প্রিয় অসুখ পর্ব ২০

0
555

প্রিয় অসুখ
পর্ব ২০
মিশু মনি
.
২২
সময় জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। কখনো অনুকূলে, কখনো প্রতিকূলে। দুদিন আগেও যে মানুষটাকে নিয়ে ভাবাটাও দুঃস্বপ্নের মত ছিলো, দুদিন পরে সময় তাকে সবচেয়ে কাছের মানুষ বানিয়ে দিলো। প্রকৃতির নিয়মটাই যেন কত অদ্ভুত!

ভাবতে ভাবতে বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো শ্রবণা। আজকে ওরা ঢাকায় ফিরছে। মা কড়া করে বলে দিয়েছেন কিছুতেই শ্রবণা নিজের বাসায় যেতে পারবে না। শীতুলদের সাথেই থাকতে হবে। মেয়ের শূন্যতা টুকু পূরণ হয়ে তিনি যেন একটা স্বর্গীয় সুখানুভূতি অনুভব করছেন। কিছুতেই আর শ্রবণাকে ছাড়তে চাইছেন না।
শ্রবণার পড়নে আজ একটা আসমানী রংয়ের থ্রি পিছ। ওড়নাটা মাথায় দেয়ায় ওকে একদম বউ বউ লাগছে। শীতুলের চোখ যতবারই শ্রবণার দিকে যাচ্ছে, ততবারই একটা কোমল অনুভূতি কাজ করছে শীতুলের। কিন্তু শীতুল শ্রবণার দিকে ভূলেও তাকাতে চাইছে না। বারবার চাইছে শ্যামলতাকে নিয়ে ভাবতে।

এমন সময় শ্রবণার ফোন বেজে উঠলো। ও ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো শীতুল কল দিয়েছে। শ্রবণা সাথে সাথেই রিংটোন মিউট করে দিলো যাতে শীতুল বুঝতে না পারে। শীতুল বসেছে শ্রবণার দুই সিট পিছনেই। এ অবস্থায় কথা বলা যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে কলটা রিসিভ করেই ফেললো শ্রবণা।

কানে ধরে বলল- হ্যালো।
– ‘ওহে শ্যাম, তোমারে আমি নয়নে নয়নে রাখিবো..’

শ্রবণা হাসতে হাসতে বলল- ‘রাখবা। তোমাকে তো আমি মানা করিনি।’

শ্রবণা বাসের সিটে এমনভাবে শুয়ে ফোনটা কানে চেপে ধরে রেখেছে যাতে শীতুল কোনোভাবেই বুঝতে না পারে শ্রবণার কানে ফোন। শীতুল ও সিটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল- জানো শ্যাম, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। উত্তেজনায় রক্ত টলমল করছে।
– ‘কেন কেন?’
– ‘এই যে তোমার কাছে যাচ্ছি। তাই। তোমার লাগছে না?’
– ‘আমি তো সারারাত একটা ঘোরের মধ্যে কাটাই।’
– ‘শুধু রাত? আমার তো তোমার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই ঘোর কাটছে না।
“কি এক পাগল নেশায় মাতালে আমায়। দিশেহারা হয়ে গেছি, কূল নাহি পাই”।

শ্রবণা হাসতে হাসতে বললো- ‘কবি হয়ে গেছো মনে হচ্ছে?’
– ‘হুম। তা কি হওয়ার বাকি আছে? কত কিছু যে হচ্ছি। জ্বলছি, নিভছি…’

এমন সময় বাসের হর্নের কারণে আর কথা শোনা যাচ্ছিলো না। দুজনে একই বাসে থাকার কারণে শীতুল বুঝতেই পারলো না শ্যামলতাও বাসে আছে। শ্রবণা চালাকি করে বলল, ‘কিসের শব্দ এত?’
– ‘বাসে আছি তো। আমি ঢাকায় পৌঁছে ফোন দেবো।’

কথাটা একরকম শেষ করে ফোন রাখলো দুজনেই। শ্রবণার খুব ইচ্ছে করছিলো শীতুলের মুখটা একবার দেখার। কিন্তু ইচ্ছে দমিয়ে রেখে আর পিছন ফিরে তাকালো না ও। পাছে আবার শীতুল বুঝে না ফেলে। কোনোভাবেই ওকে বুঝতে দেয়া যাবে না। যখন দেখবে শ্রবণাই ওর শ্যামলতা, তখন কি অনুভূতি টাই না হবে। সেটা ভেবেই শিহরিত হতে লাগলো শ্রবণা। বাসের জানালা দিয়ে আসা শিরশিরে বাতাসে মনটাও ফুরফুরে হয়ে উঠতে লাগলো।

শীতুল উত্তেজনায় স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। গত রাতে অনেক্ষণ শ্যামলতার সাথে কথা বলার পর থেকেই ঘোর ঘোর লাগছে। কখনো উঠছে, কখনো বসছে, কখনো শুয়ে পড়ছে। কিন্তু স্থির হয়ে থাকতে পারছে না মোটেও। উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। প্রেমে পড়ার পর যে অনুভূতি হয়নি, তা এখন হচ্ছে। না কাউকে বলা যায়, না ভাষায় প্রকাশ করা যায়। শীতুলের ভেতরে কি অস্থিরতা চলছে তার বর্ণনা কোনো শব্দ দিয়েই হয়তো শেষ করা সম্ভব না।

বাস ঢাকায় এসে থামলো। শীতুল মাকে হাত ধরে বাস থেকে নামানোর সময় শ্রবণা ওর দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিচ্ছিল। হাসির ভাবটা বুঝতে পারলো না শীতুল। শ্রবণাকে দুদিন ধরেই অন্যরকম লাগছে। এই শ্রবণাকে যেন চেনেও না শীতুল।
শ্রবণা মায়ের ব্যাগ একহাতে নিয়ে আরেক হাতে মাকে ধরে গাড়িতে এসে উঠলো। শীতুলের বাবা রিসিভ করতে এসেছেন। বাবাকে এই প্রথম দেখলো শ্রবণা। দেখেই পা ছুঁয়ে সালাম জানালো। সালাম দিয়ে ওঠার পরপরই উনি বললেন, ‘পা ছুঁয়ে সালাম দেয়াটা আমার পছন্দ না। তবুও করেছো যখন, এবারের মত কিছু মনে করলাম না। মেয়েটা আমার কেমন আছে?’

প্রথম দেখাতেই বাবা এত আপন করে নেবেন এটা ভাবতেই পারেনি শ্রবণা। ও বাবাকে জাপটে ধরে বলল, ‘এমন একটা বাবা থাকলে কেউ কি খারাপ থাকে হুম? আমার বাবাটা কেমন আছে?’
– ‘ভালো আছে খুব ভালো। তবে আমাকে কিন্তু বাবা বললে মাইন্ড করবো। আব্বু ডাকতে হবে।’

শ্রবণার চোখে পানি এসে গেলো। আব্বু ডাকটা দিয়েই কেঁদে ফেললো ও। বাবাকে জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘জীবনে এমন আদর পাইনি আমি আব্বু। আমার আব্বুটা তো পর হয়ে গেছে। আমার আজকে আনন্দে কান্না আসছে।’
– ‘পাগলী মেয়ে। তোমাকে কিন্তু আমি তুই করেই বলবো। মাইন্ড করবে?’
– ‘বাবার কথায় কেউ বুঝি মাইন্ড করে?’
– ‘নো বাবা, কল মি আব্বু।’

হেসে ফেললো শীতুল ও মা। তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রবণার কেবলই মনে হতে লাগলো সত্যিকার পরিবার পেয়েছে ও। মানুষ গুলো কত দ্রুত আপন হয়ে উঠলো!

২৩
শীতুল অনেক্ষণ যাবত শ্যামলতাকে কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। শ্রবণার সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য ওর ঘরে এসে দেখলো শ্রবণা নেই। শ্রবণার নাম্বারে কল দিতেই ফোনটা বিছানার উপর বেজে উঠলো। ভাগ্যিস শীতুল শ্যামলতার নাম্বারে ফোন করেনি। ফোন করলেই বিছানার উপর ফোনটা বেজে উঠতো আর শ্রবণা ধরা পড়ে যেতো। শীতুল ফোন করেছে অন্য আরেকটা নাম্বারে। বিছানার উপর বাজতে দেখে শীতুল আর ডাকাডাকি করলো না। নিজের অজান্তেই এগিয়ে এসে শ্রবণার ফোনের দিকে তাকালো। দেখলো লক স্ক্রিনের উপর শীতুলের নাম্বার ভেসে উঠছে। মিসড্ কল, ফোন নাম্বার সেভ করা “kolija” দিয়ে। চমকে উঠলো শীতুল। মনেমনে বললো, ‘শ্রবণা আমাকে এত ভালোবাসে! আমার নাম্বার কলিজা দিয়ে সেভ করে রেখেছে। ওহ মাই গড! কিন্তু আমি যে কিচ্ছু করতে পারবো না। আমি যে আমার শ্যামলতাকে পেয়ে গেছি। সরি শ্রবণা, সরি।’

আপন মনে কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো শীতুল। বাইরে এসে কল দিলো শ্যামলতার নাম্বারে। এবারও ঘরের ভিতরে শ্রবণার ফোন বেজে উঠলো। শীতুল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। ভেবে নিলো অন্যকেউ হয়তো ফোন করেছে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে চলে গেলো।

শ্রবণা ফোন হাতে নিয়েই অবাক। শীতুল ওর দুটো নাম্বারেই ফোন করেছে দেখে বেশ অবাক হলো। ফোনটা রুমে রেখে শীতুলের রুমের দরজায় গিয়ে বলল, ‘আসবো?’
– ‘এসো। তোমার রুমে গিয়েছিলাম।’

চমকে উঠলো শ্রবণা। ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকায় ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো। শীতুল বললো, ‘গল্প করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম তুমি নেই তাই কল দিয়েছিলাম।’

হাফ ছেড়ে বাঁচলো শ্রবণা। শীতুল কিছু বুঝতে পারে নি। শ্রবণা বললো, ‘একটু ছাদে গিয়েছিলাম। বলুন?’
– ‘আহা তেমন কিছু না। মাইন্ড না করলে একটা কথা বলি?’
– ‘হুম।’
– ‘শ্যামলতার সাথে দেখা করতে গেলে কিভাবে ওকে সারপ্রাইজ দেয়া যায় বলো তো?’
– ‘দেখা করতে গেলে তো আপনি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবেন।’
– ‘মানে!’

শ্রবণা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, ‘না মানে এত অপেক্ষার পর দেখা। প্রথমবার দেখে সারপ্রাইজড তো হবেনই।’
– ‘তা অবশ্য ঠিক। জানো মেয়েটা আমার অসুখে পরিণত হয়েছে। ওর কথা ভাবলেই পাগল হয়ে যাই। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। পারি না রে!’
শ্রবণার শরীর শিউরে উঠলো। শীতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে ওর সমস্ত ইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছিলো, ‘শীতুল আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, প্রচন্ড।’

শীতুল কথা শেষ করলেও শ্রবণা ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়েই রইলো। শীতুলের মনে পড়ে গেলো নাম্বারটা “kolija” দিয়ে সেভ রাখার কথা। ও আর শ্রবণাকে কষ্ট দিতে চায় না বলে প্রসঙ্গ এড়াতে বললো, ‘চা খাবা?’
– ‘আমি নিয়ে আসছি, বসুন।’

শ্রবণা দ্রুত চা বানাতে চলে এলো। চা চুলায় তুলে দিয়ে রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শীতুলকে অনুভব করতে লাগলো। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। এ কেমন অনুভূতি বুঝতে পারে না শ্রবণা।

তারাতাড়ি চা করে শীতুলের রুমে আসলো শ্রবণা। এসেই হাসিমুখে বলল, ‘সারপ্রাইজ দিতে চাইলে একটা কাজ করতে পারেন। মেয়েটা যা পছন্দ করে সেরকম একটা খাবার নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে যাবেন।’
– ‘এটা কি সারপ্রাইজ হবে? রান্না প্রথমদিন নিয়ে যাওয়াটা কেমন দেখায় না?’
– ‘তাহলে.. একটু ভেবে বলি?’
– ‘আচ্ছা বাদ দাও। চা ভালো হয়েছে।’

শ্রবণা আরো আগ্রহ সহকারে আরেকটা আইডিয়ার কথা বললো। কিন্তু শীতুল বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইছে। শ্রবণা যতবারই গিফট কিংবা সারপ্রাইজ নিয়ে কিছু বলে, শীতুল ততবারই বলে, থাক না। বাদ দাও এ ব্যাপারটা। শীতুল শ্রবণাকে কষ্ট দিতে চাইছে না। কিন্তু শ্রবণা যে কতটা আনন্দ পাচ্ছে সেটা শীতুলের অজানাই থেকে গেলো।

নিজের রুমে এসে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শ্রবণা। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। কথা বলতে হবে শ্যামলতা হবে। একইসাথে দুটো চরিত্র হয়ে ওঠাটা খুবই কঠিন একটা কাজ। তারচেয়েও কঠিন হচ্ছে এখন শীতুলকে কি বলবে সেটা। কারণ রিসিভ করলেই শীতুল দেখা করতে চাইবে। ভাবতেই শিউরে উঠছে শ্রবণা। উফফ!

চলবে..