শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-২৯

0
486

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৯

ধূসর আকাশের বুকজুড়ে এক ফালি রক্তিম আভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মৃদু হাওয়ায় ঝাপটে পড়ছে কৃষ্ণচূড়ার লালচে ফুলের তোড়া। কালচে পাথুরে রাস্তার উপর কার্পেটের মতো বিছিয়ে আছে ছোট ছোট পাতা। বেলা আর শিলা জানালার ধারে বসে আছে। আকাশের বুকে নিবদ্ধ থাকা দৃষ্টি সরিয়ে বেলা মনোযোগ দিলো ফোনের ওপর। গত দু’দিন ধরে শাইনি ক্রমাগত ওর ফোনে ফোন করে যাচ্ছে। যখন থেকে বেলার মুখে শুনেছে ও আরাফাতকে বিয়ে করতে চায় তখন থেকেই শাইনি একপ্রকার সাইকোর মতো বিহেভ করছে। জেলাসিটা চরম পর্যায়ে
পৌঁছাতে পেরে বেলার খুব শান্তি শান্তি লাগছে। বেলা ইচ্ছাকৃতভাবে শাইনির একটা ফোনও রিসিভ করছে না। করতে থাকুক ফোন, দেখুক কেমন মজা। দ্বিতীয় বিয়ে করার সাধ জেগেছে মনে! করুক এবার দ্বিতীয় বিয়ে। ও বিয়ে করলে বেলা কেন পারবে না বিয়ে করতে? মুখে বললেও বেলা কখনোই তা করবে না। শুধু শাইনিকে ক্ষেপানোর জন্যই কথাটা বলা। এবার ফোন বাজতেই বেলার ঠোঁটের কোণে থাকা দুষ্টুমির হাসিটা চওড়া হলো। আঙুলে গুণে বলে উঠলো, ‘এই নিয়ে ৫৪৮+ কল।’

শিলা বসে ছিলো ওর পাশে। বেলার কান্ড দেখে সে হেসে বলে উঠলো, ‘এটা করা কী ঠিক হচ্ছে ভাবি?’

বেলা অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘অবশ্যই ঠিক হয়েছে।’

‘ভাইয়া না জানি পাগল হয়ে যায়..’

‘দেখুক কেমন লাগে। বিয়ে করবে, করাচ্ছি বিয়ে..’

‘তোমরা একেকজন টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া করছো কিন্তু।’

বেলা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ঝগড় কোথায় করলাম শিলা? আমি তো ওনাকে সত্যটা বললাম।’

‘তুমি কী আর আরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করবে?’

বেলা দুষ্টু হেসে বলল, ‘করলেও করতে পারি। তোমার ভাই পারলে আমি কেন নই? নারী-পুরুষের সমান অধিকার, জানো তো?’

এ পর্যায়ে শিলার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে থাকা হাসিটা নিমিষেই মুছে গিয়ে সেখানে বিব্রতকর এক টুকরো হাসি জন্মালো। কোনোরকমে বলল, ‘ভাইয়া তো তোমাকে ভালোবাসে।’

‘সে তো আমিও বাসি।’

‘তাহলে কেন আরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করবে?’

‘তোমার ভাইয়া কেন দ্বিতীয় বিয়ে করবে?’

শিলা বলল, ‘ওটা তো মজা করে বলেছে।’

‘তা জানি না। তবে ওনি করলে আমিও করতে পারি। আমি তো আর বুড়ি হয়ে যাইনি যে লোকে আমাকে পছন্দ করবে না। এখনো যথেষ্ট কিউট লুক আছে আমার, তাই না?’

শিলা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘তা আছে। তুমি দেখতে খুব মিষ্টি।’

বেলার হাতের ফোনটা আবারও বাজলো। এবারেও শাইনি। তবে এবারের ফোনটা কেটে দিয়ে সে শিলাকে ঘিরে বসলো। শিলার চিন্তিত, বিমর্ষ মুখখানি দেখে ওর একটু খারাপই লাগলো। ওর কী এখানে থাকতে ভালো লাগছে না? নাকি বেলা ওকে ঠিকঠাক সময় দিতে কার্পণ্য করছে? সমস্যা কী ওর? মেয়েটার মনে কী চলছে? বেলা বেশ কিছুক্ষণ ওকে অবলোকন করলো। ভাবনা শেষে আনন্দিত গলায় অতি উৎসাহের সহিত জানতে চাইলো, ‘তোমার কাউকে পছন্দ আছে শিলা?’

শিলা বিব্রত কন্ঠে বলল, ‘আরে নাহ!’

‘তোমার ক্লাসমেট বা টিউশনেও কেউ নেই?’

‘নাহ।’

বেলা গম্ভীর গলায় বলল, ‘শুনো শিলা। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, তোমার এখনকার বয়সটা খুব সেনিসেটিভ। সেটা জানো তো?’

শিলা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘এই বয়সে ছেলেমেয়েরা আবেগ দিয়ে বেশি চলে, জানো তো?’

‘হ্যাঁ।’

বেলা আলতো হেসে বলল, ‘এই সেনসেটিভ বয়সটাতে তুমি যতটা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে চলতে পারবে, ততোই ভালো। এই বয়সেই বেশিরভাগ মানুষ ভুলের দারস্থ হয়। জগতের সবকিছু আমাদের কাছে রঙিন লাগে। রাগ, জেদ বেড়ে যায়। এগুলোকে একটু কন্ট্রোল করতে পারলে জীবনটা জটিল হবে না। যেমন- আমিও এই বয়সটাতে নিজেকে খুব নিয়ন্ত্রণ করে চলেছি। বাবা-মাকে নিজের বন্ধু করে নিয়েছিলাম, সব ঘটনা ওদের সাথে শেয়ার করতাম। যার ফলে আমি কোনো প্রবলেমে পড়লে ওরা সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতো। জানো তো, জগতে বাবা-মায়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর একটাও নেই?’

শিলা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার কাছে তো ওরা কেউ-ই নেই। আর আম্মু তোমাদের সাথে যা করেছে, আমি কিছুতেই মাফ করবো না তাঁকে।’

বেলা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,’এভাবে বলতে নেই শিলা। মায়ের ওপর এতটা রাগ রেখো না। তিনি তোমার জন্মদাত্রী, তোমার নিজের মা।’

শিলা আক্ষেপের সুরে বলল, ‘মা হলেও কী? মায়ের মর্যাদা ওনি রাখতে পারেননি। ভাইয়ার সাথে যা করেছে এটা ক্ষমার অযোগ্য।’

বেলা নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো, ‘ভেবে দেখো, ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তুমি যা যা ভুল করেছো তা কী তোমার প্যারেন্টস’রা ক্ষমা করে দেয় নি? স্পেশালি তোমার মা?’

শিলা নিরস গলায় বলল, ‘হুম।’

‘তাহলে? তুমি কেন পারবে না? তুমি তো তোমার মায়েরই মেয়ে, মানে আরেক মা। ধরো, তুমি একজন মা, আর আন্টি তোমার সন্তান। তাহলে তোমার সন্তান যদি ভুল করে তাহলে মা হয়ে তুমি নিজের সন্তানকে ক্ষমা করতে পারবে না?’

শিলা ব্যথিত গলায় বলল, ‘মন থেকে আসছে না ভাবি। ক্ষমা তো মন থেকে আসতে হয় তাই না?’

বেলা মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি সময় নাও। মায়ের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবো, তাহলে বুঝতে পারবে প্রতিটি মা-ই নিজের সন্তানের কল্যাণের জন্য যে-কোনো কিছু করতে রাজি।’

শিলা মন খারাপ করে বলল, ‘তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সত্যিই কী তুমি ভাইয়াকে ছেড়ে আরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করবে?’

বেলা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এজন্য তোমার মন খারাপ?’

শিলা মাথা নিচু করে বলল, ‘হুম। ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবাসে!’

বেলা সহাস্যে বলে ওঠলো, ‘আমিও বাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি। ওসব তো ওনাকে রাগানোর জন্যই বলেছিলাম!’

শিলার অস্থির মনটা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। যাইহোক, বেলা শাইনিকেই ভালোবাসে। আরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করবে না। সে খুশি গলায় বলল, ‘যাক নিশ্চিত করলে আমাকে। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম তুমি বুঝি..’

ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বেলা বলল, ‘এক মুহূর্তের জন্য তুমি ভেবেছিলে আমি তোমার ভাইয়াকে ছেড়ে আরাফাত ভাইকে বিয়ে করে নিলেও নিতে পারি। কী তাইতো?’

শিলা বলল, ‘হ্যাঁ।’

বেলা বলল, ‘এই জীবনে আর পিছু ছাড়ছি না তোমার ভাইয়ের। এতোদিন অনেক জ্বালিয়েছে, এবার আমার পালা। দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি নিতে আসলে এমন দেব না, আমাকে ছাড়ার কথা সে বেমালুম ভুলে যাবে। পৃথিবীতে ওই এক পিস অমূল্য জিনিস আছে, যাঁর ভাগ আমি কখনো কাউকে দিতে পারবো না!’

শিলা হাসতে হাসতে বলল, ‘ভাইয়া তোমার জিনিস?’

বেলা মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিল, ‘জিনিসই তো! সাইন করা আছে তাঁর উপর। আমার নিজস্ব সম্পত্তি। যে ভাগ বসাতে আসবে তার প্রাণনাশ করে ফেলব।’

শিলা বলল, ‘জিনিয়াস তুমি, ভাবিজান।’

‘দেখতে হবে না কার ভাইয়ের বউ!’

‘এক্সিলেন্ট!’

………

‘ভালোবাসার’ ব্যক্তিটির কাছে সবসময় নিজের প্রাধান্যটাই পেতে চায় মানুষ। কিন্তু সেখানে যদি তৃতীয় কোনো ইনসানের নাম আসে, তখন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু শাইনির বেলার তার ব্যতিক্রম ঘটলো। বেলার ওপর প্রচন্ড রেগে গেলো। কেন ওর মুখে অন্য পুরুষের নাম থাকবে? কেন বলবে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায়? বেলা কী বুঝে না তাঁকে ছাড়া শাইনি সম্পূর্ণ অচল! গাছকে যেমন বাঁচিয়ে রাখতে সারের প্রয়োজন হয়, তেমনি ওকে বেঁচে থাকতে হলে বেলার প্রয়োজন। আর সেখানে ও কি-না নিজের মুখে অন্য অবিবাহিত পুরুষের নাম নিচ্ছে? আবার দু’দিন ধরে ওর ফোনও রিসিভ করছে না! সাহস বেড়েছে মেয়েটার। বড্ড সাহস বেড়েছে। ডানা বেশি উড়লে কীভাবে ছাঁটতে হয়, তা জানা আছে শাইনির। সে ঘরের মধ্যে পাক খেতে খেতে কয়েকবার ভাবলো সে কী করবে। বেলার কথাটাকে সে মোটেও সহজভাবে নিলো না। বরংচ বেশ গুরুত্ব দিয়েই নিলো। কারণ ওর অনুপস্থিতিতেও আরাফাত নামক ডাক্তার ছেলেটা নাকি বেলাদের অনেক সাহায্য করছে। বাজার করা, হেলথের খেয়াল রাখাসহ বিভিন্ন কাজে ওদের সাহায্য করেছে, উপরন্তু সে বেলার অতি নিকটাত্মীয়। সে হিসেবে আলাদা একটা কনসার্ন তো থাকবেই। এসবে শাইনির আপত্তি না থাকলেও, আরাফাত ছেলেটাকে ওর সহ্য হয় না। চেনাজানা নেই, তবুও শাইনির মনে হয় আরাফাতকে দেখলেই নাক বরাবর ঘুসি মারবে!

এরপর বেলার মুখে বিয়ের কথা শুনে ভাবলো, আরাফাত নিশ্চয়ই নিজেকে বেলার সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যার ফলে বেলা ওকে বিয়ে করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছে। এর জন্য বেলার কোনো দোষ নেই। দোষ নিশ্চয়ই ওই আরাফাতের। নিজেকে স্মার্ট দেখাতে চায়, হুহ! বিষয়টা শাইনি কিছুতেই মানতে পারলো না। বাবার সাথে আলোচনা করে খুব দ্রুত নিজের চিকিৎসা, যাবতীয় ফর্মালিটি এবং যা যা দরকারি কাজ ছিলো সবকিছু কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে ফেললো। তখন অবশ্য শাইনি পুরোদমে সুস্থ। অতঃপর টিকেট কেটে বাবাকে নিয়ে সোজা প্লেনে চেপে বসলো। বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালো সন্ধ্যা সাতটায়। আলম সাহেবকে মানা করলো দেশে ফেরার ঘটনাটা কাউকে না জানাতে। ড্রাইভারকে ব্যাগপত্র বুঝিয়ে দিয়ে জোর করে আলম সাহেবকে বাসায় পাঠিয়ে দিলো। আর নিজে এলো আরাফাতের হসপিটালে। আরাফাতের সম্বন্ধে লোক লাগিয়ে আগেভাগেই সব খোঁজ নিয়ে রেখেছিলো শাইনি। রাতে যখন ডিউটি শেষ করে বাসায় ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে হসপিটাল থেকে ক্লান্ত হয়ে বেরুচ্ছিলো আরাফাত, ঠিক তার অদূরেই কয়েকজন ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো। ছেলেগুলো ওর পথ আটকালে আরাফাত বেশ অবাক হলো। কিছু বলতে যাবে, তখনই একদল দুর্বৃত্ত আক্রমণ করে বসে ওকে। চার-পাঁচজন আধবয়সী ছেলে বেধড়ক মারতে শুরু করলো আরাফাতকে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছুটার পর হসপিটালের সিকিউরিটি গার্ড দূর থেকে দেখতে পেলো ঘটনাটা। বাঁশি বাজিয়ে এদিকে ছুটে আসতেই দুর্বৃত্তরা দৌড়ে পালালো। আর লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালের ভেতর নিয়ে গেলো আরাফাতকে। ক্লান্ত অসাড় দেহখানি এতোটা ধকল সইতে না পেরে তখন জ্ঞান হারিয়েছে। একটা হাত ভেঙে দিয়েছে ওর, চোখেমুখে জখম। দূর থেকে তা দেখতে পেয়ে বাঁকা হাসলো শাইনি। নিজে মারতে না পারুক, অন্তত বুকের জ্বালাটা মিটলো তো। শাইনি প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘এবার দেখি বেলা বউ, কীভাবে এই হাতভাঙা ছেলেটাকে বিয়ের কথা ভাবো তুমি। যা শিক্ষা দিয়েছি না, তোমার দিকে চোখ তুলেই তাকানোর সাহস করবে না। শ্রীঘ্রই আমি আসছি তোমার কাছে প্রিয়!’

চলবে…ইনশাআল্লাহ।