প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-১+২+৩

0
553

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১

ক্লাবে সকলের সামনে কুপ্রস্তাব ও অশালীন আচরণ করার কারণে নিজের হাতে থাকা গ্লাসের সব শ্যাম্পেইন ছুঁড়ে মারে ঐশ্বর্য কৌশিক শাহিনের দিকে। চোখেমুখে লাল আভা ক্লাবের লাল, নীল হরেক রঙের আলোতে বোঝা না গেলেও চেহারার অঙ্গিভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে ঐশ্বর্য ভয়ানক রেগে আছে। শুধু তাই নয় তার সামনে থাকা কৌশিকও রেগে আছে। তার শার্টে, মুখে শ্যাম্পেইন ছুঁড়ে মারার ভয়াবহ অপরাধ যেন করে ফেলেছে ঐশ্বর্য।
“হাউ ডেয়ার ইউ? তোমার মতো মেয়েদের রাতে বেডে আর পরেরদিন টিস্যু পেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলি। একটু বেশি সুন্দরী জন্য এমাউন্ট বেশি দিতে চেয়েছিলাম জন্য এটিটিউট দেখাচ্ছো?”

“শাট আপ! ইউ ব্লাডি, তোমার ওইসব টাকা নিজের চরিত্রের ঢেলে যদি চরিত্রবান হতে পারো তাহলে কাজে লাগবে। ওইসব আমাকে দেখাতে আসবে না। নয়ত…”

রাগে চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে ঐশ্বর্যের। নাইট ক্লাবের নানানরকম আলোতে ঢাকা পড়েছে তার লাল চোখজোড়া। বড় শ্বাস নিয়ে যুবকটির পাশ কাটিয়ে যেতেই যুবকটি রাগে-জেদে শক্ত করে চেপে ধরে ঐশ্বর্যের হাত। যুবকটির সম্মানে আঘাত লেগেছে। এভাবে তাকে কেউ রিজেক্ট করেনি। তার ওপর চোখেমুখে যেভাবে শ্যাম্পেইন ছুঁড়ে মেরেছে! এই মেয়ের সাহস আছে বলতে হয়। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ঐশ্বর্য। কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। বরং কৌশিক তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। ঐশ্বর্য অন্য হাত দিয়ে তার গালে থাপ্পড় মারতে চাইলে কৌশলে সেটাও ধরে নেয়। নাইট ক্লাবের লোকজনদের এসব দেখার সময় নেই। কেউ নেশা করছে নয়ত ডান্স করছে নয়ত কারো হুঁশই নেই। দুই-একজন দেখলেও এসব পাত্তা দেয় না।

“আমাকে টাচ সাহস করছো তুমি। ফল খুব একটা ভালো হবেনা। ছাড়ো আমাকে।”
রাগে দাঁত চেপে বলল ঐশ্বর্য। বড় বড় আঁখিতে তার ভয়াবহ দৃষ্টি কৌশিকের কাছে বেশ মজার! সে হেঁসে বলল,
“কাম অন বেবি। ইটস নরমাল। সকালে কেউ কাউকে চিনব না। তাছাড়া তোমার মতো তেজি মেয়েকে আরো ভালো লাগে আমার।”

রাগে ফুঁসে উঠল ঐশ্বর্য।
“আমি তোর এমন অবস্থা করতে পারি যে সকালে এমনিতেই তুই চেনার অবস্থায় থাকবি না।”

“এই মূহুর্তে আমি সেটাই চাইছি। লেটস গো!”

কৌশিক ছাড়ল না ঐশ্বর্যকে। বরং তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ির দিকে উঠে যেতে লাগল। একসময় সিঁড়ি দিয়ে বেয়ে উঠে ঘরে আনা হলো ঐশ্বর্যকে। ছিটকে ফেলে দিল কৌশিক তাকে। ঐশ্বর্য গিয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। পেছন ফিরে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো সে। হালকা আলোতে মোটামুটি সবকিছু দৃশ্যমান। ঐশ্বর্য নেশার ঘোরে থাকলেও এসব টানাহেঁচড়াতে কেটে গেছে নেশা। এখন তার মনে অন্যকিছুর নেশা কাজ করছে।

কৌশিক এগিয়ে এলো ঐশ্বর্যের দিকে। ফিসফিস করে বলল,
“জোরজবরদস্তি একটুও ভালো লাগে না মিস. বিউটিফুল। তার থেকে বলো তোমার কত চাই। ততই দেব আমি। টাকাই ভরিয়ে দেব।”

ঐশ্বর্য মুচকি হাসে। ঘাড় বাঁকিয়ে হেঁসে হেঁটে গিয়ে চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে। চোখ ছোট করে মুখে হাসির রেশ রেখে বলে,
“টাকা, গয়নাগাটি, লাক্সারি এসব তো কমন জিনিস। বাট আই এম নট কমন। আমি যেহেতু কমন না আমার পছন্দও নিশ্চয় কমন হবেনা!”

“তো বলো বলো কি চাই তোমার?”
বেশ আগ্রহের সঙ্গে এসে জিজ্ঞেস করল কৌশিক।

“তোমার মৃত্যু!”

বেশ খুশি হয়ে থাকলেও নিমিষে মুখটা জড়িয়ে গেল কৌশিকের। মেয়েটা কি পাগল নাকি? তবুও কৌশিক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“মজা করছো নাকি?”

“এতক্ষণ মজাই করছিলাম বাট নাউ আই এম সিরিয়াস। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না? আমার কি চাই? এই মূহুর্তে তোমার প্রাণ আমি নিজের হাতে কেঁড়ে নিতে চাই।”

ঐশ্বর্য উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে কৌশিকের দিকে। তার মুখে এখনো হাসি তবে হাসিটাতে কেমন জানি ভয়ানক হাসি নামে মানায়। সে কৌশিকের বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে বলে,
“হঠাৎ করে এখানে যেই হার্টবিট চলছে সেটা বন্ধ হয়ে গেলে কেমন লাগবে তোমার? তুমি কি ভেবেছিলে তুমি চেয়েছো জন্য আমাকে এই রুম অবধি আনতে পেরেছো? না, আমি চেয়েছি জন্য তুমি আমাকে এই অবধি আনতে পেরেছো। নাউ ইটস মাই টার্ন।”

কৌশিকের মনে হলো নেশার ঘোরে মেয়েটার মাথা পুরোটাই গেছে। তাতে কৌশিকের কি? সে তো চায় তো ঐশ্বর্যকে। সে স্বাভাবিক আছে কি নেই সেটা কি দেখার দরকার আছে? ঐশ্বর্যের হাত ধরতে নিল কৌশিক। হাত ধরতেই যেন ধারালো তীক্ষ্ণ কিছু একটা তার হাতে আঘাত করল। ‘আহ’ করে দুই ধাপ পিছিয়ে গেল সে। নিজের হাত চেপে ধরে ঐশ্বর্যের হাতের দিকে নজর নিল। কি আছে ওর হাতে? নিজের হাত তুলে ধরল ঐশ্বর্য। তার হাতে যেন নখ নেই! ছুরির ন্যায় ধারালো একেকটা নখ। স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকার ধারণ করেছে তার নখ। সেই সাথে নখের মাথা সরু হয়ে এসেছে। যা দিয়ে সহজে কাউকে আঘাত করা যায়। চোখ তুলে তাকালো ঐশ্বর্য।

ঐশ্বর্যে চোখজোড়া দেখে আরো ঘাবড়ে গেল কৌশিক। এটা কি মানুষ? চোখে যেন রক্ত বইছে। লাল চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। হা করল ঐশ্বর্য। দুইধার দিয়ে বেরিয়ে এলো ধারালো ও তীক্ষ্ণ দুটো দাঁত।

গায়ের লোম শিউরে উঠল কৌশিকের। হাসল ঐশ্বর্য। ঘাড় কাঁত করে বলল,
“টাচ করবে না আমাকে?”

“দূ…দূরে যাও। কে তুমি? দূরে যাও আমার থে…থেকে।”

ঐশ্বর্য আরো এগিয়ে গেল। আচমকা চোখের পলকে ঐশ্বর্য কৌশিককে ধরে এনে দেয়ালে ঠেকিয়ে তার গলা টিপে ধরল। সবই হলো ঝড়ের গতিতে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করল কৌশিক। এতে ভাবান্তর হলো না ঐশ্বর্যের। তার চোখে জ্বলছে আগুন। মানুষ মেরে ফেলা তার নেশা! শুধু মানুষ কেন প্রাণ নেওয়া যেন মজার খেলা আর যদি কেউ তার অপছন্দের কাজ করে তাহলে তো কথায় নেই! ছটফটিয়ে পাশেই একটা ফ্লাওয়ার ভাস পেল কৌশিক। সেটা কোনোরকমে হাতে নিয়ে ঐশ্বর্যের কপালের বাম পাশে আঘাত করতেই কৌশিককে ছেড়ে দিয়ে নিজের কপালে হাত দিল ঐশ্বর্য। চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। চোখ খুলতেই সে দেখল কৌশিক পালানোর জন্য প্রাণপণে দরকার দিকে ছুটছে। সেকেন্ডেই বিদ্যুতের গতিতে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। থমকে গেল কৌশিকের পা। ঐশ্বর্য থেমে থেমে গর্জে উঠে বলল,
“ভ্যাম্পায়ারের সাথে ছুট লাগানো এতোটা সহজ নয় কৌশিক!”

“ভ্যা….ভ্যাম্পায়ার?

” ইয়েস! ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য।”

হাত-পা কাঁপছে থরথর করে কৌশিকের। কূলকিনারা পাচ্ছে না সে। গলা জ্বলছে তার। রক্তও পড়েছে হয়তবা। সে বাঁচতে চায়। বুদ্ধি না পেয়ে এবার ঐশ্বর্যের গলা টিপে ধরে সে। ঐশ্বর্য কিছুটা চমকে গেলেও রেগে ওঠে প্রচুর। নিজের হাত কৌশিকের হাতে রাখতে যাবে তৎক্ষনাৎ খুলে যায় রুমের দরজা। বাহিরের আলোতে আর লোকজনের উপস্থিতিতে চোখ বন্ধ করে স্বাভাবিক হয়ে উঠল ঐশ্বর্য। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিয়ে ভাবতে থাকল, ‘সামনের লোকজন কি সব দেখে ফেলল? তাহলে আজই ওদেরও শেষ দিন হওয়া নিশ্চিত করতে হবে।’

এমন ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে অনুভব করল কেউ তার কপালের আঘাত লাগা জায়গায় কিছু একটা চেপে ধরেছে। আস্তে করে চোখ মেলল ঐশ্বর্য। নাকে এলো এক অদ্ভুত সুভাস। মানুষের শরীরের ঘ্রাণ তবে একটু অদ্ভুত। হয়ত পারফিউমের কারণে এমনটা লাগছে। চোখ খুলে স্পষ্ট তাকাতেই সামনে একটা প্রশস্ত বুক হাজির হলো। যা কালো কোট, লাল টাই আর সাদা শার্টের আস্তরণে ঢাকা। একবারে ফর্মাল ড্রেসআপ যাকে বলে! একজন পুরুষ তাকে স্পর্শ করেছে। পুরুষটি তার একটা হাত কপালে অন্যহাত মাথা ধরে রেখেছে। কোনো বিশ্রী স্পর্শ নয় এটা। মাথা তুলে তাকালো ঐশ্বর্য। একটা সুন্দর মুখ তার চোখের সামনে। সুদীর্ঘ চোখে রাগি দৃষ্টিতে বেশ মানিয়েছে। চোয়াল শক্ত করে আছে লোকটা। কপালের চামড়াতে ভাঁজ পড়েছে কয়েকটা। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে সে যেন একেবারে মানানসই। হঠাৎ ঐশ্বর্য লক্ষ্য করে লোকটা তার দিকে তাকালো। বুকের ভেতরটা যেন ধক করে উঠল তার। লোকটার চোখে হারিয়ে যাওয়া যায় নাকি? দেখতে থাকলো ঐশ্বর্য। এই দৃষ্টিতে ঐশ্বর্য হারিয়ে যাচ্ছে।

“আর ইউ ওকে? আই এম সরি। আমার আসতে লেট হয়ে গেল।”

ঐশ্বর্যের সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। হয়ত কিছু না বলাই ভালো। লোকটার ঠোঁটজোড়া আবারও নড়ছে।
“হয়ত একটু আগে এলে এই আঘাত লাগতো না তোমার। কি করব? আই ওয়াজ হেল্পলেস! একটা ডিলের জন্য এসেছিলাম। সেটা ফেলে রেখে আসতেও পারছিলাম না।”

ঐশ্বর্যের বেশ লাগছে কন্ঠস্বর। সে চাইছে লোকটা আরো বলুক কিছু কথা কিন্তু বলছে না। এতে বিরক্তও লাগছে তার। কিন্তু তার বিরক্ত লাগার কথা তো নয়। অস্ফুটস্বরে ঐশ্বর্য বলল,
“ইটস ওকে।”

“আর তুমি! কৌশিক শাহিন হও আর যেই হও পুলিশে কল করেছি আমি। মেয়েদের অশ্লীলতার অপরাধে কত প্রকার শাস্তি হয় সেটা জানো তো? তোমাদের মতো ছেলেদের জন্য কোনো মেয়ে কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারে না। যদি পারতাম তোমাকে নিজের হাতে মেরে ফেলতাম। ডিজগাস্টিং ম্যান!”

কৌশিক হতবাক। সে বাকরুদ্ধ। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে কি বলার দরকার? ঐশ্বর্যের যে রুপ সে দেখেছে সেটা বলবে? তৎক্ষনাৎ পুলিশ আসে। কৌশিককে ধরে। কৌশিক দ্রুত বলে ওঠে…
“ও…ও মানুষ না। ও একটা… মানুষ না ও।”

হকচকিয়ে তাকায় ঐশ্বর্য। চোখ গরম করে তাকায় কৌশিকের দিকে। ওর কথা এখন কেউ শুনছে না এতে সে নিশ্চিন্ত হলেও আশঙ্কা রয়েই যায়। তাকে তো ছাড়া যাবে না! এখন ধরাও যাবে না। মহা মুসিবত!

“আর তুমি! এটা ভেবো না ভুলটা শুধু ওর ছিল। তোমারও ছিল। তুমি একটা মেয়ে। আর যতই হক এতো রাতে এভাবে এমন একটা জায়গায় নাচ-গান যারা করে তাদের ভালো মেয়ে বলে না। এখানে আসাও তোমার একটা ভুল।”

ঐশ্বর্য কিছুটা ঠোঁট উল্টে বলে,
“আপনিও এসেছেন এখানে ভুলে যাচ্ছেন বুঝি?”

“শেখ আনন প্রেমের এমন জায়গায় পা দেওয়ার রুচি নেই। কিন্তু যাদের বিজনেস ডিল ছিল তাদের আসতে হয়েছে। আর ভাগ্যক্রমে দেখা হলো। নয়ত… বাই দ্যা ওয়ে, তোমার পরিবার তোমাকে কেমন শিক্ষা দিয়েছে জানি না কিন্তু এরপর থেকে এসব জায়গায় না এলেই নিরাপদ হবে তোমার জন্য। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

ঐশ্বর্য কিছু বলল না। শুধু সরে আসতে চাইল। কিন্তু কপালে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল সে। ‘আহ’ করে উঠতেই প্রেম নামক পুরুষটি আবারও তার আঘাত লাগা জায়গায় তার রুমাল চেপে ধরল।
“ব্লিডিং হচ্ছে। তোমার ইমিডিয়েট ফার্স্ট এইড হওয়া দরকার। অনেকটা কপাল কেটেছে।”

ঐশ্বর্য মুগ্ধ হয়েছে আজ। মুগ্ধ নয়নে দেখছে মানুষটাকে। এই প্রথম সে কারো ওপর মুগ্ধ। সে ভাবছে, লোকটা এতো মনোমুগ্ধকর কেন? প্রেম নাম বলে সবার প্রতি এতো প্রেম নাকি শুধু তার প্রতি?

চলবে….

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২

“আহ, এই ডক্টর আস্তে ড্রেসিং করুন। লাগে তো নাকি? আর একবার লাগলে আপনাকেও…”
রাগে কটমট করে চোখ খিঁচে বলল ঐশ্বর্য। মেজাজটা তার তুঙ্গে উঠে গেছে। এর ফলে ডক্টরকে বেশ জোরেশোরে ধমক দিয়ে বসল সে। অতঃপর তার মনে হলো কথাগুলো একটু বেশি জোরে বলে ফেলেছে তখন একচোখ মেলে তাকালো সে। ডক্টর ঐশ্বর্যের কপাল ক্লিন করা ছেড়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঁড়চোখে তাকাতেই ঐশ্বর্য দেখল হাত বুকে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা চেহারার এক ব্যক্তিকে। ব্যক্তিটি প্রেম। আচ্ছা মানুষটার নাম প্রেম সেকারণেই সবার প্রতি তার প্রেম? কি জানি!

প্রেম আচমকা ঐশ্বর্যের এমন চেঁচিয়ে বলা কথায় কিছুটা চমকেছে। হাসিও পেয়েছে খানিকটা। তবে যার-তার সামনে হাসাটা কেমন যেন বেমানান লাগে প্রেমের কাছে। দৈনন্দিন সব মানুষের সামনে সে গম্ভীর একজন লোক যে কিনা যেকোনো বিষয় নিয়ে বেশ সিরিয়াস! তবুও সে মুখ খুলে বলল,
“একটু শান্ত হয়ে বসো। একটু তো লাগবেই।”

ঐশ্বর্য না চাইতেও মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকল। সে কেন প্রেমের কথা শুনছে সে জানে না। সে তো কারোর কথা শোনার মেয়ে না তবে? ঐশ্বর্যের এসব ড্রেসিং এর দরকারই নেই। তবুও সে এমন একজন লোকের কথায় এসব করাচ্ছে যাকে কয়েক মূহুর্ত আগে সে চিনতোই না।

প্রেম গম্ভীর মুখোভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি ঐশ্বর্যের দিকে। এতো ঝামেলায় মেয়েটার দিকে নজর পড়েনি। এতো সময় কোথায় তার? এখন না চাইতেও নজর পড়ছে। কারণ সে একেবারে অদ্ভুত! গোলাপি ফর্সা চেহারায় ডাগরডাগর চোখ। চোখগুলো যেন মেয়েটাকে একটু আলাদা করে। স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বড় চোখ রয়েছে তার। ঘন চোখের পাপড়ি তা আড়াল করে রেখেছে। মাঝে বড় বড় গোল নীল রঙের চোখের মনি। রেয়ার চোখ! ভেবে আরো একটু মনোযোগ বাড়ায় প্রেম। সরু নাক আর চিকন ঠোঁট! চুলগুলো বেঁধে রাখা ওপরদিকে। হালকা কোঁকড়ানো চুল পিঠে কালো জ্যাকেটে ছড়িয়ে রাখা। ঘাড়ের বাম দিকে বেয়ে নেমেছে একটা ট্যাটু। একটা ড্রাগনের ট্যাটু। তার ড্রেসআপও আধুনিক। কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স, হাতে চিকন চেইনের ন্যায় ব্রেসলেট। গলায় ঝুলিয়ে রাখা একটা চেইন। হাতের দিকে খেয়াল করতেই প্রেমের নজর যায় একটা দাগের দিকে। ঠিক দাগ বললে ভুল হবে। ট্যাটুই করেছে হয়ত।

চোখ সরিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল প্রেম। এমন মেয়ে তার খুব একটা পছন্দ নয়। দেখলে বিরক্তি আসে। ঐশ্বর্যের একাধিক সৌন্দর্যের মান রয়েছে ঠিক কিন্তু মেয়েলি কোনো গুন খুঁজে পায়নি প্রেম। তাছাড়া মেয়েটা উশৃংখল। কোনো মেয়েলি গুন এখন অবধি দেখতে পেলো না প্রেম। ভাবনা বাদ দিয়ে আবারও ডক্টরের দিকে তাকায় প্রেম। এতো ভেবে লাভ আছে কি? মেয়েটাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেলে আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা সন্দেহ!

ড্রেসিং শেষে ঐশ্বর্যের মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিল ডক্টর। ঐশ্বর্যের বিরক্ত লাগলেও চুপচাপ তা হজম করে নিল সে। জীবনে প্রথমবার ব্যান্ডেজ লাগিয়েছে সে। বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে প্রেমের দিকে তাকাতেই বিগড়ে যাওয়া মেজাজ হঠাৎ করেই পাল্টে গেল। একধ্যানে ফোন ঘাঁটছে প্রেম। ভ্রু কুঁচকে দেখছে কিছু একটা। ডক্টরের কথায় ধ্যান ভাঙে প্রেমের। মুখ তুলে তাকায় সে।
“হয়ে গেছে। বেশ গভীরভাবে আঘাত লেগেছে। তবে সমস্যা নেই। সেড়ে যাবে। ব্যান্ডেজ তিনদিন পর খুলবেন। আর আপনি যেন পেশেন্টের কে হন? হাজবেন্ড?”

কাশি উঠে গেল প্রেমের। ঐশ্বর্য চোখ বড় বড় করে তাকালো। কি বলল এটা ডক্টর। ভাবতেই চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল ঐশ্বর্যের। অতঃপর ঐশ্বর্যের নিজেরও কাশি উঠে গেল। দুজনেরই কাশি দেখে ডক্টর নিজেও থতমত খেলো। প্রেম কাশি থামিয়ে আগের ন্যায় গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“কেউ না ও আমার। আমি ওর নামটা অবধি জানি না।”

“তাহলে?”

“আমাদের দেখা কিছুক্ষণ আগে। ওর জন্য কোনো মেডিসিন বা কিছু লাগবে?”

ঐশ্বর্য ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। আর বলল,
“আমার এসব কিছু লাগবে না। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”

প্রেম আর কিছু বলল না। পেমেন্ট করার সময় প্রেম পেমেন্ট করার সময় ঐশ্বর্য পেমেন্ট দিল। প্রেম কিছু বলল না। হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো সে। পিছু পিছু বেরিয়ে এলো ঐশ্বর্য। এই লোকটা দেখি প্রয়োজনের বেশি একটা ওয়ার্ডও উচ্চারণ করছে না। একবার অন্তত জিজ্ঞেস করা উচিত নয় কি যে তার এখন কেমন লাগছে? এবার ঐশ্বর্যের মনে হলো লোকটা এতোটাও প্রেমিক লোক না। একবারে গম্ভীর!

গাড়িতে এসে বসল প্রেম। ঐশ্বর্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকালো সে। প্রেম গাড়ির জানালা থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি একা বাড়িতে যেতে পারবে?”

ঐশ্বর্য কি বলবে ভাবতে শুরু করল। কিন্তু বলবে তা ভেবে পেল না। প্রেম নিজের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত প্রায় ১২ টা ছুঁইছুঁই। এতো রাতে একটা মেয়েকে ছাড়া ঠিক বোধগম্য হলো না তার। বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
“গাড়িতে বসো।”

ঐশ্বর্য হতবাক হয়ে বলল,
“হোয়াট?”

“গাড়িতে বসো। তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি নিজে বাড়িতে যাব। ফাস্ট!”

ঐশ্বর্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে প্রেমের ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। মেয়েটা কি কানেও শুনতে পায় না? বিরক্তে চোখ বুঁজে ঐশ্বর্যকে কিছু বলতেই হঠাৎ নিজের পাশে ঐশ্বর্যের কন্ঠ পেয়ে চোখ খুলল সে।
“আই এম রেডি। লেটস গো!”

অবাক হলো প্রেম। এই মেয়েটা না এখনো গাড়ির বাহিরে ছিল? এখনি গাড়ির ভিতরে কি করে? হাউ? ঐশ্বর্য মুচকি হাসলো। যেন সে জানতো প্রেম অবাক হবে। নিজেকে সংযত করে গাড়ি স্টার্ট দিল প্রেম।

এক শহর থেকে অন্য শহরে এসেছে প্রেম। সে ভেবেই পাচ্ছে না মেয়েটা এতো দূর এসেছে তাও একা?
“আর কত দূর তোমার বাড়ি?”

প্রেমের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে ছিল ঐশ্বর্য। তার কন্ঠস্বরে কিছুটা নড়েচড়ে বসল সে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“সামনে গিয়ে বাম রাস্তায় মোড় নিলেই আমার বাড়ি।”

“নেক্সট টাইম এমন কোথাও যাবে না যেখানে সম্মানহানি হতে পারে। বার বার সবাই তোমাকে বাঁচাতে আসবে না।”

“আমাকে বাঁচাতে এসে তো ওই কৌশিককে বাঁচিয়ে দিলেন।”

বিড়বিড়িয়ে বলল ঐশ্বর্য। তা ভালো করে শুনতে পেয়ে সে বলল,
“হোয়াট?”

“নাথিং।”
হকচকিয়ে বলল ঐশ্বর্য। প্রেম গাড়ি ব্রেক করে ঐশ্বর্যের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমার বাড়ি এসে গেছে।”

নিজের জানালার ডানপাশে তাকালো ঐশ্বর্য। নিজের বাড়ি দেখে বলল,
“আপনি চিনলেন কি করে?”

“কমন সেন্স! এখানে এই বড় বাড়িটা একটা আছে। আর তুমি বড়লোকের উশৃংখল মেয়ে দেখলেই বোঝা যায়। এই বাড়িটা নিশ্চয় তোমার হবে।”

ঐশ্বর্য কিছু বলল না। মুখ কাঁচুমাচু করে বসে রইল। তারপর বসে থেকে নেমে গেল। একবার প্রেমের দিকে তাকালো সে। আচমকা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে গেল প্রেম। ঐশ্বর্য তাকিয়ে রইল সেই পানে। মনটা যেন পড়ে রইল গাড়িতেই প্রেমের কাছে!

বাড়িতে ঢোকার আগে মেইন দরকার সামনে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ ঐশ্বর্য। এখন বাড়িতে ঢুকলে নির্ঘাত কোনো না কোনো ঝড় বয়ে নিয়ে আসবে তার মা তার ওপর। ঢক গিলে বাড়িতে নক করতেই খুলে গেল দরজা। পিছিয়ে গেল ঐশ্বর্য। তার মা স্বয়ং সামনে দাঁড়িয়ে। মাধুর্য সিনহা! তার মা। মাধুর্যের চোখমুখে ভয়ানক রাগ। মেয়ের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে রাগটা উবে গেল তার। অস্থিরতার সঙ্গে এগিয়ে এসে বলল,
“কি হয়েছে? নিজের কি অবস্থা করেছো এটা? কি করে হলো এটা?”

“তেমন কিছু না মা ওই একটু লেগে গিয়েছে।”

“কোথায় গিয়েছিলে? তোমাকে খুঁজে হয়রান হয়েছে সবাই। আর নিজের কি অবস্থা করে বাড়ি এসেছো? নিশ্চয় কিছু ঘটিয়েছো? সত্যি করে বলো ঐশ্বর্য!”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩

“লেট ইট গো মা। আমার যদি কিছু হয়ও তাহলে এটার জন্য বাবা দায়ি। বাবাকে কে বলেছিল আমার জন্য সব ক্লাব ব্যান করতে? আমাকে ক্লাবে ঢুকতেই দিল না কি সাহস! ইচ্ছে করছিল ওখানে সব কয়টাকে মেরে দিই। বাট আই ওয়াজ হেল্পলেস। আমার ঘুম পাচ্ছে আর প্লিজ আমাকে যেতে দাও।”

ঐশ্বর্যের এমন গা-ছাড়া স্বভাবে রাগ লাগছে মাধুর্যের। মেয়েটা এমন কেন? মাধুর্য চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“তুমি ভুলে যাও কিভাবে ঐশ্বর্য? তুমি ভ্যাম্পায়ার! ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। তোমার এমন কাজকর্মে সবাই লজ্জিত হয়। এমন উশৃংখল জীবনযাপন করা আমাদের কাম্য নয়।”

“ভ্যাম্পায়ার, ভ্যাম্পায়ার, ভ্যাম্পায়ার! ভ্যাম্পায়ার হয়েছি বলে কি নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পারব না? তুমি তো ইচ্ছেমতো কাউকে মারতে অবধি দাও না। কেন দাও না? কারণ আমাদের অধিকার নাকি নেই তাদের প্রাণ নেওয়ার। মানুষ মারা আমাদের নেশা, তাদের রক্ত খাওয়া আমাদের নেশা তবে তাদের মারা যাবে না। এটা কেমন নিয়ম? তাদের মেরে সবকিছু শেষ করে জিততে পারি তো আমরা?”

মাধুর্য হতভম্ব ঐশ্বর্যের কথায়। তার মেয়ে হয়ে ঐশ্বর্য এসব কথা কি করে বলতে পারে? যেখানে রাজ্যের নীতি শান্তি বজায় রাখা সেখানে ঐশ্বর্য একজন ভ্যাম্পায়ার হয়ে এমন কথা কি করে বলতে পারে? মাধুর্য এবার ধমক দিয়ে উঠল,
“ঐশ্বর্য! মুখ সামলাও তোমার। হয়ত রক্ত পান আমাদের নেশা কিন্তু যাকে তাকে খুব সহজে মেরে ফেলা আমাদের অধিকার বা নেশা কোনোটাই নয়।”

“তাহলে এতোসব শক্তি পেয়ে আমাদের লাভ কোথায় মা?”

মাধুর্য হতাশ মেয়ের এসব কথায়। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। এমন মেয়েকে সে নিজে চিনতে পারছে না।
“তুমি ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য। তোমার বিয়ের পর তোমার অভিষেক হবে। তোমার মুখে এসব কথা মানায় না। আজকে আমি তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি ব্যর্থ হয়েছি। জন্মের পর থেকে একটা দিনও আমাকে শান্তিতে কাটাতে দাওনি তুমি। কেন এতো অদ্ভুত তুমি? ভ্যাম্পায়ার হয়েও কেন তুমি আলাদা?”

“এতো প্রশ্ন, এতো জ্ঞান অসহ্য লাগে মা। প্লিজ জ্ঞান দিও না। আমাকে আমার মতো চলতে দাও। আর ওসব অভিষেকের দরকার নেই আমার।”

আর কোনো প্রকার কথা শুনতে রাজি নয় ঐশ্বর্য। এসব প্রসঙ্গ উঠলে তার বিরক্ত ও রাগ লাগে ভীষণ। মাধুর্যের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে হনহনিয়ে উঠে গেল ঐশ্বর্য। মাধুর্য পেছন থেকে ডাকল বেশ কয়েকবার। কিন্তু মেয়েটা কথা শোনার নয়। উদ্বিগ্ন হয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল মাধুর্য।

রাতটা গভীর হয়েছে বেশ। আজ অমাবস্যার রাত। চারিদিক অন্ধকার। চাঁদকে গ্রাস করে ফেলেছে অন্ধকার। এমন সময় গাড়ি এসে থামে সিনহা প্যালেসের সামনে। গাড়ির দরজা খুলে বেশ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামে অনুভব। হাতের ঘড়ি দেখল সে। অন্ধকারে দেখতে তার কোনো সমস্যা হলো না। তার কাছে সব স্পষ্ট। রাত ১ টা বেজে ১৫ মিনিট। নিশ্চয় মাধুর্য তার জন্য না খেয়ে বসে রয়েছে প্রতিদিনের মতো। তাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কয়েকদিন অফিসে ঝামেলা চলছে খুব। তাই আসতে আসতে অনেক রাত হয়। বাড়ির মেইন গেট থেকে চট করেই নিজের হাওয়ার বেগে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় অনুভব। ঐশ্বর্য কি আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল? বের হলেও কোনো লাভ হওয়ার কথা নয়। শহরের সব ক্লাবে বলা হয়েছে ঐশ্বর্যকে যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়। বাবা হওয়ার কারণে তার চিন্তা যেন দ্বিগুণ মেয়েটাকে নিয়ে।

সদর দরজা খোলা। দরজা পেরিয়ে সামনে আসতেই হলরুমে বড় ল্যাম্প এবং ওপরের ঝাড়বাতির অল্প আলোতে বেশ ভালোভাবে নজর পেল তার প্রেয়সী এবং তার স্ত্রীর। তার তৃষ্ণার্ত চোখ যেন একেবারে জুড়িয়ে গেল। কিন্তু মাধুর্যের চিন্তিত চেহারা নজর এড়ালো তার। কয়েকটা ধাপ পেরোতেই মাধুর্য থমথমে কন্ঠে বলে ওঠে,
“আসার সময় হলো আপনার?”

“কি করব বলো? আমি যে নিরুপায়। তবে আমি আমার প্রেয়সীকে ছাড়াও নিরুপায়।”

“আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন? একদম পাল্টালেন না আপনি।”

অনুভব মুচকি হাসে। তার হাসিতে এখনো ঘায়েল করার ক্ষমতা যেন রয়েই গেছে। চশমার ফাঁক দিয়ে নীল চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে আসছে। অনুভব মাধুর্যের হাত ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি কি পাল্টেছো? আগের মতোই তো মুগ্ধময়ী রয়ে গেছো। তোমার চুল থেকে এখনো সেই সুভাস পাওয়া যায়। তোমার বড় বড় চোখজোড়া এখনো আমাকে ঘোরে এনে নেয়। তোমার হাসিতে এখনো আমি খুন হয়ে যেতে পারি। বদলেছো কোথায়?”

“সে তো আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই। বদলে যান নি তো আপনিও। আজও তো দেখি অফিসে অনেক নতুন লেডি স্টাফ কাজ করতে লাগলে আপনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চশমা দিয়ে নিজের বয়স বাড়াতে চাইলেই বাড়বে?”

বলেই ফিক করে হেঁসে ওঠে মাধুর্য। তার হাসিতে অনুভবেরও হাসি চলে আসে। অতঃপর সে বলে,
“সো মাই কুইন, টেল মি দ্যাট! কি হয়েছে? আপসেট ছিলে কেন? ঐশ্বর্য আবার কিছু করেছে?”

হাসি মুখটা আবার কালো হলো মাধুর্যের।
“আপনার মেয়েকে তো আপনি চেনেন। আমি মাঝেমধ্যে অবাক হই ও আমাদের মেয়ে। একেবারে বেপরোয়া, অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। দিন যাচ্ছে আরো বিগড়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি ওকে আমাদের মতো করতে কি করব? আমাদের ভ্যাম্পায়ার কিংডমের সব থেকে অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক মানুষ যখন ও হয়েছিল তখন বলেছিলেন ও আমাদের মতো হবে না। ওর মাঝে কিছু শয়তানি শক্তি আছে। যেটা আপনার মাধ্যমে প্রবেশ করেছে। কারণ আপনারও অংশ। আপনি পুরোপুরি শয়তানি শক্তি মুক্ত হলেও সেটা গিয়ে প্রবেশ করেছে ঐশ্বর্যের মাঝে। কিন্তু শুনেছিলাম বড় হওয়ার পর ওকে ধীরে ধীরে খারাপ জগত থেকে যদি আড়াল করতে পারি তাহলে সেই শক্তি কাটবে। কিন্তু পারছি কোথায়? সব উল্টো হচ্ছে।”

অনুভবের মুখটাও থমথমে হয়ে যায়। প্রশ্ন করে,
“আবার কি করেছে সে?”

“ওর মাথায় দেখলাম আঘাত লেগেছে। ও নিশ্চয় কিছু করে এসেছে। আমাকে তো বললই না। উল্টে অদ্ভুত ব্যবহার করে চলে গেল। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না আর।”

“সব ঠিক হয়ে যাবে। ঐশ্বর্যকে ব্যস্ত রাখতে হবে। ওকে আমাদের রাজ্যে যত তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে পারব তত তাড়াতাড়ি ও আমাদের মতো হবে। তখন ও আমাদের সাথে মিশে যাবে। হতে পারে ও আমার অংশ। আমার মাঝে যা খারাপ শক্তি ছিল সেটা ওর মধ্যে বিরাজমান কিন্তু এটাও তো ঠিক যে ও তোমারও অংশ। তুমি আমার কাছে একটা সতেজ ফুল। আর ফুলে কখনো ভুল থাকে না।”

অনুভবের স্পর্শে এবং কথায় মাধুর্যের মনটা শান্ত হলো। তবুও রয়ে গেল চিন্তা। কপালের থেকে চিন্তার ভাঁজ কমলো না।

নিজের রুমে টেবিলে হাত রেখে পায়ে পা তুলে বসে আছে ঐশ্বর্য। ধারালো চোখে কল্পনায় কারো মৃত্যুর ছবি আঁকছে সে। টেবিলে থাকা ফল কাটার ছুরি হাতে তুলে তীক্ষ্ণ চোখজোড়া দৃষ্টি রাখলো তাতে। নিজের শক্তি দিয়ে ছুরিটা ফলের বাটিতে অ্যাপেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল ঐশ্বর্য। রাগে দপদপ করছে কপালের রগ।
“ওই কৌশিক! ওকে ছাড়ব না আমি। শেষ করে দেব। ওকে বাঁচিয়ে রাখলে ও মরার আগ পর্যন্ত যাকে পাবে তাকে বলবে আমি ভ্যাম্পায়ার। এতো রিস্ক ঐশ্বর্য নেয় না। আজকে যদি ওই লোকটা না আসতো তাহলে…”

ঐশ্বর্য থামে। প্রেমের চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তৎক্ষনাৎ সে অনুভব করল তাকে কল্পনা করতেই কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করছে। যা অন্য কাউকে ভাবলে করে না। ঐশ্বর্য তো কাউকে নিয়ে ভাবেই না তবে? সে বেডে বসে। গালে হাত দিয়ে অজানা ভাবনায় আনমনে বলে,
“শেখ আনন প্রেম! এই প্রেম নামটা যেন উনার জন্যই তৈরি। দিস নেম ইজ পারফেক্ট ফর হিম। কিন্তু আমি ভাবছি কেন উনার ব্যাপারে?”

দরজার টোকা পড়তেই মেজাজ তিক্ত হলো এলিনার। খিটমিট করে বলল,
“কাম এলিনা!”

এলিনা দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। হাতে খাবারের ট্রে।
“ইউ নো হোয়াট এলিনা? এতো রাতে কাউকে নিজের ঘরে দেখলে বিরক্ত লাগে। কেন আসো তাও খাবার নিয়ে?”

“আমাদের ভ্যাম্পায়ার কুইনের আদেশ। অমান্য করার সাধ্য নেই যে। এমনি আপনাকে দেখে রাখতে পারি না। আঁটকে রাখতে পারি না। এরজন্য খুব খারাপ লাগে।”

“আমাকে আঁটকে রাখার সাধ্য আমার মায়েরও নেই। হোয়াটএভার এখন তুমি যেতে পারো।”

এলিনা শুধু হাসে। ঐশ্বর্যের এমন আচরণে সে অভ্যস্ত। দরজার দিকে যেতেই পিছু ডাকে ঐশ্বর্য।
“হেই লিসেন। আই হ্যাভ এ কুয়েশ্চন।”

“ইয়েস প্রিন্সেস?”

“আচ্ছা কাউকে কখন সবসময় কল্পনা-জল্পনা আঁকতে ভালো লাগে? কেন ভালো লাগে?”

এলিনা বুঝতে পারে না ঐশ্বর্যের কথা।
“ঠিক বুঝলাম না?”

“উফফ… জাস্ট ইমাজিন রাস্তায় তোমার সাথে একজন অচেনা কারোর দেখা হলো। তাকে তুমি আগে কোনোদিন দেখনি। কিন্তু তার সঙ্গ তোমাকে মাতাল করে তুলল। তাকে তুমি কল্পনায় আঁকতে লাগলে। সেটাকে কি বলে?”

এলিনা কিছুটা ভাবল। তারপর বলে,
“ইটস কলড ফার্স্ট লাভ এট সাইট!”

ঐশ্বর্য হতবাক হয়ে উঠে তাকায়। উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
“হোয়াট?”

“বাট হুয়াই প্রিন্সেস? হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

ঐশ্বর্য তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,
“ওতো জানতে হবেনা। তুমি যাও তো!”

এলিনা হেঁসে বেরিয়ে যায়। ঐশ্বর্য ভ্রু কুঁচকে চোখ বন্ধ করে ফেলে। প্রেমের গম্ভীর চোখেমুখে থাকা চেহারা মনে পড়তেই আনমনে বলে,
“লাভ? মানে বাংলাতে যাকে বলে ভালোবাসা? ভালোবাসা এভাবে হয় কখনো? তাও মানুষের সাথে?”

রাত প্রায় তিনটা! ঐশ্বর্য বেডে শুয়ে এদিক-ওদিক করছে। ঘুম আসছে না। অমাবস্যার রাত আসলেই এমন হয় তার। শান্তি পায় না কোথায়। উঠে বসে পড়ে এক পর্যায়ে সে। মুখ দিয়ে বিরক্তির ‘চ’ এর শব্দ করে বড় নড় শ্বাস ফেলে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তার মধ্যে আচমকা অনুভূত হয় তার বাম হাতের এক অংশ জ্বলছে। হাত উঠিয়ে দেখে বাম হাতে থাকা একটি বিশেষ চিহ্ন সেটা জ্বলজ্বল করছে। যেন আগুন বের হচ্ছে সেখান থেকে। অসহ্য রকম জ্বলছে তার। এই চিহ্ন তার জন্ম থেকেই ছিল। বয়সের সাথে সাথে চিহ্নটা স্পষ্ট হয়েছে। একটা মুকুটের মতো চিহ্নটা। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে সে।

চলবে…