প্রেম পায়রা পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
1562

#গল্পের_নাম:|| প্রেম পায়রা ||
#লেখনীতে:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব______২২ (শেষ/সমাপ্তি পর্ব)

৩৪.

তিথির মাথাটি সম্পদের কাঁধে রাখা।তার দৃষ্টি সামনের বিস্তর জলরাশি আর তার সৌন্দর্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।আপাতত তারা হাইয়াত পার্কে বসে আছে।দুপুরে লাঞ্চ করে তারা বের হয়েছিল।এখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।সানসেট দেখে তারা তারপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।

সম্পদ তিথির হাত চেপে উঠে দাঁড়ালো।খালি পায়ে বালির উপর দিয়ে হাঁটলো কিছুক্ষণ।নদীর স্বচ্ছ জলে পা ভেজাল।চারিদিকে হিম শীতল বাতাস।বাতাসের বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে যেন।বাতাসের প্রতিটি ঝাপটা লোমকূপ কাঁপিয়ে দিচ্ছে।তিথি শাড়ির উপর দিয়ে গায়ে লং কোট পড়েছে।রাত যত বাড়বে শীত তত বেড়ে চলবে।হঠাৎ সম্পদ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তিথির মাথার খোলা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল।নিজের মাথার টুপিটা খুলে তার মাথায় পড়িয়ে দিল।

সরে গিয়ে দুজন পাথরের উপর বসে পড়লো।সূর্য ততক্ষণে নদীর জলে ডুবে যাচ্ছে।একটু একটু করে সামনের বিস্তীর্ণ জলরাশি গিলে খাচ্ছে সূর্যকে।শেষ বিকেলের সূর্যের রক্তিম আভা বিচ্ছুরিত হয়ে জলের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।ঢেউয়ের তালে তালে নানা রকম নকশা তৈরি হচ্ছে।কি সুন্দর লাগছে!তিথি মুগ্ধ হয়ে সম্পদের হাত খামচে ধরলো।

হঠাৎ করেই দূর আকাশে দুটো যুগলবন্দী পায়রা উড়ে যেতে দেখলো সে।তিথির কল্পনা কি না জানা নেই!সে দেখলো,পায়রা দুটো সমান তালে উড়ে চলেছে।একটা পিছনে, তো একটা সামনে নয়!গাণিতিক ভাবে মেপে মেপে যেন ছুটে চলেছে।এতটা কাছাকাছি হয়ে উড়ে চলেছে যে একে অপরের পাখার সাথে স্পর্শ করে যাচ্ছে।দূর থেকে তাদের একক মনে হচ্ছে। এত দূর থেকেও যেন তাদের একে অপরের প্রতি বন্ধন দেখে মুগ্ধ হলো।সে ফিসফিস করে সম্পদের কানে কানে বলল,

—‘প্রেম পায়রা!’

৩৫.

#পরিশিষ্ট:

—‘তিথি,দেখো তো আমায় কেমন লাগছে?’

পাঞ্জাবির হাতা সামান্য গুটিয়ে, কলার ঠিক করতে করতে বলল সম্পদ।তিথি গভীর আগ্রহ নিয়ে সম্পদের দিকে তাকালো।সম্পদের পরণে জিন্সের সাথে ব্ল্যাক কালারের পাঞ্জাবি।মাথার চুল সুন্দর মতো ব্রাশ করা।অল্প কিছু চুল কপাল স্পর্শ করেছে।খাড়া নাক,পুরু ঠোঁট,মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর দুটো স্বচ্ছ চোখ নিয়ে কি দূর্দান্ত চেহারা ছেলেটির!দিন কে দিন তার সৌন্দর্য যেন আরো বেড়ে চলেছে।দুই বছরের বেশি সময় হলো ছেলেটার সাথে একত্রে থাকা।তবুও প্রতি মুহূর্তে নতুন করে মানুষটার প্রেমে পড়ে সে।প্রতিটি সেকেন্ডে তার ভালোবাসার পাগলামি দিয়ে বাধ্য করে তাকে প্রেমে ফেলতে!

তিথি আরো প্রেমে পড়তে চায়!প্রতি বছর,প্রতি মাস,প্রতি দিন,প্রতি ঘন্টা, প্রতি মিনিট!এমনকি প্রতি সেকেন্ড!সে হাজার বার নয়,লক্ষ কোটি বার শুধু এই মানুষটার প্রেমে মরতে চায়।এই মানুষটার ভালোবাসায় খুন হতে চায়।

দশ মাস আরো অল্প কিছু দিনের ভরা পেট নিয়ে তিথি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো।বিছানা থেকে ফ্লোরে পা রাখার আগেই সম্পদ দৌঁড়ে এসে তাকে বাঁধা দেয়।তিথিকে দু হাতে আগলে ধমকের সুরে বলে উঠে,

—‘এই অবস্থায় নড়াচড়া করছো কেন তিথি?তুমি একদম কথা শোনো না।তোমার পিছনে সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থেকেও সামলাতে পারি না।চোখের পলকে এটা ওটা করে বসো!’

তিথি মিষ্টি করে হাসলো।দু হাতে সম্পদের কলার ধরে টান মেরে কিছুটা কাছে নিয়ে আসলো।সম্পদ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—‘কি,করছো কি?’

তিথি উত্তর দিল না।পাঞ্জাবির কলার টেনেটুনে ঠিক করে দিল।সামনের দুটো বোতাম লাগিয়ে দিল।মাথার চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

—‘মাই পার্সোনাল প্রোপার্টি!তুমি দিন দিন আরো সুদর্শন হয়ে যাচ্ছো!যেটা বড্ড চোখে লাগে।এত সুন্দর হওয়ার কি দরকার?এদিকে আমি বাবু পেটে আসার পর থেকে কেমন মুটিয়ে যাচ্ছি।আ……’

সম্পদ তিথির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।কিন্নর কন্ঠে বলল,

—‘বাবু পেটে আসার পর থেকে তোমার সৌন্দর্য্য কত গুণ বেড়ে গেছে, কোনো আইডিয়া আছে তোমার?সমস্ত শরীরে কেমন আলাদা একটা মায়া এসে ভর করেছে!আলাদা একটা গন্ধে তোমার চারপাশ ভরে থাকে সবসময়।আলাদা একটা উজ্জ্বলতায় আমার চোখ ধাঁধিয়ে যায়।আহা!আমার চোখ দিয়ে যদি তোমার সৌন্দর্য তোমায় দেখাতে পারতাম!তুমি চমকে উঠতে!এত সুন্দর কেন তুমি?বার বার,হাজার বার!তোমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে।’

—‘সব আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলা।বুঝি তো!’

—‘এই একদম চুপ!এবার নিচে চলো।’

—‘যাব, তার আগে তোমার ব্যবস্থা করি।আজ বাড়িভর্তি মেহমান।আর তুমি মেয়েদের সামনে এত সেজেগুজে ঘোরাফেরা করবে?জাস্ট ইসপসিবল।’

বলে তিথি অপেক্ষা করলো না।সম্পদের মুখের সর্বত্র দু হাত দিয়ে ঘঁষা দিয়ে স্নো জাতীয় জিনিসটা উঠিয়ে ফেলল।পান্জাবির একটা হাতা কনুইয়ের উপরে তুলল।আরেকটা টান টান করে কব্জি পর্যন্ত করলো।মাথার চুল নেড়েচেড়ে অবিন্যস্ত করে দিল।কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

—‘আজ স্নেহার বিয়ে।তোমার নয়!তুমি এক কাজ করো।জিন্স খুলে ফেলো!জিন্স খুলে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরো!’

সম্পদ বিস্ফারিত নয়নে বলল,

—‘কি?পাঞ্জাবির সাথে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট?তিথি তুমি পাগল হয়ে গেছো।এভাবে মেহমানের সামনে গেলে স্নেহার বিয়ে ভেঙে যাবে।ওর প্রেমিক ডাক্তার বর বেঁকে বসে বলবে, স্নেহা তোমার ভাই বাংলাদেশের টপ মেন্টালদের মধ্যে একজন।দুঃখীত, তোমায় বিয়ে করতে পারবো না।’

—‘আচ্ছা, আচ্ছা!ঠিক আছে।এইভাবেই চলো!’

সম্পদ হাসিমুখে তিথিকে ধরে দাঁড় করালো।তিথির পরণের কালো শাড়ির আঁচল গুটিয়ে দিয়ে বলল,

—‘খুব সাবধানে!’

তিথি সম্পদের হাত চেপে এগিয়ে চলল।তার কনসিভ করার পর থেকে সম্পদ টোটালি পাগল হয়ে গেছে।সারাক্ষণ তার পিছু ছাড়ে না,দুই মাস হলো একেবারে অফিস যা-ওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে।তাকে সময় মতো খাবার খাওয়ানো,মেডিসিন খাওয়ানো,ঘন ঘন মুড সুইং এর সময়টাতে আগলে রাখা!সব করেছে সব!সম্পদের প্রতিটি কর্মকান্ড দেখে আর মনে মনে ভাবে,এতটাও ভালোবাসা যায় কাউকে?কি করে সম্ভব?

সমস্ত বাড়ি লাইটিং আর বাহারি ফুলে ছেয়ে আছে।বাড়িভর্তি প্রচুর মানুষ।যার বেশিরভাগ মানুষ তিথির অচেনা!সে বসে আছে ড্রয়িং রুমের এক কোণায় সোফায়।সম্পদের কড়া নির্দেশ।এখান থেকে যেন এক পা না নড়ে।হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে গেছে।কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে যেন ফোন করে।

সম্পদ ছুটোছুটি করে সব সামলাচ্ছে।একটু পর পর আড়চোখে তিথির দিকে নজর দিচ্ছে।আবার কাজ করছে!

সোবাহান সাহেবের আজ সবচেয়ে খুশির দিন।এই মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন।মেয়েটা ছোটবেলা থেকে মায়ের ভালোবাসা পায়নি।একবার তো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেছে।অথচ এই দুটো সন্তান নিয়ে তার যত কল্পনা জল্পনা।কত কঠিন কাজ করেছেন তিনি এই সন্তান দুটোকে রক্ষার জন্য।তাদের ভালো ভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।বাবা হলে বোধ হয় মানুষের মধ্যে অন্য সত্তা বসবাস করে।যৌবন থেকে শুরু করে এতগুলো বছর তিনি সম্পূর্ণ একা বসবাস করেছেন।মাঝে মধ্যে ভাবনা গুলিয়ে গেলে সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতো।তাদের দুঃখ, কষ্টের দিক খেয়ালে আসতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতো।নারীর প্রতি যে তার আজন্ম ভয়!সেজন্য একটিবারের জন্য মনে হয়নি দ্বিতীয় বিয়ে করার!

মুহুর্তে তার ছলছল দৃষ্টি ছাপিয়ে সামনের দৃশ্য গুলো অস্পষ্ট হয়ে উঠলো।আশপাশের এত কোলাহল, এত আনন্দ কিছুই কর্ণকূহরে প্রবেশ করলো না।হঠাৎ একটা মেয়েলি কন্ঠ কানে আসলো।যে বার বার ‘বাবা’ বলে ডাকছে।তিনি পেছনে তাকালেন।তিথি ডাকছে তাকে!
হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে তিথির কাছে আসলেন তিনি।মুখে প্রশান্তির হাসি ঝুলিয়ে বললেন,

—‘বৌ মা!তোমার বাবার বাড়ির লোকজন আসছে না কেন এখনো?’

—‘একটু আগে ফোন দিয়েছিলাম বাবা।এসে পড়বে।নিশান ভাইয়ের ছেলে তূর্যর অল্প জ্বর।সেজন্য আসতে দেরি হচ্ছে।’

—‘অহ!’

সোবাহান সাহেব থেমে গেলেন।তিথি তার মুখের দিকে চেয়ে দেখলো কেমন অস্থির অস্থির ভাব।কিছু একটা বলতে নিয়ে যেন জড়তা পাচ্ছে।তিথি অনুরোধের স্বরে বলল,

—‘বাবা!আপনি কি কিছু বলতে চান আমায়?কোনো আড়ষ্ট করবেন না।বলুন বাবা।’

সোবাহান সাহেব চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে আরো একটু কাছাকাছি এলেন তিথির।তার চোখে মুখে গভীর বিষাদের ছাপ।তিনি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,

—‘কিছু কথা বহু বছর ধরে নিজের মধ্যে চেপে রেখেছি।কাউকে বলিনি।আজ কেন জানি তোমায় বলতে ইচ্ছে করছে বৌ মা।কতটা বলতে পারবো জানি না।তবে এটুকু বলি যে আমি আমার বাষট্টি বছরের জীবনে একটা গর্হিত অপরাধ করেছি।ভয়ংকর পাপ করেছি।যদিও এই পাপ করে আমার একটুও অনুশোচনা নেই।কিন্তু পাপ তো পাপই!সেজন্য তার শাস্তি পেয়েছি।অকালে পঙ্গু হয়েছি।তাতেও আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই।বরং অনেক সুখী মনে হয় নিজেকে।এই ঘরবন্দী জীবন ভালো লাগে।কারন একজনের পাপকে আমি পাপ দিয়ে মুছে ফেলেছি।আমার সেই পাপের বিনিময়ে ছেলের সুখের সংসার দেখে যেতে পারছি,মেয়ের মুখের হাসি দেখে যেতে পারছি।এতেই আমি সন্তুষ্ট।হয়তো মরার পরে পরকালে পরম করুণাময় আমায় শাস্তি দিবেন!তবুও আমি বলবো, এই পাপটা আমি সন্তানদের মঙ্গলের জন্য করেছি।’

তিথির বুকের ভেতরটা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো!তার শ্বশুর কি এমন পাপ করেছে?কি বলছে এসব?সোবাহান সাহেব আবার মুখ খুললেন,

—‘স্নেহার যখন তিন বছর বয়স তখন আমার খুব কাছের একজন তাকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। সম্পদের খাবারে বিষ মিশিয়ে রেখেছিল।একটুর জন্য আমি আমার সন্তানদের হারিয়ে ফেলিনি।শেষ মুহূর্তে তাদের বাঁচাই!তবে তাদের সুস্থ মতো ফিরে পেয়ে অনেক বড় একটা কাজ করি।সেই মানুষটাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলি!’

তিথির মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হলো।হাত পা অসম্ভব কাঁপতে লাগলো।চোখ বেয়ে পানি ঝরতে তার মনে পড়লো সম্পদের মায়ের কথা।তার জানামতে সম্পদের মা এক্সিডেন্টলি আগুন পুড়ে মারা গেছেন।তিনি রান্না করা অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে গেছিল।সে ভেজা চোখে সোবাহান সাহেবের দিকে তাকালো।সোবাহান সাহেবের চোখ ছলছল করছে।তিনি অনুতপ্ত কন্ঠে বললেন,

—‘ওই মানুষটিকে আমি ভালোবাসতাম।কিন্তু সে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল।ব্যভিচারে লিপ্ত ব্যক্তিকে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা উচিত।আমি অবশ্য সেসব ভেবে কাজ করিনি।হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে কাজটা করেছি।আমার এই কাজের কথা আমি বাদে পৃথিবীর কেউ জানে না।আজ তুমি জানলে!
তুমি কি আমায় ঘৃণা করছো বৌ মা?’

তিথি কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—‘না বাবা!’

—‘ঘৃণা করা উচিত।তবে জানো কি?সম্পদ আর স্নেহা আমার নিঁখাদ ভালোবাসার ফুল!সেজন্য ওদের চরিত্র বিন্দুমাত্র কলুষিত নয়।আমার দেখা পৃথিবীর সেরা মানুষদের তালিকায় ওরা থাকবে।ওদের উপর মায়ের ছায়া পড়তে দেইনি।মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলেছি।ওদের মা যখন মারা যায় তখন দুজনেই অনেক ছোট ছোট!ওদের আজকের অবস্থানে আনার জন্য আমার অনেক চড়াই উৎরাই পার করতে হয়েছে।অনেক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছি।তবুও দিনশেষে আমার জয় হয়েছে।একটা মা যেমন সন্তানের মঙ্গলের জন্য হিতাহিত বোধ শূন্য হয়ে যায়, আমিও তেমন!আমাকে যে ওদের মায়ের জায়গা নিতে হয়েছে!মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে!আমি আসছি!’

সোবাহান সাহেবের কন্ঠ ধরে এলো।তিনি চাকা ঘুরিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন।তিথি বাঁধা দিল না।উনার একাকী সময় কাটানো প্রয়োজন।আজকের এই বিশেষ দিনে উনি চোখের জল ফেলবেন।আনন্দের জল!

তিথি তব্দা মেরে পড়ে আছে।মানুষের জীবন কত বিচিত্র!আজকের এই অমোঘ সত্যটি সে স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলল।সবার আড়ালে চোখ মুছে দাঁড়াতে নিতে পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে।সে এক হাতে পেট চেপে ধরলো।ঝাপসা চোখে সম্পদকে খুঁজলো।কোথাও চোখে পড়লো না।সে আর কাউকে ঘাঁটাল না। বিয়েতে আসা একটা মেয়ের হাত ধরে রুমে চলে এলো।বিছানায় শোওয়ার পর তার ব্যথা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।সে দাঁত কামড়ে পড়ে রইলো।বরযাত্রী আসার সময় হয়ে গেছে।সম্পদকে কিছুতেই পেট ব্যথার কথা জানানো যাবে না।বুঝতে দেয়া যাবে না।
_________

বরযাত্রীর সাথে স্নেহাকে বিদায় দেয়ার পর সম্পদ জানতে পারলো তিথির অসুস্থতার কথা।মুহুর্তে তার ভেতরে ভাঙচুর হয়ে গেল যেন!রাত দশটার দিকে তিথিকে হাসপাতালে নিয়ে যা-ওয়া হয়।কর্তব্যরত মহিলা ডাক্তার নার্সের সাহায্যে তাকে কেবিনের ভেতর নেন।শেষ মুহূর্তে মহিলা ডাক্তার সম্পদকে বাইরে বের হতে বলে।কিন্তু সে গোঁ ধরে বসে থাকে।কিছুতেই বাইরে বের হবে না।তিথির হাত চেপে এখানেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।তিথির সাহস প্রয়োজন।কিছুতেই যাবে না।সে বিদেশের হাসপাতালগুলোর প্রসঙ্গ টেনে তুললো। যেখানে ডেলিভারির সময় স্বামীরা স্ত্রীদের পাশে থাকে।মহিলা ডাক্তার এবার হতাশ সুরে বললেন,

—‘আমি আপনার কথা ভেবেই চলে যেতে বলছি।বাচ্চা প্রসবের সময় আপনার স্ত্রীর যতটা কষ্ট হবে তা নিজ চোখে দেখে সহ্য করতে পারবেন না।তার চেয়ে আপনি হসপিটালের বাইরে অবস্থান করুন।’

সম্পদের চোখে মুখে আতংক এসে গ্রাস করেছে।তার দৃষ্টি সাদা চাদরের উপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির উপর।বাম হাতে টান পড়তে সে পেছন ঘুরে তাকালো।নিশান আর তুলি এসে দাঁড়িয়েছে।সম্পদ ছলছল চোখে নিশানের দিকে তাকাতে নিশান তাকে জোর করে টেনে বাইরে নিয়ে গেল।কেবিনের দরজা বন্ধ হতে সম্পদ নিশানকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো।নিশান হতভম্ব!সাথে হাসপাতালে আসা প্রতিটি ব্যক্তি!

__________

তিথি চোখ খুলে মাথার উপর ছাদ আবিষ্কার করলো।কিছুক্ষণ সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করলো কোথায় রয়েছে সে।মাথা সামান্য কাত করতে সম্পদের ক্লান্ত চেহারা নজরে এলো।তার স্যালাইন মুক্ত ডান হাত চেপে বিছানায় মাথা রেখে আছে সম্পদ। দু চোখ বন্ধ তার।মুখের উপর থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ এখনো যায়নি।গালে পানির শুষ্ক বলিরেখা।তিথি খুব সাবধানে ডান হাতটা ছাড়িয়ে সম্পদের মাথায় হাত বুলাল।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো।তিথির হাত চেপে তার দিকে ঝুঁকে একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—‘তিথি তুমি ঠিক আছো?এখন কেমন লাগছে?পেট ব্যথা কমেছে?দূর্বল লাগে?বলো,তুমি ঠিক আছো তো?’

তিথির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ডান হাতটা উঁচু করে সম্পদের গাল স্পর্শ করলো।টলমল চোখে বলল,

—‘আমি একদম ঠিক আছি।ছি!মাত্র কয়েক ঘন্টায় নিজের কি হাল করেছ তুমি?কি পঁচা দেখতে লাগছে!’

সম্পদের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তিথির হাতটা বুকে জড়িয়ে নিল।সমস্ত হাতে ভেজা চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে পাশে বসে পড়লো।কেবিনের দরজায় নক পড়তে দুজন সেদিকে তাকায়।নিশান এগিয়ে আসছে।তার গলায় ক্যামেরা ঝুঁলানো।তিথি অবাক হয়ে বলল,

—‘নিশান ভাই, আপনার গলায় ক্যামেরা ঝুলানো কেন?’

—‘আর বলিস না! স্নেহার বিয়েতে ফটোগ্রাফার আসেনি।বাধ্য হয়ে আমাকে ছবি তুলতে হলো।পরে খুলে রাখার কথা আর মনে নেই।শোন, তূর্যসহ বাবা মাকে বাসার উদ্দেশ্যে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি।তুই ঘুমিয়ে ছিলি তখন।সকালে আসবে সবাই। তোর শ্বশুর আর স্নেহাকে এসএমএস কর জানিয়ে দিয়েছি যে, মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছে। দাঁড়া!তোদের মেয়েকে দেখবি না?’

নিশান হাসিমুখে দরজার দিকে তাকিয়ে তুলিকে ডাক দিল।তৎক্ষনাৎ তুলি ভেতরে ঢুকলো।তার হাতে শুভ্র টাওয়ালে মোড়ানো পিচ্চি একটা মেয়ে।সে হাসিমুখে দুজনের মাঝে তাকে শুইয়ে দিয়ে বলল,

—‘তোমার মেয়ে কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে আপু!’

সম্পদের গলা শুকিয়ে আসছে।এই বিড়ালের বাচ্চার মতো পুঁচকিটা কবে বড় হবে?ইয়া মাবুদ!পুঁচকিটা বড় বড় চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।সে অবাক হয়ে বলল,

—‘তিথি,এই তিথি!তোমার মেয়ে এত রাত অবধি জেগে রয়েছে কেন?ওই দেখো,ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ওকে ঘুমাতে বলো!’

—‘তোমার মেয়ে তুমি ঘুমাতে বলো!’

—‘আমার কথা শুনবে?দেখা যাক!সোণামণি ঘুমিয়ে পড়ো।পাপা হুকুম করেছে!’

সম্পদের সন্দিহান কথায় সবাই ফিক করে হেসে ফেলল।তিথির মনের ভেতর একরাশ নতুন অনুভূতি।সে আস্তে করে কাত ঘুরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিল।আশ্চর্য!মেয়ে তার কোলে গিয়েও বড় বড় টানা চোখে সম্পদের দিকে চেয়ে আছে।সম্পদ এক হাতে তিথির হাত চেপে আরেক হাতে ভয়ে ভয়ে পুঁচকিটার হাতের আঙুল স্পর্শ করলো।সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো।তিথি এ কি নতুন সুখের সন্ধান দিল?এ কি নতুন অনুভূতির সাক্ষী করলো?এই মেয়েটার এত ঋণ সে কি করে শোধ করবে?

সম্পদ গভীর আবেগে কাঁদছে।তার এক হাত তিথির হাতের ভাঁজে, আরেক হাত সদ্য জন্ম নেয়া মেয়েটার আঙুল আঁকড়ে আছে।তিথি টলমল চোখে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সম্পদের দিকে চেয়ে আছে।আর তাদের মেয়ে ‘সততা জুহায়ের’ টানা টানা চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিশানের মনে হলো এত চমৎকার একটি দৃশ্য পৃথিবীতে বিরল।একে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সে গলায় ঝোঁলানো ক্যামেরা দিয়ে পর পর কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল।ভালোবাসার এমন মুহূর্তগুলো চির অম্লান হয়ে থাক!

*সমাপ্ত*

আসসালামু আলাইকুম।অবশেষে গল্পটার ইতি টেনে দিলাম।সম্পদ+তিথির এই জার্নিতে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে।চাইলে গল্পটা আরো বড় করা যেত।মেহেন্দি, গায়ে হলুদ,বিয়ে, রিসেপশন,দু চারটে নেগেটিভ চরিত্র ইত্যাদি যোগ করে।কিন্তু এসব যোগ করার ইচ্ছে নেই।আমি সবসময় চেষ্টা করি,গল্পগুলো নেগেটিভ চরিত্র বিবর্জিত লিখতে এবং ভবিষ্যতেও লিখবো।নেগেটিভ চরিত্র আমার গল্পে এলাউড না!(নিতান্ত বাধ্য না হলে)!আমরা আশাবাদী,আমাদের চারপাশের বাস্তবতা আমাদের কল্পনার মতোই সুন্দর এবং পজিটিভ হয়ে উঠুক।

বিঃদ্রঃ এক লাইন করে আমার লেখালেখির ত্রুটি(অবশ্যই ত্রুটি) বলে যাওয়ার অনুরোধ রইলো।যাতে সেই অংশটা ইমপ্রুভ করতে পারি।🤎