বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব-৭১

0
647

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৭১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

বেশ কিছুক্ষণ ধরে পূর্ণর পাশে উত্তরের আশায় বসে আছি, প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। তবু উনি যেন দেখেও না দেখার ভান করে একধ্যানে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন বিছানায় বসে। অবশেষে অতিষ্ঠ ভংগীতে তার পাশ থেকে উঠে সামনে গিয়ে দাড়ালাম, কোলের উপর থেকে ল্যাপটপ নিয়ে সাইড টেবিলে রেখে দিলাম। এতকিছুর পরেও উনার ভাবভঙ্গীর বিশেষ পরিবর্তন হলোনা, বরং স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শান্তভাবে বলে উঠলেন,

—ল্যাপটপ সরালে কেন? তুমি বসবে নাকি কোলে?

আচমকা উনার এমন কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে এতক্ষণ মনে মনে যা ভেবে রেখেছিলাম সব ভেস্তে গেলো। কিছুক্ষণ চেস্টা করেও পুনরায় শব্দবিন্যাসে সক্ষম হলাম না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সুধালাম,

—এসব কিন্তু ঠিক না বুঝেছেন?

—কি ঠিক না, তুর পাখি?

—এই যে এখন আপনি যেটা করছেন। আমায় আংশিক কথা বলে বাকিটুকু বলছেন না, এখন তো পুরোটা না শুনা পর্যন্ত আমি ভেতরে ভেতরে শান্তি পাচ্ছিনা। মন আকুপাকু করছে বারবার! দিস ইজ নট ফেয়ার!

আমার উদ্বিগ্নতায় মৃদু হাসলেন পূর্ণ। যে হাসি এ মুহুর্তে মেজাজ বিষিয়ে দিলো। বুঝলাম উনি বলার মুডে নেই, এখন কোনোকিছু করেই লাভ হবেনা। তার একরোখা স্বভাবে বিরক্ত হয়ে চোখমুখ কুচকে চলে যেতে উদ্যত হলেই হাত ধরে থামিয়ে দিলেন। শুধু থামিয়েই ক্ষ্যান্ত হলেন না, হাত টেনে নিজের কোলেই বসিয়ে নিলেন রীতিমতো! অতঃপর রাগের বশে ফুলে যাওয়া আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,

—এটুকুতেই এত অধৈর্য? আমি তোমার জন্য এত বছর অপেক্ষা করেছি আর তুমি আমার জন্য এটুকু ধৈর্যও ধরতে পারবেনা? এটাও তো ঠিক না, তাইনা?

ব্যস! সময় মতো আমার দূর্বল জায়গায় আঘাত করে বসলেন। উনি জানেন এই একটা কথায় তাকে কিছু বলতে পারবোনা তাই হয়তো সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। পূর্ণর কথায় আবেগী হয়ে অস্থিরতা কিঞ্চিৎ কমে এলো, দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে উদাস চোখে চেয়ে বললাম,

—আপনি তো জানেনই আমার ধৈর্য কম, তাহলে এমন করছেন কেন? বলুন না প্লিজ? আমার সত্যিই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব৷ কিভাবে চিনেছিলেন আমায়? আর যদি জানতেনই তবে আমাকে বলেননি কেন? আর ইগ্নোর-ই বা কেন করতেন বিয়ের আগে? ভালোভাবে কথা বলা তো দূর, তাকাতেনও না ঠিকমতো৷ আমি তো কখনো বুঝতেই পারিনি আপনি বিয়ের আগে আমায় চিনেছিলেন!

আমায় এত্তগুলো প্রশ্নের ঝুলি মেলতে দেখে কপালের মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো উনার। আলতোভাবেই আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে তার বুকে স্থান দিলেন। সেখানে মাথা রাখতেই চুলে হাত বুলানোর মাঝেই বলে উঠলেন,

—এত প্রশ্ন? একটু শান্ত হও। তুমি বড্ড অস্থির, তুর পাখি। এত চঞ্চল হলে হয়? আমি একটা বিশেষ দিনে বলার জন্যই মূলত কথাটা এখনো জানাইনি তোমায়। আজ নেহাৎ-ই তুমি ওমন কথা বললে দেখেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে! তাই আপাতত এটুকুই জানো যে আমি বিয়ের আগেও তোমায় চিনতাম। কারণটা যেদিন বলার জন্য ভেবে রেখেছি সেদিনই বলবো। এর আগে নয়!

—এটা কোনো কথা নয় কিন্তু…

—কোনো কিন্তুই নয়। কথা এখানেই শেষ।

—আরে শুনুন না…

অতঃপর কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে বসলেন উনি। লজ্জায়, হতভম্বতায় কথা বলার উপায় থাকলোনা আর। ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে আমায় কোল থেকে নামিয়ে পুনরায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে অন করতে করতে গম্ভীর মুখে বললেন,

—হুট করে এভাবে যখন-তখন কোলে বসার কোনো মানে হয়, তুরফা? তুমি এত দুস্টুমি করলে আমি কাজ করবো কিভাবে? প্লিজ কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ।

চোখ পাকিয়ে তার দিক কিছুক্ষণ চেয়েও লাভ হলোনা, উনি নিজের মতো কাজ করছেন। জানতাম এমন কিছুই হবে! তাই উনার কথায় হতাশ চোখে তাকানো ছাড়া আর কিছুই করার ইচ্ছে হলোনা। রুম থেকে বেরোনোর আগে দাতে দাত চেপে বললাম,

—আপনি একটা অসহ্যকর। একটা কথাও তো নিজে থেকে বলেন না আমায়, আমাকেই জিজ্ঞেস করে শুনে নিতে হয়। তাই এখন আপনার সাথে কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছে নেই, বুঝেছেন? কাজ-ই করুন! আপনার কথা আর শুনতেও চাইনা আমি। যেদিন বলতে চাইবেন ওইদিনও শুনবোনা!

কথাগুলো বলে দরজার দিকে যেতেই কানে এলো তার শান্ত কণ্ঠস্বর। ধীর গলায় বললেন,

—তুমি বুঝোনি কারণ আমি তোমায় বুঝতে দিইনি। যদি তোমাকে ভালো না-ই বাসতাম তবে তোমায় চোখে চোখে রাখতাম না। নিজের ভাইয়ের ইংগেজমেন্টের দিন খাওয়া বাদ দিয়ে তোমার জন্য মলম আনতে ছুটতাম না। যদি তোমাকে না-ই দেখতাম তবে মেঘলা দিনেও সানগ্লাস পড়ে তোমার সামনে যেতাম না। শুধু পার্থক্য এটাই যে আমি বিয়ের আগে নিজের অনুভূতি তোমার সামনে প্রকাশ করতে চাইনি, তোমাকে সময় দিতে চেয়েছি। আপাতত এটুক জানলে কি চলবে না, তুরফা রানী?

কর্ণকুহরে তার বাক্যগুলো এসে পৌঁছাতেই পা-জোড়া নিজ হতেই থেমে গেলো! এক পলক পেছন ফিরে তাকাতেই তার স্নিগ্ধ চোখজোড়ায় চোখ পড়লো। হঠাৎ করেই হৃদযন্ত্র যেন একটা হার্টবিট মিস করলো!

______________________

ড্রয়িংরুমে বসে আছি সবাই। আপাতত পরিবেশে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। তার কারণ পূর্ণ ও বড়াব্বুর মধ্যে একদফা কথা কাটাকাটি হয়েছে ইতোমধ্যেই। কারণটা যে আমার এডমিশন রেজাল্ট এটা বলার উপেক্ষা রাখেনা। বড়াব্বু এখন চাইছেন আমি যেন রাজশাহী যাই। পূর্ণর সেদিনের কথায় বলা চলে তার উপর চটে আছেন তিনি। কিন্তু পূর্ণ তো পূর্ণ-ই। তার ইচ্ছা না হলে কথা বের করবেন না মুখ থেকে, এক্ষেত্রেও নীরবতা পালন করছেন। উনার বাবা যে তাকে ভুল বুঝে বসে আছে সেদিকে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই যেন তার! তাই আমি উনার হয়ে সেদিনের কথার পেছনের কারণ বড়াব্বুকে বললেও তিনি মানতে নারাজ, তার মনে হচ্ছে আমি পূর্ণর সাফাই গাইতে এসব বলছি। বুঝলাম উনারা বাপ-বেটা দুজনেই সমান একরোখা, নিজে যা বুঝবেন সেটার নড়চড় হবেনা। তাই বড়াব্বুকে বুঝানোর হাল ছেড়ে দিয়ে বড়াম্মুর দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই তিনি বুঝে গেলেন আমার মনের কথা। হালকাভাবে মাথা নাড়িয়ে বড়াব্বুকে বললেন,

—কি গো, এত রাগ করলে হয়? ছেলেকে তো তুমি চিনোই। ও কি তুরফাকে ইচ্ছা করে কস্ট দেওয়ার মতো কিছু বলতে পারে তুমি নিজেই বলো? বাচ্চারা যখন কেউ চাইছেনা দূরে থাকতে তখন তোমার রাজি হতে সমস্যা কোথায়?

—তোমার ছেলে উপর দিয়ে চুপচাপ হলেও ভেতরে ভেতরে কি সেটা আমি ভালোই জানি, বুঝেছো? আমি জানি তুরফা এখানে থাকতে না চাইলেও ও শুনবেনা, ওর উপর জোর করে নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিবে।

তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলেন বড়াব্বু। এবার বোধহয় পূর্ণ জ্বলে উঠলেন খানিকটা। সরু চোখে সেদিক তাকিয়ে অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,

—তুমি যখন আমাকে চিনোই তখন ওকে রাজশাহী পাঠাতে চাচ্ছো কেন, বাবা? জানোই তো আমি যেতে দিবোনা। অযথা সিনক্রিয়েট করার কি মানে হয় তাহলে? তুরফা এখানেই থাকছে ব্যস! কথা শেষ।

—ভুলে যেয়োনা আমি তোমার বাবা। তোমার এসব জিদ আমার উপর চলবেনা, বুঝেছো? তুরফা মা, তুই নিশ্চিন্তে রাজশাহী যা। আমিও দেখি এই বেয়াদবটা তোকে কিভাবে আটকায়!

—ফাইন! আমি ওকে আটকাবোনা। ওকে যেখানে ইচ্ছা পাঠিয়ে দেও।

পূর্ণর গম্ভীর কণ্ঠে থমকে গেলেন বড়াব্বু। চমকে উঠলাম আমি, একিসাথে রুমের বাকিদেরও একি অবস্থা। কেউ যেন এত সহজে তার রাজি হওয়ার ব্যাপারটা আশা করেনি! বড়াব্বু কিছুটা থেমে ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলেন,

—সত্যি বলছো? তুমি আসলেই রাজি তো?

—হুম।

উনার এত ঠান্ডা রিয়েকশন দেখে আড়চোখে তার দিক তাকালাম। কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না হঠাৎ করে। ঠিক এমন সময় পূর্ণ এক পলক আমার দিক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে আবার বড়াব্বুর দিক তাকিয়ে বললেন,

—তুরফা যদি রাজশাহী যায়, তাহলে আমিও ওর সাথে যাবো।

—কিসব ছেলেমানুষী কথা বলছো তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? তুমি রাজশাহী গেলে অফিস কে করবে?

—সেটা তোমার ব্যাপার। বিয়ে যেহেতু করেছি, ওর দায়িত্ব নিয়েছি তাই এখন সেখান থেকে তো পিছপা হতে পারবোনা, তাইনা? দূর থেকে কি ঠিকভাবে আমার বউয়ের খোজখবর রাখতে পারবো? তুমি নিজেই বলো। আর ওখানে যেয়ে যদি ওর কোনো বিপদ হয় তবে আমরা কি সময়মতো সে খবর পাবো? চাচ্চুদের সময় আমরা দূরে ছিলাম বলেই এত অঘটন ঘটেছে। তখন যদি সময়মতো খবর পেতাম তবে হয়তো শেষবার তাদের দেখার সুযোগ হতো। তুরফাকেও হারাতে হতোনা আমাদের।

শেষের কথাগুলো বলার সময় পূর্ণর কণ্ঠ কিছুটা কেপে উঠলো! এবার উনার কথায় যেন পিনপতন নীরবতা ভীড় করলো কক্ষজুড়ে! বড়াব্বু পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে নিচের দিক চেয়ে আছেন, বাকি সবাইও নিশ্চুপ। এতদিন পর বাবা-মায়ের শেষ স্মৃতির কথা স্মরণ হতেই চোখে ভর করলো নোনাজল। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই পাশ থেকে আমার হাত চেপে ধরলেন পূর্ণ। চোখ তুলে উনার দিক তাকাতেই আলতোভাবে চাপ দিলেন হাতের তালুতে, যেন আশ্বাস দিচ্ছেন উনি আছেন আমার পাশে, সর্বদা সব পরিস্থিতিতে! ভরসার হাত পেয়ে কিছুটা শান্ত হলো মন!

এমন সময় নীরবতা ভেঙে প্রান্ত ভাইয়া বলে উঠলেন,

—এইবার কিন্তু মানতেই হচ্ছে, বাবা। এটার উপর কোনো যুক্তি নেই। তুরফা কোথাও যাবেনা। আমাদের সাথেই থাকবে ঢাকায়!

বড়াব্বু চোখ তুলে একবার চোখের ইশারায় আমার মত জানতে চাইলেন, আমি মাথা নাড়িয়ে তাতে সায় দিলাম। অতঃপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়াব্বু বললেন,

—ঠিক আছে। সবাই যা ভালো মনে করো। আফটার অল, তোমাদের জীবন তোমাদের ডিসিশন। আমি এমনিতেও চাইছিলাম তুরফা এ বাসায় থাকুক, তাই আমার কোন প্রব্লেম নেই।

বড়াব্বুর কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। মুহুর্তেই হাসিখুশি পরিবেশ ফিরে এলো ঘরজুড়ে। আচমকা পূর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে বড়াব্বুর উদ্দেশ্যে বললেন,

—এখন যেহেতু তুরফা এখানেই থাকছে, ওর পরীক্ষাও শেষ তাই এবার আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হোক। বড়ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান বাকি অথচ সে বিষয়ে দেখছি তোমার কোনো চিন্তাই নেই, বাবা। বড্ড বেরসিক তুমি!

ছেলের এহেন কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালেন বাবা। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কিছু বলতেও ভুলে গেলেন যেন। বারকয়েক কিছু বলার চেস্টা করেও শব্দগুলো যেন গলার মধ্যেই মিলিয়ে গেলো তার! বড়াব্বুর এমন অবস্থা দেখে হাসি পেলো আমার, কেননা তার ছেলের এমন পল্টিবাজ আচরণে এতদিনে বেশ অভ্যস্ত আমি! উনার পরিস্থিতি ঠিক বুঝতে পাচ্ছি। ঠোঁট টিপে এসব ভেবে হাসতেই পাশের সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন প্রান্ত ভাইয়া। পূর্ণর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,

—দ্যাটস গ্রেট! ভাই চাইছে মানে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। এবার তাহলে সামনের বছর আমরা আরেকটা গুড নিউজ পাবো আশা রাখা যায়। কি বলো, বড় ভাইয়া?

কথার মাঝেই পূর্ণর কাধে হাত রেখে চোখ টিপে রসিকতার ছলে বলে উঠলেন প্রান্ত ভাইয়া। যে কথার প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপভাবেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলেন উনি। এদিকে প্রান্ত ভাইয়ার কথা শুনে মিটিমিটি হাসলো রুমের সবাই। যদিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই তিনি এমন মজা করলেন তবুও অসস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে কোনোরকম পানি খাওয়ার বাহানা দিয়ে রুম ছেড়ে চলে এলাম আমি। পেছনে রয়ে গেলো একগুচ্ছ উচ্চহাসির শোরগোল!

#চলবে