শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-০১

0
1749

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_01
#Writer_NOVA

শাড়ির কুচিগুলো একহাতে ধরে তাড়াহুড়ো করে রিকশা থেকে নামলাম। তারপর যেই কলেজ গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকবো ওমনি একজনের মাথার সাথে জোরে বারি খেয়ে ধপ করে নিচের মাটিতে পরে গেলাম।কিন্তু সে পাথরের মূর্তির মতো সোজা দাঁড়িয়ে আছে।

আমিঃ আমার মাথাটা গেলো রে।নিশ্চয়ই ফেটে গেছে। কে রে? চোখে কি দেখেন না নাকি?আমার মাথা ফাটানোর দায় সম্পূর্ণ আপনার।কারো মাথার সাথে লাগলো নাকি লোহার সাথে তাই বুঝতেছি না।

মাথা ধরে নিচে বসে বিলাপ করা শুরু করলাম।আমার মাথাটা নিশ্চয়ই ফেটে গেছে।প্রচুর ব্যাথা করছে। কয়েক মিনিট তব্দা মেরে ছিলো।আশেপাশের কোনকিছুতে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।যখন হুশ এলো তখন চিৎকার করেই কথাগুলো বলে উঠলাম।সামনের মানুষটা আমাকে মাটির থেকে উঠানোর জন্য তার হাতটা আমার দিকে বারিয়ে দিলো।আমি সশব্দে তার হাতে একটা চড় মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়ালাম। মাটি থেকে উঠে শাড়ি ঝাড়া দেওয়ায় মনোযোগ দিলাম।যার দরুন সামনে থাকা ব্যক্তিটাকে আর দেখা হলো না।

—- আর ইউ ওকে?

তার প্রশ্ন শুনে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তার দিকে রাগী লুকে তাকালাম।দুই হাত পকেটে গুঁজে একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার পেছনে আরো কতগুলো ছেলে।মাথায় বারি খাওয়ার চক্করে আশেপাশের কোন দিকে খেয়াল ছিলো না আমার।শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে দুই হাত কোমড়ে রেখে তাদের দিকে ঝগড়া করার ভঙ্গিতে বললাম।

আমিঃ ইচ্ছে করে আমার মাথার সাথে আপনার মাথা বারি খেয়ে এখন ভালো সাজা হচ্ছে। দিলেন তো আমার শাড়ির অবস্থা খারাপ করে।আমার মাথাটা এখনো ব্যাথা করছে।আপনার মাথাটা কি লোহা দিয়ে বানিয়েছেন নাকি? মেয়ে দেখলে কি হুশ থাকে না?সবসময় অযুহাত খুঁজেন কিভাবে মেয়েদের ডিস্টার্ব করা যায়।

আমার শেষের কথা শুনে সবাই রেগে গেলো।সাথের ছেলেগুলো আমার দিকে তেড়ে আসতেই সে ছেলেটা হাত বাড়িয়ে চোখের ইশারায় তাদের মানা করলো।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে অনেকটা রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।

— আপনি কিন্তু এবার বেশি বলছেন?

আমিঃ আমি একটুও বেশি বলছি না।যা সত্যি তাই বলছি।আপনাদের সাথে কথা বলার মতো কোন মুডে আমি নেই। তাই রাস্তা মাপেন।যত্তসব, মুডটাই খারাপ করে দিলো।

পরপর দুইবার ভেংচি কেটে তাদেরকে সাইড কাটিয়ে সামনের দিকে চলে গেলাম।একবার পেছনে ঘুরে দেখি সবাই অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু কেন তা আমি জানি না। পেছনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে আরেকজনের বুকের সাথে এসে মাথা বারি খেলো।আজকের দিনটাই খারাপ আমার।আমি মাথায় শুধু বারিই খাচ্ছি। বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে মাথা উঠিয়ে দেখি লোকটা আর কেউ নয়।আমার খালাতো ভাই তায়াং।চোখ দুটো হাতির চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

তায়াংঃ চোখ কোথায় রেখে হাঁটিস নোভা? পেছনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে না জানি কখন কিছুর সাথে বেজে উষ্ঠা খেয়ে পরিস।আর শাড়ি খুলে তেরটা বেজে যায়।এত সময় লাগে তোর? তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার মাথার চুল সাদা হওয়ার জোগাড়। এক মিনিট কারো সাথে ঝামেলা করিস নি তো আবার?

আমিঃ এই তোর মাথায় কি ভালো কিছু ঘুরে না রে? সবসময় আমি ভেজাল করতে কলেজে আসি।আজকে একটা অনুষ্ঠানের দিন সেখানে আমি ভেজাল করবো।এতটা বোকা এই নোভা নয়।

তায়াংঃ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

আমিঃ তোর বিশ্বাসের গুল্লি মারি।তন্বী কোথায়?

তায়াংঃ স্টেজের ভেতর বসে আছে। আমি তোকে নিতে এসেছি। আর পাঁচ মিনিট দেরী করলে আমি বাসায় যেতাম।সেখান থেকে কান ধরে তোকে নিয়ে আসবো বলে।

আমিঃ একে তো আমাকে রেখে চলে এসেছিস তার মধ্যে এত কথা।যা ভাগ সামনের থেকে।

তায়াংঃ এখানে দাঁড়িয়ে কি ঝগড়া করবি শাঁকচুন্নি? নাকি ভেতরেও যাবি।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া একদম শাঁকচুন্নি বলবি না।আমি কি তোকে এখন পাঠা বলি।

তায়াংঃ দেখ আমি মোটেও ঝগড়া করার মুডে নেই। ভেতরে চল।

আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিলাম।তার আগেই তায়াং ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো।স্টেজের ভেতরে তন্বীর পাশে বসিয়ে কোথায় জানি চলে গেল।আজকে দুটোর সাথে মাথায় বারি খেলাম।কিন্তু কাউকে মন মতো বকতে পারিনি বলে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম।

তন্বীঃ কি গো কি হয়েছে নোভা আপু তোমার? মুখটাকে এমন পেঁচার মতো করে রেখেছো কেন?

আমিঃ একদম কথা বলবি না। সবকিছু তোর জন্য হয়েছে।

তন্বীঃ আমি কি করছি?

আমিঃ তোরা ভাই-বোন ইচ্ছে করে আমার সাথে এমনটা করেছিস।আমাকে একা রেখে চলে এসেছিস।

তন্বীঃ আমার কবিতা আবৃত্তি ছিলো।তোমাকে তো বললাম আজ আমার জলদী যেতে হবে।কিন্তু তুমি তো শুনলি না।সকাল আটটা পর্যন্ত পরে পরে ঘুমালে।তৈরি হওয়ার সময় তোমাকে তো ঠেলে ধাক্কিয়েও উঠাতে পারলাম না।তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম আমি কি চলে যাবো, তুমি কি আমাদের সাথে যাবে?তখুনি স্পষ্ট করে কাঠ কাঠ গলায় বললে যে, “তোরা চলে যা, আমি একা চলে যেতে পারবো।”

আমিঃ ঘুমের মধ্যে আমি কি বলেছি তা নিজেও জানি না।তাই বলে আমাকে একা রেখে চলে আসবি?

তন্বীঃ আমাদের কি দোষ? তুমিই তো বললে।

আমিঃ তোরা থাকলে কি এত কাহিনি হতো?না আমি তাড়াহুড়ো করে আসতাম না ঐ ছেলের সাথে ঝামেলা হতো।

তন্বীঃ কোন ছেলের সাথে আবার ঝামেলা করেছো?আজকের দিনেও এসব ছাড়োনি?(অবাক হয়ে)

আমিঃ বকরবকর করিস না তো।মেজাজ গরম আছে। ঠাস করে কানের নিচে দুটো দিয়ে বসতে পারি।

আমার কথা শুনে তন্বী চুপ হয়ে গেলো।আজ আমাদের কলেজে পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠান।প্রতি ২০ বছর পর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই উপলক্ষে দুই দিনের জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাখা হয়।সাথে থাকে বিভিন্নরকম প্রোগ্রাম। নতুন,পুরাতন সকলের জন্য এই দুইটা দিন অনেক আনন্দের।পুরাতন সবার সাথে দেখা,সাক্ষাত হয়।কত আনন্দ যে হয় এই দুই দিন।তা বলে বোঝানো যাবে না। সেই উপলক্ষে আমি ও তন্বী রাণী গোলাপি পাড়ের কালো শাড়ি পরে এসেছি। আশেপাশে মানুষের গিজগিজ।

আপনাদের এবার শর্ট করে আমার পরিচয়টা দিয়ে দেই।আমি নোভা ইসলাম।গ্রামের এক মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। আমার কোন ভাই নেই। আমার পর আমার এক ছোট বোন।বাবা এক ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করে।আর মা আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। এতক্ষণ যে মেয়ের সাথে কথা বললাম সে হলো আমার একমাত্র খালামণির মেয়ে। তন্বীরা এক ভাই এক বোন।বড় ভাই তানভীর রহমান তায়াং আর ও তনীমা রহমান তন্বী।পড়াশোনার সুবাদে আমাকে খালামণিদের বাসায় থাকতে হয়।এবার অনার্সে একাউন্টিং-এ ২য় বর্ষে আছি।তন্বী আমার থেকে পাক্কা এক বছরের ছোট।ও এবার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১ম বর্ষে।তায়াং ভাইয়া এই কলেজের স্টুডেন্ট। সেই হিসেবে আজ সেও এসেছে।

স্টেজের মধ্যে বক্তারা বকরবকর করেই যাচ্ছে। কিন্তু আমার সেদিকে খেয়াল নেই।তবে ধ্যান ভাংলো তন্বীর কথায়।

তন্বীঃ আপু, একটু ওয়াসরুমে যাবো চলো না।

আমিঃ ওকে চল।

ভিড় ঠেলে কোনরকম তন্বীকে ওয়াসরুমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আসার সময়।বাগানের দিকটায় ততটা মানুষ নেই। বলতে গেলে ফাঁকাই বলা যায়। নাচ শুরু হয়েছে বলে সবাই স্টেজের দিকে ছুটেছে।সেই বাগানের দিকে কতগুলো বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে আমি ও তন্বী দুজনেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।হঠাৎ করে আমার শাড়ির আঁচলে টান পরতেই পেছনে ঘুরে তাকালাম।তারপর যা দেখলাম তা সহ্য করার মতো অবস্থায় আমি নেই। একটা ছেলে আমার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে।আমি দুই হাত ঘষে থাপ্পড় মারার প্রস্তুতি নিয়েও ফেললাম।কিন্তু তখনি পেছন থেকে কেউ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।

—- কি হচ্ছে এখানে?

#চলবে।