প্রীতিলতা আসবে বলে পর্ব-০৫

0
1238

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট :৫

আবেশ আজ রাতের খাবার তার ছেলে মেয়ের সাথে বাইরে খাবে ৷বেশ ভালোই যাচ্ছে তার দিন কাল ৷অন্য দিকে আরেকটা মানুষ তার ছেলে মেয়েকে কেড়ে নেওয়ার জন্য ৷তারই বাড়ীর সামনে অধির আগ্রহে বসে আছে ৷ তা হয়তো সে জানেই না ৷

রাত নয়টা বাজে আবেশ তার ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ীর দিকে চলে এসেছে ৷গেটের কাছে আসতেই দেখলো দারোয়ান একটা মেয়েকে বকা দিচ্ছে ৷আবেশ গেটের কাছে গাড়ী থামিয়ে দারোয়ানকে বলল

কি হয়েছে রহিম ভাই ৷মেয়েটাকে এভাবে বকছো কেন ৷

স্যার দেহেন কহন থেইকা যাইতে কইতাছি ৷কিন্তু এই কালা ছেড়িডা যাইতাছে না ৷

আবেশ এবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল

এই ভাবে ঝামেলা কেন করছো বোন ৷রাস্তার মানুষ খারাপ ভাববে ৷

স্যার আইজকা দুই দিন ধইরা কিছু খাই নাই ৷আমার মেলা খিদা লাগছে ৷তাই কিছু খাওন চাইছিলাম এই ব্যাডার কাছে ৷কিন্তু দেহেন আমারে কেমনে ধমকাইতাছে ৷

আবেশের কেন যেন খুব মায়া হলো ৷কোনো কিছু না ভেবেই বলল কাজ করবে আমার বাড়ীতে ৷

কি করা লাগবো স্যার ৷আপনে খালি কন ৷আমারে খাইতে দিলে আমি সব করমু ৷আমার কেউ নাই ৷

ঠিক আছে ভেতরে চলো ৷

নিরুপমা নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল এইভাবে একটা অচেনা মেয়েকে বাড়ীতে ঢুকতে দেয়া টা কি ঠিক ৷

মেয়েটাকে খারাপ মনে হচ্ছে না নিরুপমা ৷আর ওর তো কেউ নেই বলছে ৷আর মেয়েটাকে বেশ সহজ সরল মনে হচ্ছে ৷

তোমার যা ইচ্ছে করো ৷শেষে খারাপ কিছু হলে আমার দোষ দিতে পারবে না ৷

আবেশ অচেনা মেয়েটাকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে এলো ৷মেয়েটাকে আবেশ বলল তা তোমার নাম কি ৷

স্যার আমার নাম পাখি ৷ আমারে আপনারা পাখি কইয়া ডাইকেন ৷

আবেশের চোখ দুটা ছলছল করে উঠেছে ৷সে তার বোনকেও পাখি বলে ডাকতো ৷আবেশ বাম হাতে নিজের চোখের পানি টুকু মুছে নিল ৷সবার চোখের আড়ালে পানি টুকু মুছলেও ৷অচেনা মেয়েটার চোখ ফাকিঁ দিতে পারলো না ৷

আবেশ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল আমরা দুপুরের দিকে কেউ বাসায় থাকি না ৷দুপুরের পর ছেলে মেয়েরা বাসায় একা থাকে ৷বাধ্য হয়ে স্কুলে দিয়েছি ওদের এই ছোট বয়সে ৷ওদের মা আর আমি বাইরে থাকি ৷তুমি যদি দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত ওদের দেখ তাহলে খুব ভালো হয় ৷আগে যে ছিল সে ওদের বকা ঝকা করতো অনেক ৷তাই বাদ দিয়ে দিয়েছি ৷পাখি নামের মেয়টা বলল স্যার আইছ থাইকা ভাববেন আমি আপনের বুইন ৷আমি ওগো নিজের পোলা পাইনের মতোই আদর করুম ৷আপনে চিন্তা কইরেন না ৷

ঠিক আছে ৷আর এই নাও দুই হাজার টাকা ৷কিছু খেয়ে নিল ৷

মেয়েটা টাকা গুলো নিয়ে নিল ৷তারপর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল ৷

আবেশের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে মেয়েটা কিছু দূর হাটলো ৷তারপর একটা প্রাইভেট কারের ভেতর ঢুকে গেল ৷নিজের ফোনটা বের করে মেয়েটা কাউকে কল করলো ৷তারপর বলল

স্যার কাজ হয়ে গেছে ৷বাচ্চা দুটোকে খুব তাড়াতাড়ি উপরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছি ৷ঐ আবেশ চৌধুরী শুধু বোকা না ৷একটা হাদারাম আবেশ চৌধুরী ৷ আর আপনার কথা মতো আমার নাম পাখি বলেছি ৷বলদটা নিজের মরা বোনের কথা চিন্তা করে চোখের জলও ফেলেছে ৷আপনার কথা মতো আমি সব করে ফেলবো ৷কেউ আমাকে সন্দেহও করবে না ৷

সাবধানে সব করবে বিপাশা ৷বিনিময়ে দুই কোটি পাবে ৷

ওকে স্যার ৷

রাত বারোটা বাজে প্রীতি দ্বীপ চোধুরীর বাড়ীর দেওয়াল খুব সাবধানে টপকে নিল ৷গার্ডরা গভীর ঘুমে আছে ৷প্রীতির ধারনা অনুযায়ী দোতলার দক্ষিন দিকে দ্বীপ চৌধুরী থাকে ৷প্রীতি আস্তে আস্তে লোহার রেলিং ধরে বারান্দায় প্রবেশ করলো ৷যদিও কাধেঁর ব্যাগটার জন্য তার একটু কষ্ট হয়েছে ৷দ্বীপ চৌধুরী ঘুমাচ্ছে এখনো ৷প্রীতি নিজের পকেট থেকে চেতনা নাশক স্প্রে টা বের করলো ৷তারপর খুব সাবধানে দ্বীপ আর তার বৌয়ের মুখে স্প্রে করে দিল ৷স্প্রে করার পাচঁ মিনিট পর প্রীতি দুইজনের কোমরে চিমটি কাটলো ৷কিন্তু না তাদের হুশ নেই ৷ এবার প্রীতি নিজের কাধঁ থেকে ব্যাগটা খুলল ৷ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু জিনিস বের করলো ৷তারপর নিজের কাজে লেগে গেল ৷ দুই ঘন্টার মতো প্রীতি নিজের কাজ করে নিল ৷তারপর একটা বাকাঁ হাসি দিল ৷প্রীতি বেড়িয়ে গেল আবারো বারান্দা দিয়েই ৷

পরের দিন সকাল নয়টা বাজে ৷প্রীতি নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিল ৷না তাকে দেখে কেউ আর সুন্দরী বলবে না ৷মেকাপের কি জাদু ৷সুন্দর মানুষটাকেও কেমন কুৎসিৎ বানিয়ে দিয়েছে ৷প্রীতিকে নকল সাজে একদম কালো কুচকুচে লাগছে ৷চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা ৷পরনে গোল একটা ঢিলা জামা ৷ প্রীতি নিজেকে একবার আয়নায় দেখে বেড়িয়ে পড়লো ৷

প্রীতি দাড়িয়ে আছে একটা বড় ভার্সিটির সামনে ৷প্রীতি কিছু না ভেবে ভেতরে পা বাড়ালো ৷ ৷ সবাই তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে ৷যেন কোনো এলিয়েন সে ৷হয়তো এতো কুৎসিত মেয়ে তাদের ভার্সিটিতে আর একটাও নেই ৷

প্রীতি যাচ্ছিল হঠাৎ তার মাথায় কিছু একটা ঠাস করে পড়লো ৷প্রীতি ব্যাথায় আহ করে শব্দ করলো ৷আর নিজের কপাল হাত দিয়ে চেপে ধরলো ৷তারপর বাম দিকে তাকিয়ে দেখলো একদল ছেলে মেয়ে দাড়িয়ে আছে ৷ছেলেমেয়ে গুলোর মধ্যে একজন বেশ সুদর্শন ৷প্রথম দর্ষনে প্রেমে পড়ার মতো ৷ছেলেটা বাইকের উপর বসে আছে ৷ প্রীতিকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা বলল

এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো কেন ৷ভার্সিটিতে নতুন নাকি ৷

জ্বী ৷প্রীতি বোকা বোকা চেহারা করে বলল ৷

কপালে যেই পাথরটা পড়েছে ৷ওটা আমিই মেরেছি ৷এখন থেকে আমাদের দেখলে সালাম দেবে বুঝেছো ৷তা কোন ইয়ার এ ৷

থার্ড ইয়ার ভাইয়া ৷ আপনি কোন ইয়ার ৷

একদম ভাইয়া বলবে না মামুনী ৷আর তোমার যা শ্রী তাতে সমস্যা নেই ৷আস্তে আস্তে আমার ব্যাপারে জানতে পারবে যাও ৷

প্রীতি মাথা নেড়ে চলে গেল ৷প্রীতি তারপর চলে গেল ভিসির রুমে ৷ভিসিকে প্রীতি নিজের পরিচয় দিতেই তিনি বললেন

আমি গোলাম মোস্তফা ৷এই ভার্সিটির ভিসি ৷তুমি এখানের মেয়েদের বাচাঁও মা ৷আমি কাউকে কিছু বলতেও পারছি না ৷আমাকে আর তিনমাসের মধ্যে দুইশ মেয়েকে পাচার কারীদের হাতে তুলে দিতে হবে ৷নইলে আমার পরিবারকে নাকি শেষ করে দেবে ৷আমার মাথায় এখন কিছুই কাজ কজ করছে না ৷

আপনি ভয় পাবেন না ৷কারো কিছু হবে না ৷ওরা এখন আপনাকে যা বলবে আপনি শুধু হ্যা বলে যাবেন ৷আর আমার ব্যাপারে কাউকে কিছূ বলবে না ৷যা করার আমি করবো ৷আর হ্যা আমার যখন যার ব্যাপারে তথ্য লাগবে ৷আপনি ঠিক তখন তা যোগার করে দেবেন ৷ আমি এখন যাচ্ছি ৷বেশিক্ষন থাকলে যে কারো সন্দেহ হতে পারে ৷

প্রীতি বেড়িয়ে গেল রুম থেকে ৷ তারপর ভার্সিটিতে ক্লাস করে চলে গেল ৷যদিও কেউ তার সাথে কথাও বলে নি ৷হয়তো প্রীতি কালো তাই ৷

নিজের ঘরে বসে কিছু কাজ করছে প্রীতি ৷তার একমাত্র লক্ষ দ্বীপ চৌধুরীকে সে চব্বিশ ঘন্টা নিজের নজরে রাখতে চায় ৷প্রীতি নিজের কাজ শেষ করলো ৷তারপর একটা বাকা হাসি দিয়ে কর্নেল ওসমানকে কল করলো ৷প্রীতি কল যেতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো ৷ওপাশ থেকে একটা ভারী কন্ঠ ভেসে এলো

কে বলছেন ৷

আমি সিআইডি অফিসার প্রীতি ৷

কেমন আছো বিউটিফুল ৷

একদম ভালো লাগছে না ৷সারাদিন একা একা ভালো লাগে না ৷আপনি কেমন আছেন স্যার ৷

উফফ এই সব স্যার বলো না তো ৷ভালো লাগে না ৷ওসমান বলে ডাকো ৷

ইশশ আমার লজ্জা লাগে ৷

আমি কিছু বুঝি না আজ থেকে নাম ধরে ডাকবে ৷তা তোমার মনটা কি করলে ভালো হবে ৷

আজকে সন্ধ্যায় একবার আসুন না আমার বাড়ীতে ৷আপনি আর আমি না হয় একটু এনজয় করলাম ৷কি বলেন ৷

ওসমান ঢোগ গিলল ৷তারপর বলল তুমি সত্যি বলছো ৷

আপনি আমাকে মিথ্যেবাদী ভাবছেন ৷ঠিক আছে আসতে হবে না ৷রাখলাম ৷

নো নো আমি আসবো ৷

তবে একটা কথা কাউকে বলবেন না যে আপনি আমার কাছে আসছেন ৷আর আসার আগে মাঝ রাস্তায় ফোনটা বন্ধ করে দেবেন ৷

কেন ৷

উফফ আপনি বোঝেন না কেন ৷কেউ যদি জানে আমরা দেখা করছি ৷তাহলে লোকে সন্দেহ করবে আমাদের ৷ আর মাঝ রাস্তায় ফোন বন্ধ করবেন যেন কেউ আপনাকে ডিস্টার্ব না করতে পারে ৷দেখা গেল জরুরী কাজের কথা বলে আপনাকে নি নিয়ে গেল ৷

ওকে ওকে তুমি যেমন বলবে ৷

প্রীতি ফোন রেখে দিল ৷তারপর ওসমানের জন্য বাকি আয়োজন শুরু করলো ৷

অপর দিকে আবেশের বাড়ীতে আসা নতুন মেয়েটার প্রতি সবাই বেশ খুশি ৷বাচ্চারাও তাকে আপন করে নিয়েছে ৷আবেশ আজ বাসায় এসে দেখে মেয়েটা তার ছেলেমেয়ের সাথে খেলছে ৷না সে ভুল কাউকে নিয়ে আসে নি ৷ওপর দিকে মেয়েটার মনে চলছে অন্য কিছু ৷এই ভালো ব্যবহারের পেছনে হয়তো অন্য কিছু লুকিয়ে আছে ৷

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ৷প্রীতির আয়োজন শেষ ৷নিজের মা বাবার ছবি হাতে নিয়ে সে বলল

আজ আমি আমার প্রথম লক্ষ্যকে শিকার করবো ৷তোমরা আমার জন্য দোয়া করো ৷ও দিকে কলিংবেল বেজে উঠলো ৷প্রীতি ছবিটা ডয়ারে রেখে দরজার দিকে চলে গেল ৷

প্রীতি দরজা খুলে একটা নেশালো দৃষ্টি ওসমানের ওপর নিক্ষেপ করলো ৷ওসমানের যেন প্রান যায় যায় অবস্থা প্রীতিকে দেখে ৷সাদা ফ্রকে একদম পরীর মতো লাগছে ৷প্রীতি ওসমানকে নিজের বাড়ীতে অতি সম্মানের সহিত ঢুকালো ৷তারপর তাকে সোফায় বসতে দিয়ে বলল

আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো ৷

না না কোনো সমস্যা হয় নি ৷তুমি বললে রোজ আসতে পারি আমি ৷

আপনার ফোনটা কি খোলা ৷

না না তোমার কথা মতো বন্ধ করে ফেলেছি ৷

ওও আচ্ছা ৷কাউকে এখানে আসার কথা বলেছেন ৷

না কেউ জানে না ৷আর তখন যে কল করলে ঐটা তোমার নাম্বার ৷

ঐটা সময় হলেই জানতে পারবেন ৷আপনার জন্য আমি একটা স্পেশাল শরবত বানিয়েছি ৷আমি বরং ঐটা নিয়ে আসি ৷

কিছুক্ষন পর প্রীতি একটা ট্রেতে করে শরবত নিয়ে এলো ৷ তারপর বলল আসুন স্যার আপনাকে খাইয়ে দেই ৷

তুমি আমাকে খাইয়ে দেবে ৷

হুমমম কেন খাবেন না ৷

দাও খাইয়ে ৷তোমার হাতে বিষও খেতে পারি ৷

ওসমান এক চুমুকে সব শরবত খেয়ে নিল ৷কিন্তু একি শরবত খাওয়ার পর তার মাথা ঘুরছে ৷সব ঘোলা দেখছে সে ৷তারপর আর কিছু মনে নেই তার ৷

রাত বারোটা বাজে ৷একটা ঘরে চেয়ারে ওসমান বাধা ৷ঘরটাতে সমান্য আলো ৷ওসমান নিজের চোখ আস্তে আস্তে খুলল ৷কিন্তু একি নড়তে পারছে না সে ৷কিছু বলতেও পারছে না ৷তার মুখ যে বাধা ৷ ওসমান সামনে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে গেল ৷

প্রীতি দাড়িয়ে আছে ৷কিন্তু তার একি অবস্থা ৷তার দিকে প্রীতি এমন ভয়ংকর ভাবে তাকিয়ে কেন আছে ৷আর প্রীতির হাতে ওটা কি ৷

প্রীতি ওসমানের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজ আবারো করতে লাগলো ৷ধারানো চাপাটি টাকে আরো ধার দিতে লাগলো ৷ যেন এক নিমিষেই যে কোনো কিছু কেটে যাবে ৷এমন ভাবে ধার দিতে লাগলো ৷

চলবে