প্রণয়ের সূচনা পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
239

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৪৬
_____________________________
–‘ ৩০ ডিসেম্বর কী কোনো বিশেষ কিছু আছে ইরা?

পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়ছিল ইরা।বিকেলের অলস প্রহরে একটু সময় কাটাতেই বই পড়ার প্রয়াশ।সূচনা বিছানায় বসেছিল,তাকে দেখে বই রেখে সূচনার সাথে কথা বলতে মন দিতেই সূচনা প্রশ্ন টা করে বসলো।সূচনার হেন প্রশ্নে ইরার মুখের রঙ পাল্টে গেছে, কেমন যেন লাগছে তাকে।সূচনা জবাব না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো-

–‘বললে না? ৩০ডিসেম্বর কী বিশেষ কিছু আছে? তোমার ভাইয়ার?

ইরা কোনোরকমে জবাব দিল-

–‘ না তো ভাবি,তেমন কিছু নেই।কেন? হ..হঠাৎ এই তারিখের কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?

সূচনা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো মিনিট দুয়েক তারপর বললো-

–‘আমাদের রুমের শেলফে রাখা কোনো এক টা বইয়ের মধ্যে একটা কাগজ পেয়েছিলাম, সেখানে তারিখ টা দেখেছি আর কিছু আকা ও ছিল সেখানে।

–‘একজন মহিলা ফ্লোরে পড়ে আছে আর তার সামনে একজন পুরুষ দাড়িয়ে আছেন।এমন?

সূচনা কিঞ্চিৎ অবাক হলো, বুঝতে পারলো ইরা জানে এ ব্যাপারে কিছু।এদিকে ইরার হুশ হয়েছে সে কি বলে ফেলেছে তা বুঝতেই জিভ কা/মড়ে ধরেছে।সূচনা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো-

–‘হ্যা। তো ঔ তারিখে কি?

–‘কি..কিছু না ভাবি আমি তো জানি না।

–‘তাহলে বললে কিভাবে সেই কাগজে কি আকা ছিল?

ইরা চুপ করে রইলো কয়েক পল তারপর আনমনে বললো-

–‘ঔ তারিখে ভাইয়ার জন্মদিন।

সূচনা অবাক হলো,জিজ্ঞেস করলো –

–‘জন্মদিন তো সেটা নিয়ে এত লুকোছাপা কেন?

–‘কারণ…ঔদিন..

বলতে বলতে থেমে গেল ইরা কথা ঘুরিয়ে ফেললো।বললো-

–‘কারণ ভাইয়া সেলিব্রেট করা পছন্দ করেন না।তাই বলেনা।

সূচনার বিশ্বাস হলো না একদম।জিজ্ঞেস করলো-

–‘শুধু কী ওনার জন্মদিন নাকি অন্য কিছুনও আছে?

–‘ ন..না শুধু জন্মদিন ই।

–‘তাহলে সেই কাগজে…

–‘ভাবি প্লিজ আমাকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমাকে কেন কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করো না।

ইরা উচ্চ স্বরেই কথাগুলো বললো।সূচনা আর কিছু বললো না।ইরা একটু পর সূচনার কাছে এসে বললো-

–‘আ’ম সরি ভাবি কিন্তু তুমি প্লিজ এই ব্যাপারে আর কিছু জানতে চেয় না।

সূচনা জোরপূর্বক হাসলো,মিহি স্বরে বললো-

–‘ঠিক আছে।

প্রসঙ্গ বদলাতে সূচনা মুগ্ধর ব্যাপারে কিছু কথা বললো।স্বাভাবিক হলো ইরা কিন্তু সূচনার সন্দেহ বাড়লো তরতর করে।সেদিন প্রণয়ের অমন ব্যবহারে রা/গ হয়েছে ঠিক ই তবুও সে জানতে চায় ৩০ ডিসেম্বরে কী আছে আর ঔ কাগজ টা ধরার পর কেন এত রিয়েক্ট করলো প্রণয়।বলা হয় নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি ই মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে।সূচনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।দুইদিন সব রকম চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে এটা নিয়েই ভেবেছে কিন্তু কিছুই পায়নি উত্তর হিসেবে।প্রণয় না বললে জানতে পারবে না আর প্রণয় বলবে না সহজে।তার মতে ছাদের সেই রুমটাতেই কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু যাবে কিভাবে?ইরার কাছ থেকে কিছু জানতে পারবে ভেবে জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু হতাশ হলো। সূচনা আপাতত এটাই ভাবছে ৩০ ডিসেম্বর শুধু প্রণয়ের বার্থডে না অন্য কিছু ও আছে।কিন্তু কী সেটাই বের করতে হবে।
___________________________
–‘আপনি কী আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছেন?

বাইরে থেকে এসেছে বিধায় ফ্রেশ হতে গিয়েছিল প্রণয়।রাত নয়টার মতো বাজে।ওয়াশরুম থেকে প্রণয়ের বের হওয়ার অপেক্ষায় ই ছিল সূচনা।প্রণয় বের হতেই সাথে সাথে প্রশ্ন টা করে বসলো সূচনা।প্রণয় অবাক হয়েছে বটে, টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো-

–‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার কারণ?

–‘পাল্টা প্রশ্ন কেন করছেন?আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

সূচনার কণ্ঠে কিঞ্চিৎ রা/গের আভাস টের পেল প্রণয়।সূচনার সামনে যেয়ে তার দুই বাহুতে হাত রেখে মিহি হেসে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কী ব্যাপার আজ টেম্পারেচার এত হাই কেন?

–‘আবার ও প্রশ্ন করছেন?আমার প্রশ্নের জবাব দিন প্রণয়।

–‘কি হয়েছে বলো তো?

মেজাজ খারাপ হলো সূচনার।দুই বাহু থেকে হাত সরিয়ে চলে যেতে নিলে প্রণয় খপ করে হাত ধরে ফেললো। সূচনার দু হাত চেপে মুড়ে ধরলো পেছনে। বা দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সূচনা।প্রণয় নরম স্বরে বললো-

–‘এদিকে তাকাও তো।

সূচনা তাকালো না,প্রণয় আবারও বললো-

–‘এদিকে তাকাও।

–‘ না।

–‘তাকাবে না?

–‘না।ছাড়ুন আমায়।

–‘ছেড়ে দিব?

–‘হ্যা।

সূচনার বলার সাথে সাথে ই প্রণয় ছেড়ে দিল তাকে।সূচনা বিস্ময় নিয়ে তাকালো তার দিকে। বললো-

–‘ছেড়ে দিলেন?

–‘তুমিই তো বললে।

–‘আমি বললেই ছেড়ে দিতে হবে?

–‘হ্যা অবশ্যই। তোমার কথা শুনতে হবে না।

সূচনা কপোট রা/গ দেখিয়ে বললো-

–‘যদি কখনো বলি আমি আপনার সাথে থাকব না ছেড়ে দিন আমায়। তাহলে কি ছেড়ে দিবেন?

প্রণয় নিষ্পলক চোখে তাকালো সূচনার দিকে। চাহনি অন্য রকম তার,রা/গ ভুলে মনে ভয়ের সঞ্চার হলো সূচনার।প্রণয় এগোলো, দুহাত সূচনার কটিতে রেখো কটিবন্ধ করলো।একেবারে গায়ে গা মিলিয়ে দাড়িয়েছে সে।ঝুকে সূচনার কানের সামনে মুখ নিয়ে হিম হওয়া কণ্ঠে বললো-

–‘তোমার আমার বিচ্ছেদ হবে,তবে তা হবে সাময়িক।কোনো এক সাঝ বেলায় নিস্তব্ধ প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে আবারো দেখা হবে আমাদের,আবারো হারাবো দুজন-দুজনায়,ডুব দিব ফেলে আসা দিনে,সাজাবো নতুন স্মৃতি, ঘটাবো আবার নতুন #প্রণয়ের_সূচনা।বুঝেছো?

সূচনা জবাব দিল না,চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো,ঠোট জোড়া কা/পছে তার,চোখের পাতা ও তিরতির করে কা/পছে।প্রণয়ের কণ্ঠ অদ্ভুত মাদকতায় ভরা,সূচনাকে ঘায়েল করার জন্য তার বলা কথাই যথেষ্ট আর এদিকে সে পরিমানের চেয়েও বেশি লজ্জা পায়।

–‘তোমার ক*ম্পিত ঠোঁটজোড়া আমাকে টানছে নারী,রাত করে শাওয়ার নিতে তোমার কষ্ট হবে কিন্তু আমার ঘাড়ে যেন না পড়ে দোষ,সব দোষ তোমার তিরতিরিয়ে কা*পতে থাকা ঠোঁটজোড়ার।তার মধ্যে চোখ পড়েছে আমার,নেশা ধরেছে।

সূচনা ভড়কালো,দু হাত দিয়ে ধাক্কা দিল প্রণয়ের বুকে।লাভের লাভ কিছু হলো না উল্টো আরও চেপে ধরলো প্রণয়।প্রণয়ের প্রশস্ত বুকেই থেমে গেল সূচনার হাত জোড়া আর তার দৃষ্টি ও থামলো সেখানেই।প্রণয় সন্তপর্ণে ঠোট ছোয়ালো সূচনার ঠোঁটে,ঠোটে উষ্ণ ছোয়া পেতেই সূচনা খাম/চে ধরলো প্রণয়ের টি-শার্টের কলার।সাথে সাথে ছাড়েনি প্রণয়,সময় নিয়েছে মিনিট দুয়েক।তারপর ছেড়ে দিয়ে পূর্বের ন্যায় ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো-

–‘ইউর লিপস ড্রাইভ মি ক্রেজি কাপকেক।

প্রণয়ের উক্ত বাক্য শুনতেই লজ্জায় সিঁটিয়ে গেল সূচনা।ভাড় ছেড়ে দিল,মাথাটা প্রণয়ের বুকে গিয়ে ঠেকলো একদম।প্রণয় হাসলো,যাক প্রসঙ্গ পাল্টাতে পেরেছে।নাহলে প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অব্দি জিজ্ঞেস করতেই থাকতো।
____________________________
–‘তার খোজ পেয়েছি, তার নাম রিয়াদ হাসান।সে এক বছর আগে পুরো পরিবার সমেত আমেরিকা তে চলে গেছে। পরিবারে তার বাবা-মা, স্ত্রী আর জমজ দুইটা ছেলে আছে।আনান সিদ্দিকীর ভাগ্নে সে,আনান সিদ্দিকী আমেরিকা তে তাদের সাথেই থাকতেন।আনান সিদ্দিকীর মৃত্যুর খবর শুনে সবাই দেশে ফিরেছেন।গুলশানে তাদের নিজস্ব ফ্লাটে উঠেছেন।ভাই রিয়াদের ক্ষমতা যা আমেরিকা তেই, দেশে তার তেমন কোনো পরিচিতি ও নেই। তার কোনো স্টেপ নিতে হলে বুঝে শুনে নিতে হবে,অনেক সময় ও নিতে হবে।ততদিনে আমরা কিছু করতে পারি।

তন্ময় মুখস্থ করা স্পিচের মতো এক নাগাড়ে বললো কথাগুলো। প্রণয় স্বাভাবিক গলায় বললো-

–‘করতে পারি।কিন্তু রিয়াদ সাহেবের সাথে তো আমার আরেকটা হিসেব বাকি।তার ওয়াইফকে নিয়ে আসতে হবে।কি যেন নাম.. হ্যা মাহিরা।তাকে আর সাথে আর একজন আছে এদের দুজনকে চাই।ব্যবস্থা করো নিয়ে আসার।

–‘ঠিক আছে কিন্তু আরেকজন টা কে?

–‘স্নেহা…আমার বউয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী।

–‘ভাবীর শুভাকাঙ্ক্ষী?

–‘হ্যা।তার বাসার এড্রেস, কলেজ সব ইনফরমেশন মেইল করে দিব- গেট হার এজ সুন এজ পসিবল।

–‘ঠিক আছে।

–‘আচ্ছা শোন মিহু কেমন আছে?

–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।

–‘ও আসে না এখন বাসায়, কল ও করে না,অনলাইন ও আসেনা।কী হয়েছে ওর?

–‘কী আর হবে আম্মুর সাথে ঝ/গড়া হয়েছে। সারাদিন ঘাপটি মেরে রুমে বসে থাকে,পিহু ও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।আমরা একসাথে থাকলে কত ভালো হত তাই না ভাই?

–‘আমরা একসাথেই আছি,তুই ছায়ার মতো থাকিস তো সারাক্ষণ আমার সাথে। মিহু ইদানীং আসে না, পিহু তো একবারো আসেনি বাসায়।কলে ও কথা হয়না অনেকদিন।এজন্য মিস করছিলাম আর কি।

–‘হুম।কথা বলবে এখন?

–‘না থাক রাত করে ডিস্টার্ব করিস না।কালকে সময় করে আমি কল দিব।

–‘আচ্ছা।

–‘রাখি তাহলে।

–‘ঠিক আছে…আল্লাহ হাফেজ।

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো,প্রণয় বিরস মুখে ফাকা রাস্তার দিকে তাকালো,হলুদ সোডিয়াম আলোয় আচ্ছাদিত রাস্তাটা,কুয়াশা পড়েছে আজ অনেক।বড় করে শ্বাস ছাড়লো। ব্যালকনি থেকে চলে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরতেই প্রণয়ের পা থেমে গেল।সামনে সূচনাকে দেখে হালকা অবাক হয়ে বললো-

–‘তুমি?

সূচনা প্রতিক্রিয়া দেখালো না শুধু অস্ফুটে স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘রি..রিয়াদ কে প্রণয়? আপনি কোন রিয়াদের সাথে কথা বলছিলেন?আপনি রিয়াদ নামে কারো সাথে কথা বলছিলেন কেন?কেন কথা বলবেন?বলবেন না একদম।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৪৭
___________________________
শান্ত চোখে সূচনার দিকে তাকিয়ে আছে প্রণয়।সূচনা ঘুমাচ্ছে, চোখে মুখে এতক্ষণ কেমন আতঙ্কের ছাপ থাকলেও এখন তা নেই।তখন রিয়াদ নামটা শুনে কেমন যেন হাইপার হয়ে গিয়েছিল সূচনা। রিয়াদ কে?বারবার জিজ্ঞেস করছিল,প্রণয় বহুকষ্টে বুঝিয়েছে রিয়াদ তার একজন ক্লাইন্টের নাম।তখন যেয়ে একটু শান্ত হয়েছে।সূচনা শান্ত হতেই প্রণয় জোর করে এনে শুইয়ে দিয়েছে। কম্ফোর্টার টা সূচনার গায়ে ভালো করে টেনে দিয়ে বেড থেকে উঠে পড়লো প্রণয়।নিঃশব্দে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।রাতে বের হওয়া হয় না তার অনেকদিন।ক্লান্ত লাগছে তার,ঝামেলা লাগছে সব।ইচ্ছে করছে লং ড্রাইভে যেতে,রিফ্রেশমেন্ট দরকার একটু, কিন্তু এখন দূরে যাওয়া যাবে না,এমনি তেই সূচনা অসুস্থ কিছু টা,তারওপর সে না থাকলে..নাহ!তাই গেল না।বাগানে হাটাহাটি করতে লাগলো।
____________________________
–‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

রুমে পা দিতেই প্রশ্ন টা কানে আসলো প্রণয়ের। তাকিয়ে দেখলো সূচনা আধশোয়া হয়ে আছে বেডে,কম্ফোর্টার টা একদম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখা গায়ের সাথে।উৎসুক দৃষ্টি প্রণয়ের দিকে।প্রণয় এগিয়ে আসলো, ধীর গলায় বললো-

–‘বাগানে,হাটাহাটি করছিলাম একটু।

–‘ওহ।

–‘তুমি উঠে পড়লে যে?

সূচনা মিন মিনিয়ে বলতে লাগলো-

–‘ঘুম ভেঙে গেছে আর পাশে তাকিয়ে দেখলাম আপনি নেই তাই..

–‘তাই?

–‘…

–‘ভ য় হচ্ছিল?

–‘হু।

প্রণয় হাসলো, সূচনার পাশে বসলো।হাসি টেনে কিছু টা ফিসফিস করে বললো-

–‘ভালোবাসার মাঝে হালকা ভয় থাকলে, সেই ভালোবাসা মধূর হয়। কেননা, হারানোর ভয়ে প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়।”
আর বানীতে আপনার প্রিয় লেখক। বুঝেছেন মিসেস.রঙ্গন।

সূচনা হাসলো ঠোঁট প্রসারিত করে।বললো-

–‘উহুম সুন্দর লাগছে না শুনতে।মিস.রঙ্গন টাই সুন্দর।

–‘আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন যে আপনি এখন ম্যারিড তার মানে মিসেস।

–‘তাহলে অন্য কিছু বলে সম্বোধন করুন লাইক কাপকেক,বউজান,প্রণয়ী।

–‘আচ্ছা ভাববো।

সূচনা আদুরে গলায় বললো-

–‘আচ্ছা। ঘুমাবেন না?আমার ঘুম পেয়েছে, একা একা ঘুম হবে না আমার।আপনিও ঘুমান।

–‘বাহ আজকে রোমান্টিক মুডে আছো দেখা যায়।

–‘একটু ও না।

–‘চলো ঘুমাই তাহলে।

সূচনাকে টেনে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো প্রণয়। কম্ফোর্টার দিয়ে একদম আপাদমস্তক ঢেকে ফেলল দুজনকে।দু হাতে টেনে সূচনাকে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসলো।গালে নাক ঘষতে শুরু করলেই সূচনা বললো-

–‘ঘুমানোর কথা বলেছিলাম আর আপনি..

–‘আজকে শীত লাগছে অনেক।

–‘লাগাম হীন হয়ে যাচ্ছেন দিনদিন।

–‘তোমার জন্য ই।জানো আজকে বছরের দীর্ঘতম রাত।আজকে রাতে অনেক সময় পাবো যদি..

–‘চুপ করুন।

সূচনার ধ ম ক শুনে প্রণয় শব্দ করে হাসলো যেন সূচনা কোনো রম্য গল্প শুনিয়েছে।ঘুম ছুটে গেছে সূচনার,দুজন খুনসুটি ঝগড়ায় মেতেছে। দুজন দুজনের উষ্ণতায় উষ্ণ হচ্ছে খানিক।হোক,রাত কা*টুক,ভালোবাসায় উষ্ণতা ছড়াক।
___________________________
কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের শুরু হলো আজ প্রণয়ের ডাকে।আলতো স্বরের নিজের নামটা উচ্চারিত হতেই সজাগ হলো সূচনা।চোখ পিটপিট করে তাকালো।শান্ত,স্থির একজোড়া চোখের চাহনি তার মুখশ্রীতে বিচরণ করছে।সূচনা ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো-

–‘শুভ সকাল।

প্রণয় বুকে হাত রেখে ফিল্মি স্টাইলে বললো-

–‘হায় মে মারজাওয়ান।

সূচনা ভ্রু কুঁচকালো।জিজ্ঞেস করলো-

–‘কেনো?

প্রণয় সূচনার ডান গালে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বললো-

-*’তোমার ঘুম জড়ানো কন্ঠ এত মা/রাত্মক!উফফ।

সূচনা বিনিময়ে লাজুক হাসলো।সলজ্জ কন্ঠে বললো-

–‘সকাল সকাল আবার শুরু করে দিয়েছেন?

–‘কিছুই তো করলাম না।তুমি কি শুরু করার কথা বলছো বলো তো?

–‘আপনি খুব বা/জে।

–‘কেনো?

–‘এমনি।

–‘এমনি না কারনটা হচ্ছে ‘তুমি’।

–‘কেনো আমি কি করেছি?করেছেন তো আপনি।আপনার জন্য এখন সকাল সকাল আমার এই ঠান্ডার মধ্যে..

–‘উহুম.. তুমি করেছো..সব দোষ তোমার।তোমার রূপের আগুনে জ্ব লে পু ড়ে ছারখার হয়ে গেছি।আমার স্বভাব বা /জে হয়ে গিয়েছে।বারবার তোমাকে ছোঁয়ার,তোমার কাছে আসার।তাহলে বলো দোষ কার?তোমার না আমার?

সূচনা আবারও লজ্জায় কুকড়ে গেল।হুট করে মুখ লটকে নিল,থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো-

–‘যদি আমি দেখতে অসুন্দর হতাম?

প্রণয় নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর ধীর কণ্ঠে বললো-

–‘নারী তুমি বাহ্যিক দিক থেকে সুন্দর হও বা অসুন্দর
মনের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী হলেই হবে,আর আমি জানি তোমার মনের সৌন্দর্য, তার ঔজ্জ্বল্য।তুমি মনের দিক থেকে অসুন্দর হলেও আমি নিজের মতো করে গড়ে নিতাম কিন্তু আমার প্রয়োজন পড়েনি, কারণ তুমি সুন্দর,তোমার মন সুন্দর থেকেও সুন্দর। ‘

সূচনা হাসলো, চোখ থেকে দুফোঁটা পানি ও গড়িয়ে পড়লো।প্রণয় আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো সূচনার কপালে,বললো-

–‘একটা প্রশ্নের উত্তর দিব,তাড়াতাড়ি উঠো যেতে হবে।

–‘প্রশ্নের উত্তর দিতে আবার কোথায় নিয়ে যাবেন?

–‘ওঠো তাড়াতাড়ি। গেলেই বুঝতে পারবে।

–‘আগে আপনি উঠুন।

–‘না..চলো একসাথে শাওয়ার নেই।

–‘ছিহহ।

প্রণয় সত্যি সত্যিই সূচনাকে কোলে নিয়ে নিল।কোলে নিতেই চমকে উঠলো সূচনা।ওয়াশরুমের সামনে যেয়ে নামিয়ে দিল কোল থেকে।শাড়ির অবস্থা বা জে হতেও বা জে।কোনোরকম পেচিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো সূচনা।লজ্জায় তার কুটিকুটি হওয়ার অবস্থা আর এদিকে প্রণয় হাসতে হাসতে শেষ।
____________________________
কুয়াশার জেরে আবছা চারপাশ।এক হাত দূরের জিনিস টাও বুঝতে হালকা কষ্ট হচ্ছে।এই কুয়াশার মধ্যে বাইরে এসেছে প্রণয় আর সূচনা। সূচনার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে প্রণয়।তারা এখন দাড়িয়ে আছে একটা কাঠগোলাপের বাগানে।বাগানই বলা যায়, প্রায় কয়েকটা কাঠগোলাপ গাছ আছে এখানে।অনেকগুলো কাঠগোলাপ আবরণ তৈরি করেছে শিশির ভেজা মাটিতে,এ যেন শুভ্র ফুলের মেলা।সূচনা বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে আছে।এজন্য ই বুঝি প্রণয় এত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এসেছে তাকে।সূচনার হাত ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেল প্রণয়।

একটা গাছের নিচ থেকে দেখে দেখে পরিষ্কার ফুল গুলো দুহাত ভর্তি করে কুড়িয়ে নিল, ধীর পায়ে এসে দাড়ালো সূচনার সামনে।একটা কাঠগোলাপ সূচনার কানে গুজে দিল,তার কানে আগে থেকেই ঠাই পেয়েছে একটা শুভ্র রঙা জবা।বাসা থেকে বেরোবার সময় প্রণয় গুজে দিয়েছে কানে।কানে ফুল গুজে দিয়ে বাকিগুলো হাতে ধরিয়ে দিল সূচনার।একহাত দিয়ে সূচনার চুল ঠিক করতে করতে বললো-

–‘শুভ্র শাড়িতে শুভ্র রাঙা ফুল কানে গুজে একদম শুভ্র মানবী লাগছে।এই শুভ্র মানবীকে ভালোবাসি।সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না ‘ভালোবাসার রঙ কী?

–‘বলেছিলেন মানুষ ভেদে তাদের অনুভূতি ভিন্ন হয়,রঙ ভিন্ন হয়।

–‘হ্যা। শোনো.. কুয়াশায় মোড়ানো এই ভোরের পরশে ভেজা মাটিতে ছড়িয়ে আছে কত শুভ্র কাঠগোলাপ, তেমার হাতে হলো তাদের ঠাই,কানে ও জায়গা হলো দুটোর।ছুয়ে দেখো,অনুভব করে দেখো,যতটা শুভ্রতায় আচ্ছন্ন এই কাঠগোলাপ,এই জবা ঠিক ততটা শুভ্র তোমার প্রতি জাগা আমার একেকটা অনুভূতি, আমার ভালোবাসা। ফুল পবিত্রতার প্রতীক, আর তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা টাও পবিত্র,সব শুভ্র ফুলের মতো শুভ্র। এবার বলো ভালোবাসার রঙ কী?

সূচনা সহসা জবাব দিল-

–‘শুভ্র।

প্রণয় হাসলো,সূচনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।কী সুন্দর লাগছে প্রণয়কে,প্রাপ্তির স্নিগ্ধ এক হাসি,সূচনা থমকে গেল একদম,কিছু বলতেও ভুলে গেল।প্রণয় অবশ্য আর তার কথা বলার অপেক্ষা করছে না।সে হাটা ধরেছে সূচনার বাহু ধরে,সূচনা পায়ে পা মিলিয়ে হাটছে।হাতের ফুলগুলো ছোট বাস্কেটটায় নিয়ে নিল,বাস্কেট টা ও প্রণয়ের গাড়িতে ই ছিল,প্রি প্ল্যান্ড নাকি।সূচনা বাস্কেট টা একহাতে নিয়ে আরেকহাতে জড়িয়ে ধরলো প্রণয় কে,নিজের মাথাটা প্রণয়ের বুকে রেখেই হাটতে লাগলো,প্রণয় হাসলো, সূচনা ও হাসছে। আজ অন্য রকম শান্তি লাগছে দু-জনের। প্রিয়রা কাছে থাকলে,তাদের সাথে সময় কাটালেই বুঝি শান্তি লাগে,হয়তো।
_______________________
বিকেলের সময় টায় বের হয়ে মহা ঝামেলায় পড়ে গেছে সূচনা,মিহু,তিথি আর ইরা।ইরা আর তিথি বলছিল বিকেলে বের হবে,অনেকদিন কোথাও যায় না তাই তো মিহুকেও কল করে আনিয়েছে।ভালো কথা বের হয়েছে কিন্তু জ্যামে পড়ে মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেছে। যদিও ঢাকা শহরে এই জ্যাম তো মানুষের নিত্য সঙ্গী।সে যাক তাদের সাথে প্রণয় ও এসেছে।টুকটাক খাওয়া ও হয়েছে, স্ট্রিট ফুড।সাড়ি বেধে দোকান বসেছে কয়েকটা,সেখানেই দাড়িয়ে একের পর এক চুড়ি, কানের দুল দেখে যাচ্ছে ইরা,মিহু,আর তিথি।হাজার থাকলেও এসব সামনে পড়লে মেয়েদের পক্ষে এড়িয়ে চলে যাওয়া দুষ্কর বিষয়।সূচনা সাইডে দাড়িয়ে আছে, অন্যমনষ্ক হয়ে।প্রণয়ের সকালে বলা কথাগুলো বারবার কানে বেজে উঠছে,বারবার মনে পড়ছে সকালের ঘটনা গুলো।প্রণয় তার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিতেই সম্বিত ফিরে পেল সূচনা।তার দিকে তাকাতে যেয়ে দুর্ভাগ্যবশত দৃষ্টি পড়ে গেল সামনে।থমকানোর সাথে সাথে চমকে উঠলো।তার থেকে কয়েক হাত দূরে সাদা রঙা প্রাইভেট কারের বসা একজন মানব, জানালা দিয়ে দৃশ্যমান তার মুখশ্রী, তার দৃষ্টি স্পষ্ট সূচনার ওপর।চারচোখ এক হতেই সূচনা আ/ৎকে উঠেছে।এই মানুষটার অপ্রত্যাশিত আগমন কেন হলো?কী হবে সামনে?

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৪৮
_____________________________
–‘ভাবীর কি হয়েছে ভাইয়া?

চিন্তিত মুখে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো ইরা।বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তারা।ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে সূচনা।বাইরে থেকে সবাইকে তাড়া দিয়ে নিয়ে এসেছে সে।কেউ যেনো না বুঝে সে জন্য বাহানা দিয়েছিলো শরীর খারাপের।কিন্তু বাসায় এসে সেই যে রুমে গিয়েছে তো গিয়েছে।প্রণয় কিছু বলবে বলবে করেও বলছে না।সেও রীতিমতো অবাক হয়েছে।ইরার প্রশ্নের জবাবে ছোট্ট করে বললো-

–‘আমি দেখছি।তুই ফ্রেশ হ গিয়ে।

ইরাও কিছু বলতে চেয়েও বললো না।অগত্যা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।প্রণয় সেখান থেকে সরে আসলো।মিনিট দুয়েক পর স্টাডি রুম থেকে নিজের ঘরের আরেকটি চাবি এনে শব্দহীন ভাবে দরজা খুললো।ভেতরে ঢুকতেই বেডে বসে থাকা মানবীর দিকে চোখ আটকালো।হাতে ফোন নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সূচনা।প্রণয় এগিয়ে গেলো।সূচনার পাশ থেকে ভেজা টাওয়াল নিয়ে বেলকনিতে মেলে দিলো।মৃদু পায়ে হেঁটে সূচনার সন্নিকটে এলো।নিঃসংকোচে সূচনার পাশ ঘেঁষে বসলো প্রণয়।সূচনা নড়েচড়ে পাশ ফিরে প্রণয়ের দিকে তাকায়।দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় স্থির করলো ফ্লোরে।সূচনার নত মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো প্রণয়-

–‘কি হয়েছে প্রণয়ী?

সূচনা নিচু স্বরে বললো-

–‘কিছুনা।

–‘তাহলে তখন এভাবে চলে এলে কেনো?আর ফিরে এসেই বা রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছো কেনো?

উত্তর দিলো না সূচনা।দ্রুত পায়ে উঠে জানালার কাছে যেয়ে দাড়ালো।বাতাসের উথাল পাতাল কল্লোধ্বনিতে সূচনার অম্বর জুড়ে খোলা চুল উড়ে বেড়াচ্ছে।সিক্ত চোখ জোড়া নিষ্ঠুর অশ্রুতে ক্লান্ত হয়ে নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে।প্রণয় উঠে যেয়ে দাড়ালো সূচনার নিকট।প্রণয় চোখ বন্ধ করে পুনর্বার চোখ মেললো।সূচনার নত মুখশ্রীতে বিচরণ করছে তার অশান্ত চোখ জোড়া।মৃদু সুরে বললো প্রণয়-

–‘কান্না থামাও,প্লিজ।

সূচনা বারণ তো শুনলোই না।বরং এ পর্যায়ে কান্নার শব্দ প্রণয়ের কানে গেলো।প্রণয় চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টানলো।স্বাভাবিক স্বরে আবারো বললো-

–‘কান্না থামাতে বলেছি।

সূচনার হেলদোল না হওয়ায় যেনো ক্ষি প্ত হলো প্রণয়।দাঁতে দাঁত চেপে স্বগতোক্তি কন্ঠে ধমকে উঠলো-

–‘সূচনা?

সূচনা কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো।দৃষ্টি জোড়া আর উপরে তুললোনা।প্রণয়ের মৃদু ধমকে বোধ হয় অভিমান হলো।জানালার কাছে থেকে সরে আসতে চাইলো।তবে ততক্ষণে প্রণয় নিজের বাহুডোরে আঁটকে ফেলেছে সূচনাকে।প্রবল ভাবে মিশিয়ে নিয়েছে নিজের কাছে।সূচনা অভিমানে সরতে চাইলো।তবে এতে ছাড়া তো পেলোই না।বরং প্রণয়ের তীব্র আলিঙ্গনে বাঁধা পেলো।হার মানলো সূচনা।প্রণয়ের পৃষ্ঠদেশ দু হাতে আকড়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেললো।বুকের ভেতর অস/হ্য গ্লানি টুকু আ/টকে রেখে ধীর গলায় বললো সূচনা-

–‘আ…আপনাকে কিছু বলতে চাই।

প্রণয় ‘হুশশ’ আওয়াজে থামিয়ে দিলো সূচনাকে।মৃদু গলায় বললো-

–‘উহুম।কিছু বলতে হবেনা।আমি কিছু শুনতে চাইনা।

সূচনা মু/চড়ে উঠলো।প্রণয়ের পরনের টি শার্ট খানিকটা হাতের মুঠোতে চেপে বললো-

–‘আপনাকে শুনতে হবে প্রণয়।বলতে দিন আমাকে।আমার অতীত আপনাকে শুনতে হবে।প্লিজ।

–‘কোনো কথা শুনবো না আমি।তোমার অতীত জানবার বিন্দু পরিমাণ ও ইচ্ছে বা আগ্রহ নেই।আমি তোমার অতীত নই।আমি তোমার বর্তমান,ভবিষ্যত।

সূচনা প্রণয়ের বুক থেকে মাথা তুলে প্রণয়ের দিকে তাকালো।অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘরে সূচনার ফোলা ফোলা মুখশ্রী চক্ষুশূল হলো প্রণয়ের।হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছে প্রতিবাদী কন্ঠে বললো-

–‘কেনো কাঁদছো প্রণয়ী?আমি থাকতেও তোমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে কেনো?আমি কি তোমায় সুখে রাখতে ব্যর্থ?

প্রণয়ের খসখসে ওষ্ঠে নিজের চিকন চিকন আঙুল রাখলো সূচনা।ফুপিয়ে উঠে অস্পষ্ট গলায় তড়িঘড়ি করে বললো-

–‘না না।আপনি আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সেরা পুরুষ।আপনার দ্বারা কেউ কখনো কষ্ট পেতেই পারেনা।কিন্তু আমি?আমি আপনার যোগ্যই না প্রণয়।আমার অতীত টা খুব একটা সুন্দর নয়।শুনতে হবে প্রণয়।আমার কথা শুনতেই হবে।প্লিজ।

–‘আমার কাছে কোনো অতীত নেই।কোনো ভবিষ্যত ও নেই।আমার বর্তমানে তুমি আছো।আমার সবকিছু জুড়ে শুধু তুমি।

সূচনা পুনশ্চ প্রণয়ের বক্ষস্থলে সন্তপর্ণে মুখ গুঁজে দিলো।পিঠের উপর শুভ্র শার্টের খামচে ধরলো।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে অনুরোধ করলো-

–‘একটাবার শুনে নিন।প্লিজ প্রণয় প্লিজ।

তৎক্ষনাত চোখ বন্ধ করলো প্রণয়।সূচনার মৃদু কম্পিত শরীর আগলে নিলো।ভয়াবহ ঠান্ডা হয়ে আছে তার শরীর।প্রণয় এক হাতে সূচনাকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতে পাশের চেয়ারে রাখা জ্যাকেটে জড়িয়ে নিলো সূচনাকে।সূচনার মাথাটা বুকে চেপে হার মেনে নেওয়ার শ্বাস ফেলে কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বললো-

–‘বলো প্রণয়ী।

সূচনা লম্বা শ্বাস টানলো,শ্বাস নিতে কষ্ট হলো বটে,যেন ভারী কিছু চেপেছে বুকে। বক্ষস্থল হতে মুখ উঠালো,জানালা ভেদ করে নিভু নিভু দৃষ্টি রাখলো বাইরে।চাপা কণ্ঠে বলা শুরু করলো-

–‘তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। ফ্রেন্ড বলতে তেমন কেউ ছিল না। একজন ছিল স্নেহা, ওর সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিল আর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। স্নেহার কাজিন ছিল রিয়াদ, ওদের বিল্ডিং এই সে থাকত, কোনো দরকারে ঢাকা এসেছিল ক’মাসের জন্য। দেখতে কম ছিল না কোনো অংশে। তাকে কোনো মেয়ের অপছন্দ হওয়ার কথা না।সব ভালোই চলছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরছিলাম আমি আর স্নেহা। স্কুলের গেইটের সামনে দেখলাম একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তখন অতকিছু ভাবিনি, না তাকে চিনতাম।কিন্তু তার পরের দিন ও স্কুলে যাওয়া ও আসার সময় একই জায়গা দেখলাম তাকে দাঁড়ানো। সেইদিন যাওয়ার পথে স্নেহা জিজ্ঞেস করল-

–‘ ওই ছেলেটাকে দেখেছিস? আমার কাজিন হয়।

ছোট্ট করে শুধু জবাব দিলাম-

–‘ও।

–‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তোর জন্য।

স্নেহার কথা শুনে ভাবলাম মজা করেছে,মজা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সে পরে এমন ভাবে বলল মেনে নিলাম সব সত্যি।তবে তখনও তার দিকে ভালো করে তাকাইনি পর্যন্ত।ঐভাবেই চলছিল,রোজ তাকে যাওয়ার পথে এবং আসার পথে দেখতাম আড় চোখে।সে অবশ্য কোনোদিন আমার সাথে কথা বলার বা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি।এর মাঝে শুরু হলো করোনার তা/ন্ডব। সারা দেশের মানুষ লকডাউনের ভেতর চলে গেল,ঘরবন্দী হয়ে পড়লাম,খুব একা লাগত,খারাপ লাগত অনেক, দমবন্ধ লাগত,

কেমন যেন কিছুর অভাববোধ করছিলাম, মনে হতো কিছু নেই। চলছিল ঐভাবেই। ভেতরে ভেতরে কা/তরাচ্ছিলাম,পুড়ছিলাম, কিশোরী মনের অতল হতে অজ্ঞাত কন্ঠ জানান দিল- তাকে মিস করছি, তার প্রতিদিন আমার জন্য দাড়িয়ে থাকা, দু’জন দু’জনকে আড়চোখে দেখা সেসব কে মিস করছি।অভ্যস্ত হয়ে গেছি সেগুলোতে তার জন্য কিছু অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে, নামহীন অনুভূতি। মাস কে/টে গেল,অস্থিরতা বাড়লো,শুধু মনে হচ্ছিল তাকে এক নজর দেখতে পারলেই বেচে যাব।সময় কা/টলো,তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী,করোনার কারণে বারবা পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছিল।লকডাউন উঠে গেছে তখন একটু একটু করে সবকিছু সচল হয়ে গেছে সবাই।পড়ালেখা ও শুরু করে দিয়েছি,স্নেহা আর আমি আলাদা আলাদা কোচিং এ পড়তাম।আবারও তার দেখা মেলল,কোচিং এর সামনে দাড়িয়ে থাকত।অস্থিরতা কমেছিল কিন্তু চোখের তৃষ্ণা মেটেনি।মন ভরে দেখতে পারিনি, আগের মতো আড়চোখে ই দেখেছিলাম। একদিন কোচিং থেকে আসার সময় এলাকার এক আঙ্কেল, আব্বুর পরিচিত সে।উনি মাঝ রাস্তায় দাড় করালেন। বা কা চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন-

–‘তোমার বাবা তো ভালো মানুষ,তুমি এমন কেন?ভালো হয়ে যাও এসব ছেলেদের কারবার ছাড়ো সময় আছে এখনও।ঔ ছেলে এমন দাড়িয়ে থাকে কেন? মান সম্মান শেষ করো না,তোমাদের মতো কয়েকটা মেয়ের জন্য এলাকার বাকি মেয়ে গুলোর নাম নষ্ট হয়।ভালো হয়ে যাও।

অবাক হলাম, রাগ ও হলো খুব কিছু না করেও এত কথা শুনতে হলো,চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলো?উল্টো হাটা ধরলাম,বলা হয়নি স্নেহাদের বাসা রেখে আমাদের বাসায়যেতে হয়,দশ মিনিটের মতো লাগে।তখন স্নেহার সাথে যোগাযোগ তেমন হত না।তাই স্নেহা হুট করে আমাকে তার বাসায় দেখে অবাক হয়েছিল।পরোয়া না করে ক্ষিপ্ত গলায় আমি সোজা যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

–‘তোর ভাই কোথায়?

স্নেহা অবাক হলেও জবাব দিল-

–‘পাশের রুমে।

রাগের পরিমান এতই বেশি ছিল যে কিছু না ভেবে সোজা তার রুমে চলে যাই। সেদিন কড়া কণ্ঠে অনেক অনেক কথা শুনিয়েছিলাম তাকে।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে জবাবে কিছু বলেনি,আমাকে কড়া কথা ও শোনায়নি। শুধু নরম স্বরে বলেছিল-

–‘পেছনেই তো ঘুরি সামনে তো ঘুরঘুর করি না।সূচনা বেশি না শুধু ছয়মাসের জন্য আমাকে একটু ভালোবাসা দাও তাহলেই হবে। আর কিছু চাইনা।

তার চুপ থাকার চেয়ে তার এই কথায় অবাক হয়েছি সাথে বিস্ময় ও ঘিরে ধরে।আরও কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে চলে আসলাম সেখান থেকে।আসার আগে স্নেহা কেও বলে আসলাম –

–‘তোর ভাইকে বলবি যেন না দাড়ায়,এসব নাটক বন্ধ করতে বলবি।

তারপর আরও কয়দিন গেল।একদিন স্নেহা আর আমি মিলে প্ল্যান করলাম শাড়ী পড়ব একসাথে।প্ল্যান অনুযায়ী বিকেলে শাড়ী পড়ে,হালকা মেকআপ,ঠোটে নুড কালার লিপ্সটিক আর চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে স্নেহাদের বাসায় গেলাম।আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম বললো-‘স্নেহা ওয়াশরুমে।ও বাসায় আগে ও গিয়েছি আমি তাই চেনা জানা আছে, ওর অপেক্ষা না করে আমি নিজেই ছাদে উঠে গেলাম।কিন্তু ছাদে যেয়েই দেখলাম ছাদের রেলিং ধরে রিয়াদ দাড়িয়ে আছে। বুক ধ্বক করে উঠলো,ঢিপঢিপানি শুরু হলো, না নামতে পারছিলাম না এগোতে পারছিলাম যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিল সারা শরীর।মনে প্রাণে দোয়া ও করছিলাম যেন সে টের না পায়,পেছনে না ফেরে বা স্নেহা এসে পড়ে।কিন্তু আসলো না।সে পেছনে ঘুরলো নজরে পড়লাম আমি,অপলক তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর এগিয়ে আসলো,তার এগোনে দেখে ভয় ঢুকে গেল মনে।সে থামলো যথা দূরত্ব রেখে।ট্রাউজার আর দৃষ্টি নত ছিল আমার কিন্তু বুঝতে পারছিলাম তখনো তার দৃষ্টি আমার মুখশ্রী তে বিচরণ করছে।শাড়ীর আচল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম।হঠাৎ তার স্বর কানে এলো।

–‘শাড়ীতে অপরূপা নারী তুমি।তোমার চোখ জোড়া..উফফ চোখে কাজল দেয়া সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি।

কী সুন্দর মনোমুগ্ধকর কণ্ঠ,তার ঔ কথাগুলো মন কেড়ে ছিল, ছোট্ট মনে ভালো-লাগা সৃষ্টি হয়েছিল আরেকদফা।সে ততক্ষণে ছাদ থেকে চলে গেছে। স্নেহার সাথে টুকটাক কথা বলে সেদিন চলে এসেছিলাম।আরও কিছু দিন কাটলো ততদিনে তাকে ভসলো লাগা শুরু হয়েছে।এমনি এক দিন কোচিং থেকে ফিরছিলাম হটাৎ করে সে কোথা থেকে যেন এসে পাশে দাড়ালো আমার,চমকে গিয়েছিলাম।পাশে দাড়িয়ে কানের সামনে মুখ এনে বললো-

–‘আর কতদিন পেছন পেছন ঘুরব এবার তো পাশে দাড়ানোর অধিকার দাও।

যেমন চমকে দিয়ে এসেছিল তেমনি চমকে দিয়ে চলে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই।তার এমন ছোট ছোট কান্ডে ভালো লাগা বাড়তে লাগলো,বুঝতে পারলাম ভালো লাগা ছাড়াও কিছু অন্যরকম অনুভূতি ও আছে।এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো,রেজাল্ট বের হলো।খুব ইচ্ছে ছিল ভালো একটা কলেজে ভর্তি হব কিন্তু সেবার প্রথম আব্বু আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করলো।আমাকে জিজ্ঞেস না করেই আমাদের এলাকার একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল।খুব রাগ হয়েছিল কিন্তু মেনে নিলাম।আব্বু করিয়েছেন যেহেতু নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।কলেজের ক্লাস শুরু হয়নি তখনও,বাসা থেকে বেরোতে ও পারতাম না আর না তার দেখা পেতাম।খবর নেয়ার ও রাস্তা ছিল না।স্বেহাকে জিজ্ঞেস করতে ও পারছিলাম না।কী করব বা করব যখন এই দোটানায় ছিলাম তখনই কল আসলো স্নেহার।রিসিভ করে কানে দিতেই তড়িঘড়ি করে স্নেহা বললো-

–‘সূচি তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় আয় প্লিজ।

স্নেহার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছিল বড় কোনো বিপদে পড়েছে, তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম।কিন্তু আমি বুঝিনি নিজেই দৌড়ে যাচ্ছি বিপদের কাছে।দুপুরের সময় তখন রাস্তা ঘাট একদম ফাকা ছিল।স্নেহাদের বাসায় যেয়ে দেখলাম সদর দরজা পুরোো খোলা,কখনে এমন খোলা রাখা হয়না দরজা কিন্তু সেদিন অমন দেখে অবাক হলাম।পা টিপে টিপে ভেতরে গেলাম।অতঃপর যা বুঝলাম পুরো বাসা ফাকা।ভয় পেলাম,বেরিয়ে আসতে গেলেই পথরোধ করলো কেউ,হাতে জোরে টান পড়লো,চোখ সম্মুখে নিতেই দেখলাম পুরুষালি বাহুতে আটকে গেছি,তার দৃষ্টি আর মুখ ভঙ্গি দেখে বুঝতে বাকি রইলো না কিছু। ধরে নিলাম সব শেষ হয়ে গেছে।আর বুঝি ফেরা হবে না সাদা মনে,খারাপ কিছু হবে?

#চলবে