ভালোবাসার চেয়েও বেশি পর্ব-০৮

0
2154

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৮

★ক্লাস শেষে নূর আর তানি বেড়িয়ে এলো। বাইরে বেড়িয়ে নূর দ্বিধায় পরে গেলো। এখন কি করবে ও?উনিতো ক্লাস শেষে যেতে বলেছে।
তানি নূরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
…কিরে কি এতো ভাবছিস?

…ভাবছি এখন কি করবো? যাবো কি যাবো না?উনার সামনে যেতে আমার কেমন যেন ভয় লাগে।

…আরে ভয়ের কিছুই নেই। উনি কোনো বাঘ ভাল্লুক না যে তোকে খেয়ে ফেলবে। এতো না ভেবে চল।আমিও তোর সাথে যাচ্ছি।

দুজন কালকের ওই জায়গায় গিয়ে দেখলো,আজও আবির আর তাসির দাঁড়িয়ে আছে।

আবির তানির দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো।
…হাই কিউটি।

তানিও মুচকি হেসে বললো।
…হ্যালো।

তাসির নূরকে বললো।
…কেমন আছো নূর?

নূর আস্তে করে বললো।
…জ্বি ভালো।

…ওকে যাও তাহলে। আদি ওখানেই আছে।

নূর মাথা ঝাকিয়ে সামনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

আদিত্য বসে বসে ভাবছে। কি দিন এসে গেলো তোর আদি?যেখানে আমার জন্য বড়ো বড়ো মন্ত্রী মিনিস্টাররা অপেক্ষা করে। সেখানে কিনা আমি একটা মেয়ের জন্য এভাবে বসে অপেক্ষা করছি।ব্যাপারটা সত্যিই হাস্যকর। জানি না কি হয়ে গেছে আমার?
কারোর পায়ের শব্দে আদিত্যর ভাবনায় ছেদ পরে। মাথা উচু করে দেখে নূর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আদিত্য বললো।
…সিট।

নূর দ্বিধাদ্বন্দ্ব করতে করতে বসে পরলো।
নূর বসতেই আবারও সেই মিষ্টি বেলীফুলের ঘ্রাণটা আদিত্যের নাকে এসে লাগলো। আদিত্য চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণটা অনুভব করতে লাগলো। ঘ্রাণটা একদম পাগল করা,নেশা ধরানো। আদিত্যের রোম রোমে যেন নেশা ধরে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আদিত্য চোখ খুলে নূরের দিকে তাকালো। মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে। আদিত্য বলে উঠলো।
…সবসময় এতো মাথা নিচু করে থাকো কেন?ঘাড় ব্যাথা করে না?এরকম করে থাকলে তো একসময় কুঁজো হয়ে যাবে।

এমন আজব কথা শুনে, নূর এক ঝটকায় মাথা তুলে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললো।
..জ্বিহহ?

এটাই তো চাইছিলো আদিত্য। এইজন্যই এসব আবোল তাবোল কথা বলেছে ও। যাতে নূর মূখটা উপরে তোলে।আর ও নূরের মুখখানা ভালোভাবে দেখতে পায়।
আদিত্য নূরের দিকে তাকাতেই, ওর বুকের ভেতর কেমন ধক করে উঠলো। মেয়েটার চেহারা কেমন শুকনো ফ্যাকাসে হয়ে আছে। চোখ দুটোও কেমন ফোলা ফোলা লাগছে।মুখটাতে হাজারো বিষাদের ছাপ।আচ্ছা মেয়েটার জীবনে কি কোনো কষ্ট আছে? এমন একটা নিষ্পাপ মেয়েকে কে এতো কষ্ট দিতে পারে?আদিত্যের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে নূরের সম্পর্কে। কিন্ত কারো পার্সোনাল ব্যাপারে তো আর এভাবে হুট করে জিজ্ঞেস করা যায় না।
দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা সকাল থেকে কিছুই খায়নি? কথাটা ভাবতেই আদিত্য সাথে সাথে ফোনটা বের করে আবির কে ফোন দিয়ে কিছু খাবার আনতে বলে। ফোন রেখে আদিত্য আবার নূরের দিকে তাকায়।

নূর আর তাকিয়ে থাকতে পারে না।আদিত্যর ওই চাহনির সামনে সে টিকতে পারে না। আবারও মাথা নিচু করে ফেললো নূর।

আদিত্য সিচুয়েশন স্বাভাবিক করার জন্য বলে।
…রিলাক্স এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো না।এখন যেহেতু আমাদের রোজই দেখা করতে হবে। তাই আমাদের একটু কমফোর্টেবল হওয়া দরকার। আর তার জন্য আমাদের কথা বলা দরকার। তুমি চাইলে আমরা বন্ধু হতে পারি।

নূর বিস্ময় নিয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
…বন্ধু???

…হ্যা,বন্ধু। আমাদের ভেতর বন্ধুত্ব হয়ে গেলে, তখন আর দুজনের কারোরই আনইজি লাগবে না।তোহ কি বলো?

নূর আমতা আমতা করে বললো।
…ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করবো।

নূরের কথায় আদিত্য খুশী হয়ে বললো।
…ঠিক আছে তাহলে।তোমার নাম তো আমি জানি। আর আমার নাম হয়তো শুনেছ তাও বলছি। আমি সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য।

ওদের কথার মাঝেই আবির চলে এলো। হাতে একটা খাবার প্যাকেট।আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
…ভাই তোর খাবার।আর তুই কবে থেকে এসব খাবার খাওয়া শুরু করলি?তুই তো এসব খাস না।

…আগে খাইনি তো কি হয়েছে? এখন খাবো।তোর সমস্যা কোথায়? তুই যা এখান থেকে।

আবির বাঁকা হাসি দিয়ে চলে এলো ওখান থেকে।

আদিত্য প্যাকেট থেকে একটা চিকেন স্যান্ডুয়েচ বের করলো।

নূর আরচোখে তাকিয়ে ভাবছে। লোকটা কি এখন খেতে বসবে নাকি? ক্ষুধা তো আমারও লেগেছে। কাল রাত থেকে না খেয়ে আছি।মাথাটাও কেমন ঘুরছে। ছিঃ ছিঃ নূর অন্য কারোর খাবার দেখে লোভ করেছিস? লজ্জা করে না তোর?
নূর মাথাটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।

আদিত্য একটা স্যান্ডুয়েচ নূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
…এটা খেয়ে নেও।

আদিত্যের কথায় নূর অবাক হয়ে, একবার আদিত্যের দিকে আরেকবার ওর হাতে থাকা স্যান্ডুয়েচের দিকে তাকালো। উনি কি এসব আমার জন্য এনেছেন? না না এভাবে কারোর কাছ থেকে খাবার নেওয়া ভালো দেখাই না। মনে মনে এসব ভেবে নূর বললো।
…না না আমার ক্ষিধে নেই। আপনি খান।

আদিত্য বুঝতে পারলো যে নূর ইতস্তত বোধ করছে। তাই গম্ভীর স্বরে বললো।
….আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি।খেতে বলেছি খাও। আসলে আমার খুব ক্ষিধে লেগেছে। আর একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না। তাই তুমিও খাবে আমার সাথে। আমরা তো এখন বন্ধু হতে চলেছি। তাই একসাথে খেতেই পারি তাইনা?

নূর আর না করতে পারে না।এমনিতেও ওর ক্ষুধা লেগেছে , তাই ও স্যান্ডুয়েচটা নিয়ে নিলো।

আদিত্য যেন হাফ ছেড়ে বাচলো।ওর মনে হচ্ছে ও কোন ছোট বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য আবোল তাবোল গল্প শোনাচ্ছে।

নূর মাথা নিচু করে খাচ্ছে। কিন্তু আদিত্য পরেছে বিপাকে। ও কিভাবে খাবে?আবির ঠিকই বলেছে।ও আগে কখনো এসব খাবার খাইনি। আসলে ওর এসব খাবার পছন্দ না। কিন্তু নূরের সামনে না খেলে নূর সন্দেহ করবে।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ মুখ কুঁচকে স্যান্ডুয়েচটা মুখে দিলো।মনে হচ্ছে মুখের ভেতর কেউ নিম আর করল্লা একসাথে মিক্স করে ঢেলে দিয়েছে। কোনরকমে খাবারটা গিললো আদিত্য। মনে মনে ভাবছে কি দিন এসে গেলো তোর আদি?একটা মেয়ের জন্য এতোগুলো মিথ্যা কথা বললি।আবার জীবনে যা খাসনি তাও খেলি, বাহ্ কি উন্নতি হয়েছে তোর।

খাওয়া শেষে নূর বসে কাচুমাচু করতে লাগলো। এখন ওকে চুমু দিতে হবে।
আদিত্য বললো,
….ঠিক আছে তাহলে আজকের টা দিয়ে দেও।
আদিত্য চোখ বন্ধ করে নিলো।নূর কিছু সময় পর চোখ বন্ধ করে আদিত্যের গালে চুমু দিয়েই কালকের মতো আবারও দৌড় দিয়ে ওখান থেকে ফুরুৎ হয়ে গেলো।
আদিত্য আবারও হারিয়ে গেলো সেই ভালো লাগার অনুভূতিতে।

—————————–

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেলো।
এই এক সপ্তাহে নূর আর আদিত্যর ভিতরের জড়তাটা অনেকক্ষানি কমে গেছে। নূর আর আগের মতো আদিত্যকে ভয় পায় না। এখন ওদের মাঝে টুকটাক কথাও হয়। নূরেরও কোথাও না কোথাও ভালো লাগে আদিত্যের সাথে সময় কাটাতে। তবে নূরের লজ্জাটা এখনো এক বিন্দুও কমেনি।এখনো রোজ আদিত্যকে চুমু দেওয়ার পর দৌড় দেয়।

আর আদিত্য যতো দিন যাচ্ছে ততই বেশি নূরের নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। ওর অনুভূতি গুলো তিব্র থেকে তিব্রতরো হচ্ছে। যেটা আবির আর তাসির স্পষ্ট বুঝতে পারছে। কারণ আজকাল আদিত্যের চোখে মুখে আলাদা একটা চমক দেখতে পায়।

আদিত্য নিজেও কিছুটা বুঝতে পারছে, ওর অনুভূতিগুলো। তবে ও এখনি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায়না। হতে পারে এটা ক্ষনিকের মোহ।সময়ের সাথে মোহটাও কেটে গেলো।তখন তো মেয়েটা কষ্ট পাবে। তাই ও আরো কিছুদিন সময় নিয়ে বুঝতে চায়।

রাত ৮-৩০
নূর টেবিলে বসে পড়ছিল।হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। অনেকক্ষণ বাজার পরও কেও যখন খুলছিল না। অগত্যা নূর উঠে গেল দরজা খুলতে।
দরজা খুলে দেখল, নূরের চাচা এসেছে। নূর ওর চাচাকে দেখে মুচকি হেসে বললো।
….আসসালামু আলাইকুম চাচা।কেমন আছেন?

…ওয়ালাইকুম আসসালাম।এইতো ভালো। তোর কি খবর মা?

…আমিও ভালো আছি। আসেন ভিতরে আসেন।

নূরের চাচা ভেতরে এসে বসে বললো।
…ভাইয়া বাসায় নেই?

নূর মুখটা ছোট করে বললো।
…না বাবাতো বাসায় নেই। কালকেই চলে গেছে।

নূরের চাচা ছোট্ট করে বললো।
…ওহহ।তা তোর পড়াশোনা কেমন চলছে? নতুন জায়গায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

…না চাচা, কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিক চলছে।

…আচ্ছা ঠিক আছে। কোন সমস্যা হলে আমাকে বলিস কেমন?
তারপর নূরের চাচা কিছু টাকা বের করে নূরের হাতে দিয়ে বললো।
…টাকাটা রাখ।

নূর ইতস্তত ভাবে বললো।
…না না চাচা। লাগবে না।আপনি আগের বার যে টাকা দিয়েছিলেন ওটা দিয়েই চলবে।

…আরে নিতে বলেছি নে।এতো কথা বলিস কেন?আমি ভালো করেই জানি তুই কখনো নিজের থেকে চাইবি না। তাই আমিই দিয়ে যায়। যখন লাগবে খরচ করবি।

নূর আর না করতে পারে না। টাকাটা হাতে নেয়।
আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলার পর নূরের চাচা চলে যায়।

এদিকে নূরের সৎ মা দুর থেকে এসব দেখছে আর রাগে ফুঁসছে। সে কতো চেষ্টা করছে নূরের পড়ালেখা বন্ধ করানোর জন্য।আর এই লোক কিনা এসে আরো টাকা দিয়ে আদিক্ষেতা দেখাচ্ছে।

নূর ওর চাচাকে বিদায় দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো।রুবিনা বেগম কোমরে হাত দিয়ে রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
…কি হয়েছে ছোট মা? কিছু বলবে?

রুবিনা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
…ভালোই তো ফাঁসিয়েছিস। তা কি দেখিয়ে ফাঁসালি?নিশ্চয় নিজের রুপ দেখিয়ে।

নূর বুঝতে না পেরে বললো।
…মানে?কি বলছ এসব? কি ফাসানোর কথা বলছ?

…হুহ্হ ভাবটা তো এমন ধরেছিস, যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানিস না।অথচ তলে তলে নিজের রুপের ফরিয়াদ করে বেরাচ্ছিস।তুই কি ভেবেছিস?আমি কিছু বুঝিনা?যাকে তার বাবাই দুচোখের বিষ মনে করে।সেখানে তোর চাচাকে কি এমন দেখালি যে তোর জন্য এতো পাগল। আবার টাকাও দেয় দেখি। ছিঃ ছিঃ শেষে কিনা নিজের চাচাকেই রুপের জালে ফাঁসালি।

এমন নিকৃষ্ট জঘন্য কথা শুনে নূরের সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে কেউ যেন কানের ভেতর গরম গরম তেল ঢেলে দিয়েছে। এমন জঘন্য কথা শুনে নূরের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নূর আর সহ্য করতে না পেরে চেচিয়ে বললো।
…ছোট মা…..।এরকম জঘন্য কথা কিভাবে বলতে পারলে তুমি? উনি আমার চাচা । আমার বাবার মতো। আর তুুমি?এমন একটা নিকৃষ্ট কথা বলতে একবারও তোমার বিবেকে বাঁধলো না??

রুবিনা বেগম ফুঁসে উঠে বললো।
….একদম চেঁচাবি না।চোরের মায়ের আবার বড়ো গলা। হুহ্হ।ভেংচি কেটে চলে গেলেন রুবিনা বেগম।

নূর যেন নড়ার শক্তিও পাচ্ছে না। এমন একটা কথা ও কিছুতেই হজম করতে পারছে না। গা গুলিয়ে আসছে ওর। নূর মুখের ওপর হাত চেপে কোনরকমে নিজের রুমে দৌড়াল।

বাথরুমে যেয়ে বেসিনে গরগর করে বমি করে দিল নূর। তারপর বাথরুমের দেয়ালে পিঠ ঘেঁষতে ঘেঁষতে নিচে ফ্লোরে বসে পরলো।
নূরের কানে শুধু বারবার ওই কথাগুলো ভেসে আসছে। নূর দু কানে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো। এমন একটা কথা শোনার আগে আমার মরণ কেন হলনা।কান্না করতে করতে বললো নূর।

————————–

নূর বসে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ওই ব্রেঞ্চটার ওপর। যেখানে ও রোজ আদিত্যের সাথে দেখা করে।
নূরের মনটা খুবই খারাপ। কালকের ওই জঘন্য কথাগুলো ও এখনো ভুলতে পারছে না। রাতে কান্না করতে করতে বাথরুমেই ঘুমিয়ে পরেছিলো।ভোর বেলা উঠে বাসার সব কাজ শেষ করে না খেয়েই চলে আসে।আজ তানিও আসেনি। তাই মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। একটা ক্লাস করেই এখানে এসে বসে পরে।
জায়গাটা ওর কাছে ভালো লাগে। একদম নিরিবিলি নির্জন পরিবেশ। চারদিকে গাছ গাছালির ছায়া আর মৃদু বাতাসে মনটা জুড়িয়ে দেয়। ব্রেঞ্চের ওপর পা দুটো উঠিয়ে, হাটু ভাজ করে হাত দুটো দিয়ে হাটু জড়িয়ে হাটুর ওপর থুতনি রেখে, সামনের ঝিলের পানির দিকে চেয়ে বসে আছে নূর।

যথা সময়ে আদিত্য আসে।পেছন থেকে নূরকে দেখে একটু অবাক হয়।আদিত্য ভাবে, ও আজকে লেট করেছে নাকি?তারপর হাত ঘরির দিকে তাকায়। নাহ টাইম তো ঠিকই আছে। তারমানে নূর আজকে আমার আগেই চলে এসেছে। কথাটা ভাবতেই আদিত্যর মনে মনে খুব খুশী লাগে। ও মুচকি হেসে এগিয়ে দিচ্ছে নূরের কাছে।
আদিত্য দেখে নূর একধ্যানে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। ও নূরেকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে করে ওর পাশে বসে।

আদিত্যর গলা খাঁকারি দেওয়ায় নূরের ধ্যান ভাঙে।নূর চমকে তাকায় আদিত্যের পানে।নূর তাকাতেই আদিত্যর হাসি মুখটা ধীরে ধীরে চুপসে যায়। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।

আদিত্য দেখে নূরের চেহারাটা কেমন বিবর্ণ হয়ে আছে। চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে বেহাল অবস্থা। কি হয়েছে মেয়েটার এমন দেখাচ্ছে কেন? আদিত্য উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
…হেইই,কি হয়েছে তোমার এমন দেখাচ্ছে কেন? কেউ কিছু বলেছে?আমাকে বলো?শুধু একবার নাম বলো।দেখ আমি কি হাল করি?

নূর অবাক হয়ে চেয়ে আছে আদিত্যের দিকে। উনি আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করছে কেন। আর উনাকে বলবই বা কি?নিজের পরিবারের জঘন্য সত্যটা ওনাকে কি ভাবে বলবো?শুধু শুধু ওনাকে বলে কি হবে?সবই আমার ভাগ্য।

নূরের চুপ থাকা দেখে আদিত্যের আরও চিন্তা হতে থাকে। ও আবার বলে।
…কি হলো? বলো?টেল মি ড্যাম ইট।

নূর জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো।
…আরে কিছুই হয়নি? কেউ কিছু বলেনি।আসলে রাতে ভালো করে ঘুম হয়নিতো তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে। আর কিছুই না।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো।নূরের কথা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছু একটা প্রবলেম তো আছেই নূরের জীবনে। আদিত্য সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। কিন্তু নূর যে নিজে থেকে কিছু বলবে না।সেটাও বুঝতে পারছে আদিত্য। কিভাবে জানা যায় নূরের ব্যাপারে,সেটাই ভাবছে আদিত্য। তানি হয়তো ওর সম্পর্কে বলতে পারবে। কিন্তু তানিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে আবার কি না ভাবে কে জানে? কোনো না কোনো উপায় তো বের করতেই হবে।

আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার নূরের দিকে তাকালো। মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে থাকে সবসময়। কখনো প্রান খুলে হাসতে দেখিনি ওকে।নাজানি হাসলে ওকে কেমন লাগতো দেখতে।
কথাটা ভাবতেই আদিত্যর খুব ইচ্ছে হয় নূরকে হাসতে দেখার।নিজের ইচ্ছের ওপর নিজেই অবাক হয় আদিত্য। ও নিজে শেষ কবে হেসেছে তাই মনে নেই। অথচ আজ অন্য কাওকে হাসাতে চায়ছে ।
আদিত্য ভাবছে কি করে হাসাবে নূরকে। কোনো জোকস বলবো? কিন্তু আমিতো কোনো জোকস বলতে পারি না। আবির ভালো কমেডি করতে পারে।ওকে ডাক দেয়।
আবার ভাবে, না না ওকে কেন ডাকবো? আমিই হাসাবো নূরকে?কি এমন কঠিন কাজ? এতো বড়ো বড়ো বিজনেস ডিল করতে পারলে। এটা আর এমন কি?গো ফর ইট আদিত্য, ইউ ক্যান ডু ইট।ইয়েস্।
আদিত্য মনে মনে নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করছে, যেন কোনো যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছে।

কিছু একটা ভেবে আদিত্য নূরকে বললো।
…জানো? আমার বোন আমাকে কি বলে?

…কি বলে?

…বলে ভাইয়া, তুমি না বেশি বেশি করে হাঁসের মাংস খাও।তাহলে দেখবা তুমিও সারাদিন হাঁসের মতো প্যাক প্যাক করে হাসবা।

নূর একটা ম্লান হাসি দিয়ে আস্তে করে বললো।
…ওহ্

আদিত্য হতাশ হয়ে গেলো। ভাবলো আমার সেন্স অফ হিউমার এতো খারাপ?আমিতো জানতামই না। এখন কি করবো?

আদিত্য আর উপায় না পেয়ে আবিরকে একটা এসএমএস করলো।

আবির তাসিরের সাথে কথা বলছিলো আর কোল্ড ড্রিংস খাচ্ছিলো। ফোনে ম্যাসেজ আসায় ফোন বের করে দেখে আদিত্যর ম্যাসেজ।কিছু জোকস্ ফরওয়ার্ড করতে বলেছে। এমন ম্যাজেস দেখে আবিরের গলায় ড্রিংস আটকে কাশি উঠে গেলো। ও অবাকের চরম পর্যায়ে। ওর রোবট ভাই, যে কখনো এসবের ধারে কাছে যায়না। সে কিনা আজ জোকস ফরওয়ার্ড করতে বলেছে। ওর ভাই প্রেমে পড়ে শেষমেষ কিনা কমেডিয়ান হয়ে গেলো?
তারপর আবির কিছু জোক্স পাঠিয়ে দিল।

আদিত্য জোক্সগুলো দেখে নূরকে বললো।
…একটা মজার জোক্স শুনবে?

…বলুন।

…এক লোক এক জিলাপি ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো। ভাই আপনি কতদিন হলো জিলাপি বানান?
জিলাপি ওয়ালা বললো। ১৫ বছর ধরে বানাই।
লোকটা বললো আপনি ১৫ বছর ধরে বানান তাও এখনো জিলাপি সোজা হইলো না।

নূর এবারো ম্লান হাসলো। তবে ওর মন খারাপটা একটু কমেছে।

আদিত্য আবারও হতাশ হলো। এভাবে আরো কয়েকটা জোক্স বললো। কিন্তু তবুও নূর হাসছে না।আদিত্যের রিতীমত ঘাম ছুটে গেছে। মনে হচ্ছে বড়ো কোনো এক্সাম দিচ্ছে।
নূর উপরে উপরে না হাসলেও, ওর মন খারাপটা কেটে গেছে। এখন ওর ভালোই লাগছে।

আদিত্য হতাশ হয়ে বসে রইলো। আবিরের ওপর ভীষণ রাগ লাগছে ওর। কি ফালতু জোক্স পাঠিয়েছে কোনো কাজই করলো না।
হঠাৎ গাছের ওপর থেকে একটা পাখি আদিত্যর মাথায় পটি করে দিলো।
আদিত্য চোখ মুখ বিকৃত করে বললো।
…ওয়াট দা ফিস্।ইয়াক,ছিহ্…
আদিত্য আর কিছু বলতে পারলো না।হঠাৎ ও হাসির শব্দ শুনতে পেল।পাশে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। নূর হাসছে, খিলখিলিয়ে হাসছে। কি সুন্দর সেই হাসি। এতো সুন্দর করে কেউ কিভাবে হাসে?হাসির সময় নূরের মুক্ত দানার মতো দাঁত গুলো চিকচিক করছে।নূরের হাসির রিনঝিনি শব্দ যেন, আদিত্যর সারা শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। আদিত্যের এখন ওই পাখিটিকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। এমন দৃশ্য দেখার জন্য ও হাজার বারও এই কাজটা করতে রাজি।

কিছুক্ষণ পর নূর হাসি থামিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে টিস্যু বের কর আদিত্যকে দিয়ে বললো।
…নিন পরিস্কার করে নিন।

নূরের কথায় আদিত্যের ধ্যান ভাঙলো। ও বললো।
….আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। কিভাবে করবো?

নূর কিছু না ভেবেই বলে উঠলো।
…ঠিক আছে আমি করে দিচ্ছি।
তারপর নূর আদিত্যের কাছে যেয়ে টিস্যু দিয়ে আদিত্যের চুল পরিষ্কার করতে লাগলো।

এই প্রথম নূর আদিত্যর এতো কাছে।আদিত্যের বুকের ধুকধুকানি হাজার গুন বেরে গেল। নূরের শরীরের সেই মিষ্টি গন্ধটা আদিত্যকে পাগল করে দিচ্ছে।ও চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
একটু পর নূর সরে এসে বললো।
…হয়ে গেছে।

আদিত্য একটা সৌজন্যে মূলক হাসি দিল।তারপর রোজকার মতো নূর চুমু দিয়ে চলে গেলো।

চলবে….