নিয়তি(১)

0
787

নিয়তি(১)
সানজিদা ইসলাম সেতু

বিয়ের আসরে বর যখন কনেকে বলে,‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি তোমাকে না তোমার ছোট বোনকে ভালোবাসি আর ওকেই বিয়ে করতে চাই। ’- তখন বধূর সাজে থাকা সেই মেয়েটির মনে অবস্থা কেমন হতে পারে তা শুধু সেই মেয়েটাই জানে। নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে শুভেচ্ছার বদলে শুনতে হয় নানা কটু কথা। আশেপাশের লোকজন তখন একমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় দোষ মেয়েটির, পরে মেয়েটির দোষ খুঁজতে লেগে পরে।

এখানে ঠিক এমনটাই ঘটছে। বিয়ের আসরে সবার সামনে শুদ্ধ সাঁঝকে উপরের কথাটা বলে। একশ্বাসে কথাটা বলে সাঁঝের মুখের দিকে তাকায় শুদ্ধ। মুখে হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে সাঁঝ, বলে,
‘মজা করছ তুমি আমার সাথে?’
শুদ্ধ বুঝতে পারে সাঁঝ ওর কথায় একটুও বিশ্বাস করে নি। টিসু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বল,
‘এটাই সত্যি সাঁঝ। আমি সন্ধ্যাকে ভালোবাসি আর সন্ধ্যা ও আমাকে ভালোবাসে। আমরা তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলে এতোদিন কিছু বলিনি, আজ আর না বলে পারলাম না। সরি সাঁঝ।’

শুদ্ধের কথা শুনে সাঁঝ সন্ধ্যার দিকে তাকায়, সাঁঝ তাকাতেই সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়।সাঁঝ দু পা পিছিয়ে যায়। সন্ধ্যা ছুটে এসে সাঁঝকে ধরতে নিরে সাঁঝ ওকে আটকে দেয়।
‘খবরদার না,একদম এদিকে আসবি না। তোমরা আমার পিঠে ছুরি না মারলেও পারতে। সন্ধ্যা তুই চল আমার সাথে।’

এমন মুহুর্তে সন্ধ্যার এমন শান্ত হয়ে থাকাটা কারোরই বোধগম্য। যার জীবনের এত সুন্দর একটা দিনে এত বিশ্রী এত ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে সে কি করে এতটা শান্ত থাকতে পারে।

৩০-৪০ মিনিট পর সাঁঝ আর সন্ধ্যা দুজনে আসে। সবাই অবাক চোখ তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কনের সাজে সন্ধ্যা এসেছে আর একটা সুন্দর শাড়ি পরে আসে সাঁঝ।

‘নাও শুদ্ধ তোর সন্ধ্যাকে। তুমি তো জানো শুদ্ধ আমি স্বার্থপর পর নই, না আমি নিজের ছোট বোনের ভালোবাসাকে তার থেকে কাড়তে পারব না আমি আমার ভালোবাসার মানুষের থেকে তার ভালোবাসার মানুষকে কাড়কে পারব।
এসব কথা পরে হবে। কাজি সাহেব বিয়ের কাজ শুরু করুন,এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

যেমন ভাবে সাঁঝের বিয়ে হবার কথা ছিল ঠিক সেভাবেই সন্ধ্যার বিয়ে হয়েছে। কারো মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কনে বদল হয়েছে, না বরের পরিবারের কারোর না কনের পরিবারের কারোর। দুই পরিবারের লোকদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি, মনে হচ্ছে এটাই হওয়ার ছিল।

সবার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁঝ। হাসি মুখে এগিয়ে যায় শুদ্ধ আর সন্ধ্যার দিকে। একটা মিষ্টি দুজনকে খায়িয়ে দেয়। ওদের দুজনকে দেখে একটুও অনুতপ্ত মনে হচ্ছে না সবাই কি সুন্দর আনন্দ করছে।

বিদায়ের সময় সন্ধ্যা সাঁঝকে জরিয়ে ধরে অনেক কাঁদে।
‘আপু পারলে আমাদেরকে ক্ষমা করে দিস।’
‘ক্ষমা চাওয়ার মতো কোনো কাজ তো তোরা করিস নি। তাছাড়া ক্ষমা তো আমার চাওয়ার কথা, আমি তোদের মাঝে এসেছি। তোরা আমাকে ক্ষমা করে দিস।’

সাঁঝের কথা শুনে শুদ্ধ হাসে,
‘তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না সাঁঝ। আমরা তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’
শুদ্ধের কথা শুনে হালকা হেঁসে ওঠে সাঁঝ,
‘তোমাদের ভালো থেকো সুখে থেকো। নাও এবার তোমার হাতটা দাও তো শুদ্ধ। ‘
‘কেন?’
‘দাও তারপর বলছি।’

শুদ্ধ সাঁঝের দিকে হাত এগিয়ে দেয়। সাঁঝ এক হাতে শুদ্ধ অন্য হাতে সন্ধ্যার হাত নিয়ে হাত দুটো মিলিয়ে দেয়।
‘আমার বোনের খেয়াল রেখ। ওহ সরি, ভুলে গেছিলাম তোমাদের লাভ ম্যারেজ, খেয়াল তো অবশ্যই রাখবে, তাইনা!’
‘চিন্তা কর না, আমি সন্ধ্যার খেয়াল রাখব। কখনো কষ্ট পেতে দেব না।’
‘তাই যেন হয়।’

সন্ধ্যার বিদায়ের সময় ওর বাবা-মা অনেক কাঁদে, আর সাঁঝ ঠায় দাড়িয়ে ছিল।
ওই গাড়িতে ওর থাকার কথা ছিল। যা হল সবটা উল্টো হল। চাইলে সাঁঝ যা নিজের তা নিজের করে পেতে পারত।

পিছন থেকে সাঁঝের কাধে হাত রাখে টিয়া, সাঁঝের বেস্ট ফ্রেন্ড আর কাজিন। ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে ওরা।
‘ভিতরে যাবি না?’
‘তা তো যাব। কিন্তু তুই এখানে কি করছিস?’
‘বাড়িতে যাব তাই এলাম। একটা প্রশ্ন করব যদি কিছু মনে না করিস?’
‘হ্যাঁ কর, এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি।’
‘এ বিয়েতে তুই হ্যাপি তো?’
‘কি যে বলিস না তুই! আমার বোনের বিয়ে হয়েছে আজ, আমি খুশি হব না তো কে হবে বল।’
‘আমি আজ বাড়ি যাব না, তোর সাথে আজ আমি থাকব, চল ভিতরে চল।’
‘কাকি কিছু বলবে না তো?’
‘আমার মা তোর মায়ের মতো না রে, চল ভিতরে চল। কয়েকদিন বেশ ধকল গেছে রেষ্ট নিবি চল।’
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাড়ির ভেতর পা রাখে সাঁঝ। সাঁঝের মায়ের রুম থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। সাঁঝ সেদিকে পা বাড়াতে নিলে টিয়া আটকে দেয়।
‘আটকালি কেন?’
‘ওনাদেরকে ওনাদের মতো থাকতে দে। ওনাদের কথা কয়েকদিন ভাবা বাদ দে তো।’
‘ওরাই তো আমার সব।’
‘এবার সরলতা বাদ দে সাঁঝ, অনেক হয়েছে। এই এদের জন্য তুই ভাবছিস, যারা আজ এতো কিছু হবার পরও তোর পাশে না দাড়িয়ে সন্ধ্যার বিয়েতে আনন্দ করেছে। কতটা স্বার্থপর এরা।’
‘আস্তে বল শুনতে পাবে।’
‘শুনুক আজ ওদের শোনা উচিত। প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা এদের হাতে তুলে দিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিস তুই। এরা তোকে ওদের মেয়ে না এটিএম মনে করে।
আমার মনে হয় কি জানিস সাঁঝ, আজ যে এতো কিছু হল সবটা তোর বাবা-মা আগে থেকে জানতে আর সন্ধ্যা ও তো ছোট বেলা থেকে তোর পছন্দের জিনিস কেড়ে নিয়েছে, তোর তখন দিতি বলেই আজ ও এমন কান্ড ঘটাল।
তোর জায়গায় আমি হলে এদের মতো সুবিধাবাদী লোকদের ছুড়ে ফেলে দিতাম। ছিহ্ এমন বাবা-মা যেন কারো না হয়, এরা বাবা-মা নামের কলঙ্ক। ‘

সাঁঝ আর সহ্য করতে না পেরে টিয়াকে চর মেরে দেয়..
‘চুপ কর টিয়া, ওনারা আমার বাবা-মা,। আমার বাবা-মাকে নিয়ে কোনো রকম বাজে কথা আমি সহ্য করব না।’

টিয়া আর সাঁঝের কথা শুনে সবাই বাইরে আসে…
‘ তুই এদের কে তোর আপনজন বলিস তাই না, তাহলে আজ বিয়ের আসরে শুদ্ধ যখন তোকে কথা গুলো বলল তখন কেউ কেন তার প্রতিবাদ করল না, এমনকি কাকা মানে তোর বাবাও না, যেখানে তুই নাকি তার চোখে মনি সেও কিছু বলল না, ঠায় দাড়িয়ে ছিল। পরে শুদ্ধর বাবার সাথে সে কি হাসি। এই নাকি আবার বাবা!!
আর কতদিন চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখবি সাঁঝ, এবার তো কালো কাপড়টা সরিয়ে পৃথিবীটা দেখ, এবার তো নিজের কথা ভাব।
আজ প্রমান হয়ে গেল, এ পৃথিবীতে কেউ কারো নয়, এমনকি নিজের জন্মদাতা বাবা অার জন্মদাত্রী মাও না।’
‘চুপ কর টিয়া, চুপ কর। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
‘শুদ্ধর কথা যখন সহ্য করতে পেরেছিস তখন আমার কথাও তোকে সহ্য করতে হবে। প্লিজ সাঁঝ সবটা বুঝেও অবুঝের মতো থাকিস না। যে তোর জন্য ভাবে তুই তার জন্য ভাব।’

সাঁঝ কিছু না বলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

মানব জীবন বড়ই অদ্ভুত। মানবজাতি কিশোরকালে যৌবনকালে মরিচিকার পিছনে ছুটে আর জীবনের শেষ ধাপে এসে বুঝতে পারে তারা এতোকাল কি ভুল করেছে।
যদি আগে বুঝতে পারত তাহলে হয়ত জীবনটা অারো সুন্দর হতো।

সাঁঝের রুম থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে আর টিয়ার মুখে হাসি ফুটছে।
কে কার ভালো চায় আর কে ক্ষতি চায় তা বোঝা সত্যিই মুশকিল।

#চলবে