রঙিন বর্ষা ৬ষ্ঠ পর্ব

0
668

#রঙিন_বর্ষা
লেখা: নীলাদ্রিকা নীলা
৬ষ্ঠ পর্ব
.
ঝুমুর ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছুটে যাচ্ছে। বাসায় ফিরে এসে খেয়াল করলো এক পায়ে নুপুর নেই। ভেবেই নিলো বৃষ্টিতে ভেজার সময় ওটা কোথাও খুলে পরে গেছে। হারানো নুপুরটা শ্রাবণের কাছে কেন?
এসব ভাবতে ভাবতে ঝুমুর পাশে তাকাতেই চমকে উঠল। বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। শ্রাবণ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ওকে দেখছে। এভাবে হঠাৎ শ্রাবণকে দেখায় ঝুমুর একটু ভয় পেয়ে বলে উঠল,তুমি!
– হ্যাঁ আমি। আমার রুমের জিনিসপত্র এভাবে এলোমেলো করছো কেন।
– আমার নুপুরটা কোথায় পেলে?
শ্রাবণ ঝুমুরের হাত থেকে নুপুরটা নিয়ে ওটা দেখতে দেখতে বললো, কে বললো এটা তোমার নুপুর! এটা তো আমার পরীর নুপুর!
,
ঝুমুর চেচিয়ে ওঠে, এটা আমারই নুপুর!
শ্রাবণ এবার একটা বাঁকা হাসি দিয়ে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বললো, নো। এটা আমার রানীর নুপুর!
– এটা আমার! আমার জিনিস আমি চিনি না!
– কই আমাকে তো চিনতে পারো না ।
ঝুমুর ভ্রু কুচকে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললো, মানে?
– আমি তো তোমা..
শ্রাবণ একটু থেমে গিয়ে আবার বললো, না কিছু না।
,
ঝুমুর বললো, ফোনটা দেবে? প্রিয়াকে একটা ফোন করবো।
শ্রাবণ এবার ঝুমুরের কাছে এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, বউ চাইলে সবই দিতে পারি।
ঝুমুর ধমক দিয়ে বলে উঠল, চুপ! দাও ফোনটা!
,
শ্রাবণ পকেট থেকে ফোন বের করে হাত বারিয়ে ফোনটা ঝুমুরের সামনে ধরলো। ঝুমুর শ্রাবণের হাত থেকে ফোনটা নিতে গেলেই শ্রাবণ সেটা ডান দিকে সরালো। ঝুমুর সেদিকে হাত বারিয়ে ফোনটা নিতে যাবে শ্রাবণ আবার সেটা বাম দিকে সরিয়ে আনলো। ঝুমুর বাম দিকে হাত বারিয়ে শ্রাবণের হাত থেকে ফোনটা নেবার চেষ্টা করতেই শ্রাবণ আবারো সেটা ডান দিকে সরিয়ে আনলো। ঝুমুর এবারও ফোনটা নিতে পারলো না। ঝুমুর ঝাপিয়ে পরে বাম দিক থেকে ডান দিক আর ডান দিক থেকে বাম দিক হাত বারিয়ে ফোনটা নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু শ্রাবণ ফোনটা তার হাতে রেখে তার ডান থেকে বাম হাতে বার বার অদলবদল করছে। আর ঝুমুরটা হাত থেকে সেটা নিতে গেলেই অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছে।
,
এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ঝুমুরের কান্না কান্না ভাব চলে এলো। শ্রাবণ এবার হাসতে হাসতে বলছে, কি ঝুমুর রানী এত অল্পতেই হাপিয়ে গেলে চলবে!
– কেন এমন করছো আমার সাথে!
– এমনি এমনি তো আর ফোন দেওয়া যাবে না। এটা কোন সরকারি মাল নয়।
,
ঝুমুর গাল ফুলিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো, কেন একটু আগেই না বললে বউ চাইলে সব দিতে পারি! শ্রাবণ এবার ঝুমুরের কাছে এগিয়ে ঝুমুরের মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলছে, সবই তো দিতে চাই কিন্তু তাহলে যে বউকে বউয়ের মতো থাকতে হবে।
তারপর শ্রাবণ তার ঠোঁটটা কিসের স্টাইল করলো।
শ্রাবণকে ঠোঁট এরকম করতে দেখে ঝুমুর শ্রাবণের বুকে ঢাক্কা দিয়ে শ্রাবণকে দূরে সরিয়ে দিলো।
,
হঠাৎ ঢাক্কা দেওয়ায় শ্রাবণ তাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। ঝুমুর শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলছে, ফোনটা দেবে কিনা?
শ্রাবণ বললো, এখন পর্যন্ত সকালে কিছু খাই নি।
ঝুমুর চোখ গরম করে বললো, তো আমি কি করবো!
– যদি বউয়ের ঠোঁটের মিষ্টি চুমুটা অন্তত খেতে পারতাম।
,
ঝুমুর এবার আর রাগ সামলাতে না পেরে রুমে যা কিছু আছে সেসব কিছু হাতে নিয়ে ওগুলো শ্রাবণের দিকে ছুড়ে মারা শুরু করলো। অবস্থা বেগতিক দেখে শ্রাবণ রুম থেকে বের হয়ে যায়। শ্রাবণ যাওয়ার পর ঝুমুর শান্ত হয়। তারপর হঠাৎ টেবিলের দিকে তাকাতেই শ্রাবণের ফোনটা দেখতে পায়। ঝুমুর হাসতে হাসতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ঝুমুর গৌরবের হাসি দিতে দিতে বলছে, এই ঝুমুরের কাছে সবাই কুপোকাত! মার খেতে খেতে ফোনটা নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলেই গেছে!
,
ঝুমুর ফোনটা হাতে নিয়েই আগে লিমনকে ফোন করলো। লিমন ফোনটা রিসিভ করতেই ঝুমুর ভাইয়া ভাইয়া.. বলে কান্না করা শুরু করে দেয়।
– বোন! বোন তুই ঠিক আছিস! ওরা তোর ওপর কোনো অত্যাচার করছে না তো?
ঝুমুর ন্যাকা কান্না করেই যাচ্ছে।
,
লিমন ড্রইংরুমের রুমের ভিতর এদিক থেকে ওদিক হাটতে হাটতে চেচিয়ে বলছে, বোন,বোন ফোন করেছে! কে কোথায় আছো!
রুমে তখন নিয়ন আর তার দলবলও ছিল। নিয়ন ছুটে এসে বললো। ভাইয়া আমায় দে!
নিয়ন লিমনের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলছে, বোন! বোন তোর কি কষ্ট হচ্ছে আমায় বল! আমি ওই শ্রাবণকে ছাড়বো না। মেরে ওর হাড়গোড় জরো করে তোর সামনে নিয়ে আসবো।
ঝুমুর কান্না করতে করতে বলছে, ভাইয়া! এখানে আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ভাইয়া !
,
লিমন এবার নিয়নের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো, সোনা বোন আমার ভয় পাস না! আমরা আসছি তোকে নিতে।
ঝুমুর কাঁদতে কাঁদতে বললো, জলদি এসো ভাইয়া। এখন রাখি।
,
ঝুমুর কল কেটে দিয়ে এবার প্রিয়াকে কল করলো। এখানে আসার পর যা যা হয়েছে সব কিছু প্রিয়াকে খুলে বললো। ঝুমুর বলছে, বুঝতে পারছি না, শ্রাবণ নুপুরের ব্যপারে কেন মিথ্যা বললো। বাট আই এ্যাম শিউর ওটা আমারই নুপুর।
-হুম,তুই এক কাজ কর। তুই ওর রুমটা আরও ঘাট৷ ঘেটেঘুটে দেখ আরও কিছু পাস কিনা!
,
ঝুমুর শ্রাবণের ওয়ারড্রোবে আবারও হাত দিলো। প্রতিটা ড্রয়ারের সব কিছু ভালো করে দেখছে। এবার একটা আশ্চর্যের বিষয় চোখে পরলো। একটা গোলাপি ওড়না। ওড়নাটা হাতে নিয়ে ঝুমুরের চোখ আবার বড় বড় হয়ে যায়। এরকম একটা ওড়না ঝুমুরের ছিলো। ওড়নাটা ক্যাম্পাসে প্রথম দিন ক্লাসে পরে গিয়েছিলো। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে হেটে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। ক্যাম্পাসে অনেক বড় বড় গাছপালা আর বিভিন্ন ফুলের গাছ রয়েছে। এরইমধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি এসে যাওয়ায় ঝুমুর তাড়াহুড়ো করে হাটতে গিয়ে ওড়নাটা একটা ফুল গাছের সাথে গেলে আটকে গেল। ঝুমুর ওড়নাটা ছাড়াতে চেষ্টা করছে। ছাড়াতে গিয়ে ওড়নাটা কিছুটা ছিড়েও গেল। কিন্তু ছাড়াতে পারলো না। এদিকে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে ঝুমুর। বৃষ্টি আর বাতাসের পরিমাণ বারতে থাকায় ঝুমুর ওড়নাটা ওখানে রেখেই চলে এলো।
,
ওড়নাটা হাতে নিয়ে ঝুমুরের ওইদিনের ঘটনাটা মনে পরে গেল। তারাতারি ঝুমুর ওড়নার আরেক পাশটা দেখার অন্য অস্থির হয়ে ওঠে। ওড়নাটা মেলে ধরতেই দেখলো গোলাপি ওড়নার আরেক পাশের কোনাটা কিছুটা ছেড়া। যেখানটায় ওইদিন আটকে গিয়ে কিছুটা ছিড়ে গিয়েছিল। ঝুমুর নিশ্চিত হয় এটা তারই ওড়না। ঝুমুর কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না এই ওড়না শ্রাবণের কাছে কেন।
,
ঝুমুর এবার শ্রাবণের টেবিলের দিকে তাকায়। ওখানে গিয়ে বই পত্র ঘাটতে ঘাটতে একটা সুন্দর ডায়েরি দেখতে পেল। ডায়েরিটা হাতে নিতেই শোভা রুমে ছুটে এসে হাফাতে হাফাতে বলছে, ভাবি ভাইয়াকে কারা যেন মেরেছে। ভাইয়ার মাথা ফেটে গেছে। রক্ত পরছে। তারাতারি চলো ভাবি।
,
শোভা ঝুমুরকে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এলো। বাসার সবাই ড্রইংরুমে এসে ভির করেছে। শ্রাবণ শোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। ঝুমুর দেখলো শ্রাবণের কপাল থেকে রক্ত পরছে। হাত পা এবং শরীরের আরও বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে। শ্রাবণ চোখ বন্ধ আছে। ঝুমুরের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখটা আধো খোলা করে বললো, ঝুমুর আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি এখান থেকে যেও না!
,
শ্রাবণের বাবা বললেন, ওকে তারাতারি ভেতরে নিয়ে যাও। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। শ্রাবণের মা কান্না করতে করতে বলছে, বাবা শ্রাবণ তোকে আমি কতো বার বলেছি কোনো ঝামেলার মধ্য যাস না! শ্রাবণ বললো, মা ঝুমুরকে যেতে দিও না।
শোভন আর শ্রাবণের চাচা শ্রাবণকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল।
,
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার এসে গেলো। শ্রাবণের জ্ঞান নেই। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। হঠাৎ বাড়ির সামনে গাড়ির হর্নের আওয়াজ পাওয়া যায়। লিমন আর নিয়ন এসেছে তাদের দলবল নিয়ে। নিয়ন গাড়ি থেকে নেমে বললো, এই তোরা সব কিছু ভেঙে ফ্যাল! পুরো বাড়ি তছনছ কইরা দে! আমার বোইনরে ওরা কষ্ট দিছে!
,
বাড়ির মেইন দরজা খোলা পেয়ে লিমন বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। সেই সাথে দলবল গুলো ঢুকে বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে। লিমনকে দেখে ঝুমুর ছুটে গেল। দৌড়ে ছুটে গিয়ে লিমনকে জরিয়ে ধরে বলছে, ভাইয়া এসেছিস!
– ঝুমুর তোর আর কোনো চিন্তা নেই আমরা এসে গেছি।
লিমন ঝুমুরকে নিয়ে বাহিরে বের হয়ে এলো। নিয়ন ঝুমুরকে দেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, এতক্ষনে আমার জানে পানি এলো। আমার তো কলিজা শুকায় গেছিলো। ঝুমুর এবার মিষ্টি করে হেসে দিয়ে লিমনের সাথে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। ঝুমুরের হাতে এখনো শ্রাবণের ডায়েরিটা রয়েছে। ঝুমুর খেয়ালই করেনি ওটা হাতে নিয়েই ঝুমুর রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো।
,
নিয়ন বললো, ওই তোরা চলে আয়। দলবল গুলো বের হয়ে গাড়িতে ওঠে। নিয়ন বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের গাড়িতে নিয়ন উঠতে যাবে তখনই বাড়ির ভেতর থেকে শোভা দৌড়েঁ ছুটে আসতে আসতে বলছে, ভাবি তুমি যেও না। ভাইয়া খুব অসুস্থ। ভাইয়াকে এই অবস্থায় ফেলে যেও না ভাবি!
লিমনের গাড়ি ততক্ষণে চলে গেছে ওখান থেকে। দলবলের গাড়িটাও স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। শুধু নিয়ন তার গাড়ির দরজাটা খোলার সাথেই শোভা এসে নিয়নের হাত চেপে ধরলো।
– আপনি প্লিজ ভাবিকে বোঝান। ভাবিকে এখন নিয়ে যাবেন না। ভাইয়ার অবস্থা খুব খারাপ। ভাইয়া সুস্থ হলে তখন না হয় ভাবিকে নিয়ে যাইয়েন।
,
নিয়ন এবার ভ্রু কুচকে শোভার দিকে তাকিয়ে শোভাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়ে এসেছে বলে ওড়না বুকে জড়িয়ে নিতে ভুলে গেছে। তারওপর এখন আবার এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। নিয়ন কিছু বলতে যাবে তখনই হঠাৎ জোরে একটা বাজ পরায় শোভা ভয় পেয়ে এগিয়ে এসে নিয়নকে জরিয়ে ধরলো।
শোভার নরম শরীরের উষ্ণতা আচমকা নিয়নের বুকে এসে লাগে। শোভা নিয়নকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে রেখেছে। দুইজনই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে।
,
চলবে….