প্রেম পায়রা পর্ব-০১

0
3174

#গল্পের_নাম: ||প্রেম পায়রা||
#লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব______০১

১.
—‘আমাকে আস্তো একটা সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য একটা অপরিচিত মেয়েকে কি করে বিয়ে করতে পারলেন নিশান ভাই?কেন বিয়ে করলেন?’

নিশানের কলার চেপে কাঁদতে কাঁদতে বলল তিথি।নিশান ব্যথিত হৃদয়ে একবার তিথির চোখের দিকে তাকালো।সে চোখে ফুটে উঠেছে গভীর ক্রোধ আর অসহায়ত্ব।মুহূর্তে নিশানের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।সে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো।এই মেয়ের এমন কষ্ট সে কি করে সইবে?

তিথি কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ফ্লোরে বসে পড়লো।নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে চুপ হয়ে গেল।ক্ষণে ক্ষণে তার শরীরের কাঁপুনি দেখে নিশানের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে মেয়েটা এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।সে নরম গলায় ডাক দিল,

—‘তিথি!’

তিথি কোনো প্রতিত্তর করলো না।যেভাবে ছিল সেভাবে বসে রইলো।নিশান ছিন্নভিন্ন মন নিয়ে আলতো করে নিজের ডান হাতটা তিথির মাথায় ছোঁয়াতে সে চোখের পলকে হাত সরিয়ে দিল।ক্রধান্বিত কন্ঠে বলল,

—‘আর কিছু বলার আছে আপনার নিশান ভাই?’

—‘তিথি, শান্ত হ!দেখ,তোকে আমি বুঝিয়ে বলছি।তুই যেমন ভাবছিস বিষয়টা তেমন না।তুলিকে আমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি।’

—‘এতটা বাধ্য হয়েছিলেন যে একটা মেয়েকে বিয়েই করে ফেললেন নিশান ভাই?বিয়ে নামক রাশভারি শব্দটাকে এতটা ঠুনকো মনে হয় আপনার কাছে?বাধ্য হয়েছেন আর দিন-দুনিয়া ভুলে কবুল বলে দিলেন?’

—‘লিসেন তিথি।তুই একদম কান্না করবি না।আমি সব ঠিক করে দিবো।তুলিকে ডিভোর্স দিয়ে তোকে বিয়ে করবো তিথি।কিছুদিন সময় দে আমাকে।আমি সবকিছু সুন্দর মতো হ্যান্ডেল করবো।প্লিজ তুই এভাবে কান্না করিস না।তুলিকে নিয়ে আমি সংসার করবো না।’

তিথি ঝট করে উঠে দাঁড়ালো।জ্বলন্ত চোখে নিশানের দিকে চেয়ে বলল,

—‘এখন আমার সাথে সাথে আরো একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কথা ভাবছেন নিশান ভাই?ছি!আপনার মতো এত সংকীর্ণ মনের মানুষকে আমি ভালোবেসেছিলাম!আই হেইট মাই চয়েস!’

নিশান এগিয়ে গিয়ে তিথির কাছাকাছির দাঁড়িয়ে অনুরোধের স্বরে বলল,

—‘তিথি একটু শান্ত হ।আমায় ভরসা কর।সব ঠিক করে দিবো আমি।আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি।’

—‘ঘরে বউ রেখে অন্য একজনকে ভালোবাসি বলছেন লজ্জা করছে না?’

—‘চুপ!তিথি তুই পাগল হয়ে গেছিস।’

তিথি কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দিশেহারার মতো তাকাল।পরক্ষণে নিজের মাথার চুল নিজে টেনে বলল,

—‘হ্যাঁ,হ্যাঁ!আমি পাগল হয়ে গেছি নিশান ভাই।আমি পাগল হয়ে গেছি।আ-আমি পাগল হয়ে গেছি।’

—‘তিথি কুল!বলছি তো আমি সব ঠিক করে দিবো।আমি শুধু তোর।আর কারো না!কিছুদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তুলিকে আমি অন্য জায়গা থাকার ব্যবস্থা করবো।’

—‘অন্য জায়গা মানে?নিশান ভাই, আপনি সত্যি মেয়েটার জীবন দুমড়ে মুচড়ে দিবেন?এটা আমি হতে দিবো না।আপনি তুলিকে নিয়েই সংসার করবেন।’

তিথির কন্ঠের দৃঢ়তা দেখে নিশান এগিয়ে গিয়ে তার বাম হাত নিজের দু হাতের মুঠোয় পুড়ে অসহায় কন্ঠে বলে উঠে,

—‘তিথি ওকে নিয়ে আমি সংসার করতে পারবো না।’

তিথি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।বাম হাতের আঙুল উঁচিয়ে বলল,

—‘ডোন্ট টাচ মি!ঘৃণা করি আপনাকে।শুনেছেন আপনি?ঘৃণা করি আপনার মন মানসিকতাকে।বিয়ে করে এখন বলছেন সংসার করতে পারবেন না।ছি!’

নিশান ফের দু পা এগাতো তিথি চোখে মুখে ঘৃণা ফুটিয়ে বলল,

—‘খবরদার!আমাকে ছুঁয়ে দেয়ার দুঃসাহস করবেন না।ডান উইথ ইউ!আ’ম ডান উইথ ইউ মি. নিশান শাহরিয়ার!”

তিথি আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না।এক দৌঁড়ে চোখ মুছতে মুছতে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেল।

২.

—‘বড় বাবা!আপনার চা।’

সাবধানে তিথি চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলেন।বেলকনির অন্ধকারে ইজি চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি চোখ খুললেন।একটু নড়েচড়ে তিথির দিকে এক পলক তাকালেন।পরক্ষণে নিজের পাশের খালি টুলটার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

—‘তিথি মা,বস তো আমার পাশে।’

তিথি নিজের ভেঙে চূড়ে যাওয়া ব্যথিত মনটা লুকিয়ে কৃতজ্ঞতার চোখে মানুষটার দিকে তাকালো।তার বড় বাবা জনাব সিদ্দিকুর রহমান!মানুষটার সাথে তার রক্তের সম্পর্ক নেই।অথচ কি অদ্ভুত কায়দায় নিয়তি মানুষটার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে।

তিথির আজও ঝাপসা একটা স্মৃতি মনে পড়ে।বহু বছর আগে সে যখন এতটুকুন বয়সে রাস্তা হারিয়ে কান্নাকাটি করছিল মা মা করে,ঠিক এই মানুষটি তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল।সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল তার আর ভয় নেই! পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিবে।প্রথম কথাটা তিনি সুন্দর মতো পালন করতে পেরেছেন।সত্যি তার আর ভয় নেই।কিন্তু দ্বিতীয় কথাটি পূরণ করতে পারেননি।তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি নিজের বাবা-মার কাছে।পরিচয় জানতে পারেননি,তাদের খোঁজ খবর পাননি!

বাবা-মায়ের কিছুই তার মনে নেই।এতগুলো বছর এরা নিজের সন্তান মনে করেই তাকে বড় করেছে।তিথি কৃতজ্ঞ মানুষগুলোর প্রতি।গভীর কৃতজ্ঞ!সে চায়ের কাপটা সিদ্দিকুর রহমানের হাতে ধরিয়ে দিল।টুল টেনে কাছ ঘেঁষে বসে বলল,

—‘বড় বাবা!দেখুন তো চিনি ঠিক হয়েছে কি না!আজ এক চামচের একটু কম দিয়েছি।আপনার ডায়াবেটিস হুড়মুড় করে বেড়ে যাচ্ছে।’

সিদ্দিকুর রহমান পরম আয়েশে চায়ের কাপে চুমুক দিল।এক চুমুক খেতে তার চোখে মুখে তৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠলো।আবছা অন্ধকার বলে সে দৃশ্য হয়তো তিথির নজরে এলো না।

চায়ের কাপ অর্ধেক খালি করে তিনি বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি মেললেন।ওপাশে ঘন ঝোঁপ আর গাছপালা।এক তলা হওয়ায় বেশকিছু লতানো গাছের ডগা বেলকনির গ্রিল টপকে ভেতরে ঢুকেছে।এখানে বসলে অনেকটা গ্রাম্য গ্রাম্য অনুভূতি আসে।তিনি বাইরের অন্ধকারে কিছুক্ষণ চেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তিথির দিকে তাকালেন।সামনের ফ্ল্যাটের দোতলার রান্নাঘরের ছিটেফোঁটা আলো এসে তিথির মুখে পড়েছে।সে আলোতে রহস্যময়ী লাগছে মেয়েটাকে।মেয়েটা সত্যি সত্যি রহস্যময়ী।নিজের কষ্টগুলোকে কতটা স্বযত্নে রহস্যে আবৃত রাখে।কাছের মানুষদেরও বুঝতে দেয় না।

আজ থেকে আঠারো বছর আগে এই ফুলের মতো মেয়েটার চোখের জল তিনি সহ্য করতে পারেননি।বুকের ভেতর কোথায় যেন হুঁ হুঁ করে উঠেছিল।তার ফলশ্রুতিতে নিজের মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা চিন্তা না করেই দুই সন্তানের ঘরে তৃতীয় সন্তান নিয়ে হাজির হয়েছিল।তার স্ত্রী রেশমা পরম মমতায় বুকে তুলে নিয়েছিলেন।তারপর কিভাবে কিভাবে যেন এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল।সেদিনের আধো আধো বুলি ফোঁটা পুঁচকে মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেছে।

সিদ্দিকুর রহমান চট করে তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।গাঢ় মমতা মাখিয়ে বললেন,

—‘তিথি মা, মন খারাপ?’

তিথি অন্ধকারে মুচকি হাসলো।মাথা নেড়ে আশ্যস্ত করে বলল,

—“না বড় বাবা।মন খারাপ কেন হবে!’

—‘আজ তো নিশি ফোন দিল না রে মা।’

সিদ্দিকুর রহমানের বড় মেয়ে নিশি।বছর পাঁচেক হলো তার বিয়ে হয়েছে।জামাই বিদেশে কর্মরত।তিন বছর হলো নিশিকে সাথে করে বিদেশে থাকে।তিথি বলল,

—‘নিশি আপু তো গতকাল উইকএন্ডে ফোন দিয়েছিল।কয়েক ঘন্টা কথা বলেছে।আজ আর কল দিবে না।কাল হয়তো ফোন দিবে।বড় বাবা,অনেক রাত হয়েছে।আপনি ঘুমিয়ে পরুন।আমি দেখি বড় মা কি করে!’

তিথি উঠে দাঁড়ালো।কয়েক পা গিয়ে আবার আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো।সিদ্দিকুর রহমান শশব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—‘তুই আর কিছু বলবি তিথি?বলে ফ্যাল!আমার কাছে এত কিসের জড়তা?’

তিথি আবার এগিয়ে এসে সিদ্দিকুর রহমানের পাশে দাঁড়াল।দুহাতে নিজের ওড়নার কোণা পেঁচানো শুরু করলো।কয়েক ফোঁটা অশ্রু চোখ বেয়ে গালে গড়িয়ে পড়তে সে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো,

—‘বড় বাবা!এ বাড়িতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।এভাবে চললে আমি পাগল হয়ে যাব।’

সিদ্দিকুর রহমান যেন অনেক কিছু বুঝলেন।তিথিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,

—‘কান্নাকাটি করবি না একদম।তোকে বলেছি না,তোর চোখের জল আমার সহ্য হয় না।তুই কি চাস সেটা বল একবার।নিশানটা যে হুট করে কেন এমন করলো!’

সিদ্দিকুর রহমান অন্য মনস্ক হয়ে গেলেন।তার একমাত্র ছেলে নিশান আজ তিনদিন হলো সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছেন।প্রথম শুনে তিনি ঘন্টাখানেক তব্দা মেরে ছিলেন।কারণ তার ধারণা ছিল নিশান হয়তো তিথিকে পছন্দ করে এবং তিথির ভার্সিটি কমপ্লিট হলে চার হাত এক করে দেয়ার ইচ্ছে ছিল।এরই মধ্যে নিশানের এমন কর্মকান্ডে তার সব হিসেব গড়মিল হয়ে গেছে।তিথি মেয়েটার কষ্ট তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন। হাসিখুশি মেয়েটা কিছুদিন হলো বড্ড অন্যরকম হয়ে গেছে।এই পরিবর্তনটা আর কারো নজরে না এলেও তার নজরে ঠিকই এসেছে।তিনি যে জাত উকিল।চট করে মানুষের মনটা পড়ে ফেলতে পারে।তিনি মাথা নিচু করে গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

—‘তিথি তুই কি চাস?’

—‘বড় বাবা আমি এই বাসায় এক মুহূর্ত থাকতে চাই না।আমায় বিয়ে দিয়ে ফেলুন।’

তিথি নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে বলতে সক্ষম হলো।সিদ্দিকুর রহমানের মুখটা থমথমে হয়ে গেল।তাহলে মেয়ের সমতুল্য দ্বিতীয় মেয়েটাও তাকে ছেড়ে চলে যাবে।বিধাতার কি নিয়ম!রেশমা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে তিথির বিয়ে দেয়ার কথা বলছিল।তিথি অনার্স তৃতীয় বর্ষে উঠে গেছে।এখুনি বিয়ে দেয়ার উপযুক্ত সময়।তিনি চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

—‘তুই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস তো মা?না হয় ভার্সিটি কমপ্লিট করে আমরা চিন্তা করি?’

—‘না, বড় বাবা।বিয়ের পর যাতে পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারি তার ব্যবস্থা করবেন।’

তিথি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে সিদ্দিকুর রহমান বললেন,

—“তিথি আর একটু বস আমার পাশে।তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’

তিথি কয়েক পা এগিয়ে আসতে পেছন থেকে কেউ থমথমে গলায় ডাক দিল,

—‘বাবা!’

দু’জনই হালকা ঘুরে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটির দিকে তাকালো।নিশান এসে দাঁড়িয়েছে।তিথি আর এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে সাবধানে বেলকনি থেকে বের হয়ে গেল।ভুলেও নিশানের দিকে তাকালো না।

৩.

তার পরের শুক্রবারে তিথিকে দেখতে এলো।বিকেল বেলা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিল নিশানের বউ তুলি নামের মেয়েটা।তিথির চেয়ে বয়সে ছোট হবে।কলেজে পড়ে হয়তো।তিথি আড়মোড়া ভেঙে মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।বেশ কিছুদিন এক বাসায় থাকার পরো সে মেয়েটির দিকে ভালো মতো তাকায়নি।আজ প্রথম ভালো করে দেখে মনে হলো,কি মিষ্টি মেয়ে।একদম নিশান ভাইয়ের উপযুক্ত।মেয়েটা তার নামের মতোই নরম।তিথির এক বারের জন্য মনে ইচ্ছে জাগলো মেয়েটার গাল দুটো টেনে দিতে।সে নিজেকে সামলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

জলপাই রঙের লং থ্রি পিস পরে, মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে তিথি ড্রয়িং রুমে ঢুকলো।বুকের ভেতর কান্না গুলো যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।বুক চিঁড়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে।সে কি হাউমাউ করে কান্না করে দিবে?কাউকে বলবে তার মন ভাঙ্গার গল্প?কাকে বলবে?

দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজেকে শান্ত করলো।চোখের দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে রেশমার হাত ধরে পাত্র পক্ষের সামনে বসলো।ভুলেও কারো দিকে তাকালো না।নিস্তব্ধতা মাখিয়ে পাত্রপক্ষের সব প্রশ্নের উত্তর দিল।

হঠাৎ কেউ বিষণ্ণ সুন্দর পুরুষালী কন্ঠে একটুখানি বিষণ্ণতা নিবেদন করে বলল,

—‘আপনার হাতের আঙুল গুলো দেখি একটু?’

কন্ঠটা তিথির বুকে খচ করে বিঁধে চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো যেন।নিজের ভেতর কেমন শীতলতা অনুভব করলো।সে কাঁপা কাঁপা হাতগুলো ওড়নার নিচ থেকে বের করে মেলে ধরলো।বিষণ্ণ সুন্দর কন্ঠের মানুষটাকে এক পলক দেখার ইচ্ছে টুকু জলাঞ্জলি দিয়ে একটুপর উঠে পড়লো।

তারপর পাত্রপক্ষের সাথে কি কথা হলো তিথি জানে না।একবার শুধু তার বড় বাবা জিগ্যেস করে গেলেন ছেলেকে পছন্দ হয়েছে কি না।তিথি মাথা নেড়ে সায় জানাতে তিনি হাসিমুখে চলে গেলেন।তার কয়েক ঘন্টা বাদে রাত দশটার দিকে তুলি আর রেশমা মিলে তাকে লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে দিল।তিথি পুরোটা সময় মূর্তির মতো বসে রইলো।

খুবই ঘরোয়া পদ্ধতিতে তার বিয়েটা সম্পন্ন হলো।কবুল বলার সময় চারপাশে তাকিয়ে চির পরিচিত মুখটা খুঁজলো।নিশান ভাই কোথায়?একটিবারের জন্য দেখা দিবে না?শেষ দেখাও দিবে না?একটু পা ছুঁয়ে সালাম করার সুযোগ দিবে না?নিশান ভাইকে কোথাও তার চোখে পড়লো না।

কাজী আর প্রিয়জনদের তোড়জোড়ে সদ্য মন ভাঙ্গা, ভস্ম হয়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে তিথি পরপর তিন বার কবুল বলে দিল।কাকে সে কবুল বলে স্বামীর স্বীকৃতি দিল?কেমন সে মানুষটা?সে কি তার ব্যথিত হৃদয় বুঝবে?তারও কি প্রিয়জন হারানোর কষ্ট আছে?সে কি তার পুড়ে যাওয়া হৃদয়ে একটুখানি বারিধারা বর্ষণ করবে?

ঝাপসা নয়নে রেজিসট্রি খাতায় নিজের নামটা লিখতে নিয়ে আবছা একটা নাম নজরে এলো।ঝর্ণার মতো স্বতন্ত্র গুটিগুটি অক্ষরে লেখা “সম্পদ জুহায়ের”!

বিদায়ের সময় খুব স্বাভাবিক রইলো তিথি।কোনো কান্নাকাটি করলো না।বড় মা,বড় বাবাকে বুকে জড়িয়ে বিদায় জানাল,তুলিকে প্রথমবার নিজে থেকে মাথায় হাত রেখে দোয়া করলো।শেষ মুহূর্তে এসেও চোখ দুটো অন্য একজনকে তন্নতন্ন করে খুুঁজলো।কোথাও সেই অ-প্রিয় মানুষটার মুখোশ্রী নজরে এলো না।

গাড়িতে উঠার সময় তিথির ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখা জোরপূর্বক হাসিটা মুছে গেল।ছলছলে দুটি নয়নে সে সিদ্দিকুর রহমানের হাত চেপে বলল,

—‘বড় বাবা,আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আপনি দোয়া করুন আমার জন্য।’

সিদ্দিকুর রহমান ঝাপসা নয়নে আঠারো বছরের পালিতা মেয়ের মাথায় হাতটা রাখলেন।মন ভরে দোয়া করলেন মেয়েকে।তারপর ভারী বুক নিয়ে অশ্রু লুকানোর জন্য অন্য দিকে তাকালেন।

তিথি শেষ বারের মতো সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে গাড়িতে উঠে গেল।দেড় মিনিট পর গাড়ি স্টার্ট দিতেই তার সহ্যশক্তির বাঁধভাঙা প্লাবন ঘটলো।সে দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল।গাড়ি চলার শব্দ ছাপিয়ে সর্বত্র যেন হাহাকার নেমে এলো।ছেয়ে গেল একটা মন ভাঙ্গার গল্পে।এতদিনের চেপে রাখা সমস্ত কষ্টগুলো যেন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো।দূরে কোথাও ক্রমাগত ডাহুক পাখি ডেকে যাচ্ছে।গাড়ি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পাখির কন্ঠ বেড়ে যাচ্ছে।সেই সাথে তিথির উজাড় করে কান্না করার শব্দ।হঠাৎ কান্নার শব্দ গুলোকে প্রতিহত করে কেউ একজন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—‘আজ থেকে তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ আর দুঃখ পেতে দিবে না।প্লিজ কান্না করে না!’

তিথির কোনো ভাবান্তর হলো না।পরক্ষণে কান্নার বেগ বাড়তে একটা বলিষ্ঠ হাত তার মুখ চেপে রাখা হাতটাতে নরম স্পর্শ করে ধরতে তিথি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।

(চলবে)