নিষিদ্ধ বরণ পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
1007

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
#অন্তিম_পর্ব

ছোট মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এরশাদ রহমান। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই বড় মেয়ের জামাইকে কল দিলেন। রিং হওয়ার মধ্যেই কোথাও থেকে উদয় হলেন আসমা রহমান। জিজ্ঞেস করলেন,
” কাকে কল করছ? ”

এরশাদ রহমান ফোন কানে ধরেই বললেন,
” মাহদীকে। কাল বিয়ে অথচ সে এখনও পৌঁছাল না! ”

আসমা রহমান ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলেন স্বামীর নিকট। ফোন কেড়ে নিয়ে বললেন,
” আমি কথা বলছি। তোমাকে বাইরে খুঁজছে। ”
” কে? ”
” বাবুর্চি। ”

এরশাদ রহমান তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে যেতে আসমা রহমান ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লেন। নিহিতার মন্দ আচরণ নিয়ে স্বামীর সাথে কোনোরূপ আলোচনা করেননি। করবেন না বলেই ঠিক করেছেন। এই বিয়েটা ভালোই ভালোই মিটে গেলে বাঁচেন। তিনি চান না শেষ বেলায় এসে স্বামী অপমানিত হোক, মেয়ের অপকীর্তি সামনে এসে সম্মানে আঘাত করুক। মেয়ের এই অধপতনটা মা হয়ে মানতে পারছেন না, বাবা কী করে পারবেন? লজ্জায় মূর্ছা যাবেন!

” আসসালামু আলাইকুম, বাবা। ”

ফোনের অপরপাশ থেকে মাহদীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে আসমা রহমান সামান্য চমকালেন। পর মুহূর্তে নিজেকে ধাতস্থ করে সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
” তুমি আসবে না? ”

মাহদী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” মন কান্নাকাটি না করলে হয়তো আসতাম না। ”

আসমা রহমান চুপ হয়ে গেলেন। মাহদীর অসহায় বদনখানি কল্পনা করে বললেন,
” না আসলে তোমার শ্বশুর খুব কষ্ট পাবেন। ”

ঐপাশটা আবারও নীরব হয়ে গেল। বেশ কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
” বাবাকে বলে দিন, আমি আসছি। ”

ফোনটা রেখেই ওযু করতে চলে গেলেন আসমা রহমান। মনটা অস্থির হয়ে আছে খুব! নফল পড়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে অস্থিরতা কমাতে চান।

________________

মাহদীরা ফুলবাড়ি রেলস্টেশনে পৌঁছাল প্রায় শেষ রাতে। মন ঘুমে বিভোর। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে বয়ে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোরের আলোর বিচ্ছরণ শুরু হয়ে গেছে। ফযরের আযান তখনও পড়েনি। গেইট পার হয়ে মাঠে পা রাখতে ঘুম ভেঙে গেল মনের। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমরা চলে এসেছি, বাবা? ”

মাহদী মৃদু হেসে মাথা নাড়তে সে কোল থেকে নামল তরতর করে। বড়বাড়ির মূল দরজায় বড় আঘাত করে নানা-নানিকে ডাকতে শুরু করে। মাহদী প্রথমে চুপ থেকে ছেলের আনন্দকে উপভোগ করলেও পরক্ষণে সতর্ক হয়ে যায়। ছেলেকে থামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
” সবাই ঘুমাচ্ছে, বিরক্ত কর না। একটু পরেই আযান পড়বে। ততক্ষণ নাহয় আমরা বাইরে অপেক্ষা করি? ”

মন বাবার কথা মেনে নিল। দরজা ছেড়ে বারান্দা থেকে নামার সিঁড়িতে পা রাখতে মূল দরজা খুলে গেল। বাবা-ছেলে চমকে পেছনে তাকালে আসমা রহমান বললেন,
” কখন এসেছ তোমরা? অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলে বুঝি? ”

আসমা রহমানের মায়াভরা কণ্ঠস্বরে মাহদী হালকা হেসে বলল,
” ব্যস্ত হবেন না, আম্মা। আমরা মাত্রই এসেছি। ”

মাহদীর কথায় আসমা রহমানের মুখ থেকে দুঃখিত ভাবটা গেল না। নাতিকে জড়িয়ে আদর করে বললেন,
” ভেতরে এসো। ”

মাহদীকে ভেতরে ঢোকার আহ্বান জানিয়ে থমকে গেলেন আসমা রহমান। কিছু একটা চিন্তা করে বললেন,
” তোমার বাবা তো এখনও উঠেননি। ভেতরে বসে কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? তার থেকে ভালো হয়, আমি ঐ ঘরের চাবি দিচ্ছি তোমরা জামাকাপড় পালটে নেও। ”

মাহদী সম্মতি প্রকাশে ঘাড় একপাশে কাত করলে তিনি আবার বললেন,
” হালকা খাবারের ব্যবস্থা করছি, খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিও। উনি উঠলে তোমাকে ডেকে দিব। ”

আসমা রহমান দ্রুত ভেতরে ঢুকে চাবি এনে নিজেই দক্ষিণ পাশের ঘরের তালা খুলে দিলেন। মাহদী ভেতরে ঢুকল প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে। গত হওয়া কয়েকটি রাত ভালো ঘুম হয়নি তার। তারমধ্যে এমন লম্বা সফর! সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। আসমা রহমান চলে যেতে নিলে মাহদী আবদার করে বসল,
” এক কাপ চা পাওয়া যাবে, আম্মা? ”

আসমা রহমান মাহদীর মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভয় পেলেন। চোখের ভেতরটা ভয়ঙ্কর রকমের লাল! বাইরে আবছা অন্ধকারে খেয়াল না করলেও ঘরের আলোতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তিনি চিন্তিত কণ্ঠে সুধালেন,
” তোমার কি শরীর খারাপ? ”

মাহদী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বিছানার এক কোণে বসে বলল,
” তেমন কিছু না, আম্মা। মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। ”
” আমি এখনই চা বানিয়ে আনছি। ”

_________
গরম পানিতে চা-পাতি দিয়ে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘর থেকে বের হলেন আসমা রহমান। বসার রুমের আলোটা জ্বালানো থাকলে দেয়ালে চেপে থাকা নিহিতাকে ঠিক দেখতে পেতেন।

মা বেরিয়ে যেতে রান্নাঘরে ঢুকল নিহিতা। চুলার পাশে একটি ওষুধের পাতা রেখে কাপে চা ঢালল। চিনি মিশিয়ে পাতা তুলে দুইটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করল, ‘ আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি, কতটা চাই তা বুঝাতে হলেও আমাদের একসাথে সময় কাটানো উচিত। যে সময়টা আপনি কেড়ে নিয়েছেন! ‘
” নিহি? ”

মায়ের ডাকে নিহিতা ভয়ে কেঁপে উঠল। চটপটে ওষুধের পাতাটা ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
” তুই এখানে কী করছিস? ”

নিহিতা কাঁপা স্বরে ধীরে বলল,
” তোমাকে সাহায্য করতে এলাম। ”

আসমা রহমান মেয়েকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বললেন,
” আল্লাহর দোহাই লাগে আর কোনো ঝামেলা বাড়াস না। সবাই ভুল শোধরানোর সুযোগ পায় না। তুই পেয়েছিস। অন্তত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে পাল্টে নিস। আহাদ অনেক ভালো ছেলে, সুখে থাকবি। ”

অনুরোধ পূর্ণ বাক্যগুলো শেষ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন দক্ষিণ ঘরের দিকে।

____________
ফজরের নামাজ শেষ করে এসে স্ত্রীর মুখে মাহদীর আসার খবর পেয়েছিলেন এরশাদ রহমান। ঘুমাচ্ছে বলে আর ডাকলেন না। কাজে ব্যস্ত হওয়ার পূর্বে বলে গেলেন, ঘুম ভাঙলেই যেন তাকে খবর দেওয়া হয়। স্বামীর আদেশ মেনে প্রতিবেশি মহিলাদের নিয়ে ঘরের কাজে হাত লাগালেন আসমা রহমান। কাজে কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে সকাল গড়িয়ে যে দুপুর হয়ে গেল খেয়ালই করলেন না৷ এদিকে মাহদীর কথাও বেমালুম ভুলে গেলেন!

এরশাদ রহমান মেয়ের জামাইয়ের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বারান্দায় পাতা কাঠের চেয়ারটায় বসে স্ত্রীকে ডাক পাঠালেন। ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসলে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমাকে যে বলেছিলাম মাহদী উঠলে খবর পাঠাতে? ”

আসমা রহমানের হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গি করে বলল,
” একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ”
” কোথায় আছে এখন? ”

আসমা রহমান উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
” আমার সাথেও তো দেখা হয়নি। ”
” মানে? ”

আসমা রহমানের এতক্ষণে খেয়াল হলো সেই যে মাহদীকে চা খায়িয়ে দিয়ে এসেছিল তারপর আর মাহদীর দেখা পাননি, গলাও শুনতে পাননি। এমনকি মনও ছুটে আসেনি। তার তো এই বেলা হৈচৈ করার কথা! আসমা রহমান খানিকটা সন্দেহ নিয়েই বলল,
” মাহদী মনে হয় এখনও ঘুমাচ্ছে। ”

এরশাদ রহমানের ভ্রু কুঁচকে এল। সন্দেহি চাহনি এঁকে বলল,
” এতবেলা অবধি ঘুম? ”
” সারারাত তো ট্রেনেই ছিল, ঘুম হয়নি। মাথাব্যথা হচ্ছিলও বলেছিল। তুমি বসো, আমি ডেকে তুলছি। ”

স্ত্রীকে বাঁধা দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন এরশাদ রহমান। বললেন,
” তোমার যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি। ”

এরশাদ রহমান উঠোনে পা রাখতেই দেখলেন মাহদীর বাবা-মা রিকশা থেকে নামছেন। তিনি সহাস্যে বেয়াই-বেয়াইনকে অভ্যর্থনা করতে ছুটলেন। কুশল বিনিময় শেষ হতে মাহদীর কথা উঠল। মাহদীর মাকে বড়ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে বেয়াইকে নিয়ে হাঁটা ধরলেন মাহদীর সাথে দেখা করতে।

এরশাদ রহমান ভেবেছিলেন মাহদী দরজা আটকে ঘুমিয়েছে তাই হালকা আঘাত করলেন। তাকে অবাক করে দরজা সামান্য নড়ে উঠল। খানিকটা সংকোচে দরজা মেলে ভেতরে ঢুকলেন। সাথে সাথে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। বিস্ফারিত চোখদুটো আটকে রয়েছে বিছানায় বিবস্ত্র দুটো নর-নারীর আলিঙ্গনরত শরীরে। মাত্রাতিরিক্ত চমকানোর প্রভাবে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিতেও ভুলে গেছেন। সেসময় ভেতরে ঢুকলেন আতাউল করিম। বেয়াইয়ের পাথরের মতো জমে যাওয়া দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালেন। দৃষ্টি স্থির হওয়ার পূর্বেই ছুটে গেলেন ছেলের পাশে। পাতলা চাদর দিয়ে নিহিতার আধঢাকা শরীরটা পুরো ঢেকে চিৎকার করলেন,
” মাহদী! ”

মাহদীর সামান্যতম না নড়লেও নিহিতা হুড়মুড়িয়ে উঠল। অপ্রস্তুতভঙ্গিতে বলল,
” আপনারা? ”

মেয়ের কণ্ঠস্বরে বুঝি এরশাদ রহমানের দেহে দ্বিতীয়বারের মতো প্রাণের স্থাপন ঘটল। ঘনপদে হেঁটে এসে মাহদীর কাঁধ চেপে ধরে সোজা করল। কাঁধে প্রচণ্ড জোরের আঘাত পেয়ে মাহদীর ভারী ঘুম হালকা হয়েছে। জোর করে চোখ মেলার চেষ্টা করতে সজোরে থাপ্পড় পড়ল গালে! এরশাদ রহমান উদভ্রমের মতো মাহদীর শরীরে আঘাত করতে লাগলেন। পাশ থেকে আতাউল কবির থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছেন না। বরঞ্চ লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন! মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পৃথিবী ছাড়তে পারলে বাঁচতেন।

নিহিতা গায়ে জামা গলিয়ে বাবাকে থামানোর চেষ্টা করে বলল,
” উনাকে ছাড়, বাবা। পাগল হয়ে গেলে নাকি? ”

মাহদীর শরীরে চলা হাতটা মেয়ের দিকে উঠতে নিহিতা দ্রুত বলল,
” আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, বাবা। ”

এরশাদ রহমানের ছুটে যাওয়া হাতটা থেমে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছেন।

মাহদীর মাকে আপ্যায়নের এক পর্যায়ে মাহদীর রুমের দিকে এগিয়ে আসছিলেন আসমা রহমান। মেহমানের এমন গগনবিদারী চিৎকারে শুনে ভেতরে ছুটে আসেন। ততক্ষণে নিহিতার যা বলার ছিল বলে ফেলেছে। সে বুদ্ধিশূন্য হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এদিকে বেদম মার খেয়ে মাহদীর চোখের ঘুম উবে গেলেও প্রকত ঘটনা বুঝতে বেশ সময় নিচ্ছিল। সেসময় নিহিতা বলল,
” আমি আহাদকে বিয়ে করতে চাই না, বাবা। মাহদীকে বিয়ে করে মনের আম্মু হতে চাই। ”

মেয়ের চাওয়া শোনে এরশাদ রহমান বাকরুদ্ধ! সকলের নির্বাক দৃষ্টি নিহিতার উপর। কারও কণ্ঠ থেকে কোনো রূপ শব্দ বের হওয়ার আগেই নিহিতার গালে সশব্দে চড় মেরে বসল মাহদী। রক্তলাল চোখে চুলের মুঠি ধরে অগ্নিঝরা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
” সাবধান করেছিলাম তোকে, বার বার বুঝিয়ে ছিলাম আমার প্রতিজ্ঞা ভাঙিস না। শুনলি না! শেষ সীমাটা পার করেই ছাড়লি! তুই তো আজ শেষ। ”

মাহদী নিহিতাকে টেনে-ছেঁচড়ে দরজার দিকে এগুতে আতাউল কবির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। ছেলের গালে কষে থাপ্পড় মেরে বললেন,
” তুই কোনো দিনও পাল্টাবি না! ”

নিহিতাকে ছাড়িয়ে নিজের কাছে নিলেন। এরশাদ রহমানের দিকে করজোড়ে হাত তুলে মাথা ঝুকিয়ে বললেন,
” এই ঘটনা পাঁচ-কান হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিন। আপনি যা বলবেন আমি তাই করতে প্রস্তুত। ”

মাহদী কিছু একটা বলতে চাইলে আতাউল কবির ধারাল দৃষ্টি ছুড়ে বললেন,
” আল্লাহর কসম, আজ যদি আমার অবাধ্য হোস গৃহ ত্যাগ করব। মায়ের দায়িত্ব বুঝে নিস। ”

এরশাদ রহমান বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। মুহূর্তকাল পর নিস্তেজ গলায় বললেন,
” ওদের চাওয়াই পূরণ হোক। আহাদের সাথে আমি কথা বলে নিচ্ছি। ”

___________

আহাদ ফোনে সবটা শোনার পর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল নিহিতাদের বাড়ি। এরশাদ রহমান লজ্জায় নিস্প্রভ হয়ে তাকালে সে বলল,
” আমি কি একটি বার নিহিতার সাথে দেখা করার সুযোগ পাব? ”

তিনি কথা বলতে পারলেন না। চোখ সরিয়ে স্ত্রীকে ইশারা করলে সে বলল,
” ভেতরে যাও। ”

সন্ধ্যার আকাশে তখন মিটিমিটি তারা। নিহিতার রুমের জানালা দিয়ে চাঁদ দেখা যায় না। তার চোখ দূরের তারাতে স্থির অবস্থায় দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। নিহিতা ছিটকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালে আহাদ বলল,
” আসব? ”

নিহিতা উত্তর দিল না। মাথা ঝুকিয়ে নিলে আহাদ ভেতরে ঢুকল। সামনে এগিয়ে বলল,
” এই বেনারশীটা মা তোমার জন্য ভালোবেসে কিনেছিল। গয়নাগুলোও। তুমি না পরলে মা খুব দুঃখ পাবে। ”

নিহিতা চোখ তুলে তাকালে আহাদ বলল,
” ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে নিতে আসিনি। এগুলো দিতে এসেছিলাম শুধু। তোমার নামে কেনা অন্য কাউকে দেই কী করে? ”

আহাদের গলার স্বর ভার হয়ে আসে। বুকের ঝড়টা কি চোখে ভাসছে? অসহ্যণীয় ব্যথাটা কোথায় হচ্ছে? আহাদ ব্যথার উৎস খুঁজার চেষ্টা না করে নিহিতার মুখের দিকে এক ঝলক তাকাল। বেনারশী দিতে দিতে বিদ্রুপের সুরে বলল,
” আমাকে নিচ্ছ না অথচ আংটিটা এখনও পরে আছ! ”

নিহিতা চমকে আঙুলের দিকে তাকাল। বা-হাতের অনামিকা আঙুলে পুরুষালি আংটিটা কী সুন্দর এটে আছে!
” যদিও উপহার ফেরত নিতে নেই, তবুও কেন জানি আংটিটা ফেরত নিতে ইচ্ছে করছে! ”

নিহিতা তৎক্ষণাৎ আংটি খোলার তোরজোর শুরু খুলল। তন্মধ্যেই সুমি কোথাও থেকে ছুটে এলো। দরজার কাছ থেকে চিৎকার করে বলল,
” ঊর্মি সুইসাইড করেছে। ”

নিহিতা আহাদকে ফেলে সুমির কাছে দৌড়ে আসে। বিস্ফারিত চোখে বলে,
” কী বলছিস! সুইসাইড করবে কেন? ”

উত্তর দিল আহাদ,
” শুনেছি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। প্রেমিক বিয়ে করতে অস্বীকার করাই… ”

কথাটা শেষ করল না আহাদ। বিদায় নিয়ে নিহিতার রুম থেকে বেরিয়ে এল।

বান্ধবীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেও বাসা থেকে বের হলো না নিহিতা। এই মুহূর্তে মাহদী ছাড়া আর কোনো কিছুকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না তার কাছে।

______________

বাবা চা খাওয়ার সময় মনও খাওয়ার আবদার করেছিল। ফলস্বরূপ তার ঘুম ভাঙল বিকেলবেলায়। ঘুমিয়ে থাকার পর বাবার উপর দিয়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঝড় দেখতে না পেলেও ঝড়ের পর ক্ষয়ক্ষতি টের পাচ্ছে। বিয়েবাড়িতে ছুটাছুটি করে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কী হয়েছে, বাবা? ”

মাহদী নিরুত্তর থাকলে মন গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল,
” আমি না আম্মুর অংশ? তাহলে বলছ না কেন? আমি ছোট হলেও আম্মু অনেক বড় ছিল। ”

মাহদীর চোখ ভিজে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মন নয় তাকে নায়রা জড়িয়ে ধরে আছে। ছেলেকে জাপটে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” একটা পাগলকে সামলাতে গিয়ে নিজের অমূল্য সম্পদটা হারিয়ে ফেলেছি, বাবা! ”
” কী সম্পদ, বাবা? ”

মাহদী উত্তর দিতে পারল না। কেঁদে ফেলল! মন বাবার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
” কোথায় হারিয়েছ, বাবা? চলো খুঁজে আনি। আমি সাহায্য করব। ”

মাহদীর কান্নার বেগ বেড়ে গেল। ছেলেকে গাঢ় করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” পাগলিটার কাছে। ”
” তাহলে চলো তার কাছ থেকে নিয়ে আসি। ”
” দিবে না। ”
” কেন? ”
” তারও ওটা চাই। ”

মন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমি বুঝিয়ে বললে দিবে। ”
” দিবে না। ”
” দিবে। আমি যখন জড়িয়ে ধরে আদর করে বুঝাব তখন ঠিক দিবে। ”

মাহদী আর কিছু বলল না। নীঃশব্দে দুঃখবিলাস করছে।

_________
কনে রুমের ভারী পর্দা সরিয়ে হুড়মুড়ে ভেতরে ঢুকল মাহদী। চঞ্চল চোখদুটো স্থির হলো নিহিতার উপর। সে বধূ সাজে বিছানার মাঝে বসে আছে। নিহিতার মা আসমা রহমানসহ বেশ কয়েক জন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা ও তরুণীকে উপেক্ষা করে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকল,
” নিহিতা? ”

সাথে সাথে কয়েক জোড়া বিস্মিত দৃষ্টি এসে পড়ল মাহদীর উপর। পর মুহূর্তে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল সকলে। ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের সামলাতে। কেউ মাথার ওড়নাটা টেনে নিল, কেউ বোরকার নিচের অংশ টেনে পা ঢাকল, কেউ খুলে রাখা হাতমোজা পরল, আবার কেউ মুখে নেকাব পরল। শুধু আসমা রহমান আগের ন্যায় বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থাকলেন। এই সময়, এই রুমে মাহদীর উপস্থিত তার নিকট যেন অবিশ্বাস্য!

সেই সময় নিহিতা বলল,
” তুমি এখানে? ”

মেয়ের কণ্ঠে আসমা রহমানের ঘোর কাটল। ঘাড় বাঁকাতে দেখলেন নিহিতা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি চট করে মাথার উপরে তোলা শামিয়ানাটা মুখের উপরে ফেললেন। মেয়েকে আড়াল করে মাহদীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোমাদের বসার ব্যবস্থা তো বসার রুমে করা হয়েছে,মাহদী। এখানে কী করছ? তুমি জানো না এই ভেতরের রুমে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ? ”

মাহদী মাথা নিচু করে বলল,
” নিহিতার সাথে একটু কথা ছিল, আম্মা। ”

আসমা রহমান সন্দেহি চোখে তাকালেন। সন্ধ্যেবেলায় হুট করেই মাহদী বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। নিহিতারও পূর্ণ মত ছিল। তাহলে হঠাৎ কী হলো? কনে রুমে কাজীর বদলে বরের পোশাক পরে মাহদী এল কেন? এক অজানা আশঙ্কা আঁচড় কাটল আসমা রহমানের অন্তরে। তাকে ভাবনায় রেখে পাশ কাটিয়ে নিহিতার মুখোমুখি দাঁড়াল মাহদী। শামিয়ানার পাতলা আস্তরে ঢাকা পড়া মুখটায় এক ঝলক চেয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরল নিহিতাকে। মাহদীর বুকের স্পর্শে অনুভূতি হারিয়ে বরফের মতো জমে গেল নিহিতা। মুহূর্তকালের জন্য বুঝি পৃথিবীর জাগতিক নিয়ম ভুলে গেল। যে মানুষটার চোখে পড়ার জন্য উন্মাদ ছিল। সেই মানুষটা আজ তাকে জড়িয়ে ধরেছে? তাও বিয়ের আগে। এ যে অবিশ্বাস্য! কল্পনার বাইরে, ভাবনার বাইরে। সে স্বপ্ন দেখছে না তো?

নিহিতা বাস্তব- অবাস্তব ভুলে দুই হাতে মাহদীর পিঠ আঁকড়ে ধরল। এই সুযোগ সে কিছুতেই হারাতে চায় না। হোক তা স্বপ্ন কিংবা বাস্তব! ঠিক সে সময় মাহদী নিচু স্বরে বলল,
” তোমার মতো আমি ধার্মিক শিক্ষায় বড় হইনি, ধর্মজ্ঞানও খুব একটা নেই। তবে কিছু দিন আগে কোথাও একটা পড়েছিলাম। আল্লাহ তার বান্দাকে তাঁর চেয়ে অধিক অন্য কাউকে ভালোবাসতে নিষেধ করেছেন। তবুও তুমি বেসেছ। এর ফলাফল কী হতে পারে, নিহিতা? ”

নিহিতা উত্তর দিতে পারল না। টের পেল তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে! চোখের পানি আটকাতে পাতা বন্ধ করে নিতে কোরআনের একটি আয়াত ভেসে উঠল। যেখানে আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি বলে দিন, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তার রাসুল এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের পরিবার-পরিজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দায় পড়ার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাড়ি-ঘর, যা তোমরা পছন্দ কর, তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর (আজাবের) নির্দেশ আসা পর্যন্ত। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সঠিক পথের দিশা দেন না।’ (সুরা তওবা, আয়াত : ২৪)

নিহিতার নিশ্চুপতার মাঝেই বলল,
” এর শাস্তি হতে পারে আমাকে তোমার থেকে কেড়ে নেওয়া। যেমনটা নায়রাকে কেড়ে নিয়েছিলেন! নায়রা বলেছিল আমি আল্লাহর দ্বারা সঠিক পথে ফিরব। হয়তো তাই হয়েছে। নায়রাকে হারিয়ে আজ আমি তাঁর পথে হাঁটছি। নিহিতা, তুমি আমার ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় এমনভাবে ডুবেছ যে নিজ সত্তাকে, নিজ স্রষ্টাকে ভুলে গেছ। এটা ভালোবাসা নয় সয়তানের ধোঁকা! ভালো তো নায়রাও আমাকে বেসেছিল। কিন্তু কখনও সয়তানের ধোঁকায় পড়ে এক মুহূর্তের জন্য তার আল্লাহকে ভুলেনি, ইবাদাত করতে ভুলেনি। তুমি যদি ভেবে থাক আমাকে অনুকরণ করবে। আমি যেমন পাগলামি করে নায়রাকে পেয়েছি তুমিও সেভাবে আমাকে জয় করবে তাহলে বলব তোমার ভাবনা ভুল। কেননা, নায়রাকে পাওয়ার জন্য আমি নিজ স্বভাব পালটাইনি। যেটা তুমি করেছ। ”

মাহদী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” মন বলেছে, এভাবে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললে নাকি তুমি আমার হারিয়ে যাওয়া সম্পদ ফিরিয়ে দিবে, দিবে না? ”

মাহদী নিহিতাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখের জল এবার নিহিতার বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাহদী সেই চোখে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল,
” এই চোখদুটো প্রথম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল নায়রার পবিত্র চোখদুটোতে। এই মন প্রথম বরণ ঢালা সাজিয়ে বরণ করেছিল নায়রার পবিত্র ভালোবাসাকে। নিহিতা, আমার মনের সবটা জুড়ে শুধু নায়রা। সে ছাড়া অন্য কোনো নারীর এখানে প্রবেশ করা নিষেধ। তুমি কি চাও সেই নিষিদ্ধ বরণ ঢালায় বরণ হতে? ”

নিহিতা টলটল চোখে মাহদীর দিকে তাকাল। পরক্ষণে অন্যদিকে ঘুরে বলল,
” চলে যান এখান থেকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আল্লাহ! এ কেমন আগুনে জ্বলছি আমি? ”

মাহদী আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘ নায়রা, আমাকে নিয়ে তোমার গর্ব হচ্ছে তো? আল্লাহর কাছে আমার হয়ে অনুরোধ করো, মৃত্যুর পরে যেন আমায় জান্নাতে ঢুকতে দেয়। এক পলকের জন্য তোমাকে দেখব। নিশ্বাসের শব্দ শুনব। ‘

কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল নিহিতা। অনুভূতিশূন্য শরীরটা টেনে ফোনটা হাতে নিল। আহাদের নাম্বারে কল করে বলল,
” আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে। ”

আহাদ মৃদু হেসে বলল,
” বিয়েটা হয়ে যাক। বাকি জীবনটা নাহয় তোমার কথা শুনেই পার করব। ”

নিহিতা আহাদের মনভোলা কথায় না ভুলে বলল,
” কথাগুলো বিয়ের আগে বলা জরুরি। ”
” চিন্তা করো না, মাহদী ভাইয়া তোমার কাছে যাওয়ার আগে আমাকে সব বলে গেছে। তার জানার বাইরেও কিছু আছে? ”

নিহিতা সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ পর ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,
” তার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নয়, শুধু মুগ্ধতা ছিল। কেন যে বুঝতে এত সময় লাগল! ”

সমাপ্তি

#অবশ্যই_পড়বেন,

ভাবছিলাম বিশাল বড় নোট যোগ করে দিব। কিন্তু ধৈর্য্য হচ্ছে না। আর কী কী লিখব মনেও পড়ছে না। তবুও বলছি,

এখন পর্যন্ত আমার লেখা কোনো গল্পে আমি খারাপ মন্তব্য পাইনি। একমাত্র নিষিদ্ধ বরণ ছাড়া। দুইটা আপু আমাকে অনেক কিছু বলেছেন। নাম উল্লেখ করছি না। কিন্তু মনে হয় দুইটা আইডি একজনেরই। যাইহোক, এই গল্পকে ইসলামিক গল্প বলব না, রোমান্টিকও না। আমি আসলে প্রেমের গল্প ছাড়িয়ে অন্যকিছু লিখতে চেয়েছিলাম। হয়তো আমি সেভাবে ফুটাতে পারিনি, তাই আপনারা ধরতে পারেননি। এটা আমার ব্যর্থতা।

আপনাদের খারাপ লাগার কারণ দুইটা। এক. নিহিতাকে প্রথমে ধার্মিক হিসেবে উপস্থাপন করার পর খারাপ বানিয়ে ফেলেছি। দুই. সম্পর্কে মাহদী নিহিতার দুলাভাই হয়। এখন বলব, যদি নিহিতাকে ভালো থেকে খারাপ দিকে না নিতাম তাহলে কি আপনারা বুঝতেন সে কিভাবে আল্লাহকে ভুলে সয়তানের প্ররোচনায় পড়েছিল? প্রিয় স্থানে আল্লাহকে না রেখে মাহদীকে এনেছিল? আবার মাহদী যদি দুলাভাই না হত তাহলে কি নায়রার সাথে তার তুলনাটা সঠিকভাবে তুলে ধরা যেত? যদি যায় তাহলে বলব, আমার জ্ঞান সীমা ও কল্পনাশক্তি অত্যন্ত সংকীর্ণ।

আরেকটা কথা, একজন ওদের সম্পর্ককে পরকিয়াও বলেছেন। তার উদ্দেশ্যে পরকিয়ার সংজ্ঞা বলে দিচ্ছি, স্বামী/ স্ত্রীর জীবিত অবস্থায় অন্য কারও সাথে সম্পর্ক করাকে পরকিয়া বলে। মাহদীর স্ত্রী নেই, সে যদি নিহিতার সাথে সম্পর্কে জড়াত তবুও এটা পরকিয়া হতো না।

আর কিছু মনে পড়ছে না। পড়লে আবার একটা পোস্ট করব। এখন এই পর্যন্ত। যারা ধৈর্য্য ধরে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। নিষিদ্ধ বরণ শেষ এখন ভালো-মন্দ মন্তব্য করতে পারেন। একটুও মন খারাপ করব না। মন খারাপ তো তখন হয় যখন দেখি লেখিকা শেষ করার আগেই কোনো পাঠক নিজ ভাবনায় শেষ করে বাজে মন্তব্য করে। কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখিত।

সমাপ্ত।