প্রেমে পড়া বারন পর্ব-০৮+০৯

0
299

# প্রেমে পড়া বারন
# পার্ট – ৮+৯
# Taslima Munni

রেহান ভাইয়ের সাথে কথা বলার পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম!!
সকালে আম্মুর গলা শুনে ঘুম ভাঙলো।আম্মু এতো উচ্চস্বরে কেন কথা বলছে??.
ঘুম হালকা হতেই কানে আসলো
– বিয়ের দিনও কেউ এভাবে পড়ে পড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায়! এই জীবনে দেখিনি!! এবার যদি না উঠিস হিয়া!!
এই যা তো…. তোর আব্বুকে ডেকে আন..।
আম্মুর কথা শুনে মনে পড়লো – আজকে আমার বিয়ে!!

তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম। দেখি দিয়া আর আম্মু দাঁড়িয়ে। আম্মুর চোখেমুখে বিরক্তি।
– এবার উঠে উদ্ধার করেন আমাকে! বিয়ের দিনেও উনারে ১০ জনে ডেকে তুলতে পারে না।
আমি আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে বললাম – আম্মু, তোমরা তো দুইজন, বাকি আটজন কই?
আম্মু আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে, রাগে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো।
মাঝেমধ্যে আম্মু যখন রেগে যায় তখন আরেকটু রাগিয়ে দিতে আমার খুব মজা লাগে।
– তোর কপাল ভালো আজকে তোর বিয়ে। না হলে আম্মু যা রেগে আছেন!! কতক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছে, তোর উঠার নাম নেই।
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।
দিয়াও চলে গেলো।
আজ বিয়ে!!
মনে পড়তেই হাত পা যেন জমে আসছে!

বিয়ের করা এতো ঝামেলা!! ধুর, এই আধ মণের বিয়ের ড্রেস পড়ে সারাদিন সঙ সেজে বসে থাকা…. অনেক বিরক্ত লাগছে আমার। আমি কখন এই আজাব থেকে বের হবো !!!
প্রাণ টা হাঁসফাঁশ করছে।।
ঘরোয়া আয়োজন বললেও আমি তো দেখছি লোকজনের অভাব নেই!
এতো লোক কোথা থেকে আসলো!!

রেহান ভাই কিছু সময় পাশে বসে ছিলো, তারপর উঠে কার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।
দিয়া,মাহি আপু সবাই ব্যস্ত। এদিকে আমার অবস্থা খারাপ!! ওয়াশরুমে যাবো তার উপায় নেই।
কাউকে সামনে দেখতে না পেয়ে, এদিক সেদিক তাকিয়ে মাহি আপুকে দেখে, ইশারা করতেই কাছে আসলো।।
(রাইবাদিনী ননদিনী! পাইছি তোমারে,অনেক তো মজা করছিলা আমারে নিয়া!
এখন তোমারে একটু খাটিয়ে শোধ টা নিয়েই নিবো)
– কিছু লাগবে তোর?
– তোমরা সবাই কই থাকো? এই দিকে আমার দম বেরিয়ে আসছে। আর কত সময় এভাবে থাকতে হবে?
– কত সময় এভাবে থাকতে হবে! সেটা নিয়ে ভাবছিস? নাকি কখন কবুল বলবি তার জন্য তড় সইছে নাহ?
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মাহি আপু।
– উফফফ! তুমি সারাক্ষণ পারোও!
ওয়াশরুমে যাবো কিভাবে?
– ওহহহ! আচ্ছা আয় আমার সাথে।
– এই লেহেঙ্গা পড়ে হাঁটা যাচ্ছে না তো! এটাতো একটু ধরে রাখতে হবে।
– তাইতো!
অই,দিয়া….
– হে,কি হয়েছে? বলো।
– হিয়া ওয়াশরুমে যাবে, একটু হেল্প কর।
মাহি আপু আর দিয়া লেহেঙ্গা সামলাতে সামলাতে নিয়ে গেলো।
ওয়াশরুমের গ্লাসে নিজেকে ভালো করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি – উফফফ! কি সুইট লাগছে আমাকে!!
– অই হিয়া! ওয়াশরুমে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ছিস?
মাহি আপু তাড়া দিচ্ছে। ধুর!
নিজেকে বউ বউ দেখতে কত্ত সুন্দর লাগছে!! ইচ্ছে তো হচ্ছে নিজেকে একটা চুমু খেতে!!
হাতে একটা চুমু দিয়ে আলতো করে গালে ছুঁয়ে দিলাম।
আপুর তাড়ায় ওয়াশরুম থেকে বের হলাম।
– আপু,আমার কেমন যেন লাগছে!
– কেমন লাগছে?!!
– জানি না, হাত- পা জমে আসছে। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবো!
– লক্ষী বোন আমার,এতো টেনশন নিচ্ছিস কেন?
এই জন্য এমন হচ্ছে।
– দেখো, আমি ঘেমে যাচ্ছি!
– এসির মধ্যে থেকেও!
আয়, তুই বস এখানে। তোকে ঠান্ডা শরবত করে দিচ্ছি।ভালো লাগবে।
আপু আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আমি মনে মনে হাসছি। খাটো খাটো!
খুব মজা করেছিলা দুজনে! বেকুব বানিয়ে ছেড়েছো!

বিয়ে পড়ানোর সময় কবুল বলতে গিয়ে আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো। আমি সেই নিজের বাড়িতে থাকবো।বাবা-মাকেও ছেড়ে দূরে যেতে হচ্ছে না।আমি যাকে মনে মনে চেয়েছিলাম, সে-ই মানুষই এসেছে আমার জীবনে। তাকেই আপন করে নিচ্ছি, তবুও কান্না পাচ্ছিলো।
বিয়ে জিনিস টা কেমন! কবুল বলার সাথে সাথে আরেক জন মানুষের জীবনের সাথে আজীবনের জন্য জড়িয়ে যাওয়া! কত দায়িত্ব গ্রহণ করা!
নিজের ব্যক্তিগত স্বাধীন জীবন কাউকে প্রবেশাধিকার দেয়া। কতকিছু মাথায় আসছে!!
বিয়ের পর্ব সমাধান হলো!
অবশেষে আমি উনাকে পেলাম।

রাতে মাহি আপু, দিয়া আমাকে রেহান ভাইয়ের রুমে দিয়ে, চলে গেলো।।
রুমটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো।
এই রুমটা আমার অপরিচিত নয়।কতবার এসেছি এই রুমে। তবুও একটা অস্বস্তি হচ্ছে।
প্রায় আধাঘন্টা পরে রেহান ভাই রুমে আসলো।উনাকে দেখে বুকের ভেতর সেই হাতুড়ি পিটানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
হাত-পা ঝিমঝিম করছে।

রেহান ভাই আর আমি! একটা রুমে!!
আমরা স্বামী-স্ত্রী! ভাবতেই আমার… উনি কি বলবেন এখন?
আমি তো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।
– এভাবে স্ট্যাচু হয়ে আছিস কেন? ঠিক আছিস তো?
উনার কথা শুনে বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরে গেছে যেন।
– হুম ঠিক আছি।
রেহান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
– তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
উনার কথায় একটু লজ্জা পেলাম। চোখ নামিয়ে নিলাম।
– জামাইকে সালাম করতে হয়,সেটাও জানিস না?

এইরে… মাহি আপু কি কি যেন বলেছিলো!
হা! সালাম করতে বলেছিলো বোধহয়! ভুলেই গেছি।।
তড়িঘড়ি করে সালাম করতে উঠতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম।
– আরে আস্ত,আস্তে!
টুপ করে সালাম করে নিলাম।
– আরে, আরে সালাম করতে হবে না।এমনি বললাম।। তুই এতো এ্যাভনরমাল বিহেভ করছিস কেন??
Take it easy!
তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।একসাথে নামাজ পড়বো।

ফ্রেশ হয়ে দুজন একসাথে নামাজ আদায় করলাম। অন্যরকম একটা প্রশান্তিতে মন ভরে গেলো।
বেডের একপাশে বসে আছি। রেহান ভাইও এসে একটা বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন।
– ওখানে বসে আছিস কেন? এখানে আয়।
আমিও বাধ্য মেয়ের মতো উনার পাশে গিয়ে বসলাম।
রেহান ভাই আমার হাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন।
উনার স্পর্শে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার।
– ওইদিন আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিলি?
– হুম।
হালকা মাথা নেড়ে জবাব দিলাম।
– আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।
সবাই কিভাবে রিয়েক্ট করবে। কিন্তু যে দিন ইশতিয়াককে দেখলাম তোর পিছনেই বেশি ঘুরঘুর করছে, আমার খুব রাগ হচ্ছিলো।
– আপনি জেলাস ছিলেন?
– হা ছিলাম। তোর পাশে অন্যকাউকে সহ্য করতে পারবো না, সেটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।কিন্তু..
– কিন্তু কি?
– বিবেক বাধা দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার আর তোর মাঝে অনেক গ্যাপ। জেনেশুনে তোকে অসম একটা সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছে করছিলো না।
রেহান ভাইয়ের কথাগুলো শুনে আমিও স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। ভয়,অস্বস্তি অনেক টা কেটে গেছে।
– ওহহহ…
এখন বুঝি বয়স কমে সমান হয়ে গেছে?
– তা কমেনি আবার!! ১০ বছর কমে গেছে!
-হুহ!!

অনেক রাত হয়ে গেছে গল্প করতে করতে।
রেহান ভাই বললো – সারাদিন তো অনেক ধকল গেলো। চল ঘুমাই।
– হুম।
আমিও সায় দিলাম।
আমি যখন বালিশটা ঠিক করে শুতে যাবো, তখন উনি বললেন
– সত্যিই ঘুমাবি?
এ কথা শুনে উনার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললাম – হা। আপনিই তো বললেন!
– আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমা।
আমি শুতে যাবো উনি হাতটা টেনে উনার বুকে টেনে নিলেন আমাকে!!
– ওখানে ঘুমাতে কে বললো তোকে!.
– তো, কোথায় ঘুমাবো?
– এখানে।
বলে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
– উফফ।এভাবে কেউ ধরে রাখলে আমি ঘুমাতে পারি না।
– এখন থেকে এভাবেই ঘুমাতে হবে!
বলেই কপালে একটা চুমু দিলেন!!
– কি, করছেন কি?
– আমার বউকে আমি দিলাম, তোর কি সমস্যা?
চুপচাপ ঘুমা।
বলেই চোখ বন্ধ করে নিলেন।।

উনার এতোটা কাছে আমি। উনার প্রতিটি হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। উনার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়…

পরদিন সকালে আম্মু,ফুপি,মাহি আপু নাস্তা তৈরি করছে। আমিও গেলাম।
ডাইনিং এ আব্বু,রিয়াদ ভাইয়া,আরিফ,দিয়া বসে নাস্তা করছে।
– রেহান কই রে?
– রেহান ভাই তো ঘুমাচ্ছে।
আব্বুর কাশি শুনে গিয়ে তাড়াতাড়ি পানি দিলাম। ভীষম খেয়েছেন।
মাহি আপু রিয়াদ ভাইয়ার মুখে, রিয়াদ ভাই মাহি আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবার আম্মুর দিকেও তাকাচ্ছে।
দিয়া খিক করে হেসে মুখ হাত চেপে হাসি থামিয়ে দিলো।।
আমি বুঝতে পারলাম না কি হচ্ছে এখানে।
এদিকে রেহান ভাইও সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছে।
– অইতো, রেহান ভাই এসে গেছে।
বলেই মাহি আপু মুখ টিপে হাসছে।

এতোক্ষনে বুঝলাম।।
আমি রেহান ভাই বলেছি বলেই আব্বু ভীষম খেয়ে গেছেন!

বিয়ে হলেও যেন কিছুই বদলায়নি এই বাড়ি আমার কাছে নতুন নয়।ছোট্ট বেলা থেকেই এই বাড়ির প্রতিটি কোনা আমার চেনা।
শুধু আমার নিজের রুমটা ছাড়তে হয়েছে!!

রুমে এসে দেখি রেহান ভাই বই পড়ছেন।
আমি যে আসলাম উনি তাকিয়েও দেখেননি।
আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গুছিয়ে রাখছি।
গ্লাসে দেখলাম উনি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম – কি?
– তোর মাথায় কি আছে?
মাথায় হাত দিয়ে বললাম- কই? কিছু নেই তো।
– এইজন্যই!!
– এজন্যই কি?
– তোর মাথায় যে কিচ্ছু নেই এই জন্যই…
– কি… বলবেন তো!!
– আমি তোর ভাই লাগি?
– অহহ!
– এতো দিনের অভ্যাস।
– এতো দিনের অভ্যাস!! সবার সামনে কি একটা লজ্জায় পড়তে হলো, তোর গাধামির জন্য!
– আমি কি ইচ্ছে করে বলেছি নাকি!!
– আর একদিন যদি মুখ ফসকেও বের হয়,তবে দেখিস!
– কি করবেন?
– কি করবো?
রেহান ভাই আরেকটু কাছে এসে বললেন – দেখিস কি করি!

চলবে….

# প্রেমে পড়া বারন
# পার্ট – ৯
# Taslima Munni

আর একদিন যদি মুখ ফসকেও ‘ভাই’ বের হয় ,তবে দেখিস!
– কি করবেন?
– কি করবো?
রেহান ভাই আরেকটু কাছে এসে বললেন – দেখিস কি করি!

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে
-হুহ!
বলে ঘুরে আমার কাজ করতে লাগলাম।
– অই হুহ! কি?
রেহান ভাই টান দিয়ে উনার দিকে ফেরালেন।
– কিছু না। এমন করে বলছেন যেন আমি ইচ্ছে করেই করেছি।
– ইচ্ছে করে করিসনি ঠিক, কিন্তু নিজেকে বিরাট বড় মাপের বুদ্ধু প্রমাণ করেছিস।এখন যা, একটা কফি নিয়ে আয়।
এইলোকটার জন্য কফি করতে করতে আমার জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে।

– বরের জন্য কফি! মিষ্টিটা একটু কম করে দিও ভাবি!
পিছনে তাকিয়ে দেখি রিয়াদ ভাইয়া আর মাহি আপু দাঁড়িয়ে।
– ভাইয়া,আপনি ভাবি ডাকছেন কেন??
– রেহান ভাইয়ের বউ বলে কথা! এই বাড়ির দশটা না, পাঁচটা না! একটাই মাত্র ভাবি!
তো কি ডাকবো?
– বুঝেছি।তো মিষ্টি কম দেবো কেন?
– মাহি,তুমি বোঝাও তোমার এই বোনকে। আমার দ্বারা হবে না বুঝে গেছি।
– কি বুঝাবে?
মাহি আপু আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বলে
– আসলে হয়েছে কি হিয়া, বিয়ের পর নতুন নতুন সব কিছুই মধু মধু মনে হয়, তাই মিষ্টি কম দিলেও চলে।
এখন যদি করলার জুস নিয়েও ভাইয়াকে দিস, সেটা খেয়েও বলবে – সাধু! সাধু! তোমার হাতে জাদু আছে,এই হাতের ছোঁয়ায় সব কিছু অমৃত মনে হয়!!.
ফিল্মি স্টাইলে ডায়লগ দিয়ে যাচ্ছে মাহি আপু।
– ওওওও…. আচ্ছা! আচ্ছা! তাই বুঝি?!
তো রিয়াদ ভাইয়া তোমার হাতের কোন অখাদ্যকে অমৃত বলেছে শুনি?
– ওসব শুনতে নেই বেবি! ওটা সিক্রেট।
বলেই চোখে টিপ্পনী কাটলো।
– আরে আরে.. সিক্রেট ফাঁস হয়ে গেলে তোমার আপুর রন্ধন শিল্পের গুমর ফাঁস হয়ে যাবে কিনা!
– মানে?
– মানে, উনি আমাকে এক কাপ চা করে দিয়েছিলেন। অতি যত্নের ঠেলায় খুব সম্ভবত দু থেকে তিন চামচ দুধ,দু চামচ চিনি,আর আধা চামচ লবণ দিয়েছেন।
ও,হা, ডাক্তার সাহেবা স্বাস্থ্য সচেতন কিনা! তাই সাথে এলাচ,লবঙ্গ, আদাও দিয়েছেন।
বুঝতে পারছো কত সুস্বাদু হয়েছিলো!।
– তুমি আবার আমাকে খোটা দিচ্ছো? আমি কি জানতাম নাকি লিকার চায়ে আদা,লবঙ্গ এসব দেয়,দুধ চায়ে দেয় না!
জীবনেও আর কিছু করে খাওয়াবো না।

রিয়াদ ভাইয়া কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ। আসলে মাহি আপু কখনো কিচেনে যায়নি। সব সময় পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতো আর রান্নায় কখনো কোনো আগ্রহই ছিলো না। ফুপি অনেক বলেও কিছু হয়নি।
ওদের খুনসুটি আমার খুব ভালো লাগছে।
আমার কফি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।
রিয়াদ ভাইয়া আর মাহি আপু এটা নিয়েই পাল্টাপাল্টি যুক্তি দেখাচ্ছে। দিয়াও এসে যোগ দিলো।

আমি হাসতে হাসতে কফি নিয়ে চলে এলাম।
– এই নিন আপনার কফি।
– হুম।।
হাত বাড়িয়ে কফি নিলেন।
– এভাবে হাসছিস কেন?
– কি হয়েছে শুনবেন?
– বল, শুনি।
ওদের কথাগুলো বললাম। বলে আবার হাসি পেয়ে গেছে।
– ঠিকই তো বলেছে। মিষ্টি বউ থাকলে একস্ট্রা মিষ্টির দরকার নেই তো।।
উনার কথা শুনে আমার হাসি থেমে গেছে। উনি কি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছেন।গভীর দৃষ্টিতে, এই দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে!!

-নে,কফিতে একটা চুমুক দিয়ে দে।।
– কেন?
– মিষ্টি ঠিক আছে কিনা দেখে দিবি সবসময়।
– সেটাতো, এক চুমুক সবসময় ই খাই!
বলতে বলতে এক চুমুক দিলাম।
– জানি তো! কিন্তু আজকে হাসির জন্য ভুলে গেছিস।
এইরে! একটা ধরা খেলাম!!
– জানেন মানে?
-অইযে, আমার কফির কাপে আমার আগে একটা বিড়াল মুখ দেয়! সেটা জানি আমি।
– আমি বিড়াল?
উনি হাসতে হাসতে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন।
– কারো উপকার করলে এমন ই,কথা শুনতে হয়! ঠিক আছে, আর দেবো না।
আমি মন খারাপ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কাঁধে গরম একটা বাতাস অনুভব করলাম।
না,ভুল হয়নি,এটা নিঃশ্বাসের।
রেহান ভাই আমার ঠিক পিছনে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ রেখে বললেন –
এই বিড়ালটি যদি মুখ না দেয়, সেই কফি তো খাওয়া যায় না। তুই যে রোজ এমন করিস সেটা অনেক আগে থেকেই জানি। একদিন দেখছিলাম, তারপর কিছু দিন খেয়াল করে দেখেছি।
শুন…
আমাকে উনার দিকে ফেরালেন।
– কি?
– আমি কিন্তু জেনেশুনেই কফি খেতাম।
এবার আমার ঠোঁটের কোনে হাসি আসলো।
– তার মানে আপনিও প্রেমে পড়েছিলেন!!?
– নাতো! জানিস না প্রেমে পড়া বারন??
– কেন বারন?
– তোর প্রেমে পড়া বারন ছিলো। তোর প্রেমে পড়ার কোনো কারণ ছিলো না।
– তাই বুঝি?
– হুম। কেন জানিস?
– কেন?
– উত্তর টা প্রথম আমিও জানতাম না।
এখন জানি।
কারণ তুই আমার প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গেছিস।যখন চাইতাম তোকে সামনে পেতাম। আমার প্রয়োজনের সবকিছু তো খেয়াল করতিস।কখনো মনে হয়নি তুই না থাকলে কি হবে!
তুই যখন আমার নিত্যদিনের অংশ হয়ে ছিলি,তাই তোর মাঝে মজে গেছি কখন নিজেই তো বুঝিনি।
বলেই কপালে একটা চুমু খেলেন।
আমার চোখ ভিজে গেছে।
আমি ভাবতাম এই মানুষটা আমার অনুভূতি বুঝে না।অথচ এই মানুষটাই আমার থেকে বেশি ভালোবেসে গেছে নিজের অজান্তেই।

-আপু…
দিয়া দরজার বাইরে থেকে ডাকলো।
রেহান ভাই সরে গিয়ে কফির মগ তুলে নিলো।
– ভেতরে আয়।
-তোকে আর ভাইয়াকে নিচে ডাকছে।

নিচে গিয়ে দেখি মাহি আপু, রিয়াদ ভাইয়া, আরিফ,দিয়া সবাই মিলে প্ল্যান করেছে ঘুরতে যাবে।
আব্বু,আম্মু,ফুপি তারা গেলেন না। আমরা অনেক বলার পরেও উনারা বাসায় থেকে গেলেন।

আমরা ১২টার দিকে বের হলাম। দুপুরের খাবারের পার্সেল নিয়ে সবাই লং ড্রাইভে শহরের বাইরে গেলাম।
যান্ত্রিক জীবনের বাইরে প্রকৃতির ছোঁয়ায় অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে।
একটা নদীর তীরে এসে নৌকা করে ঘুরলাম অনেক সময়। বিকেলে শান্ত নদীর শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে গেছে।
মনে হয় অনন্তকাল যদি এভাবেই থাকতে পারতাম!!

দিয়া,আরিফ রেহান ভাইকে ধরলো একটা গান শুনাতে।
রেহান ভাই কিন্তু দারুণ গান করেন। সেই ছোট্ট বেলায় কত শুনেছি উনার গান! বাসায় প্রায়ই গাইতেন।
কিন্তু বাইরে থেকে ফেরার পরে আর গাইতে শুনিনি।
আজ সবাই ধরলো গাইতে।কিন্তু উনি রিয়াদ ভাইয়া থাকায় একটু ইতস্তত করছেন। মাহি আপু, রিয়াদ ভাইয়ার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত একটা গান ধরলেন —
——————

ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো– তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণমঞ্জীরে।।

ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি– তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণ।।

মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী– তোমার
কনককঙ্কণে॥

আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো– তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো– তোমার
ললাটচন্দনে।

আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো– তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো– তোমার
অতুল গৌরবে।।

————–

গানটা শুনতে এতো ভালো লাগছিলো যে বলে বুঝাতে পারবো না। এই পরিবেশে যেন গানটা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
আমাদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে।
সারাটা দিন সত্যিই অনেক আনন্দ হয়েছে সবার সাথে।

রাতে সবাই যখন যে যার রুমে চলে গেছে। তখন আমিও রুমে এলাম।
মাহি আপু আর দিয়ার সাথে অনেক সময় গল্প করলাম।
রুমে এসে দেখি রেহান ভাই রুমে নেই।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।
– এখানে কি করছেন?
– শুনে কি করবি?
– কেন?
– তোর শোনার সময় কই!! এতো তাড়াতাড়ি তোর গল্প করা শেষ হয়ে গেলো??
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি- অনেক রাত হয়ে গেছে।
– এতটা বেজে গেছে! খেয়াল ই করিনি।
– হুম।
– রুমে আসবেন না?
– নাহ! এখানেই ভালো লাগছে।
আমিও গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালাম।উনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হয় রেগে আছেন কিছুটা।
আমিও চুপ করে আকাশ দেখছি।
কিছু সময় পরে উনি বললেন
– তুই এখানেই থাক।আমি গেলাম।
বলেই রুমে চলে গেলেন।
আজব! আমি দাঁড়িয়ে আছি আর উনি চলে গেলেন রুমে!

রুমে এসে আমিও বললাম – কি সমস্যা আপনার? আমাকে ফেলেই চলে আসলেন?
নাহয় একটু দেরি হয়েছে, তাতে কি হয়েছে শুনি?
উনি হঠাৎ উঠে এসে আমাকে দু’হাতে শক্ত করে ধরে
-এই মেয়ে, তুই কি কিছুই বুঝিস না? এতো বোকা কেন তুই?
উনার কথায় আমার মুখভার হয়ে গেছে।

চলবে….