নিয়তি (২)

0
806

নিয়তি (২)
সানজিদা ইসলাম সেতু

বধূবরণ এর বেশ বড় আয়োজন করা হয়েছে শুদ্ধদের বাড়িতে। সন্ধ্যাকে বেশ আদরের সঙ্গে বরণ করেন শুদ্ধের মা। তিনি আগে থেকেই চাইতেন সন্ধ্যা যেন তার পুত্রবধূ হয় কিন্তু কোনো কারনে সেটা হয়নি। এবার তার মনের সাধ পূরণ হয়েছে।
নতুন বউয়ের মুখ দেখে তিনি গলার হার, হাতের বালা, কোমড়ের বিছা, আংটি পরিয়ে দিয়েছেন, সবগুলোই সোনার।
আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজন কানাঘুষা করছে।
‘বিয়ে করতে গেল যে মেয়েকে, আর বিয়ে করে নিয়ে এল সে মেয়ের ছোট বোনকে। কি কান্ড বাপু!’
‘আমার মনে হয় সেই মেয়ের কোনো দোষ আছে নাহলে এমনটা হবে কেন বল?’
‘আমি তো শুনেছি ১ বছর আগেই নাকি শুদ্ধের সাথে সেই মেয়ের আংটিবদল হয়েছিল। ‘
‘দেখ মেয়ে হয়ত অন্য কোনো নাগর জুটিয়েছে, তাই মেয়ের বাবা-মা ছোট মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছে।’
‘আমার কিন্তু অন্য কিছু মনে হচ্ছে। ‘
‘তোমার আবার কি মনে হচ্ছে? ‘
‘শুদ্ধের মাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই বউকে পেয়ে সে খুব খুশি,যেন এ মেয়ের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছিল।’
‘এদের কান্ডকারখানা কিছু বুঝতে পারছি না। দেখি কি হয়।’

দূর থেকে নিজের মায়ের এসব কান্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নম্রতা, নম্রতা শুদ্ধর ছোট বোন। বিয়ের আসরে অমন বিশ্রী কান্ড ঘটার পর ও বাড়িতে চলে আসে। মা’কে সবটা জানায়, কিন্তু ওর মা সবটা শুনে খুশি হয়।
‘মা তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি সবটা আগে থেকে জানতে।’
‘জানতাম তো। আমি তো নিজেই চাইতাম সন্ধ্যা আমার শুদ্ধের বউ হয়ে আসুক কিন্তু তোর দাদীর জন্যই তো সাঁঝের সাথে শুদ্ধর আংটিবদল করতে হয়।’
‘মা, তুমি একজন মা হয়ে এমনটা কি করে করতে পারো।’
‘আমি কিছু করি নি। যেনে শুনে নিজের ছেলেকে কষ্ট দিতে পারব না।’
‘তাই বলে এসব বিয়ের আসরে না করলেই কি চলছিল না। এ কথা গুলো তো বিয়ের ডেট ফিক্স হওয়ার আগে বলতে পারতে।’
‘দেখ নম্র তোর এতো কথার উত্তর দিতে পারব না। যা তো এখান থেকে। আমার বউমা আসবে অনেক কাজ বাকি।’

নম্রতা আর কিছু না বলে চলে যায়। বিরক্ত লাগে ওর মা-বাবা আর ভাইয়ের প্রতি।

শুদ্ধর ডাকে ওর ধ্যান ভাঙে,
‘নম্র সন্ধ্যাকে ঘরে নিয়ে যা। ও অনেক টায়ার্ড।’
নম্রতা বেশ কড়া গলায় বলে,
‘তোর ভালোবাসার বউকে তুইই নিয়ে যা। এর প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। একটা কথা সবাইকে বলে দিচ্ছি, এই মেয়েটার ব্যাপারে কোনো কথা আমাকে বলতে আসবে না।’
‘নম্র কি বলছিস তুই এসব? ও তোর ভাবি। ‘
‘ভাবি মাই ফুট। একে তো আমি মানুষ বলেই মনে করি না।’

নম্রতার কথায় সবাই অবাক হয়। যে মেয়েটা ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে এতো এক্সাইটেড ছিল সে আজ এমন কথা বলছে।
সন্ধ্যার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে, তা দেখে শুদ্ধর মা পুরো তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। নম্রতাকে মারতে তেড়ে যায় কিন্তু শুদ্ধর বাবা আটকে দেয়।

দরজার ওপাশ থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ এখনো আসছে। সাঁঝের বাবা-মায়ের যেন কোনো হেল দোল নেই। ওনাদের বড় মেয়ে সাঁঝের বিয়ে ভেঙে গেছে, বরের সাথে ওর ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়েটার এমন মানুষিক অবস্থা কিন্তু বাবা-মা একবারও একটা কথাও বলল না। এমনকি মেয়েটা খেল কিনা তাও জিজ্ঞেস করল না। হায়রে জীবন!!

একটা মেয়ে বড় হবার পর তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বেষ্ট ফ্রেন্ড হয় তার মা। কিন্তু এখানে যে দুজন মায়ের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে একজনও তাদের মেয়ের বন্ধু হতে পারে নি।

সাঁঝের ফোন হাতে নিয়ে ডাটা কানেকশন অন করে টিয়া। কিছু মেসেজ আর একটা মেইল এসেছে। মেসেজ গুলো একই নাম্বার থেকে এসেছে।
মেইল ওপেন করে তা পরতেই টিয়ার মুখে হাসি ফুটে, দেখে মনে হবে তা যেন বিশ্ব জয়ের হাসি। টিয়া ওর পরিচয় দিয়ে নাম্বারে মেসেজ সেন্ড করে। সাথে সাথে একটা রিপ্লাই মেসেজ আসে। অার তার কিছুক্ষণ পরেই সেই নাম্বার থেকে ফোন আসে।

‘আপনি যে মেইলটা সেন্ড করেছেন তা কতদিনে কার্যকর হবে?’
‘চাইলে ২-৩ দিনের মধ্যেই কার্যকর হবে।’
‘আপনি সব ব্যবস্থা করুন। কাজ হয়ে যাবে, এটা আমি আপনাকে কনফার্ম করছি।’
‘ওকে।’

ফোন রেখে টিয়া একটা স্বস্তির নিশ্বাস নেয়।
‘তোর জন্য নতুন কিছু অপেক্ষা করছে রে। কার নিয়তিতে কি যে থাকে তা বোঝার সাধ্য কারোর নেই রে।’

ঘরের মেঝেতে নানা রকমের জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাঁঝ সব জিনিস গুলো বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে। এগুলো শুদ্ধর স্মৃতি। সাঁঝের চোখে শুদ্ধের সাথে কাটানো দিন গুলো ভেষে উঠছে। কত না সুন্দর ছিল সে দিন গুলো।

‘এই কালো জামদানী শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে সাঁঝ। দেখি হাতটা দাও তো।’
‘কেন?’
‘আগে দাও তারপর বলছি।’
সাঁঝ হাত দিলে ওর হাতের কড়ে আঙুলের একটু নখ কামড় দিয়ে কেটে দেয়।
‘এটা কি করলে?’
‘ছোট বেলায় যখন নতুন জামা পরতাম মা তখন এভাবে নখ কেটে দিত বলত, নজর কেটে দিলাম এবার আর কারো নজর লাগবে না।
তাই আমি তোমার নজর কেটে দিলাম, এবার আর কারোর নজর লাগবে না।’
সাঁঝ তখন লজ্জা রাঙা দৃষ্টিতে শুদ্ধকে দেখেছিল।

দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ধ্যান ভাঙে সাঁঝের। দরজার ওপাশ থেকে টিয়ার গলা শোনা যাচ্ছে।
‘সাঁঝ, ওপেন দ্যা ডোর ইয়ার।’
সাঁঝ দরজা খুলে দেয়। ঘরে ঢুকে মেঝেতে দেখে অনেক জিনিস ছড়িয়ে আছে। টিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘এগুলো নিয়ে নেক্সট প্লান কি?’
‘বলছি বাইরে চল।’
কালো জামদানী শাড়িটায় সব জিনিস বেঁধে টিয়ার হাতে দেয়।
‘এগুলো দিয়ে আমি কি করব?’
‘বাইরে নিয়ে যা আমি আসছি।’
টিয়াকে বাইরে পাঠিয়ে রান্নাঘর থেকে কেরোসিন আর দিয়াশলাই নিয়ে বাইরে আসে সাঁঝ। সাঁঝের হাতে এ সব দেখে সবটা বুঝতে পারে সাঁঝ। শাড়িতে ক্যানের পুরো কেরোসিন ঢেলে দেয়। দিয়শলাইয়ের একটা কাঠি পরতেই পুরো শাড়িতে আগুন জ্বলে যায়।
‘এখন যে কাজটা করলি তাতে যে আমি কতটা খুশি হয়েছি তা তোকে বলে বুঝাতে পারব না। সামনে অনেকটা পথ তোকে চলতে হবে, তৈরী কর নিজেকে।’
‘তুই থাকবি তো আমার পাশে?’
‘আমি সারাজীবন তোর পাশে আছি। তোর ছায়া আমি।’
‘তোর মতো বোন বন্ধু যেন সবাই পাই।’
‘সবার কথা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাব। খাবি চল, কাল থেকে কিছু খাসনি।’
‘চল।’

বাড়ির চৌকাঠে দাড়িয়ে বাড়ির ভিতরের কথা শুনে থমকে যায় সাঁঝ। নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না ও, ওখানেই বসে পরে।

‘আমি এটাই চাইছিলাম সাঁঝ। এবার আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। ওল দ্যা বেষ্ট মাই ফ্রেন্ড।’

চলবে