষণে ভীষণ উৎসাহে হাত মিলিয়ে বলল,
” আমি বাবার ছেলে মন। ”

ড. আমিদ হেসে ফেলল। মাহদীও মুচকি হাসল। গল্প করার ছলে ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেড়ে ফেললেন ড.আমিদ। বিদায় নিয়ে চলে যেতে মন বলল,
” বাবা, আমি কিন্তু কাল একটুও দুষ্টুমি করিনি। খালামনি মিথ্যে কান্না করতে বললেও শুনিনি। তবুও ড.আমিদ আংকেল আমাকে দুষ্টু বলল। আমি কষ্ট পেয়েছি। ”

এই প্রথম ছেলের কষ্টটা মাহদীর মনে ঝড় তুলল না। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল,
” খালামনি তোমাকে মিথ্যে কান্না করতে বলেছিল? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” যাতে আমরা এখানে আরও কয়েক দিন থাকি। ”

মুহূর্তেই মাহদীর ভেতরটা নড়ে উঠল। ভয়ংকর কিছু ভাবতে চাপ দিচ্ছে চিন্তা-ভাবনারা। সন্দেহটা স্পষ্ট করতে বলল,
” তুমি যে খালামনির কথা শুনোনি সে রাগ করেনি? ধমক দেয়নি? ”

মন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” না। ”

মাহদী আটকে রাখা নিশ্বাসটা ফেলল। খারাপ চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। নিহিতাকে সন্দেহ করার জন্য নিজেকে গালাগালি করল মনে মনে। তারপর ছেলের পাশে বসল। নরম স্বরে বলল,
” বারান্দায় তো আলো ছিল, তাহলে তুমি পড়ে গেলে কিভাবে? সিঁড়ি দিয়ে নামোনি? ”

মন দ্রুত বলল,
” সিঁড়ির কাছে যাওয়ার আগেই তো খালামনি আমাকে ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দিল। ”

মাহদী তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। উরুতে ঘন ঘন আঘাত করতে করতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। অকস্মাৎ মনকে ছেড়ে বেরিয়ে আসে করিডরে। হাসপাতালের গেইটের কাছে ছুটে চলে ঝড়ের গতিতে। তার সাথে ধাক্কা লেগে যে একজন বয়স্ক লোক পড়ে গেল খেয়ালও করল না। খালি রিকশায় উঠে দ্রুত ছোটার হাঁক দিল ভয়ংকর গলায়! রিকশাওয়ালা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পা রাখল প্যাডেলে।

____________
মায়ের সাথে নিহিতাও যেতে চাইল। বোরকার সাথে হাতে-পায়ে মোজা পরে বাবার পিছু নিয়েছিল। রিকশায় একপা রাখতে তার মন বদলে গেল। ইচ্ছা অনিচ্ছায় পরিণত হলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
” তোমরা যাও। আমি একটু পর আসছি। ”

আসমা রহমান বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেন? ”
” মাথাটা ঘুরছে। ”
” ঘুরবেই তো। রাত থেকে না খাওয়া। ”

নিহিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
” একটু ভালো লাগলে আমি চলে আসব, আম্মু। ”

আসমা রহমান আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েকে কিছু খেতে বলে নিজের রিকশায় স্বামীকে ডেকে নিলেন।

বাবা-মা চলে গেলেও নিহিতা ঘরে ঢুকল না। বোরকা পরা অবস্থায় বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকল। রাতের ঘটনা চোখের পাতায় ভেসে উঠতে চোখের কোল ভরে উঠল। তীর ভেঙে পানি গড়িয়ে পড়ার মুহূর্তে মাহদীর উপস্থিতি টের পেল। তাকে অবাক করে দিয়ে মাহদী পাশে বসল। নিহিতা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। বেশ কয়েক সেকেন্ড পর চেতনা ফিরল। মাহদীর পাশ থেকে উঠতে চাইলে বলল,
” চলে যাচ্ছ যে? গল্প শুনবে না? ”

নিহিতা থমকে গেল। বিভ্রান্ত গলায় বলল,
” গল্প? ”
” হ্যাঁ। বসো। ভয় নেই, মা-বাবা এতক্ষণে হসপিটালে পৌঁছে গেছেন। আমাদের একসাথে দেখবেন না। গেইটটাও ভেতর থেকে লাগিয়ে এসেছি, বাইরে থেকে কেউ আসবে না। ”

নিহিতা চট করে গেইটের দিকে তাকাল। তারপরেই দৃষ্টি স্থির হলো মাহদীর মুখটার দিকে। সহজ, নরম, কোমল ভাব। এই মুহূর্তে এই স্বাভাবিক আচরণটাই তার কাছে অস্বাভাবিক লাগল। চাপা ভয় কাজ করছে। মাহদী সামান্য হেসে বলল,
” লজ্জা পাচ্ছ নাকি? ”

নিহিতা চুপ থাকলে মাহদী পুনরায় বলল,
” হাত ধরে টেনে বসাতে হবে? ”

নিহিতা চমকে গেল। ধপ করে বসে পড়তে মাহদী বলল,
” এই গল্পটা তোমার বোনকে একবার বলতে চেয়েছিলাম। কেন জানি বলা হয়নি। সে যেহেতু নেই, তাই তোমাকেই বলছি, আমি ছোটবেলা থেকেই বদরাগি ছিলাম। একটু কিছু হলেই মারামারি শুরু করে দিতাম। ছেলেমেয়ে দেখতাম না। একবার তো তন্বী নামের এক মেয়ের মাথার অর্ধেক চুল ছিঁড়ে এনেছিলাম। সেবার বাবা আমাকে খুব মেরেছিল। ঘরে বন্দী করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ পর একটা শর্ত দিয়ে আমার শাস্তি মওকুফ হলো। কী শর্ত ছিল বলো তো? ”

নিহিতা জিজ্ঞেস করল,
” মারপিট বন্ধ করা? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” তন্বীর সাথে বন্ধুত্ব করা। ”

নিহিতা আশ্চর্য হলে মাহদী বলল,
” বন্ধুত্ব করেছিলাম। কঠিন বন্ধুত্ব! একজন অসুস্থ হলে আরেকজন অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করে দুজন এক সাথে হাসপাতালে ভর্তি হতাম। এই কঠিন বন্ধুত্ব নিয়ে স্কুল শেষ করে কলেজে উঠলাম। ফার্স্ট ইয়ার পর সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই পুরো কলেজে ছড়িয়ে পড়ল আমরা নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা। প্রকাশ্যে প্রেম করে বেড়াচ্ছি। প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ চলে গেল পর্যন্ত। তিনি তো রেগে আগুন! পারলে আমাদের তখনই কলেজ থেকে বের করে দেয়। ভদ্রলোক ধৈর্য্য ধরে আমার আর তন্বীর মা-বাবাকে ডেকে টি.সি. ধরিয়ে দিলেন। আমাদের বাবা-মা রাগে-দুঃখে সিদ্ধান্ত নিলেন তন্বী আর আমার বিয়ে দিবেন। এই বার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। চিৎকার করে বললাম, আমি বিয়ে করব না। কারণ, আমি তাকে ভালোবাসি না। সেও আমাকে ভালোবাসে না। আমরা শুধু বন্ধু। আমার কথা তাদের বিশ্বাস হলো না। সবাই তন্বীর দিকে তাকাল। তাকে জিজ্ঞেস করল আমি সত্যি বলছি নাকি। তন্বী প্রথমে চুপ থাকলেও পর মুহূর্তে বলল, ‘ মাহদী মিথ্যে বলছে। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোবাসি। আমরা বিয়েও করতে চাই কিন্তু এখন না। পড়ালেখা শেষ করে। ‘ কথাটা শেষ করতেই আমি ঠাটিয়ে চড় বসালাম তন্বীর গালে। একটা নয় পরপর তিনটা মেরেছিলাম। কেন বলো তো? ‘

মাহদীর আকস্মিক প্রশ্নে নিহিতার মনোযোগ ক্ষুন্ন হলো। জিজ্ঞেসা চোখে তাকালে মাহদী বলল,
” ও মিথ্যে বলেছিল। যেটা আমার একদম সহ্য হয়নি। বড় হওয়ার পর সেই প্রথম কোনো মেয়েকে আমি চড় মেরেছিলাম। এক চড়েই আমাদের কঠিন বন্ধুত্ব শেষ। তারপর থেকে মেয়েদের একদম সহ্য করতে পারতাম না। আশেপাশে থাকলেই মাথায় রাগ চড়ে বসত। অসংখ্য মেয়েকে চড়িয়েছি আমি। খুব সাধারণ কারণেই। এই যেমন কলিগের কফি অফার করার কারণে, কাজে খুশি হয়ে সিনিয়র গিফট দেওয়ার কারণে, প্রতিবেশি প্রেমে পড়ে চিঠি লেখার কারণে। শেষ চড় মেরেছিলাম কাগজে নাম্বার লিখে পাঠানোর জন্য। সে মেয়েটি কে ছিল নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ? ”

নিহিতা মাহদীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” আমাকে এ সব কেন শোনাচ্ছেন? ”

মাহদী ঠোঁট টেনে হাসল। নিহিতার পাশ থেকে উঠে বলল,
” নায়রাকে থাপ্পড় মারার পর আমি অনুতপ্ত হই। সেই অনুতপ্ত থেকে তাকে ভালোবাসি, বিয়ে করি এবং শপথ নিই আর কোনো মেয়েকে থাপ্পড় তো দূর ভালো করে তাকাবই না। ”

মাহদী থামলে নিহিতা বলল,
” আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারিনি আমাকে এসব বলার কারণ কী। ”

মাহদী উত্তর দিল না। চলে যাওয়ার জন্য নীরবে পা বাড়ালে নিহিতা পেছন থেকে বলল,
” আমার মনে হয়, আপনার কথা শেষ হয়নি। ”

মাহদী থামল। সেখানে দাঁড়িয়েই বলল,
” তুমি খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে নিহিতা। বোকা সাজার চেষ্টা করে বোকামি কর না। ”

মাহদী আরও দু-পা আগালে নিহিতা বলল,
” শাসাচ্ছেন? ”
” ধরে নেও তাই। ”

চলবে