লালগোলাপ Part-03+4

0
3849

লালগোলাপ
Part-03+4
Writer-Moon Hossain

বাসর নিয়ে সব মেয়ের একটা সাজানো সপ্ন থাকে। থাকে কিছু আশা, চাওয়া-পাওয়া। ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল খাট। এখন এই ফুলের খাট একাই রাজ ঘুমিয়ে আছে। কেঁটে যাওয়া স্থান গুলোতে মলম লাগানো হয়েছে।
শীতল রাতে কিছু খেলো না। সারাদিন না খেয়ে দূর্বল হয়ে পড়েছে। মাথা ঘোরাচ্ছে।
রাজ বেহুশের মতো পড়ে ঘুমুচ্ছো।
আজ তাদের বাসর ছিল সেটার সম্পর্কে কোন ধারণায় নেই রাজের।
শীতল কে অনেক বার বলার পরেও সে রাজের কামরা থেকে গেলো না।
দরজায় স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
স্বামীর পাশে বসবে সেটারও সাহস নেই।
কে জানে কখন রাজের ঘুম ভাঙে আর ঘুম ভাঙলে আবার হয়ত তান্ডব চালাবে।
-তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম মা।
লাঠি তে ভর দিয়ে শীতলের শশুর দাড়িয়ে আছে পেছনে।
শীতল ঘোমটা টেনে বলল- না বাবা। সব কপাল আমার।
-তোমার কপাল নয় মা। আমি তোমার বাবার কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে ছিলাম। তোমার বাবার সরলতার সুযোগ নিয়ে ছিলাম।
-থাক বাবা এসব।
-আমার পাগল ছেলের সাথে কোন মেয়ের বাবা তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে না। তাই ছলনার আশ্রয় নিয়েছি।
বউ পেলে যদি ছেলেটা ভালো হয়ে যায় এই আশায়। চোখ থেকে ফোটা ফোটা পানি পড়তে দেখলো শীতল। মুরুব্বি মানুষ এমন করে কান্না করলে নিজের চোখেও কান্না এসে যায়। অপরাধ বোধ হয়।
– বাবা থামুন। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।
আপনি অযথা চিন্তা করবেন না।
-তুমি আমাকে তাহলে মাফ করেছো?
-হ্যাঁ। আমার কোন অভিযোগ নেই কারও উপর।
-তাহলে খাবে এসো। না খেলে ভাববো তুৃমি এই বুড়োটা কে মাফ করোনি।
শীতলের শশুর বসে আছে আর শীতল খাচ্ছে।
শীতলের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
পাগল হলেও চলতো কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা!
কথা টা ভাবতেও পাচ্ছেনা সে। আত্মা কেঁপে উঠছে বার বার।
শীতল রাজের দুই বোনের সাথে ঘুমিয়েছে।
কেউ শীতলকে একটি কথাও বলল না। কথা বললেই শীতল কান্না শুরু করে দেবে তাই হয়ত কেউ বিরক্ত করছেনা।
.
-আপনার লজ্জা করেনা?
-কেন?
-এভাবে গার্লস কলেজের সামনে দাড়িয়ে আছেন তাই।
-ওআচ্ছা। কই আমি তো অনেকটা দূরে দাড়িয়ে আছি।
-কথায় পারা যাবেনা আপনার সাথে।
-তাহলে অযথা প্রশ্ন কেনো করো?
-একটা কথা রাখবেন?
-একশটা রাখব। বলেই দেখো।
-দাড়িয়ে আছেন, দাড়িয়ে থাকুন কিন্তু আমার পিছু পিছু আসবেন না।
– এটা রাখতে পারবনা। আই এম সরি।
যদি বলো একশত একটা নীল পদ্ম এনে দিতে তাও পারি।
যদি বলো সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে, তাও আমি পারি।
একবার বলে দেখো সুন্দরী!
-হাসন ভাই থামুন। লোকজন দেখছে।
-দেখলে দেখুক। তাতে আমার কি?
রাফিয়া আহত চোখে তাকিয়ে রইলো হাসানের দিকে।
-এভাবে তাকিয়ে থেকো না তুমি।
তাহলে যে খুন হয়ে যাব আমি।
-হাসান ভাই আপনার কিছু হবে না। হবে আমার। একটা ছেলে প্রতিদিন এক টাইমে দাড়িয়ে কথা বলে আমার সাথে। আশেপাশের লোকজন এটা লক্ষ্য করেছে। সবাই কেমন ভাবে তাকিয়ে থাকে দেখেছেন?
হাসান এদিক ওদিক তাকালো। আসলেই তাকিয়ে রয়েছে অনেকে।
হাসান রাফিয়ার থেকে একটু সরে দাঁড়ালো।
সে রাফিয়াকে দেখার জন্য আসে।ওর সাথে কথা বলার লোভ সামলাতে না পেরে কাছে এসে কথা বলে।
এক টাইমে কলেজে আসায় লোকজনও কেমন পরিচিত হয়েছে। অনেকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না এবার থেকে রাফিয়াকে শুধু দূর থেকে একবার দেখলেই হলো। কথা বলে রাফিয়াকে সমস্যায় ফেলার প্রয়োজন নেই।
রোদে দাড়িয়ে আছে হাসান।
রাফিয়া কলেজের গেইটের বাহিরের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে তাদের প্রাইভেট কারের জন্য অপেক্ষা করছে।
হাসানের ফর্সা শরীর রোদে পুড়ে লাল হয়েছে। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। বেচারার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন এতোটা পথ রোদে হেঁটে কেন আসতে যায়।
রাফিয়ার ইচ্ছে করছে হাসান কে ছাউনিতে আসতে বলতে। কিন্তু অস্বস্তি লাগছে বলতে।
হাসান আনন্দ মোহনে ফাইনাল ইয়ারে কেমিস্ট্রিতে পড়ে।দারুণ মেধাবী ছাত্র। হয়ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যেত কিন্তু হাসান ফর্ম পর্যন্ত তুলেনি। বিশেষ কারণে সে ময়মনসিংহে আনন্দ মোহনে রয়ে গেলো।আর রাফিয়া মুমিনুন্নেসা তে ইন্টার ১ম বর্ষে আর্টসে আছে।
হাসান প্রতিদিন ক্লাসের ফাঁকে হেঁটে রাফিয়াকে দেখতে আসে যখন রাফিয়ার ক্লাস শেষ হয়। রাফিয়া চলে না যাওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকে রোদের মধ্যে তারপর আবার বাকি ক্লাস করার জন্য হেঁটে আনন্দ মোহনে নিজের ক্লাসে যায়।
হাসান রাফিয়ার বাবার পরিচিতের ছেলে। গ্রাম থেকে ময়মনসিংহে লেখাপড়ার জন্য রাফিয়াদের বাসায় থাকে। রাফিয়ার বাবা যদিও হাসানের সব খরচ দিতে চায় কিন্তু হাসান তা নেয়না।
রাফিয়ার বাবার সম্মানের খাতিরে ওদের বাসায় থাকে আর খাওয়া-দাওয়া করে। বিনিময়ে রাফিয়া আর তার ছোট বোন রাফা কে টিউশন পড়ায়। হাসান অনেক গুলো টিউশন পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ সহ সবকিছু চালায়।
রাফিয়া তাদের লাল গাড়ি করে চলে গেলো।
হাসান কটকটে রোদে দাড়িয়ে রাফিয়ার যাওয়া দেখলো। হাসানের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।
আনন্দ মোহন থেকে রাফিয়ার কলেজ অনেকটা রাস্তা। হাসান চাইলে রিকশা নিতে পারে কিন্তু টাকা বাঁচিয়ে রাখে। কোনদিন রিকশা ভাঁড়ার টাকা গুলো দিয়ে বড়লোকের মেয়ো রাফিয়া কে গিফট দেবে সেই আশায়।

.
শীতল খুব ভোরে উঠে গোসল করেই নামাজ পড়ে নিয়েছে। কাল রাতের ঘটনার পর শীতল সকালে আর কোন মেহমান দেখেনি।
বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। বিশাল বাড়ির তুলনায় লোকজন একেবারে কম।
শীতল তার স্বামীর কামরা বহু কষ্টে খুঁজে পেলো। কাজের মেয়ে শীতল কে কামরা দেখিয়ে দৌড়ে চলে গেলো।
রাজ এখনো ঘুমুচ্ছে শেকল বাঁধা অবস্থায়।
রাজকে জীব জন্তুর মতোই দেখাচ্ছে।
শীতল ভয়ে ভয়ে রাজের কাছে গেলো। এখন ঘুমুচ্ছে তাছাড়া শেকলে বাঁধা তাই শীতল কে কিছু করতে পারবে না।
সকাল হয়েছে সবাই নাশতা করে নিয়েছে। রাজ এখনো করেনি তাই শীতলও করেনি।
আচ্ছা একবার কি রাজকে ডেকে নাশতা খাওয়াবে?
হঠাৎ শীতল কে অবাক করে দিয়ে রাজ চোখ খুলে ফেললো।
-তুমি আমার রুমে কি করো?
শীতলে ভয়ে চলে যেতে নিলে রাজ শীতলের হাত ধরে ফেললো।
-বলো এখানে কেন তুমি?
-আপনি যেখানে আমিও সেখানে। এটা কাল থেকে আমার বাড়ি হয়েছে।
-আমাকে তোমার পাগল মনে হচ্ছে?
শীতল ভয় পেয়ে গেলো। পাগল বলে তাকে পাগল মনে হচ্ছে নাকি!
সত্যি কথা বললে রাজ কামড়ে দিতে পারে। শীতল কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।
-চুপ করে আছো কেন? কালকের কথা
বলো? তুমি কার বউ?
রাজ গর্জনের সুরে কথা গুলো বলল।
শীতল কেঁদে দিলো।
-আরে কাঁদছো কেন?
আমি কি তোমাকে মেরেছি?
তবুও কাঁদে। এবার কাঁদলে কিন্তু আমি তোমার হাত কামড়ে খেয়ে ফেলব।
দিলাম কামড়।
শীতল কান্না থামালো।
-আমি আপনার বউ। আপনি আমার স্বামী। আমাদের কাল বিয়ে হয়েছে। আপনার বাবা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আপনি যেখানে থাকবেন সেখানে আমিও থাকব।
রাজ মাথা চুলকাচ্ছে।
-আমাদের বিয়ে হয়েছে?
-জ্বি।
-আমি তোমার স্বামী?
-জ্বি।
-তুমি আমার বউ?
-জ্বি।
রাজ কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে হাসতে শুরু করলো।
-আচ্ছা বিয়ে মানে কি? রাজের এমন কথা শুনে,
শীতল আহত চোখে কাঁদছে।
-এই তুমি কেঁদোনা। কারও কাঁদা দেখলে আমারও কান্না পায়।তুমি টেনশন করোনা। আমি একবার শেকল থেকে ছাড়া পেয়ে নিই, তোমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাব।
আই এম শিউর নিজের বাড়ি হাড়িয়ে ফেলেছো শ্রেয়সী।
শীতল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল – ইয়েস, হারিয়ে ফেলেছি। যতক্ষণ না নিজের ঠিকানা খুঁজে না পাব ততদিন আপনার বাড়িতে থাকব।
রাজ মাথায় হাত দিয়ে বলে – তোমার বাড়ি খুঁজে তোমাকে দিয়ে আসা এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য।
তোমার বাবা মা নিশ্চয়ই তোমার মতো কান্না করছে।

-ভাবি আমি রাফা। তোমার আপন হাসব্যান্ড এর আপন ছোট বোন।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– ভাবী তুমি রাগ করেছো আমাদের উপর?
-নাতো।
-বারান্দায় দাড়িয়ে তুমি কাঁদছিলে ভাইয়ার জন্য?
-নাতো।
রাফা রোগা ফর্সা হাসিখুশি টাইপ মেয়ে। এখনো সর্ট স্কার্ট পড়ে দুটো ঝুটি বেঁধে রাখে মাথায়। সবসময় সাজগোছ করে থাকে।
-আমি জানি উনার ছোট দুই বোন আছে। আপনার আরেক বোন কোথায়?
-আসসালামু আলাইকুম ভাবি।আপা কলেজে আছে। এখনি এসে পড়বে। আমি সবে এস এস সি দেব। এখনো স্কার্ট পড়ি। আর তুমি কিনা আমাকে আপনি বলছো?

-এই কান ধরলাম। ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
-নো, নেভার। এর মূল্য দিতে হবে।
-কি মূল্য?
রাফা হঠাৎ করে শীতলের কোলে মাথা রেখে বিছানায় পা ছড়িয়ে দিলো।
– শুনেছি বড় ভাবিরা মায়ের মতো হয়। তোমাকে দেখতেও আমার মায়ের মতো লাগছে। আমরা কখনো মায়ের আদর পাইনি। ভাইয়া একটু পেয়েছে, আপা হালকা কিন্তু আমার জন্মের পরেই তো…
রাফা থেমে বলল- বাবা অফিস নিয়ে পড়েছিল মায়ের সৃতি ভুলতে আর আমাদের আত্মীয় স্বজনরা নিজেদের সংসার নিয়ে বিজি ছিলো। কাজের লোকের হাতে আমরা ভাইবোন মানুষ হয়েছি।
মা বলতে ঠিক কি বোঝায় তা জানিনা। মায়ের আদর কেমন হয় তাও জানিনা।
রাফার হাসি মুখটা চোখের জলে ভরে গেলো।
শীতল রাফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
জানতে ইচ্ছে করছে তার শাশুড়ির কথা কিন্তু রাফা কে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে না।
-ভাবি দুপুর হতে চললো তুমি নাশতা করোনি এখনো।
সেই ভোরে উঠেছো।
-উনি না খাওয়া পর্যন্ত আমি খেতে পারিনা।
-কি ভালোবাসা তোমাদের। আমি কিন্তু বিয়ের পর কারও জন্য ওয়েট করব না।
শীতল হাসলো।
-আচ্ছা ভাবি তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কেন পড়?
তোমার আলসেমি লাগে না?
– না বরং মনে শান্তি আসে তাছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে গুনাহ সমূহ মাফ হয়ে যায়। মহানবী (সাঃ) কি বলেছো শুনবে?
-বলো।
– পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে মানুষের শরীর থেকে গুনাহসমুহ বের হয়ে যায়’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,তোমরা কি মনে কর,তোমাদের কারো ঘরের সামনে যদি একটি নদী প্রবাহিত থাকে এবং প্রতিদিন সে যদি উহাতে দৈনিক পাঁচ বার গোসল করে,তবে তার শরীরে কি কোন ময়লা থাকবে? সাহাবিগণ বলিলেনঃইয়া রাসুলাল্লাহ(সঃ),কোন ময়লাই বাকী থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃএরকম উদাহরণ হল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী ব্যক্তির ক্ষেত্রেও।এভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের বিনিময়ে আল্লাহ্ ঐ নামাজী ব্যক্তির যাবতীয়(ছগিরা)গোনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেন। [বুখারী ও মুসলিম শরীফ]
-আমাকে শিখিয়ে দেবে নামাজ কিভাবে পড়তে হয়?
-অবশ্যই।
.

-বৌমা তোমাকে নিজের বাড়িতে চলে যেতে হবে।
-কেন?
-রাজ কে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না ও বিয়ে করেছে। তুমি ওর বউ। ও তো পুরো কথা শুনছেই না। ওর কি সিচুয়েশন সেটা তো দেখতে পাচ্ছো। ভেবেছিলাম বিয়ে করলে বউ পেলে কিছুটা সুস্থ হবে। শেকল খুলে দিলেই একটা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে।
শীতল খুশি হয়ে বলল – কবে? কখন? কটায় বাড়িতে যেতে হবে।
-আজই।
শীতল নিজের জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো।
মনে হচ্ছে এই বাড়িতে রাজের সাথে তাকে আর থাকতে হবে না।
.
-আমি বাড়ি খুঁজে পেয়েছি।
শীতল মাথা নীচু করে রাজের সামনে এসে বলল কথাটা।
– তুমি চলে যাবে?
-আপনিই তো বললেন এটা আপনার বাড়ি। তাহলে আমি কেন আপনার বাড়িতে থাকব?
– চলে যাও।
আচ্ছা বিয়ে মানে কি?
একটু বলবে?
সবাই আমাকে বলেছে আমি বিয়ে করেছি কিন্তু আমি তো বিয়ে মানে কি সেটাই বুঝতে পাচ্ছিনা।
শীতল শান্ত গলায় বলল- আল্লাহ কে শাক্ষ্যি রেখে কবুল বলে একটা ছেলে একটা মেয়ে কে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেয়। তারা স্বামী এবং স্ত্রী হয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একসাথে থাকে।দুজনের উপর দুজনের অধিকার তৈরি হয়। সুখে দুঃখে একসাথে জীবন কাটায় তারা। এর নাম হলো বিয়ে।
রাজ মাথা চুলকিয়ে বলল- আমাদের বিয়ে হয়েছে!
-হ্যাঁ।
রাজ খুব শক্ত করে শীতলের হাত ধরে বলল- তাহলে তুমি এখন থেকে আমার সাথে থাকবে এই বাড়িতে,এই রুমে,আমার মতো শেকলে বাঁধা থাকবে।

.
চলবে……….

#লালগোলাপ
Writer-Moon Hossain
Part-04
শীতল রাজের সমস্ত দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিলো। সেই সাথে পুরো বাড়ি নিজের অধীনে নিয়ে নিলো। শীতল মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে সমস্ত সংসার চালনা করে। কখনো স্বামী শশুর ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সামনে যায়না। কঠিন পর্দা মেনে তার সকল দায়িত্ব পালন করে। একাই সবার দেখাশোনা করে সে। রাজদের বাড়ির সমস্ত কামরা, সিন্ধুক, লকারের চাবি শীতলের হাতে। বাড়ির সদস্য সহ সমস্ত কাজের লোকেরা শীতলের আদেশে চলে। এদিকে রাজদের আত্মীয় স্বজনরা কানাঘুষা শুরু করেছে।শীতল বউ হওয়ার আগে নিজের ইচ্ছে মতো যে যার মতো লুফে নিতো।বিশেষ করে শীতলের চাচী শাশুড়ী। তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখেন আর মনে মনে শীতলের সর্বনাশ চান কোটি কোটি বার। তার একটা ছোট পরিকল্পনা ছিলো যা ভেস্তে গিয়েছে শীতল এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর।
চাচী সুযোগের অপেক্ষায় আছে কখন সে নিজের পরিকল্পনা সফল করতে পারবে। এখন কেউ বাড়িতেও ঢুকতে পারেনা শীতলের অনুমতি ছাড়া। শীতলের পার্সোনালিটি এমন যে, শীতল সামনে দাড়ালে তার নেতৃত্ব সবাই মেনে নেবে।সংসারের সকল দায়িত্ব শেষ করে রাজ কে ঘুম পাড়িয়ে, শশুরের ঔষধ খাইয়ে, দুই ননদ কে পড়াশোনায় গাইড দিয়ে, কাজের লোকদের ঘুমুতে পাঠিয়ে, সংসারের সকল হিসেব নিকাশ শেষ করে এশারের নামাজ আদায় করে অনেক রাত পর্যন্ত কোরআন তেলওয়াত করে। রাতের কোলাহল মুক্ত নীরব স্তব্ধ পরিবেশে সবাই শীতলের সুরেলা তেলওয়াত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। মনের তৃপ্তি মিটিয়ে তেলওয়াত শেষ করে সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে রাজের দিকে মুখ করে। রাজ পুরো বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়। যেখানে শীতলের জায়গা হয়না তাছাড়া শীতলের কোথায় যেন একটা বাঁধা আছে রাজের কাছে ঘুমুতে। শীতল চোখ বন্ধ রাখলেও তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় রাজের উপর থাকে। শেকল মুক্ত রাজ হঠাৎ করে ভয়াবহ কিছু করে ফেলতে পারে। কারও উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে বা নিজের ক্ষতিও করতে পারে। শীতল ঠিক মাঝ রাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে। শীতলের কোরআন তেলওয়াতের সুরেই সবার ঘুম ভাঙে। এখন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনা শীতল কখন ঘুমায় আর কখন জেগে উঠে। নাকি সারা রাত পাগল স্বামীর পাহারা দেয় না ঘুমিয়ে। রাজ শীতলের সমস্ত কথা শুনে চলে। এপর্যন্ত কাউকে আঘাত করেনি। যখন শীতল কাছে থাকে তখন ঠিক সদ্য জন্মানো শিশুর মতো হয়ে থাকে তার কাছে। কিছুক্ষণ না দেখতে পেলেই রাজের মাথা ঠিক থাকে না। তখনই মাথা চুলকিয়ে গর্জন করে উঠে। আর বলে, আমার কিছু ভালো লাগছে না, আমার মন ভালো নেই, বুকে পাশে ব্যাথা করছে। শ্রেয়সী, শ্রেয়সী, শ্রেয়সী বলে চিৎকার করে।
শীতল তখন কোমরে হাত দিয়ে বলে – মহাশয়ের কি চাই?
রাজ কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে শীতল কে টেনে বিছানায় বসিয়ে কোলে মাথা রেখে হাত পা গুটিয়ে শুয়ে থাকে। তারপর শীতলের শাড়ির আচল নিজের হাতে বাঁধে। যেন তার কাছ থেকে চলে যেতে না পারে। শীতল বলেছিল বিয়ে মানে একসাথে থাকা। রাজের মাথায় কথাটা আটকে আছে তাই সে বিয়ে মানে একসাথে সবসময় থাকা বোঝে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যে দায়িত্ব গুলো থাকে তা রাজের বোঝার বাহিরে। রাজের মতো এমন শেকলে বাঁধা পাগল কে কিভাবে নিজের বসে এনেছে শীতল সেটা নিয়ে অনেকে জল্পনা কল্পনা বানিয়েছে। কেউ বলে, নতুন বউ জাদু করেছে, নতুন বউ মানুষ না।, নতুন বউয়ের উপর জ্বীন আছর করেছে।
রাজ শীতলের মাঝে যে পরম শান্তি খুঁজে পেয়েছে তা দেখে রাজের বাবার মনে শান্তি এসেছে। তিনি এখন দুঃশ্চিতা মুক্ত হয়ে অফিসে যান।
রাজ কে এখন শেকলে শেকলে বেঁধে রাখতে হয়না। এখন সে তার স্ত্রীর স্নেহের আঁচলে বাঁধা পড়েছে। সারাক্ষণ শীতলের সাথে থাকতে পছন্দ করে রাজ।
শীতল যখন কথা বলে তখন সে নানা রকমের প্রশ্ন করে শীতল কে।
শীতল সেগুলো যত্ন সহকারে বুঝিয়ে বলে। না বুঝলেও রাজ মাথা নাড়ায় যেন সব বুঝেছে। শীতল তখন রাজের কপালে টোকা দেয় আর রাজও শীতলের মাথায় টোকা দিয়ে হাসতে শুরু করে।
রাজ সারাক্ষণ শীতলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে সে।
এরমধ্যে রাজের মধ্যে একবারও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়নি।
শীতলের কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলো মাথায় ঘুরপাক খায়। রাজের কথা বার্তা দেখে মনে হয় সে যথেষ্ট শিক্ষিত। একজন শিক্ষিত লোক কিভাবে পাগল হয়ে গেলো সেটার উওর এখনো পাওয়া যায়নি। রাফিয়ার কাছ থেকে জানতো পারলো রাজ মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে ম্যানেজমেন্টে। রাজ দারুণ মেধাবী ছাত্র এতোকিছু হওয়ার পরও। শীতল রাজকে বোঝার চেষ্টা করে কিছু তো আছো যা সবাই ওর কাছ থেকে লুকাচ্ছিলো।
শীতল তার শাশুড়ির বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। সবার কথা বার্তায় বোঝা যায় তিনি গত হন নি।
বেঁচে যদি থাকেন তাহলে তিনি কোথায়? কেন তিনি তিন সন্তান কে ফেলে দূরে আছেন।শীতল রাজকে রাতের খাবারের পর দুধের সাথে চিনি মিশিয়ে দুধ পান করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। গরম দুধ হালকা চিনি মিশিয়ে খেলে ভালো ঘুম হয় আর ব্রেইনের জন্যও ভালো। রাজের জন্য এর উপকারিতাও রয়েছে। শীতলের কোলে মাথা রেখে এক ঘন্টা না শুয়ে থাকলে রাজের ঘুম হয়না। শীতল বিছানায় বসবে, রাজ শীতলের কোলে মাথা রাখবে গুটিশুটি ভাবে শুয়ে। আর শীতল কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে তবেই রাজের ঘুম আসবে।
.
শীতল কিচেনে গিয়ে আরও কয়েক গ্লাস দুধ গরম করলো। তারপর দুধে হালকা চিনি মিশিয়ে সবাই কে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেলো। বাড়ির সকল সদস্যের সাথে কাজের লোকদেরও জন্য শীতলের বিশেষ দুধ বরাদ্দ। শীতল সবাই কে এক চোখে দেখে।কাজের লোক বলে কাউকে অবহেলা করেনা। পৃথিবীতে সবাই এক সমান। আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব।
.
শীতল আজও প্রতিদিনের মতো সব কাজ সেরে দুধ নিয়ে শশুরের কামরায় গেলো। টেবিল থেকে ঔষধ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বলল –
-বাবা আসতে পারি?
ইজিচেয়ারে বসে আকাশের তারা দেখতে দেখতে তিনি বলল -এসো মা।
তোমার স্বামী ঘুমিয়েছে?
-জ্বি বাবা।
-ছেলেটা তোমাকে বড্ড জ্বালায় তাই না মা।
শীতল কিছু বলল না।
-জানো মা, রাজ কিন্তু খুব ভালো ছেলে ছিলো ছোট বেলায়। তার মায়ের সব কথা শুনে চলতো। আমাকেও অনুকরণ করতো।
আমি ওর মা কে নাম ধরে না ডেকে শ্রেয়সী বলে ডাকতাম। আর আমার ছেলেটা ঠিক মনে রেখে বিয়ের পর পরই তোমাকেও শ্রেয়সী নামে ডাকে।
শীতল শশুরকে দুধ, ঔষধ খাইয়ে চলে আসার সময় ভাবলো, আজ মনের প্রশ্ন গুলো বলবে, তিনি সারারাত কেন বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে কাটান। কি দেখে আকাশে। উনার কামরার দরজা খোলা থাকে তাই শীতল মাঝে মাঝে এসে দেখতে পায় উনি কি করছে। আজ পর্যন্ত খাটে ঘুমুতে দেখেনি, সারারাত ইজি চেয়ারেে বসে কাটায়। বসে থাকতে থাকতে যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন উনার মুখ থেকে শ্রেয়সী নামটা শোনা যায়। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদেও তিনি।
শীতল ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসী, সূরা ফাতিহা, আর সূরাতুল
বাকারাহ’র অংশ বিশেষ পড়ে ঘুমুতে গেলো। ঘুমানোর আগে শীতল সবসময় মহানবী (সাঃ) এর মতো সূরা গুলো পড়ে।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের ফজিলত: . “কোনো একদিন হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে বসে ছিলেন। হঠাৎ প্রচন্ড একটি শব্দ শোনা গেলো । হযরত জিবরাঈল (আঃ) নিজের মাথা উচু করে বললেন, এটা আকাশের সেই দরজা খোলার শব্দ যা আজকের পূর্বে আর কখনো খোলা হয়নি। উক্ত দরজা দিয়ে একজন ফিরিশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন, যিনি ইতোপূর্বে আর কখনো পৃথিবীতে আগমন করেননি । সে ফিরিশতা নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, আপনার জন্যে দুটো নূরের সুসংবাদ রয়েছে। সূরাতুল ফাতিহা এবং সূরাতুল বাকারার শেষ দুটো আয়াত উক্ত দুটো নূর । যা আপনার পূর্বে অন্য কোনো নবীকে প্রদান করা হয়নি। সূরা ফাতিহা এবং সূরাতুল বাকারার শেষ দুটো আয়াত থেকে একটি অক্ষরও পড়ে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আপনি যা কিছু প্রার্থনা করবেন তা প্রদান করা হবে ।” (মুসলিম, হাদীস নং- ৮০৬) . নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যামীন সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বে একটি কিতাব লিখেছেন। সেই কিতাব হতে তিনি দু‘টি আয়াত নাযিল করছেন। সেই দু‘টি আয়াতের মাধ্যমেই সূরা আল-বাক্বারা সমাপ্ত করেছেন। যে ঘরে তিন রাত এ দু‘টি আয়াত তিলাওয়াত করা হয় শাইতান সেই ঘরের নিকট আসতে পারে না। (তিরমিজি— ২৮৮২) . আয়ফা’ ইবনু ‘আবদিল কালা‘ঈ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আরয করল,হে আল্লাহর নাবী(ﷺ)! কুরআনের কোন আয়াত এমন, যার বারাকাত আপনার ও আপনার উম্মাতের কাছে পৌঁছতে আপনি ভালবাসেন? তিনি (ﷺ) বললেন, সূরা আল বাকারাহ্’র শেষাংশ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ‘আরশের নীচের ভাণ্ডার হতে তা এ উম্মাতকে দান করেছেন। দুনিয়া ও আখিরাতের এমন কোন কল্যাণ নেই যা এতে নেই। (মিশকাত— ২১৬৯) . জুবায়র ইবনু নুফায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সূরা আল বাকারাকে আল্লাহ তা‘আলা এমন দু’টি আয়াত দ্বারা শেষ করেছেন, যা আমাকে আল্লাহর ‘আরশের নীচের ভাণ্ডার হতে দান করা হয়েছে। তাই তোমরা এ আয়াতগুলোকে শিখবে। তোমাদের রমণীকুলকেও শিখাবে। কারণ এ আয়াতগুলো হচ্ছে রহমত, (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উপায়। (দীন দুনিয়ার সকল) কল্যাণলাভের দু‘আ। (মিশকাত— ২১৭৩) . হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, এটা আমার জানা নেই, উপযুক্ত বয়সের এবং জ্ঞান-বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন কোনো মুসলমানদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছে যে, রাতে ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী এবং সূরাতুল বাকারার শেষ দুটো আয়াত তিলাওয়াত করে না। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৫) . বাদ্‌রী সাহাবী আবূ মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, সূরা বাকারার শেষে এমন দু’টি আয়াত রয়েছে যে ব্যক্তি রাতের বেলা আয়াত দু’টি তিলাওয়াত করবে তার জন্য এ আয়াত দু’টোই যথেষ্ট। অর্থাৎ রাত্রে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করার যে হক রয়েছে, কমপক্ষে সূরাহ বাকারার শেষ দু’টি আয়াত তেলাওয়াত করলে তার জন্য তা যথেষ্ট। (সহিহ বুখারী— ৪০০৮)
.
শীতল রাজ কে নিয়ে এক ফ্যামিলির অনুষ্ঠানে গেলো আজ। অনেক দিন পর রাজ বাহিরে বের হলো। শীতল নিজ হাতে রাজকে পোশাক
পরিচ্ছদ পড়িয়েছে। অনুষ্ঠানে সবাই নানা ধরনের কথা বলছিল তাদের নিয়ে। আর তাদের থেকে একটু দূরে দূরেও থাকলো। আড়ালে কিছু মহিলারা ওদের সাথে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠলো। শীতল মুরুব্বি বলে কিছু বললনা। সময় হলে ঠিক প্রতিবাদ করবে। শীতল কথা বলছিল আর রাজ তার পাশেই বসেছিল হঠাৎ রাজ কে দেখতে পেলো না। শীতলের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। এক জায়গায় ভিড় দেখে সেখানে গিয়ে শীতল রাজকে দেখতে পেলো। কিছু লোকজনদের মারধর করছিল রাজ। রাজকেও অনেকে আঘাত করছে।
এক লোকের মাথা ফেটে রক্তাক্ত অবস্থা। রাজের কপাল থেকেও রক্ত পড়ছে কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। বেশ ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে অনুষ্ঠানে।
চলবে