প্রেমপ্রদীপ পর্ব-০১

0
6722

#প্রেমপ্রদীপ
Part–1
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রোদেলার ব্যাগের এক কোণে প্রেগ্ন্যান্সি পজেটিভ রিপোর্ট টা পড়ে আছে আর হাতে ডিভোর্স পেপার! আজকে তার জীবনে আরো একটা খুশির সংবাদ ধরা দিয়েছিল। কিন্তু সংবাদ টা আবেগকে দেওয়ার আগেই রোদেলার হাতে তার শ্বাশুড়ি মা ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দেন। রোদেলা ডিভোর্স পেপার হাতে দেখা মাত্র হতভম্ব হয়ে পড়ে। সে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল নিষ্পলক চোখে ।

রোদেলা আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার শ্বাশুড়ি মার দিকে। হাতে একটা সম্পর্ক শেষ হওয়ার দলিল তো ব্যাগে একটা সুখ উঁকিঝুঁকি মারছে। সময় খুব অদ্ভুত! আরো অদ্ভুত মানবজীবন।

মায়ের চোখে-মুখে আগুনের ফুলকা। সাপের মতো ফুসছেন তিনি।

রোদেলা হতভম্ব হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, এসব কি মা?

–আমার ছেলে তোমার সাথে আর সংসার করতে পারবে না। তোমার মতো চরিত্র হীন মেয়ে ভালো পরিবারের বউ হওয়ার যোগ্য না৷ আমার বাসা থেকে এই মূহুর্তে বিদায় হও।

রোদেলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ চোখ ফেটে কান্না আসছে তার। সে আশেপাশে তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, আবেগ কোথায়?

–যা বলার আমার সাথে বল৷ আমার ছেলে তোমার সাথে কথা বলবে না৷

রোদেলা নিস্তেজ গলায় বলে, কেন কথা বলবে না ও আমার সাথে? আর ডিভোর্স পেপার দেওয়ার মানে টা কি? মা আমি আবেগের সাথে কথা বলব কারন সম্পর্কটা ও আর আমার। তৃতীয় পক্ষের কথা আমি শুনব না।

— বললাম না ও তোমার সাথে কথা বলবে না! আর কাকে মা বলে ডাকছো তুমি? তোমার মতো বেশরম মেয়ের মুখে মা ডাক শোনার আগে খোদা আমাকে উঠায় কেন নিল না?

রোদেলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, আপনার গুনোধর ছেলে কথা বলবে না? নাকি কথা বলার সাহস নেই ওর?

–রোদেলা! মুখ সামলে কথা বল! তুমি একটা বাজারি মেয়ে। যেই মেয়ে সংসার -স্বামী, ছেলে ফেলে সারা দিন বাইরে পড়ে থাকে তার নামের আগে পরিবারের বউ তকমাটা যায় না।

রোদেলা আহত গলায় বলে, আমি বাইরে পড়ে থাকি না। চাকরি করতে যাই। আমার বেতনের টাকা এই সংসারের পেছনেই ব্যয় করি।

জাবেদা খাতুন মুখ বাকিয়ে বলে, কি যে চাকরি কর বুঝা হয়ে গেছে। রাতের বেলা কোন অফিস খোলা থাকে? আমার জানা মতে ঢাকা শহরের সব অফিস বিকেল পচটায় বন্ধ হয়ে যায়। রাতের বেলা পতিতালয় ছাড়া সব অফিস বন্ধ হয়ে যায়৷

একথা শুনে রোদেলার কান দিয়ে গরম বাতাস বের হতে লাগলো। তার শ্বাশুড়ি কোন কারন ছাড়াই তাকে সহ্য করতে পারে না। রোদেলা তার মন গলানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে জাবেদা খাতুনের মনে রোদেলাকে ঘৃণা করার পরিমাণ আরো বেড়েছে৷ কমার কোন নাম-গন্ধ নেই। এক সময় রোদেলা ও তার শ্বাশুড়ির মন জয় করার চেষ্টার হাল ছেড়ে দেয়।

রোদেলা জাবেদা খাতুনের কথায় তোয়াক্কা না করে বাসার ভেতরে ঢুকে নিজের রুমে যায়।

গেট খুলেই দেখে আবেগ বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে। শার্ট ভিজে গেছে। আবেগ যখন রেগে যায় তখন দরদর করে ঘামতে থাকে। রোদেলা আবেগকে দেখেই বুঝতে পারছে আবেগ প্রচন্ড রকমে রেগে আছে।

গেট খোলার আওয়াজে আবেগ মাথা তুলে তাকায়। রোদেলাকে দেখা মাত্র তার সারা গায়ে আগুন জ্বলে উঠে।

আবেগের চেহারা দেখে রোদেলা কিছু একটা আন্দাজ করে ফেলে। নিশ্চয়ই আবারো তার শ্বাশুড়ি রোদেলার নামে আবেগের কান ভরেছে৷ রোদেলা রুমের ভেতরে প্রবেশ করবে ঠিক সেই সময় আবেগ হুংকার দিয়ে বলে উঠে, খবরদার আমার রুমে আসবে না!

রোদেলা কেপে উঠে আবেগের চিৎকারে। সে অবাক চোখে আবেগের দিকে তাকালো।

আবেগ উঠে এসে রোদেলার সামনে দাড়িয়ে বলে, আমি তোমাকে এই মূহুর্তে তালাক দিতে চাই। ডিভোর্স পেপার পেয়েছো না?

–হু।

–তুমি সিগনেচার করে আমাকে পাঠাবে পেপার। আমি সই করে দিব৷

রোদেলা চোখের পানি ফেলে বলে, কালকে পর্যন্ত তো সব ঠিক ছিল আবেগ। তুমি মানুষের কথায় কেন কান দিচ্ছো? আমাকে বিশ্বাস করো না?

আবেগ রাগী গলায় বলে, নাহ। তোমার উপর সকল ধরনের বিশ্বাস উঠে গেছে। আর এই বিশ্বাস তুমি নিজ হাতে গুরগুর করে ভেঙে দিয়েছো রোদেলা, জাস্ট লিভ ফ্রম মাই লাইফ৷

–আবেগ আমি তোমার সন্তানের মা।

–আজকে থেকে সমুদ্রের জন্য তার মা মৃত। এখন থেকে আমি ই ওর মা, আমি ই ওর বাবা।

রোদেলা যেই না তার প্রেগ্ন্যাসির খবরটা আবেগকে দিবে তার আগেই আবেগ রোদেলার হাত ধরে টেনে বাইরে এসে দাড়ালো।

রোদেলা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।

আবেগ রোদেলার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, আমি ধরলে ছাড়ানোর চেষ্টা করো কিন্তু আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে কোন আপত্তি থাকে না। কেন রোদেলা? আমাকে এভাবে তিলে তিলে যন্ত্রনা দিলে?

রোদেলা আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে কোন ধরনের অপবাদ দিবে না আবগ।

–তোমার মতো মেয়েদের কি উচিৎ আল্লাহর দোহাই দিয়ে কিছু বলা? আল্লাহকে ডাকার জন্য মনের পবিত্রতা প্রয়োজন রোদেলা। যেই পবিত্রতা তোমার মধ্যে নেই৷ তুমি তো জাহান্নামেও জায়গা পাবে না।

রোদেলা কাদতে কাদতে হিচকি তুলছে আর বিলাপ করে বলতে লাগে, বিশ্বাস করো রিশাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কেন শুধু শুধু তুমি আমাকে সন্দেহ করো? আর কেন ই বা তুমি বারবার আমাকে অবিশ্বাস করছো!

আবেগ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, তোমার কর্ম- কারখানাই এমন! মা ঠিক ই বলে, তোমার মতো সস্তা মন-মানসিকতার মেয়ে খুব সহজেই মিথ্যা কথা বলতে পারে।খুব নিখুঁত অভিনয় করতে পারো তুমি রোদেলা।

রোদেলা জোর গলায় বলে, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু এই কথাটা তোমার মা খুব ভালো করেই সঠিক প্রমাণ করেছে৷

আবেগ সজোরে রোদেলার গালে থাপ্পড় বসালো৷ রাগে তার শরীর কাপছে। আবেগ সত্তর বেতের আঘাত সহ্য করতে পারবে নির্বিকার ভাবে কিন্তু মায়ের বিরুদ্ধে একটা চুল পরিমাণ বাজে কথাও সে নিতে পারেনা। সেটা যেই বলুক না কেন!

রোদেলা থাপ্পড় খেয়ে হতবিহ্বল। সে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। আবেগের মতো শিক্ষিত ছেলে কিভাবে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলল? রোদেলার আত্মসম্মান চরম ভাবে ক্ষত হলো। আঘাত হানে আত্মসম্মানে তার। সে লজ্জায় কেদে দিল।

আবেগ বাজখাঁই গলায় রোদেলা কে উদ্দেশ্য করে বলে, খবরদার আমার মাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলবে না৷

রোদেলা গাল থেকে হাত সরিয়ে দাতে দাত চেপে বলে, তুমি আমার গায়ে হাত তুললে কোন সাহসে?

–আসলেই তো! আমার হাতটা নোংরা হয়ে গেল।

রোদেলা বিষ্ফরিত চোখে আবেগের দিকে তাকায়। আবেগ ধারালো কন্ঠে বলে, প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও রোদেলা। পারছি না আমি। হাপিয়ে গেছি। আমি শান্তি চাই। দয়া করে আমার জীবন থেকে চলে যাও। আমি বাইরে যাচ্ছি। এসে যেন দেখি তুমি চলে গেছো। আমি তোমাকে আমার জীবনে চাই না৷ তোমাকে ঘৃণা লাগতে শুরু করেছে আমার। মনে হচ্ছে নর্দমার কীট তুমি!

রোদেলা টলটলে চোখে বলে, তোমার ও তো প্রাক্তন প্রেমিকা ছিল। আমি কোন দিন তোমাকে সন্দেহ করেছি?

আবেগ হুংকার দিয়ে বলে, আমি তো আর তোমার মতো কারো সাথে ঢলাঢলি করি নি।

একথা বলে হনহন করে আবেগ বাসার বাইরে চলে গেল।

রোদেলা সেদিকে তাকিয়ে থেকে তার পেটে হাত দিয়ে হুহু করে কেদে দিল। সে মনে মনে বলে উঠে, তুমি দ্বিতীয়বারের মতো বাবা হচ্ছো এই সুখবর টা তোমায় দিতে পারলাম। জানালেও লাভ হত না৷ তোমার মনে আমার জন্য অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। এই মূহুর্তে কন্সিভ করার খবর দিলে তুমি তোমার সন্তানের অস্তিত্ব নিয়েই দ্বিধা করবে। এতে আমার গর্ভে থাকা সন্তানের অপমান হবে! যেটা আমি চাই না আবেগ। তুমি শান্তিতে থাকতে চেয়েছো না? আমি সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কোন দাবী নেই। শুধু এতোটুকুই চাই তুমি শান্তিতে থাকো। তুমি আমাকে ঘৃণা করলেও আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারব না কারন তুমি আমার দুই সন্তানের পিতা৷

রোদেলা ডিভোর্স পেপার আকড়ে ধরে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

ওমনি জাবেদা খাতুন এসে থামালেন রোদেলাকে।

রোদেলা বলে উঠে, আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করব।

জাবেদা খাতুন জোর গলায় বলে, বাজারি মেয়েরা মা হয়না। তাদের মা হিসেবে কোন পরিচয় থাকেনা। তুমি এখুনি আমার বাসা থেকে বের হও৷

রোদেলা কঠিন গলায় বলে, ঠিক আছে। কিন্তু দেখবেন একদিন আজকের এইসব কথার জন্য আপনারা মা-ছেলে পস্তাবেন৷

এইটুকু বলেই রোদেলা বের হয়ে যায় আবেগের বাসা থেকে। নিজের ছয় বছরের ছেলেকে রেখে যেতে তার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। বাবু কিভাবে রাতে থাকবে তাকে ছাড়া? এসব ভাবতে ভাবতেই রোদেলাকে মাঝরাস্তায় কেদে দেয়। হুট করে তার মাথা ঘুরাতে লাগে। সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই হরহর করে মুখভর্তি বমি করতে লাগলো।

চলবে।