নিষিদ্ধ বরণ পর্ব-২০+২১

0
297

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২০)

মেরুন রঙের শাড়ির সাথে পিঠময় ছড়িয়ে আছে ঘন গোছার চুল। উল্টো দিকে ঘুরে থাকলেও একপাশে কানের লতিকায় ছোট্ট ঝুমকা জ্বলজ্বল করছে! মাহদীর পুরো মনোযোগ যখন দুলটায় এসে পড়ল ঠিক তখনই ঝুমকাটা নড়ে উঠল। চুড়ির ঝনঝন শব্দে তার কর্ণলতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। বুকের মধ্যে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া সাইক্লোনটা থেমে গেল। ভ্রম কাটিয়ে চেতনা ফিরতে খেয়াল করল একটা মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। পাখার হাওয়াই এলোমেলোভাবে উড়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করতে গিয়েই হাতটা বার বার ঝুমকোতে বাড়ি খাচ্ছে। চিকন দুটো চুড়ি একে অপরের সাথে লেগে মৃদু শব্দ তুলছে। মাহদী এক হাতে পাখা বন্ধ করল অন্য হাতে দরজায় ঝুলে থাকা পর্দা টেনে ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারল শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে। মাথাসহ মুখ ঢেকে যেতে মাহদী ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
” দুই মিনিটের মধ্যে নায়রার ব্যবহৃত জিনিস খুলে রাখবে। ”

নিহিতা ভয়ে কেঁপে উঠলেও দমে গেল না। পর্দা ফেলে মাহদির দিকে ঘুরে বলল,
” কেন? আমি কি আপুর শাড়ি পরতে পারি না? ”

মাহদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আগুনের ফুলকির মতো উত্তপ্ত চাহনি! নিহিতা পুড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলে মাহদী বলল,
” অবশ্যই পার। কিন্তু বউ সাজতে পার না। ”
” বউ সাজতে যাব কেন? আমি তো শুধু শাড়িটা পরে দেখছিলাম আমাকে কেমন লাগে। ”

নিহিতা দুর্বল জবানবন্দি দিয়ে মাহদীর দিকে তাকাল। খেয়াল করল সে তার হাতের চুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। নিহিতা চট করে হাতদুটো পেছনে নিলে, মাহদী রুষ্ট স্বরে বলল,
” আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। মনে রেখ, তোমার হাতে মাত্র দুই মিনিট সময়। ”

মাহদী বেরিয়ে যেতে নিলে নিহিতা জেদ ধরে বলল,
” খুলব না। ”

মাহদী দরজা চেপে ধরল শক্ত চাপে। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করেও রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। মুখমণ্ডল কাঁপছে অনবরত!

সেই সুযোগে নিহিতা তার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি কিছু বলার আগেই সব বুঝে যান কেন, বলুন তো? আপনার এই বিশেষ গুণটি আমাকে আরও বেশি পাগল করে দেয়। এখনও দিচ্ছে। ”

মাহদী তখনও নীরব, চুপচাপ, বাক্যহীন। নিহিতা উৎসাহ নিয়ে বলল,
” ভালোই হয়েছে, আমাকে কষ্ট করে কিছু বলতে হয়নি। লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। ”

নিহিতার অনুভূতি প্রকাশে মাহদী কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালে সে আরও উতলা হয়ে পড়ে। মাহদীর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল,
” কেমন লাগছে বলবেন না? ”

নিহিতার লজ্জামাখা তুলতুলে মুখটার দিকে তাকায় মাহদী। তাকিয়েই থাকে। তাকিয়ে থেকেই তার হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে বলল,
” পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুখটির অধিকারী আমার নায়রা, আমার বউ। যে লজ্জা পেলে জোসনা গলে পড়ে। হাসলে তারা খসে পড়ে। কাঁদলে অমাবস্যা হয়। সেই নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র, স্নিগ্ধ মুখটিতে প্রসাধনী মাখতে হয় না। আমি তাকালেই সৌন্দর্যের প্রলেপ ভারী হয়। ”

নিহিতার কান থেকে দুলজোড়া খুলে বলল,
” এগুলো আমার দেওয়া উপহার ছিল বলে পড়ে থাকত। মুগ্ধ করতে নয়, ভালোবাসা প্রকাশ করতে। আমার সেই বিশেষ গুণটি তৈরি হয়েছে তোমার আপুর জন্য। কারণ, সে মনের কথা মুখে আনতে লজ্জা পেত। ”

মাহদী নিহিতাকে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিহিতা পিছু নিয়ে বলল,
” মানছি আপু দেখতে সুন্দর ছিল। কিন্তু আমার থেকে বেশি নয়। বিশ্বাস না হলে ভালো করে চেয়ে দেখুন। ”

মাহদী থমকে দাঁড়িয়ে না ঘুরে বলল,
” আমার চোখদুটো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নায়রা ছাড়া আর কাউকে দেখবে না। ”

নিহিতার চোখ জলে টলমল। হাল ছাড়তে রাজি নয়। দৌড়ে এসে বলল,
” যে নেই, তার নামে প্রতিজ্ঞা রেখে কী লাভ? ”
” প্রতিজ্ঞার সাথে থাকা- না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। নিহিতা, এটা আমার থেকেও তোমার খুব ভালো করে জানা। ”

নিহিতা কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুত হতে দূর থেকে আসমা রহমানের গলা ভেসে এলো,
” মাহদী? কখন এলে? ”

নিহিতার দিক থেকে সম্পূর্ণ মনোযোগ সরিয়ে হালকা হাসল মাহদী। শাশুড়ির দিকে এগুতে এগুতে সালাম দিয়ে বলল,
” এইতো কিছুক্ষণ হলো। আপনারা কখন এসেছেন, আম্মা? বাসা খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়? একটা কল করলেই হতো। আমি মনকে নিয়ে স্টেশনে চলে যেতাম। ”

আসমা রহমান আন্তরিক হেসে বললেন,
” কষ্ট হবে কেন? নিহিতার বাবা ছিলেন তো সাথে। ঢাকা শহরের সব চেনা হয়ে গেছে তার। ”

দুজনের কথপোকথনের মধ্যে মন বের হয়ে আসল পাশের রুম থেকে। ঘুম চোখে নানির কোমরের সাথে ঘেষে দাঁড়ালে মাহদী জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় ছিলে তুমি? বাসার ফোন বন্ধ কেন? কামাল কোথায়? ”

কামাল এ বাসার বিশ্বস্ত কাজের লোক। মনকে দেখাশুনাসহ প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কাজ করে। বয়সে মাহদীর চেয়ে কিছুটা ছোট হবে। মন বাবার প্রশ্ন দেওয়ার বদলে চোখ বন্ধ করে নিলে আসমা রহমান বললেন,
” কামালকে নিয়ে উনি একটু বেরিয়েছেন। এখনও আসেনি বোধ হয়। মন আমার সাথেই ছিল। আগরিবের নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিলাম। কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতে পারিনি। ”

মনের অবস্থা দেখে মাহদী বুঝে নিল নানির সাথে সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখনও ঘুমাচ্ছে। ছেলেকে দাঁড়িয়ে ঘুমাতে দেখে তার খুব হাসি পেল। হাসি চেপে তাকে কোলে তুলে বলল,
” সমস্যা নেই, আম্মা। অনের দূর থেকে এসেছেন তো তাই শরীর ক্লান্ত। আমি মনকে শুয়িয়ে দিয়ে আসছি। ”

মনকে নিয়ে মাহদী চলে গেলে আসমা রহমানের নজর পড়ল নিহিতার উপর। চোখ কপালে তুলে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” তোর পরনে শাড়ি! কোথায় পেলি? ”

নিহিতা বিরক্ত চোখে তাকাল। নিরুত্তরে মায়ের পেছনের রুমে ঢুকে পড়ল। তিনি রুমের দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে পা চালালেন।

___________

রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, আক্রোশ, অভিমানে যখন নিহিতার চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তখন ফোনটা বেজে ওঠল। ভেজা পাতা মেলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমবারে ধরল না। দ্বিতীয়বারেও না। তৃতীয়বারে রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
” আমি আহাদ, চিনতে পারছ? ”

আহাদের নামটা শুনতে তার সর্বাঙ্গে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো। বাকশক্তি হারিয়ে বসলে আহাদ বলল,
” আমি জানি তুমি ছেলেদের সাথে ফোনে কথা বলো না। হয়তো আমার সাথেও বলবে না। তাই মন চাইলেও কল দিইনি। আজ মনটা বড্ড আনচান করছিল, নিহি। কল না দিয়ে থাকতে পারলাম না। একটু কি কথা বলার অনুমতি পাব? ”

নিহিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ মুছল। ঢোক গিলে গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
” জি বলুন। ”

অনুমতি পেয়ে আহাদের কণ্ঠস্বর পালটে গেল। সহজ স্বরে ভালো-মন্দের খোঁজ নেওয়া শেষে জিজ্ঞেস করল,
” চিঠিটা পড়েছিলে? ”

নিহিতা চিঠি পড়েনি। কোথায় রেখেছিল তাও মনে নেই। এদিকে আহাদকে ‘ না ‘ বলতেও খারাপ লাগছে। তাই চুপ করে থাকল।

আহাদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,
” আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে চিঠি পড়ার পর তোমার কেমন লেগেছে। বলবে না? ”

নিহিতা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তন্মধ্যে আহাদ বলল,
” আর আংটিটা কী করেছ? এখনও পরে আছ নাকি খুলে রেখেছ? ”

নিহিতা চট করে হাতের দিকে তাকাল। অনামিকা আঙুলে আংটি নেই। কোথায় গেল? সে তো খুলে রাখেনি! নিহিতা ফোন কানে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিছানার বালিশ সরিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। সে সময় মন দৌড়ে এসে বলল,
” খালামনি, বাবা বলেছে এটা তোমার। ”

মনের হাতে আংটি দেখে নিহিতা খুশি হলো। পর মুহূর্তে মন খারাপের ঢেউ আছড়ে পড়ল মনপাড়ায়। খানিকটা ভীত হলো এই ভেবে যে, মেয়েলি আংটি না হওয়া সত্ত্বেও বুঝে গেছে এটা তার। তাহলে কি সে জানে আহাদের দেওয়া উপহার গ্রহণ করেছে?

নিহিতার মনখারাপের মধ্যে মন ছুটে চলে যাচ্ছিল। সে দৌড়ে আটকাল। কোলে করে খাটে বসিয়ে বলল,
” ছোট আব্বু, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? ”

মন প্রথমে বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল তখন নিহিতার দিকে তাকাল বেশ কৌতূহলে। চুপচাপ গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
” খুব সুন্দর। ”

মনের ছোট্ট প্রশংসায় পুলক অনুভূত হলো নিহিতার। মনখারাপ উবে গেল নিমিষেই। চোখের তারায় খুলি ঝিলিক দিল। আবেগে ভেসে মনের কপালে, গালে, নাকে চুমু খেয়ে বলল,
” বাবার কাছে যাও, আমি একটু পর আসছি। ”

মন ছুটি পেয়ে চলে যাচ্ছিল। কী মনে করে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পেছন ঘুরে বলল,
” তুমি আম্মু না সেজে খালামনি সাজলে বেশি সুন্দর লাগে। ”

একটু থেমে আবার বলল,
” বাবা, বলেছে আমি এখন বড় হয়েছি। তোমার সাথে কথা বলার সময় এক হাত দূরে থাকতে হবে। খালামনি, তুমি যে আমাকে চুমু খেলে আল্লাহ কি রাগ করবে? ”

নিহিতা জবাব দিল না। ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। নিজের মতো যে ছেলেকেও তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে খুব বুঝতে পারছে। ইচ্ছে করছে মাহদীর কাছে ছুটে যেতে। মনের জ্বালা মেটাতে যা যা করা দরকার সব করতে। মা জেগে আছে বলে রাগটা ভেতরে ধরে রাখল। এর মধ্যে বাবার গলা পেতেই মন ‘নানা’ ডাকতে ডাকতে চলে গেল।

____________

সে রাতে ঘুম হলো না নিহিতার। পরের দিন সকালে ফজরের নামাজ কাযা করে ফেলায় মায়ের হাতে বকুনি খেল খুব। যার সবটাই কর্ণগোচর হলো মাহদীর। নীরবে সবটা সহ্য করে চুপচাপ নাস্তা করে শ্বশুরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাকে মাহফিলের স্থানে পৌঁছে দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসল। তিনি আজ রাতে বাড়ি ফিরবেন না। ফিরতে ফিরতে পরের দিন সকালে। শ্বশুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে পৌঁছাতে একটু দেরি হলো।

দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য বাসায় ফিরে রক্ত গরম হয়ে গেল মাহদীর। নিহিতা আজও নায়রার শাড়ি পরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” সীমা লঙ্ঘন করো না, একদম ভালো হবে না। মাফ কিন্তু বার বার করা যায় না। ”

নিহিতা পেছন থেকে বলল,
” মাফ করতে বলেছে কে? আপু যদি আপনার রাগকে ভালোবসতে পারে, আমিও পারব। ”

কথার মাঝেই নিজের গাল বাড়িয়ে বলল,
” চাইলে চড়ও মারতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ”

চলবে

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২১)

নিহিতা কথার মাঝেই নিজের গাল বাড়িয়ে বলল,
” চাইলে চড়ও মারতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ”

মাহদী অগ্নি ঝরা দৃষ্টিতে তাকাল। দুটো তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ সংযত করছে। দৃষ্টি সরিয়ে বিদ্রুপ করে বলল,
” আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তুমি নায়রার বোন! ”

নিহিতা অপমান বোধ করল না। খুশি হয়েছে এমনভাবে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,
” আমারও ভাবতে কষ্ট হয়, আপনি আপুর স্বামী। ”

একটু থেমে আবার বলল,
” কষ্টটা একটু বেশিই হয়। অসহ্য রকমের। আপনি কি বুঝতে পারেন? ”

মাহদী উত্তর দিল না। নিহিতার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। সে সময় মন দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। নিহিতার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
” খালামনি, তুমি আবার আম্মু সেজেছ? ”

নিহিতা মনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। গাল টেনে মিষ্টি করে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” আমার আম্মু সাজতে ভালো লাগে। ”

মন একটু চুপ থেকে বলল,
” আমার যে খালামনি সাজে বেশি ভালো লাগে? ”
” কেন? ”
” খালামনি সাজলে বাবা খুশি হয় তাই। ”

নিহিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বাবা বলেছে? ”
” না। ”
” তাহলে জানলে কিভাবে? ”

মন সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসে বলল,
” তুমি যেদিন আম্মু সাজ সেদিন বাবার চোখ লাল হয়ে থাকে। আমি ভয়ে কাছে যাই না। একা একা ঘুমাই। ”
” তাই? ”

মন মাথা উপরনিচ নাড়ালে নিহিতা বলল,
” আর বাবা? তিনি ঘুমান না? ”

মন উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। আসমা রহমানের গলা পাওয়া গেল,
” নিহিতা, মাহদী এসেছে? ”

আসমা রহমানের হাতে বাদামী রঙের কাগজ মোড়ানো একটি প্যাকেট। নিহিতার হাতে প্যাকেটটি দিয়ে আগের প্রশ্নটি আবার করলেন,
” মাহদী এসে পড়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”

আসমা রহমান বোরকা খুলছিলেন। মেয়ের কাছ থেকে উত্তর পেয়েই গলার স্বর বদলে গেল,
” তাহলে তুই এখানে কী করছিস? ”

মায়ের প্রশ্নে নিহিতা চমকে তাকাল। চোখেমুখে ভয়! আসমা রহমান খানিকটা ধমকের সুরেই বললেন,
” রুমে যা, আমি না ডাকলে বাইরে বের হবি না। ”

নিহিতা মনকে ছেড়ে চুপচাপ পাশের রুমে ঢুকে গেল। আসমা রহমানের দৃষ্টিতে সন্দেহ। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার সচেতন মেয়েটা জামাকাপড় ছাড়াই এত দূর বেড়াতে চলে এসেছে! মেয়েদের যে প্রতি মাসের একটি বিশেষ দিন মনে রাখতে হয় সেটাও ভুলে গিয়েছে।
_________________

মন বালিশে শুয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। আসছে না দেখে উঠে পড়ে। বাবার কাছে এসে দাঁড়ালে মাহদী বলল,
” মন, দেখ তো আশেপাশে কোথাও তোর মায়ের কিছু আছে নাকি। ”

বাবার আদেশ পেয়েই মন পুরো রুমে তল্লাশি চালিয়ে একটা রাবার ব্যাণ্ড পেল। বিজয়ী কণ্ঠে বলল,
” এটা আছে। ”

মাহদী রাবার ব্যাণ্ড হাতে নিয়ে দেখল ধূলো লেগে আছে। পরনের টি-শার্টের বুকের কাছটায় ময়লা মুছে কাঠের বক্সটাতে রাখল। তালাবদ্ধ করে আলমারিতে রেখে বলল,
” ঘুমাবি চল, সকালে আমার সাথে উঠবি। ”

মন বিছানায় উঠতে উঠতে মনে করিয়ে দিল,
” আমি তো রোজ তোমার সাথেই উঠি, বাবা। ”

মাহদীর মনে পড়েছে এমন ভাব করে বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু অন্য সময় নিজ ইচ্ছেয় উঠিস, কাল আমার ইচ্ছেতে উঠবি। ”

মন মাথা নেড়ে বুঝাল সে উঠবে। তারপর বাবার বুকে ঘাপটি মেরে চোখ বন্ধ করে নিল।

পরের দিন সকালে মনের হাতে কিছু জিনিসপত্র দিয়ে বলল,
” আজ তোর যা যা দরকার হবে সব এখানে আছে। এগুল নানির কাছে রেখে আয়। ”

মন নানির রুমের দিকে দৌড় দিলে মাহদী নিজের রুমের দরজায় তালা দিল। চাবি নিয়ে শাশুড়ির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে ডাকল,
” আম্মা? ”

আসমা রহমান বেরিয়ে আসলে তার হাতে চাবি দিয়ে বলল,
” ঐ রুমে আপনি ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দিবেন না। ”

______________

দুপুরে খেতে আসার পূর্বে নামাজ পড়ে নেয় মাহদী। মসজিদ থেকে বের হয়ে টুপি খোলা হয়নি। সেভাবেই বাসার কলিংবেল বাজিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল। দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকাতে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
” আব্বু! ”

ছেলের কণ্ঠে আব্বু ডাকটা যেন আতাউল করিমের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল। এক সুখকর ব্যথা অনুভূত হতে চোখের কোণে জল জমতে শুরু করে। গড়িয়ে পড়ার আগেই মাহদীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
” বাবাদের কি মুখে বলতে হয় মাফ করে দিয়েছি? ”

মাহদী নীরব থাকলে আতাউল করিম পুনরায় বললেন,
” আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তোর পরিবর্তনটা কয়েক দিনের নাকি সারাজীবনের। সেজন্য সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ”

এবার মাহদী কথা বলল,
” কী মনে হচ্ছে? পরিবর্তনটা কয়েক দিনের নাকি সারাজীবনের? ”

আতাউল করিম মাহদীকে ছেড়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
” অনিশ্চিত উত্তরটা না-ই দিলাম। শুধু বলব, তোকে এই রূপে দেখলে বউমা খুশিতে কেঁদে ফেলত। ”

সামান্য বিরতি টেনে আবার বললেন,
” বউমার খুশির জল দেখতে পারলাম না বলে ভারি আফসোস হচ্ছে! ”

বাবার আফসোসের ফেলা ভারি নিশ্বাসটা মাহদীর বুকে ব্যথার ঝড় তুলে দিল। সেই ঝড়ে এলোমেলো হয়ে স্মৃতির ডায়রী খুলে বসল মাহদী।

তখন নায়রা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পেটের সাথে হাত, পা, মুখও অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। ইচ্ছে হলেই বসতে পারে না। খাবার-দাবারে খুব অনিহা। এমন অবস্থায়ও সে চেয়ারে বসে নিয়ম করে নামাজ পড়ে, কোরআন তেলাওয়াত করে। এমনি একদিন নামাজের পর তেলাওয়াত শেষ করে উঠে দেখে মাহদী তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে হালকা হেসে কোরআন শরীফে চুমু খেয়ে বলল,
” কী দেখছ? ”

মাহদী বসা থেকে উঠে এসে কোরআন শরীফ নিজের কাছে নিয়ে বলল,
” তোমার কষ্ট। ”
” কষ্ট? ”
” হ্যাঁ। সেজদা দেওয়ার সময় তুমি কাঁপছিলে। কোরআন পড়ার সময় ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছিলে। এত কষ্ট করা কি জরুরি? ”

নায়রা সাথে সাথে উত্তর দিল না। ধীর পায়ে খাটে বসতে চাইলে মাহদী এসে ধরল। পাশে বসে বলল,
” তোমার কষ্ট দেখলে আমার খারাপ লাগে, নায়রা। ”

নায়রা মাহদীর কাঁধে মাথা রাখে। স্বামীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কোমল স্বরে বলল,
” যার দয়ায় পৃথিবীতে নিশ্বাস নিচ্ছি তাকে ভালোবাসতে আবার কষ্ট কিসের? আমার তো আনন্দ হয় এই ভেবে যে, এখনও তার নাম জপতে পারছি! ”

নায়রার কথায় মাহদী খুশি হলো না, দুঃখও পেল না। নীরবে নায়রার তৃপ্তিভরা হাসিখানা দেখল। মুহূর্তকাল পর বলল,
” আমাকে নামাজ পড়ার জন্য জোর কর না কেন, নায়রা? এমনও তো হতে পারে, জোর করলে আমি..”

মাহদীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নায়রা উত্তর দিল,
” আমি চাই না তুমি আমাকে খুশি করতে নামাজ পড়ো। ”

মাহদী চুপ হয়ে গেলে নায়রা আবার বলল,
” আমি চাই তুমি আল্লাহকে খুশি করতে তাঁর পথে আসো। তবেই না জান্নাত উপহার পাবে। ”

নায়রার কথার গাম্ভীর্য অর্থটা মাহদী ধরতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমি যদি হঠাৎ বদলে যাই, তুমি আমাকে খুব ভালোবাসবে তাই না? ”
” না। ”

নায়রার উত্তরে মাহদী অবাক হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” ভালোবাসবে না? ”
” অবশ্যই বাসব। এখন যেমন বাসি তেমন। ”

মাহদী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” তাহলে পালটে কী লাভ! ”

নায়রা মৃদু হাসল। মাহদীর গালে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” গুণ দেখে ভালোবাসা কম-বেশি হয় না, গুণ দেখে সম্মান আর শ্রদ্ধা কম-বেশি হয়। তুমি হঠাৎ পালটে গেলে তোমার প্রতি আমার সম্মান বাড়বে, শ্রদ্ধা বাড়বে। বাবার সামনে চোখ তুলে গর্ব নিয়ে বলতে পারব, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের প্রতিদান পেয়েছি। ”

নায়রার কথাগুলো মাহদীর ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলেও স্বভাব পাল্টাতে পারেনি। এতে যেমন নায়রার মন খারাপ হয়েছিল তেমন মাহদীরও। একদিন মাহদী মনখারাপের সুরে বলেই ফেলল,
” আমি তোমার সম্মান বাড়াতে অক্ষম। ”

নায়রা হেসে বলেছিল,
” তোমার নামের অর্থ কী জানো? ”
” কী? ”
” সৃষ্টিকর্তা দ্বারা পথপ্রদর্শিত। তোমাকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। তুমি অধৈর্য্য হলেও আমি ধৈর্য্য হারাব না। তাঁর সময়মতো তোমাকে ঠিক পথে আনবেন। আমি তো সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি। ”

মাহদী দীর্ঘস্বাস ফেলে স্মৃতির ডায়রী বন্ধ করে আপনমনে বলল, ‘ সে সময় এসেছে, নায়রা। অথচ, তুমি নেই! ‘

__________________

নিহিতা এশারের নামাজ পড়তে বসল অস্থিরমনে। মাহদী প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটার সময় বাসায় আসলেও আজ আসেনি। ঘণ্টার কাঁটা সাতটা পার হতেই সে চিন্তায় পড়ে। চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো রাত আটটায়। এশারের আজান শুনতে শুনতে মাহদীর নাম্বারে কল করে, রিসিভ হয় না। বেশ কয়েকবার কল করার পরও যখন ধরল না তখন মেসেজ পাঠায়। উত্তর আসেনি। এদিকে মা ওযু করার জন্য তাড়া দিয়ে নিজেও ওযু করে নেয়। জায়নামাজ বিছিয়ে যখন নিয়ত বাঁধল তখন নিহিতার মনে পড়ল হয়তো মা কিছু জানে। এখন প্রশ্ন করা যাবে না দেখে নিজেও ওযু করে জায়নামাজে বসে। ঠিক করে নামাজ শেষ হলে জিজ্ঞেস করবে।

মাহদীর ভাবনায় নিহিতা খেয়ালই করল না সে নিয়ত ভুল করেছে। চার রাকাতের জায়গায় তিন রাকাত সুন্নত পড়েছে। সালাম ফেরাতে গিয়ে ঘাড়ের পাশে না তাকিয়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। জায়নামাজে মনোযোগ না রেখে কান খাড়া করে শুনছে কলিংবেল বাজছে নাকি। সুন্নত শেষে ফরযের এক রাকাতের সেজদা করতে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। নিহিতা জায়নামাজ ফেলে শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দিল। মাহদী নিহিতার দিকে না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। নিহিতা উদ্বিগ্নচিত্তে জিজ্ঞেস করল,
” এত দেরি করে এলেন? আমার চিন্তা হচ্ছিল। কল করেছিলাম, ধরেননি কেন? ”

নিহিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ডাইনিং পার হচ্ছিল মাহদী। কী মনে করে পাশের রুমে তাকাল। ফাঁকা জায়নামাজে দৃষ্টি পড়তে প্রশ্ন করে বসল,
” তুমি নামাজ ছেড়ে এসেছ? ”

নিহিতার চেতন ফিরল বুঝি। খোলা দরজার দিকে তাকাতে সেও জায়নামাজ দেখতে পেল। সভয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” হ্যাঁ। ”

মাহদী অকস্মাৎ নিহিতার ডান হাতের কনুই চেপে ধরল। দ্রুতকদমে বাইরে হেঁটে চললে নিহিতা জিজ্ঞেস করল,
” কী করছেন? হাত ছাড়ুন। আম্মু দেখতে পাবে। ”

মাহদী কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। মূল দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসল। খালি রিকশা ডেকে বলল,
” উঠো। ”

চলবে