নিয়তি (৩)

0
1069

নিয়তি (৩)
সানজিদা ইসলাম সেতু

বাড়ির নতুন বউ সবার জন্য চা করেছে কিন্তু তাতে চিনির বদলে দিয়েছে লবন। শ্বাশুড়ির হাতে চায়ের কাপ দিয়ে পাশে দাড়ায় নতুন বউ। কাপে চুমক দিতেই চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাবার জোগাড়, না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে। বাকি সবারই একই দশা। নতুন বউ তাই মুখ ফুঁটে কেউ কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু সন্ধ্যা সবার মুখ দেখে কিছু যে একটা হয়েছে তা বুঝতে পারছে। এরই মাঝে নম্রতা এসে কাপের পুরো চা সন্ধ্যার মুখ ছুড়ে দেয়। উপস্থিত সবাই স্তব্ধ। নম্রতা প্রচন্ড জেদী আর ও সবার উপর রেগে আছে কিন্তু তাই বলে এমন কিছু করবে তা কেউ আশা করে নি।

‘নম্র কি করেছিস তুই এটা?’
মা’য়ের এমন ঝাঁঝাল কন্ঠ শুনে হেঁসে উত্তর দেয়,
‘শুকরিয়া কর গরম চা দেই নি। আর তোমার স্বাধের বৌমাকে বলে দিয় তার হাতে একফোঁটা পানিও খাবার ইচ্ছে আমার নেই।
আর হ্যাঁ চা যে চিনি দিয়ে তৈরী করা হয় তা তার কানে একটু ঢুকিয়ে দিও।’
‘তুই কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছি। এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।’
‘ওয়েল ইয়র ওউন মেশিন।’

নম্রতা চলে গেলে শুদ্ধর মা সন্ধ্যার কাছে যায়।
‘তুমি ওর কথায় কিছু মনে কর না মা।’
‘না মা আমি কিছু মনে করিনি। আজ আমার উপর রেগে আছে কাল ঠিক রাগ পরে যাবে।’
‘লক্ষী মা আমার। তুমি গিয়ে শুদ্ধকে ডেকে আন।’

‘ভাগ্যিস শুদ্ধ আর সন্ধ্যা ঠিক সময়ে সব বলে দিয়েছিল,নাহলে কি যে হত!’
‘সাঁঝের মা আমরা কি কাজটা ঠিক করলাম? সাঁঝ যদি জানতে পারে আমাদের খারাপ ভাববে।’
‘ও কিছু জানতে পারবে না। আর জানলেও কিই বা করতে পারবে? তাছাড়া ও করতে পারেই বা কি? সারাজীবন তো শুধু লেখাপড়া, ঘরকন্যার কাজ আর বছর চারেক হল চাকরি, এইতো।’
‘আমাদের অন্তত সাঁঝের বিয়ের সাজে সাজার আগে সন্ধ্যার সত্যিটা বলার উচিৎ ছিল। বেচারি কত কষ্টই না পেল।’
‘রাখত তোমার কষ্ট, হুহ। বিয়ে ভেঙেছে বিধবা তো হয়নি। কপালে থাকলে বিয়া করতে পারবে।
সন্ধ্যা শুদ্ধকে ভালোবাসে, তা তো আমরা শুদ্ধর সাথে সন্ধ্যার বিয়েতে রাজি হয়েছি, শুধু সন্ধ্যা কেন শুদ্ধও তো সন্ধ্যাকে ভালোবাসে।
একটা কথা মনে রেখ, আমরা কোনো ভুল করি নি। আর সাঁঝকে বলে দিও পরের মাস থেকে যেন সংসার খরচের টাকা যেন বেশি দেয়। এ বাজারে ও যা দেয় তাতে হয় না।’
‘তুমি শুধু সন্ধ্যার কথাই ভাবলে, সাঁঝের কথা ভাবলে না?’
‘এ কথা তুমি বলতে পারলে? ওকে যে খায়িয়ে পরিয়ে এত বড় করলাম তা কিছু না। ওকে যে জন্মের পর লবন খায়িয়ে মেরে ফেলিনি এই ওর ভাগ্য। মুখ পুড়ি জন্ম নিতে না নিতেই আমার বাবা-মাকে খেয়ে নিয়েছে, ওকে যে বাঁচিয়ে রেখেছি এটাই বাপ-বেটিতে শুকরিয়া কর।’

বাবা-মায়ের কথা শুনে সাঁঝের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ওর সমস্ত ভাবনা চিন্তা এলোমেলো হয়ে গেছে।
টিয়া সাঁঝের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ফেটে কান্না আসছে ওর। ছোট বেলা থেকে সাঁঝের সাথে ওর ছায়া হয়ে রয়েছে। সাঁঝের মা যখন রেগে গিয়ে সাঁঝকে খেতে দিত না তখন টিয়া ওর ভাগের খাবার সাঁঝের সঙ্গে ভাগ করে নিত, যখন সারারাত ঘরের বাইরে রেখে ঘরের দোর দিয়ে দিত তখন টিয়াও ওর সাথে ঘরের বাইরে থাকত।
টিয়ার এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে ওর মায়ের কোনো সমস্যা না থাকলেও সাঁঝের মায়ের বেশ সমস্যা ছিল।
তিনি সাঁঝের প্রতি অন্যের এতো আদর এতো খেয়াল কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। সাঁঝের জন্মের ৭দিনের দিন ওর নানা-নানি ওকে দেখতে আসছিল,তখন এক অ্যাকসিডেন্ট এ সাঁঝের তারা মারা যায়। সেই থেকেই সাঁঝের মা এটা মনে নিয়ে বসে আছেন যে, তার মা বাবার মৃত্যুর কারণ সাঁঝ, ও অপয়া অলক্ষী। সেদিন থেকে শিশু সাঁঝকে সে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়। খুধা পেলে সাঁঝ কাদত কিন্তু ওর মা ফিরেও তাকাত না। তখন টিয়ার মা সাঁঝকে দুধ দিত। এটা সাঁঝের মা কিছুতেই সহ্য হত না, কয়েকবার তো সাঁঝকে মারতে গেছিল কিন্তু প্রতিবারই সে কাজে সে ব্যর্থ হয়। সবাই ওর মা থেকে ওকে দূরে রাখত।
টিয়ার আর ওর মায়ের সাথে সাঁঝের এতো সখ্যতা সহ্য করতে না পেরে সাঁঝের মা সংসারের হাড়ি আলাদা করে দেয়। আর তার পরই শুরু হয় সাঁঝের প্রতি অমানবিক অত্যাচার। ঠিক মতো খেতে দিত না,ঘুমাতে দিত না, সারাদিন কাজ করাত, স্কুলে যেত দিত না, পরতে দিত না। তাও বহু কষ্টে সাঁঝ ওর লেখাপড়া চালিয়ে যেত। এতো কিছুর পরও সাঁঝ মুখ ফুটে কিছু বলত না, হাসি মুখে সবটা মেনে নিত। কেউ কিছু বললে বলত
‘ উনি অামার মা, আমি ওনার কথার অবাধ্য হতে পরব না। অামি ওনাকে অনেক ভালোবাসি।’
একটা সময় সাঁঝের বাবাও ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। লেখাপড়ার কোনো খরচ দিত না। টিউশনি করিয়ে আর উপবৃত্তির টাকা দিয়ে নিজের লেখাপড়ার চালিয়েছে, অবশ্য তা থেকেও অনেকটা টাকা ওর মায়ের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। টাকা না দিলে ৩ বেলার ২ বেলা খাওয়া বন্ধ।
কিন্তু সন্ধ্যার ক্ষেত্রে হয়েছে পুরোটা উল্টো। সাঁঝ যতটা কষ্ট করেছে তার চেয়েও ১০গুন বেশি সুখ সন্ধ্যা পেয়েছে। ওকে কখনো বুঝতে দেয়া হয় নি কষ্ট কি। যথেষ্ট আদরে ওকে বড় করা হয়েছে, কখনো এক গ্লাস পানি নিজ হাতে গড়িয়ে খেতে হয় নি।
কথায় আছে, অভাগা যে দিকে তাকায় সেদিকে সাগর শুকিয়ে যায়। এখানে সাঁঝের হয়েছে সেই অবস্থা।

‘ওঠ সাঁঝ, ভিতরে চল।’
‘কেন যাব? ওখানে কেউ আমাকে চায় না। আমি কখনো কাউকে সুখী রাখতে পারিনি, যেখানে গেছি সেখানেই কষ্ট নিয়ে গেছি। বেঁচে থেকে কি হবে আমার? সবাই কষ্ট পাবে আমার জন্য, পাবে বলছি কেন পাচ্ছে তো।’
‘সবার কষ্টের দায় তোর নয়। তোর থেকে যদি কেউ কষ্ট পায় সেটা তার সমস্যা।
তোকে অামি আগেও বলেছি অন্ধের মতো কাউকে ভরষা করিস না, যাদের ভরষা করবি তারাই তোর পিঠ পিছে ছুরি মারবে যেমন তোর বাবা-মা, সন্ধ্যা আর শুদ্ধ। এতো ভালোবাসা দিলি এদের, কিন্তু কোনো লাভ হল কি?
সন্ধ্যা তো জানত তুই শুদ্ধকে ভালোবাসিস, তাহলে ও এমনটা করল কি করে?’
‘আমি আর কিছু ভাবতে চাই না।’
‘তোকে আর কিছু ভাবতে হবে না, যা ভাবার সব আমি ভেবে নিয়েছি।’
‘কি ভেবেছিস তুই?’
‘ তার আগে বল আমার উপর কি তোর ভরষা আছে?’
‘হুম।’
‘ আগে আমাকে কথা দে আমি যা বলব তুই কোনো প্রশ্ন ছাড়া সবটা মেনে নিবি।’
‘আচ্ছা।’

নতুন বর-বউকে নিয়ে বসার ঘরে আড্ডার আসর জমানো হয়ে। সবাই গোল হয়ে বসেছে। নম্রতাকে জোর করে আনা হয়েছে।
কাজিনদের একের পর এক প্রশ্নে শুদ্ধ আর সন্ধ্যার নাজেহাল অবস্থা।
‘তা মি.বর সন্ধ্যার সাথে আপনার প্রেম কাহিনীটা একটু বলুন, আমরাও শুনি।’
‘সন্ধ্যাকে প্রথম দেখাতেই আমার চোখ আটকে গেছিল। যাকে বলে লাভ এট ফাষ্ট সাইড। তার পর কথা, পরে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা আর এখন বিয়ে।’
‘তা হ্যাঁরে শুদ্ধ তোর লাভ এট ফাষ্ট সাইড কয়বার হয় রে?’
এক কাজিনের এমন প্রশ্নে পুরো আসরে হাসির রোল পরে যায়। লজ্জায় মাথা নিচু হয় শুদ্ধ সন্ধ্যা দুজনেরই। এর পর একেক জনের একেক রকম খোঁচা দেয়া কথা শুরু হয়। শুদ্ধ আর সন্ধ্যা চাইলেও ওখান থেকে বের হতে পারবে না।
‘ভাই শুদ্ধ তোকে দেখলে বোঝা যায় না তুই এতো চালু, এক সাথে দুই বোনকেই নাচালি।’
‘কি ভাবে করলি সেই ট্রিকস টা আমাদেরও একটু বল।’
‘আমি ভাবছি অন্য কথা, সন্ধ্যা মানে আমাদের ভাবি কিভাবে পারল নিজের হবু দুলাভাই এর সাথে এমনটা করতে? ও তো জানত সাঁঝ আর শুদ্ধের কথা।’
‘তুই ঠিক বলেছিস। বিয়ে করলে আমি সাঁঝের মতো নিঃস্বার্থ মেয়েকে বিয়ে করব।’

কানে ইয়ারফোন নিয়ে হাসছে টিয়া,প্রান খোলা হাসি। সাঁঝ পাশে বসে শুধু দেখছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘সাঁঝ রে আগামিকাল তোর স্বাধীনতা দিবস।’
কথা শেষ করে আবারও সেই হাসি….

চলবে