নীলচে তারার আলো পর্ব-০৬

0
727

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৬

“থ্যাংক ইউ তো তুমি বললে না এট লিস্ট নিজের নামটা তো বলো। থ্যাংক ইউ না হয় আমি পরেই নিয়ে নিবো।”, বলেই ছেলেটা হালকা রহস্যময় হাসি হাসলো।ছেলেটার হাসি দেখে হিয়ার কেমন যেনো লাগলো। হিয়া নিজের নাম বলতে চাইছে না। কে না কে? আবার এতো ভাব নিয়ে নাম জানতে চাইছে, চুপ করে থাকাই ভালো।

হিয়াকে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটা বললো,” চুপ থেকে লাভ নেই নাম বলো নয়তো এক্ষুনি বাস থেকে ফেলে দিবো।” হিয়া রীতিমতন চমকে তাকালো।
আয়হায় এই ছেলে কি পাগল নাকি? চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিবে বলছে। হিয়ার রাগ হলো ভীষন, কি আশ্চর্য! সে চুপ থাকে বলে সবাই তাকে এভাবে আতঙ্কের মধ্যে রাখবে। ওই বনমানুষটাও একি কাজ করে।

হিয়া প্রায় রেগে বললো,” দিন, ফেলে দিন। পড়লে আমি একা পড়বো না আপনাকে নিয়েই পড়বো।” বাসের বাকি মানুষগুলো অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগের মাথায় কথাগুলো জোরেই বলে ফেলেছে সে। তখন না বুঝলেও এখন ঠিক বুঝেছে। পাশে বাস হেল্পার বলে উঠলো,” মনে হয় প্রথম প্রথম ঝগড়া।”বলেই ফিক করে হেসে উঠলো সে।

লোকটার কথা শুনে হিয়ার সামনের এলিয়েনটাও হেসে ফেললো। হিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। প্রথম প্রথম ঝগড়া আবার কি? হিয়ার কেনো জানি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। বার বার শুভ্রের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার। সব হয়েছে ঐ লোকটার জন্যে, লোকটাকে হাতের কাছে পেলে হয়।

বাসটা নেক্সট স্টপে এসে দাড়াতেই ছেলেটা নেমে গেলো আর যাওয়ার আগে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” আবার দেখা হচ্ছে কিন্তু।”ঠোঁটে আবার সেই রহস্যময় হাসি।

আবার দেখা হচ্ছে মানে কি? কাল থেকে সে আর বাসে করে যাবে না দরকার প্রয়োজনে হেঁটে হেঁটে যাবে।

শুভ্র মেডিকেলের সামনে গাড়ি দেখে মনে মনে খুশী হলো কারণ এই অফিস টাইমে বাসে করে যেতে হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। গাড়ির দরজা খুলে পিছনে বসতে বসতে বললো,” এসেছ ভালো করেছো। এবার চলো।”

ফিরতে ফিরতে শুভ্রের মাথায় মেয়েটির কথা এলো। এতো তাড়াতাড়ি মেয়েটা বাসায় পৌছে গেছে। ভেরি স্ট্রেঞ্জ! ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না সে। বাসায় গেলেই দেখা যাবে।

শুভ্র নিজের ঘরে এলো, বাড়িটা কেমন শান্ত হয়ে আছে। আগে যেমনটা থাকতো। হটাৎ এমন শান্তিময় পরিবেশের কারণ…..? শুভ্র রুম থেকে বেরিয়ে একবার এদিক ওদিক তাকালো। ডান দিকে হিয়ার ঘর, ওদিকে তাকাতেই দেখলো ঘরটা খালি। আচ্ছা, বাঁদরটা ফেরেনি তাহলে। তাই তো বলি এতো নিঝুম লাগছে কেনো? এসেই তো উৎপাত শুরু করবে। শুভ্র টাওয়াল নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

হিয়া বাড়িতে ফিরেই প্রথমে রবীউল সাহেবকে খুঁজলো। করিডোরে চা হাতে চিন্তিত মুখে তিনি দাড়িয়ে আছেন। হিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,” এতো দেরী হলো কেনো তোর?”

হিয়া রবীউল সাহেবকে খুঁজছেন দুটি কথা বলবেন বলে। প্রথমটি হলো সে আর গাড়ী করে কলেজে যাবে না। দ্বিতীয়টি হলো আজ থেকে সে আর ডাইনিং টেবিলে খাবে না। কিভাবে বলবে হিয়া বুঝে উঠতে পারছে না। রবীউল সাহেবের দিকে তাকিয়ে হিয়া হালকা হাসলো। তারপর অনেক সাহস করে কথাগুলো বলতেই রবীউল সাহেব গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ভারি গলায় বললেন,” দুটোর একটাতেও আমার অনুমতি নেই।”

হিয়া পড়েছে মহা বিপদে যে করেই হোক রবীউল সাহেবকে তার রাজি করাতেই হবে। না হলে সব সময় হিয়াকে একটা সস্থির মধ্যে থাকতে হয়। যেটা সে চায় না।


শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলো, কালো রঙের শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে। সামনে তাদের একটা মেডিকেল ক্যাম্পিং আছে। পাহাড়ি এলাকার মানুষদের জন্য সে ক্যাম্পিং এ বিনামূল্যে সেবা প্রদান করবে তারা। সেটা নিয়েই শুভ্র ভীষন স্ট্রেসে আছে। তার মতে কোনো প্ল্যান সাকসেসফুল হতে হলে অবশ্যই সেটা ভালো ভাবে অর্গানাইজড করতে হবে। কিন্তু এই ক্যাম্পিং এর অবস্থা নাজেহাল। কয়দিন পর ক্যাম্প আর এখনো এমন খাপছাড়া ব্যাপার।

শুভ্র কাউচে বসে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছিল। হটাৎ নূপুরের অস্পষ্ট আওয়াজ তার কানে ভেসে এলো। ধীরে ধীরে সে আওয়াজ আরো স্পষ্ট হতে লাগলো। খুব কাছাকাছি কেউ নূপুর পায়ে হেঁটে আসছে। শব্দটা একদম কাছে আসতেই শুভ্র চোখ খুলে তাকালো। সামনে তাকাতেই দেখলো হিয়াকে।ব্যাগ কাধে সে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। শুভ্র কিছুক্ষনের জন্যে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারপর ভ্রূ কুচকে ডান পাশের দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকালো। মেয়েটা এতো দেরিতে বাড়ি ফিরছে কেনো?
কোন কলেজে আবার এতক্ষণ ক্লাস হয়।
আর এই মেয়ের নূপুরের আওয়াজ ভেবেই শুভ্র দু আঙ্গুলে কপাল ডলতে লাগলো। বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলে বির বির করে বললো,” আচ্ছা, এইজন্যে বাড়িটা এতক্ষণ নিঝুম লাগছিল।”

হিয়া ব্যাগটা টেবিলে রেখেই বিছানায় গা হেলিয়ে দিলো। আহ! অবশেষে এই লম্বা দিনটা শেষ হলো। কালকে থেকে নো চিন্তা ডু ফুর্তি। অনেক কষ্টে রবীউল সাহেবকে সে রাজী করিয়েছে। বাপরে এক দিনে কি কি ঘটলো? প্রথমে প্রভা তারপর ড্রাইভারকে তাড়ানো, বাসে ওঠার যুদ্ধ, তারপর মঙ্গলগ্রহের সেই এলিয়েন শেষমেশ রবীউল সাহেবকে রাজি করানো। কালকে থেকে আর কোনো ঝামেলায় পড়বে না সে। মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করবে। ভাবতে ভাবতে উঠে বসলো। তার উফফ পা টাও অসহ্য ব্যাথা করছে। হিয়া পা থেকে মোজা জোড়া খুলে বিছানায় রাখলো। তারপর তোয়ালে আর জামা নিয়ে শাওয়ার গেলো। আজ সে অনেক্ষন আরাম করে গোসল করবে।

শুভ্র অনেক্ষন ভেবে একটা প্ল্যান বের করলো। কিন্তু ক্যাম্প ইন্সট্রাক্টরের সাথে তার কথা বলা প্রয়োজন। নাম্বার কি তার কাছে আছে? শুভ্র বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিয়ে চেক করলো কিন্তু না, তার কাছে নাম্বার নেই। কার কাছে নাম্বার থাকতে পারে? প্রভা! হ্যা থাকতেই পারে, ওর কাছে থাকবে না এমন কোনো জিনিস আছে! শুভ্র প্রভাকে কল করতেই দিবা কল রিসিভ করলো।

শুভ্র কিছু বলার আগেই দিবা বললো,” শুভ্র ভাইয়া, হিয়াকে একটু ফোনটা দিবেন কথা বলবো। ওর নাম্বারটা নিতে ভুলে গেছি। ফোনটা একটু দিন না।”

” হোয়াট? কাকে দিবো?”, যেই মেয়েটিকে নিয়ে শুভ্রের এতো সমস্যা তার নামটাই শুভ্রের জানা নেই।

দিবা কিছু বলার আগেই প্রভা এসে দিবার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,” দিবা তুই বড্ড বেয়াদব হয়েছিস।” বলেই ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেলো প্রভা ফোন কানে দিয়ে বললো,” কি ব্যাপার তুই রাতে ফোন করেছিস? তা জনাব এতো রাতে ফোন করার কারণ?”

শুভ্র সোজাসুজি কথা না বাড়িয়ে নাম্বারটা চাইলো। প্রভা ওপাশ থেকে বললো,” দাড়া! খুঁজে দিচ্ছি। ওয়েট কর।”

শুভ্র কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বারান্দায় এলো। হটাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দ কানে ভাসছে। আসলে শুধু ঝুম শব্দই কানে ভাসছে না সঙ্গে নূপুরের শব্দটা আবারো কানে ভাসছে তার। শুভ্র বারান্দায় দাড়িয়ে সে শব্দ শুনছে। বৃষ্টির কয়েকটি বিন্দু এসে ভিড়েছে তার বাম গালে। কেনো জানি আজ তার বৃষ্টি ভালো লাগছে ভালো লাগার কারণ কি সেই নূপুরের আওয়াজ। সে আওয়াজ হটাৎ আজ নেশার মতন তাকে গ্রাস করছে। শুভ্র হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। ফোনটা রেখে দিয়েছে বারান্দার টুলটার উপর। ফোনটাও ভ্রাইভ্রেট করছে কিন্তু শুভ্রের সে দিকে খেয়াল নেই।

শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে রুমে এলো। হটাৎ তার ফোনের কথা মনে পড়লো। ফোনটা সে টুলে ফেলে এসেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে অন করতেই দেখলো প্রভার মিসড কল উঠে আছে। শুভ্র তোয়ালেটা একপাশে রেখে হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো এলো মেলো করে প্রভাকে কল দিলো।
ফোন ধরে প্রভা রাগী গলায় বলল,” ফোন রেখে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?”

” তেমন কিছু না। তুই নাম্বার পেলি?”, হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো।

” হ্যা পেয়েছি।” ওপাশ থেকে বলল।

শুভ্র ফোন হাতে রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে বললো,” ওকে, আমাকে ইনবক্স কর।”কথাটা বলে শেষ করতেই অজস্র পানির ছিটে শুভ্রের মুখে এসে পড়লো। শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো। সবে সে চুলের পানি মুছে বেরিয়েছে এখন আবার….!
শুভ্র চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় রাগে প্রভার কল কেটে দিলো। তারপর চোখ খুলে তাকাতেই সামনে যাকে দেখলো তাকে দেখে শুভ্র একটুও অবাক হয় নি। এইসব কাজ একজনের দ্বারাই সম্ভব।

বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হিয়ার চুল থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। তার তোয়ালেটা ভেজা তাই মোহনা আপুর কাছে আরেকটা তোয়ালে চাইতে যাচ্ছিল। যাওয়ার পথে চুলগুলো পিছনে ফেলতেই যে পানির ছিটে শুভ্রের মুখে গিয়ে পড়বে কে জানতো। উফফ!
এই লোকের যা রাগ আবার তার চুল গুলোও না কেটে ফেলতে বলে।
হিয়া ভীত চেহারায় শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। কি করবে সে? দৌড়ে পালাবে…? কিন্তু পালানোর আগেই শুভ্র হিয়ার টেনে এনে দেওয়ালের সামনে দাড় করিয়ে দুপাশে হাত রাখলো।

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে আছে শুভ্রের দিকে। লোকটা সবকিছুতে এমন রেগে যায় কেনো। মুখে সামান্য পানি পরেছে এতে এতো রাগের কি আছে।
শুভ্র নিজের রাগ সামলে শান্ত গলায় বললো,” তোমার আর কোনো কাজ নেই আমাকে বিরক্ত করা ছাড়া? বিরক্ত করারও তো একটা লিমিট থাকে। সারাদিন নূপুর পরে সাড়া বাড়িতে শব্দ করেও শান্তি পাওনি তাই না? এখন আবার এইসব শুরু করেছো?”

শুরু করেছি বেশ করেছি দরকার হলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে সারাদিন আপনার রূমের সামনে ঘুরে বেড়াবো, যত্তসব। ইস কথাগুলো লোকটার মুখের উপর বলতে পারলে ভালো হয়। যা হবার হবে। আমাকে কাচা গিলে ফেললে ফেলবে। আজ আমিও বলবো, সবসময় কেনো শুনবো।

” দেখুন আমি কিছু শুরু করিনি। আমার পা তাই আমি নূপুর পরে যেখানে খুশী হাটবো আমার ইচ্ছে। আপনার এতো সমস্যা কিসের? এতো সমস্যা হলে কানে তুলো দিয়ে রাখুন।”, একটু থেমে থেমে বললো কারণ শুভ্র চোয়াল শক্ত করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ভেবে পায় না মাঝে মাঝে এই মেয়ে চুপ করে থাকে একটা কথাও বলে না আবার মাঝে ট্রেনের মতোন ছুটে আর থামে না।

কিন্তু শুভ্রও কম যায় না।
শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার আরো কাছে আসতে থাকে। দূরত্ব কমে আসায় হিয়া একটা ঢোক গিললো। লোকটা এভাবে এগিয়ে আসছে কেনো? কি করতে চায় সে?

এইবার একদম কাছে চলে এসেছে শুভ্র। হিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হিয়া চোখ নামিয়ে এদিক সেদিন তাকাতে লাগলো। শুভ্রের এমন চাহিনির সাথে সে পরিচিত নয়। শুভ্রের নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে হিয়ার গলায়। সাড়া শরীর যেনো শিউরে উঠলো তার। বুকের ভিতর ড্রাম বাজতে লাগলো। হিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগে শুভ্র টান মেরে হিয়ার ওড়নাটা নিজের হাতে নিয়ে নিতেই হিয়া ভয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো।

শুভ্র হিয়ার চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলতেই নিঃশব্দে হাসলো। তারপর ওড়নাটা দিয়ে নিজের মুখের পানি মুছতে মুছতে বললো,” আশা করছি নেক্সট টাইম থেকে চুলের পানি দিয়ে বন্যা ভাসানোর ইচ্ছে বা শখ কোনোটাই তোমার হবে না।”শুভ্রের এমন উক্তিতে হিয়া পিট পিট করে চোখ খুলে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলো।

[ #চলবে ]