ভাগ্য ১১ পর্ব (অন্তিমপর্ব)

0
3415

#ভাগ্য ১১ পর্ব (অন্তিমপর্ব)

নিধি আমার ঔরসজাত সন্তান, তাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে, আমি তা সহ্য করব না।
কোথাকার এক তুহিন এসে বলল, নিধি আমার মেয়ে না, তোমরা বিশ্বাস করে নিলে, আমি তোমাদের ছেলে আমাকে তোমাদের বিশ্বাস নেই।

আমার শাশুড়ী হাসিবের কাছে এসে বললেন,

নিধি তোর সন্তান আমি বিশ্বাস করব, তুই আমাকে ছুঁয়ে কসম করে বল।

তোমাকে ছুঁয়ে কসম করে প্রমাণ দিতে হবে, নিধি আমার মেয়ে কি না, বাহ দারুণ যুক্তি, অন্যজনের কথায় যদি কসম করে প্রমাণ দিতে হয় নিধি আমার সন্তান কি না, তাহলে থাকো তোমরা তোমাদের অবিশ্বাস নিয়ে, আমি ইসরাত আর নিধিকে নিয়ে এই বাসা থেকে এখনি চলে যাচ্ছি।

হাসিব আমাদের রুমে এসে সব কাপড় বের করে ব্যাগে তুলতে শুধু করছে, আমাকে বলছে সব রেডি করতে আজই বাসা ছেড়ে চলে যাবে।
আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি, কি হতে যাচ্ছে, হাসিব আমার মেয়ের জন্য নিজের পরিবার ছেড়ে দিচ্ছে, শুধু আমার আর আমার মেয়ের জন্য হাসিব এতকিছু করছে।

হাসিবের ভাবী শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলল, আমার শ্বশুর এসে হাসিবকে বাধা দিয়ে বলল, তোর কোন কসম করতে হবে না, তোর মায়ের কি, কিছু বুঝে না, বাবা তুই যাসনে বাসা থেকে।
শ্বশুরের কথা শুনে হাসিব বলল,

যাবো না ঠিক আছে, কিন্তু আজকের পর এই বিষয়ে যেন একটা কথাও না হয় এই বাসায়, আমি যদি কখনো শুনি আমার মেয়েকে নিয়ে কিংবা ইসরাতকে নিয়ে কোনো সমালোচনা হয়, সেদিনই আমি এখান থেকে চলে যাবো, কথাটা সবাই মনে রেখো।

সেদিনের পর থেকে কেউ কোনো কথা বলেনি, কিন্তু আমার শ্বশুর শাশুড়ী এখন আগের মত আমাকে পছন্দ করে না সেটা আমি বুঝতে পারি।
তারা এখন নিধিকে কোলে নেয় না, নিধি দাদু দাদু বলে কাছে গেলে একটু কথা বলে, নাহলে কাছে ডাকে না, এতদিন তো নিধি নিধি বলে পাগল ছিল।
মানুষের রুপ এত সহজে কিভাবে পাল্টাতে পারে, সেটা ভেবে অবাক হই।

হাসিব আমাকে মাঝেমাঝে জিজ্ঞাস করে বাসার লোকেরা আমার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করে, আর নিধিকে আগের মত আদর করে কি না।
তাকে আমি মিথ্যা বলি, সত্যটা জানতে পারলে হাসিব কষ্ট পাবে, এই বাসায় সে এক মুহূর্ত থাকবেনা।
আমি চাইনা আমাদের জন্য হাসিব তার মা বাবাকে ছেড়ে দিক।

দিন ভালোই যাচ্ছে, আমার শাশুড়ীর এখন বড় ছেলের বউয়ের সাথে মিল হয়েছে, আমি বুঝতে পারি আড়ালে আমার নামে অনেককিছু বলে, কিন্তু হাসিবের ভয়ে সামনে কিছু বলেনা।
আমিও আড়ালের কথা ধরে মন খারাপ করিনা, আমার স্বামী তো ভালো অন্যরা যা ইচ্ছা তাই বলুক আমার তেমন সমস্যা নেই।

অফিস থেকে এসেই হাসিব আমাকে জড়িয়ে ধরে খুশী খুশী মুখ নিয়ে বলল,

আমি ইন্ডিয়া যাবার অফার পেয়েছি, দেড় মাসের একটা আইটি সেক্টর প্রোগ্রামে ট্রেনিং করতে।
সোমবারে ইন্ডিয়া যাবো, সেখান থেকে ট্রেনিং করে আসলে আমার প্রমোশন হবে।

হাসিবের কথা শুনে খুশী হলাম, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল, তাকে ছাড়া এতদিন থাকতে হবে, আর সে বাসায় না থাকলে বাসার সবাই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারে।

হাসিব যাবার সময় আমাকে বলে গেল, বাসার কেউ কিছু বললে তাকে জানাতে, আর টাকা দিয়ে বলল, যখন যা প্রয়োজন আব্বুকে বলবে আব্বু এনে দিবে, আমি আব্বুকে বলে যাচ্ছি।

হাসিব যাবার পর থেকে আমার শাশুড়ীর সাহস বেড়ে গেছে, সে এখন সামনাসামনি আমাকে কথা শোনাচ্ছে, নিধি কাছে গেলে বলে কার না কার সন্তান না কি জারজ, আর এই মেয়ের জন্য আমার ছেলের কি দরদ।
হাসিব বলেছিল, বাসার কেউ কিছু বললে তাকে জানাতে, কিন্তু আমি তাকে এখন কিছু জানতে চাইনা, সে যদি জানতে পারে তাহলে ট্রেনিং এ মনযোগী হতে পারবে না দুশ্চিন্তা করবে আমাদের জন্য।

কথা শুনে আমি চুপচাপ থাকি, অপেক্ষা করছি হাসিব আসার, সকালে নাস্তা বানাতে গেলাম শাশুড়ী তার বড় ছেলের বউয়ের সাথে বলছে, এই মেয়ের মুখ দেখতে ইচ্ছা হয়না, কি করব তবুও দেখতে হচ্ছে, এই মেয়ের কি কোনো লজ্জা সরম নেই এতো কথা বলছি গায়ে লাগেনা, অন্য মানুষ হলে বাসা ছেড়ে চলে যেতো।
জা বলল, কি করে যাবে অন্যজনের জারজ সন্তানকে হাসিবের ঘাড়ে ঝুলাইছে।

আর সহ্য করতে পারলাম না, বললাম ঠিক আছে আমি আপনাদের বাসা থেকে এখনি চলে যাচ্ছি আমার মুখ আর আপনাদের দেখতে হবে না।
একটা কথা শুনে রাখুন আমার মেয়ে জারজ না, সে বৈধ। চলে আসলাম বাবার বাড়ি, হাসিবকে বললাম তোমাকে ছাড়া তোমার বাসায় থাকতে ভালো লাগে না তাই আমাদের বাড়িতে চলে আসছি।
কেন আসছি সেটা বলিনি, হাসিব অবশ্য একটু সন্দেহ করেছে, আমি বলছি এমনি আসছি কেউ আমাকে কিছু বলেনি।

হাসিব আজ দেশে ফিরবে, আমাকে ফোন করে জানতে চাইল ইন্ডিয়া থেকে আমার আর নিধির জন্য কি কি আনবে।
আমি বললাম আমাদের কিছু লাগবে না, তুমি ভালোই ভালোই চলে আসো।
ইমা আর মিলি আমাকে বলল, কিরে দুলাভাই তোর জন্য শপিং করতে চাইল তুই না করলি, আচ্ছা আমাদের জন্য শপিং করতে বল।

আমি বললাম, পারব না, তোদের ইচ্ছা হলে তোরা বল।
ইমা আমার মোবাইল দিয়ে হাসিবকে কল দিয়ে বলল,
দুলাভাই আপনার দুইটা শালী আছে তাদের জন্য শপিং করে নিয়ে আসবেন।
ইমা কাল শ্বশুর বাড়ি থেকে আসছে, আমার বোন গুলো অনেক লোভী।
হাসিব বাংলাদেশে এসে আগে ওদের বাসায় গেল, বিকালে আমার এখানে আসছে, বড় একটা ব্যাগ তার হাতে, সবার জন্য শপিং করে নিয়ে আসছে, নিধির জন্য অনেক খেলনা এনেছে।

মা বাবা ইমা মিলি খুশীতে বাগবাগ হয়ে বলতেছে, হাসিব অনেক বড় মনের মানুষ।
সবার আনন্দিত চেহারা দেখে ভাবি, হাসিব দিতে পারে বলে অনেক ভালো হয়ে গেছে, না দিলে ভালো হতে পারতো না তোমাদের কাছে।

হাসিব বলল, এখানে তো অনেকদিন থাকলে, চল বাসায় চলে যাই।
বললাম, ওই বাসায় আমি আর যাবো না, আমার মুখ তাদের দেখতে ইচ্ছা হয়না, আমার লজ্জা সরম নেই বলে তাদের বাসায় পড়ে থাকি, নিধিকে বারবার জারজ সন্তান বলে ডাকে।

কি আমার মেয়েকে জারজ বলেছে, এতো বড় সাহস, আমি তাদেরকে একদিন বলে দিয়েছিলাম যেদিন নিধিকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলবে সেদিনই আমি ওই বাসা ছেড়ে চলে আসব।

সত্যি হাসিব তার কথা রাখছে, এখন আমরা অন্য জায়গায় থাকি, হাসিবকে মাঝেমাঝে বলি আমাদের জন্য মা বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছ, এটা আমার কেমন যেন লাগে, তুমি তো তাদের সন্তান।
হাসিব আমার প্রতিউত্তরে বলে, নিধিও আমার সন্তান, যে মা বাবা আমার সন্তানকে মেনে নিবেনা সে মা বাবার সাথে আমারো সম্পর্ক থাকবেনা।

আমি এখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা, জানতে পেরেছি ছেলে হবে, হাসিব সবসময় বলতো, আমার একটা মেয়ে আছে, এখন একটি ছেলে হলেই আমার সংসার পরিপূর্ণ। তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে, নিধির পাঁচ বছর হাসিব তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে, সকাল সাতটায় হাসিব নিধিকে স্কুলে দিয়ে আসে, আবার নয়টায় নিয়ে এসে পড়ে সে অফিসে যায়।
সে সবদিক দিয়ে পারফেক্ট, স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে।

এখন ভাবি আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করে, দেখে আমার বান্দা আমার পরীক্ষার উপর কেমন আস্থাশীল থাকে, আল্লাহ তো দয়াবান তার উপর অগাধ আস্থা বিশ্বাস রাখলে, একদিন না একদিন আল্লাহর অশেষ রহমত তার বান্দার উপর ঠিকই বর্ষন করবে ইনশাল্লাহ।

সাদমান হাসিব সাদ