প্রিয় অসুখ পর্ব ১১

0
388

প্রিয় অসুখ
পর্ব ১১
মিশু মনি
.
১৩
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম আর জ্যামকে উপেক্ষা করে আড়ংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে শ্রবণা। শীতুল ওভারব্রীজের ওপর থেকে শ্রবণাকে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য চমকালো। শ্রবণার পড়নে একটা সুতি আসমানী রংয়ের শাড়ি । শ্যাম্পু করা চুল গুলো পিঠের উপর বিস্তৃত হয়ে আছে। শীতুল ধীরেধীরে ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই শ্রবণা বললো, ‘অনেক্ষণ ধরে ওয়েট করছি।’
– ‘হুম। এই গরমে শাড়ি!’
শ্রবণা কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বললো, ‘কি অদ্ভুত লোক বাবা। একটা মেয়ে শাড়ি পড়েছে, তাকে কেমন দেখাচ্ছে সেটা না বলে উলটো বলছে এই গরমে শাড়ি।’

শীতুল ছেলেটা বরাবরই এরকম। সৌন্দর্যের থেকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টা ওর কাছে বেশি জরুরি। একগাল হেসে বললো, ‘একজন মানুষ তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে তারচেয়েও তোমার কমফোর্টের ব্যাপারটা চিন্তা করছে, সেটা কি সামান্য হয়ে গেলো?’

শ্রবণা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কিঞ্চিৎ ভ্রু ভাঁজ করে শীতুলের দিকে একবার তাকালো। শীতুলের গাল, গলা ঘেমে একাকার। কারো চেহারার ঘামও এতটা আকর্ষণ করতে পারে এটা জানা ছিলো না শ্রবণার। সে চোখ বড়বড় করে শীতুলের দিকে তাকিয়েই রইলো।
শীতুল হেসে বললো, ‘নাহ, তোমাকে সুইট লাগছে। ঠিক আজকের সন্ধ্যার মতন।’

শ্রবণা তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো, ‘বারে, এই সন্ধ্যা আপনার সুইট মনে হচ্ছে? যা গরম রে বাবাহ।’

শীতুল দুষ্টুমি করে বললো, ‘তাহলে ধরে নাও সিস্টেমে তোমাকে হট লাগছে বললাম।’

শ্রবণা ক্ষেপে চোখ পাকিয়ে শীতুলের দিকে তাকালো। যতটা দুষ্টু ধারণা করেছিলো, এখন বোধহচ্ছে তারচেয়েও বেশি। শীতুল দুষ্টুমি হাসি হেসে বললো, ‘আবার রাগ কোরো না। আমি কিন্তু জাস্ট ফান করলাম। মানবাধিকার লংঘন করিনি।’

শ্রবণা হেসে বললো, ‘ঠিক আছে বাবা সমস্যা নেই। আন্টি কেমন আছে?’

দুজন মিলে টুকটাক কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করলো। শ্রবণা পিছন দিক দিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে ধরে রেখেছে। আরেকহাতে মাঝেমাঝে কুঁচি ধরে সামলিয়ে হাঁটছে। শীতুল বিষয়টা সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলেও শ্রবণাকে বুঝতে দেয় নি।

শীতুল ওর কয়েকজন বন্ধুর সাথে শ্রবণার পরিচয় করিয়ে দিলো। পাঁচজন ছেলের সাথে দুজন মেয়েও আছে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করার পর সংসদ ভবনের সামনে ফুটপাতে বসে ফুচকা ও পেয়ারা খাওয়া হলো। শীতুলকে আজ অনেক হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এতটা উৎফুল্লতার কারণ বুঝতে পারছে না শ্রবণা। বারবার আড়চোখে শীতুলের দিকে তাকাচ্ছিলো ও। শীতুল যখন কথা বলে, অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেও গভীরভাবে ওর কথাগুলো অনুভব করতে থাকে শ্রবণা। শীতুল আশেপাশে থাকলেই ওর অন্যরকম এক ধরণের অনুভূতি হয় যার উপস্থিতি টের পেলেও বিষয়টা ব্যাখ্যা করার সাধ্য নেই শ্রবণার। এ এক অদ্ভুত যন্ত্রণাময় অনুভূতি। আবার একইসাথে সমান ভালোলাগা ও।

সবাই মিলে গান ধরলে শ্রবণা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো। আজ বহুদিন পর নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। জীবনে বন্ধুদের অবদান অনেক। বন্ধু ছাড়া সবকিছু থেকেও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই শহরে এত মানুষ অথচ একজন কথা বলার মানুষের বড্ড অভাব শ্রবণার। আজকে মনেহচ্ছে, না; কথা বলার জন্য অনেকেই আছে। শীতুলের বন্ধুরা ওর সাথে এত সহজে মিশে যাবে এটা ভাবতেও পারেনি শ্রবণা। আড্ডা ও গান বাজনা চলতেই লাগলো। রাত যখন সাড়ে নয়টার মতন, এলোমেলো বাতাস বইতে শুরু করলো। শহরের ভ্যাপসা গরম থেকে খানিকটা স্বস্তি মিলবে এই আশায় সবার মুখে দেখা গেলো স্বস্তির হাসি। গানের ফাঁকে আয়াশ কয়েকবার শ্রবণার সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পাত্তা পায়নি। শ্রবণা তো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুধু শীতুলকেই অনুভব করছে।

গান গাইছে শীতুলের বন্ধু পিয়াস। সবাই সাথে সুর মিলাচ্ছিলো। কয়েকজন ছেলে মেয়ে দূর থেকে ওদের গান শুনছে। কেউ আবার ওদের পাশে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে গান শুনছে। শহুরে ছেলেমেয়েরা অবশ্য ফিরেও তাকাচ্ছে না। কে কোথায় বসে গান গাইছে, কে কাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে এসব ছোটখাটো বিষয়ে নজর রাখার অভ্যাস শহুরে ছেলেমেয়ে দের একেবারেই নেই। সবাই একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়ে চলে। কিন্তু শীতুলের বন্ধুরাও শহুরে হলেও শ্রবণা এখনো ওদের মাঝে কোনো আলগা ভাবের রেশ দেখে নি। হয়তো বন্ধু বলেই।

– ‘কি ভাবছো?’
শ্রবণা চমকে উঠে খেয়াল করলো শীতুল ওর পাশে বসে হাঁটুতে হাত রেখে, গালে হাত দিয়ে কেবল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। লজ্জা নামক বস্তুটা যে শ্রবণার মাঝেও আছে সেটা এখন হারে হারে টের পেলো ও। নিজেকে আজকে পরিপূর্ণা মনে হচ্ছে। লাজুক হেসে বললো, ‘ভাবছি আজকের সন্ধ্যাটা অনেক সুন্দর।’
– ‘বলেছিলাম না তোমার মত সুইট। পাত্তাই দাও নি আমার কথায়।’
– ‘চলুন না ওদিক টায় একবার হেঁটে আসি। বাতাসের ঝাঁপটায় নিশ্চয়ই অনেক বকুল ফুল পড়েছে। যাবেন?’
– ‘ এমনিতে বললে যেতাম না। বকুল ফুলের লোভনীয় ঘ্রাণ তো মিস করা যায় না।’
– ‘তাহলে চলুন না প্লিজ।’
শীতুল উঠে দাঁড়ালো। আয়াশকে বললো, ‘দোস্ত চল একটু হেঁটে আসি।’

শ্রবণা অপ্রস্তুত বোধ করছে। এটা কিছু হলো? আয়াশকে তো সাথে নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। শীতুলের সাথে আলাদা করে কিছু সময় কথা বলার মাঝে যে প্রশান্তি আসবে, আয়াশ সাথে থাকলে তার সমপরিমাণ বিরক্তি আসবে। দুজনের মাঝখানে একজন তৃতীয় ব্যক্তি কেন! উফফ।

শ্রবণা কিছু বলতে পারলো না। কি ই বা বলে আটকানো যেতে পারে। শীতুলকে রেখেই হাঁটতে শুরু করলো ও। মনেমনে রাগ হচ্ছে। এতক্ষণ বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দেয়ার পরেও হয়নি? আবার একজনকে ডেকে নিয়ে হাঁটতে হবে। মনটা যে চায় সারাক্ষণ শুধু শীতুলকেই সামনে বসিয়ে রেখে তাকিয়ে থাকি।

শ্রবণার পাশে শীতুল হাঁটছে। শ্রবণা পিছন ফিরে তাকিয়ে আয়াশকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ অবাক হলো। জানতে চাইলো, ‘উনি আসলেন না?’
– ‘না। ঊর্মী জোর করে ওকে বসিয়ে রাখলো।’
শ্রবণা অট্টহাসি হেসে সামনে আসা চুলগুলো এক ঘটকায় পিছনে পিঠের উপর ছুড়ে মেরে হাসতেই লাগলো। শীতুল অবাক বিস্ময়ে ওর হাসি দেখছে। মেয়েটা হাসছে কেন এভাবে!

শ্রবণা বললো, ‘খুব মজা পেয়েছি।’
– ‘কিন্তু আমি তো মজা দেয়ার মত কিছু বলি নি।’
– ‘হা হা হা। তাও পেয়েছি। ঊর্মি আয়াশকে ছাড়লো না কেন?’
– ‘আয়াশ ছাড়া গান জমে না সে কারণে। তুমি কি ভেবেছো ঊর্মি আয়াশকে পাশে বসিয়ে রাখার জন্য ছাড়ে নি? হাও ফানি ইয়ার। হা হা হা।’
শ্রবণা মুখ কাচুমাচু করে শীতুলের দিকে তাকালো। আহা এভাবে কেউ ইনসাল্ট করে নাকি? কি অদ্ভুত ধরণের ফাজিল এই লোকটা। শ্রবণার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে।

শীতুল হাসি থামিয়ে বললো, ‘আজকের সন্ধ্যাটা অসম্ভব ভালো কাটিয়েছি। বহুদিন পর ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা। এই এক সপ্তাহ আমি একটা অন্যরকম ঘোরের মাঝে ছিলাম। আজ মনে হচ্ছে বাস্তবে ফিরে এসেছি।’

শ্রবণা কি ভেবে যেন আশার আলো দেখতে পেলো। কথাটা আনন্দ পাবার মত কিছুই না। কিন্তু ওর অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে। হঠাৎ করে প্রশ্ন করেই বসলো, ‘আচ্ছা তাহলে আপনি বুঝতে পেরেছেন। যাক বাবা। এখন তাহলে নতুন কিছু ভাবুন।’

শীতুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, ‘সরি, তুমি কিসের কথা বলছো?’

শ্রবণা কি বলতে কি বলে ফেলেছে ভেবে লজ্জিত হলো। ধেৎ কি যে করে না মেয়েটা। হেসে বললো, ‘প্রেমিকার ভূতটা মাথা থেকে নেমেছে না? সেটাই বললাম। এবার তাহলে নতুন করে কিছু ভাবুন।’

শীতুল একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘ভূত! সে কি আর নামবে? আরো বেশি করে মাথায় চেপে বসেছে। আগে ছিলো ঘোর, এখন তাকে বাস্তবে সত্যিকারে পাওয়ার নেশা চেপেছে। যেভাবে হোক তাকে তো..

শ্রবণা শীতুলকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘প্লিজ আপনার প্রেম কিংবা প্রেমিকা নিয়ে আমার সামনে কিছু বলবেন না।’
– ‘কেন? সমস্যা কি? তুমি আমার ফ্রেন্ড না?’

শ্রবণা কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলে ফেললো, ‘প্রেম ভালোবাসায় আমার এলার্জি আছে। আমি এসব নিতে পারি না। আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। দয়া করে এসব আর আমার সামনে বলবেন না।’

শীতুল একটা বেঞ্চির উপর বসতে বসতে বললো, ‘আচ্ছা বলবো না। তোমরা বোধহয় একটু বেশি আপডেটেড হয়ে গেছো। প্রেমে তোমাদের বিশ্বাস নেই। অথচ আমার প্রেয়সী এখনো সেই পুরনো আমলের প্রেমিকা টিই রয়ে গেছে। যাকে ফিল করে করে আমিও শিখেছি ভালোবাসাটা আসলে কি!’

শ্রবণার গায়ে বিষের মত লাগলো কথাগুলি। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে যেন। বললো, ‘কি করে আপনার প্রেমিকা?’
– ‘তা তো জানিনা। তবে সুন্দর একটা মন আছে তার।’
– ‘দেখতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর?’
– ‘তাও জানিনা। জানবো কি করে? আমি তো তাকে দেখিই নি।’
– ‘দেখেন নি? তাহলে প্রেমে পড়লেন কিভাবে?’
– ‘শুধু কি চেহারা দেখে প্রেম হয় রে পাগলী? তার মনটাকে জেনেছি যে। তার ধ্যান ধারণা, সাধনা, ভালোবাসা সবটা জানি যে।’

শ্রবণা’র মেজাজ খারাপ হলেও সামলে রেখেছে। বললো, ‘পরিচয় কি তাহলে ফেসবুকে? নাকি রং নাম্বারে?’

শীতুল হেসে বললো, ‘সে এক অদ্ভুত কাহিনী। তুমি শুনলে আমাকে পাগল বলবে। অবশ্য মাঝেমাঝে নিজেরই মনেহয় আমি পাগল হয়ে গেছি। “প্রত্যেকেই তার জীবদ্দশায় কোনো না কোনো সময় পাগলের ন্যায় আচরণ করে”, উক্তি টার প্রমাণ পাচ্ছি।’

শ্রবণা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। মন খারাপ হয়ে যায় এসব শুনলে। যাকে নিয়ে এত বছর সাধনা করে এসেছে, আজকে সে বলছে অন্য কারো সাধনার কথা। কি অদ্ভুত সময়!

শীতুল বললো, ‘শুনবে আমার প্রেয়সীর গল্প? আমি কিভাবে তার প্রেমে পড়েছি, কেন পড়েছি শুনবে?’

শ্রবণা শীতুলকে থামিয়ে দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘না। এসবে আমার এলার্জি আছে। ভালো লাগে না এসব প্রেম টেম। প্লিজ…’

শীতুল আর কিছু বললো না। শ্রবণা মনেমনে কষ্টে ডুবে যাচ্ছে আর বলছে, ‘আমি তোমাকে তোমার প্রেমিকার চেয়েও আরো পুরনো ধাচে ভালোবাসি শীতুল। জানিনা সে কেমন কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে অনেক গুলো বছর যাবত কল্পনা করে এসেছি। সময় আদৌ অনুকূলে আসবে কিনা আমি জানিনা। শুরু থেকেই তোমার আমার মাঝে এক দৃঢ় দূরত্ব বেঁধে দিয়েছে যেন।’

ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস!

চলবে..