শ্রাবণ তোমার আকাশে পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
1466

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___শেষ পর্ব

বিস্ময়ে অভিভূত বেলার কাছে সবকিছু স্বপ্ন-ই মনে হচ্ছিলো। এই বুঝি ঘুম থেকে উঠে দেখবে সবকিছু কল্পনা ছিলো। শাইনি ওর চমকানোটা বেশ ভালোই উপভোগ করছে। ড্রইংরুমের দরজায় কাছেই দু’জনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সীমা বেগম, শিলা হাসছেন বেলার কান্ড দেখে। শাইনি বলল, ‘এবার তো ঘরে ঢুকতে দাও, পা দুটো ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।’

বেলা মাথা তুলে দরজা থেকে খানিকটা সরে দাঁড়ালো। শাইনি ঘরে ঢুকলো, পেছন পেছন বেলাও এলো। সীমা বেগম আর শিলার হাসি দেখে বেলা কটমট করে তাকালো। শাইনি বেডরুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো, ফ্রেশ হয়ে আসতেই সীমা বেগম জোর করে খেতে নিয়ে গেলেন ডাইনিংয়ে। আনন্দে তখন বেলার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। সব দুচিন্তা আর বিরহের যন্ত্রণা নিমিষেই সুখের আলোয় আন্দোলিত হতে লাগলো যেন। মানুষটা তার সামনে বসে খাচ্ছে, কতদিন পর দৃশ্যটা অবলোকন করলো ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হলো। আল্লাহ ওর কথা শুনেছেন, লোকটাকে ওর কাছে সুস্থ করে পাঠিয়েছেন। বেলা শুকরিয়া আদায় করে নিলো।
এরইমধ্যে হাঁটাহাঁটি সেরে বাসায় ফিরে এলেন নাইমুদ্দীন ও আলম সাহেব।

বেলা আলম সাহেবকে দেখে এগিয়ে গেলো। অনেক কথাবার্তা বললো ওনার সাথে। নাজনীন বেগমের ব্যাপারেও কথা হলো। শিলার কথা চিন্তা করে ওনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করলো। আলম সাহেব রাজি হলেন না, কারণ সত্যিটা এখন শাইনিও জানে। সত্যটা জানার পরে শাইনি ভালোমন্দ কিছুই বলেনি ওনাকে। তাই তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তবে তিনি নিজেও নাজনীন বেগমকে ক্ষমা করেন নি। দুঃখের দিনে যে পাশে না থাকে, সুখের দিনে তার পাশে থাকার অধিকার নেই। মানুষ চেনা যায়, দুঃখ, বিপদাপদের দিনে। বেলার সঙ্গে আলম সাহেবের কি কথা হলো শাইনি তা জানতে চাইলো না। সব কাজ শেষ হওয়ার পর বাসার সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলো। সবাই খুব ক্লান্ত থাকায় এরপর, ঘুমানোর উদ্দেশ্যে যার যার ঘরে চলে গেলো। বেলার সঙ্গে শাইনিও ওর ঘরে চলে এলো। কতদিন পর দু’জন কপোত-কপোতী প্রিয় মানুষটাকে পাশে পেয়েছে নিজেদের। শাইনি বিছানায় সটান শুয়ে পড়লো। বেলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নাজনীন আন্টিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আপনার অভিব্যক্তি কী?’

শাইনি চোখ তুলে তাকালো, ‘তোমার কী?’

বেলা বলল, ‘ফিরে আসুক, অন্তত শিলার জন্য।’

শাইনি বলল, ‘সেটাই হবে।’

বেলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মন থেকে বলছেন তো?’

শাইনি ওর মাথার নিচে দু’টো হাত যুগলবন্দী করে রাখলো। তারপর শূন্য দৃষ্টিতে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অন্যরকম কন্ঠে বলল, ‘কোনোদিন কল্পনাও করিনি তিনি আমার মা নন। আমার যে জন্মদাত্রী একজন মা ছিল, তা আমি জানতে পারি মাস ছ’য়েক আগে। বাবা নিজেই বলেছিলো। হসপিটালের বেডে শুয়ে সেদিন আমি অনুভূতি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, কষ্টেসৃষ্টে আমার বুক দুমড়েমুচড়ে কয়েক ফোঁটা জল চোখের কোণে জমেছিলো। শিলার-মা আমার মা নয়, আমার মা নেই, তাঁকে চোখের দেখাও দেখিনি, সে পৃথিবীতেই নেই এসব কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমি। শিলার মা-কে আমি এত ভালোবাসতাম যে, ওনি যা বলতো আমি তাই করতাম। তবুও ওনি আমার প্রতি কখনো মনোযোগ দেন নি, যার ফলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই মা-ছেলের মধ্যে যেটুকু আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকার কথা, তাও কমে যাচ্ছিলো। তবুও সম্মান-শ্রদ্ধা করতাম ওনাকে। এসবকিছু মানলাম। কিন্তু আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে তিনি যে তোমাকে প্রতিনিয়ত আমার থেকে দূরে করার চেষ্টা করেছে এটা আমি মানতে পারছি না কিছুতেই। এজন্য মন থেকে ক্ষমাটা আসছে না। মন থেকে ক্ষমা না আসলেও আমি কিছুই বলবো না তাঁকে। কারণ সারাজীবন আমি মা বলেই মেনে এসেছি তাঁকে। আব্বু চাইলে ফিরিয়ে আনতে পারে, আমার সমস্যা নেই কোনো। তবে কোনোদিন আর নিজের মা ভাবতে পারবো না আমি।’

কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে শাইনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলো। বেলা ঘাবড়ে যায়। ওর ভেতরে কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা অনুমান করার চেষ্টা করে। শাইনিকে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে চুপটি করে ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। শাইনি ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে, ‘কষ্ট পেয়েছিলাম খুব।’

বেলা আনমনে বলে, ‘কষ্টের পরেই সুখ আসে।’

শাইনি বিগলিত গলায় বলে, ‘দূরে থাকলে নাকি সম্পর্ক, একে অপরের প্রতি টান ভালো হয়? আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। প্রেমে পড়েছি আবার নতুন করে, তোমার!’

‘ভালোবাসি!’

শাইনি ঠোঁট ছোঁয়ালো বেলার চিবুকে, কপোলে। অদ্ভুত এক ভালোলাগা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছিলো ভালোবাসা নামক অদ্ভুত অনুভূতির স্রোত। এতগুলো রাত অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে নিজেদের কাছে পেয়েছে দু’জন। এই পাওয়াটাই তো ভাগ্যের ব্যাপার।

……………..

ভোরের নরম রোদ চোখের উপর মাখামাখি হতেই আঁখি পল্লব দুটো কুঁচকে ফেললো বেলা। পক্ষীদের কিচির-মিচির শব্দ খুব জোরে কানে বাজছে। বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো ও। চোখজোড়া আধো আধো খুলে
জানালার পর্দাটা সে টেনে দিলো। এলোমেলো খোলা চুলগুলো পিঠের নিচে পড়ে আছে। বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে চুলের কাঁটা বের করে সযত্নে চুল বাঁধলেও বিরক্তির কালচে আঁধারে ছেয়ে আছে ওর চেহারা। বিছানার অপর পাশে চোখ পড়তেই বিস্মিত মুখটা অল্পবিস্তর হা হয়ে গেলো। শাইনি উদোম গায়ে শুয়ে আছে, তাও আবার ওর কোলের ওপর হাত রেখে। মানে কী? তাহলে সত্যিই এটা! কাল রাত থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ওর ভ্রম বলে মনে হচ্ছিলো শুধু। বেলা শিওর হওয়ার জন্য নিজের হাতে নিজে খুব জোরে চিমটি কাটলো, চোখ ডলে ভালো করে তাকালো সে শাইনির দিকে। নাহ, সবকিছু ভ্রম নয়। বেলার ঠোঁটের কোণে ভোরের টুকরো রোদের মতো এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে চুমু খেলো শাইনির ঘুমন্ত চোখের পাতায়। নিজের ওপর কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে শাইনির ঘুমটা ভেঙে গেলো। কিন্তু বেলার কান্ড দেখার জন্য সে চোখ বুজে ওর অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে। বেলা চুমু খেয়ে ফট করে সরে যেতে নিলেই শাইনি রোবটের মতো চোখ খুলে তাকায়। বেলা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। শাইনি ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, ‘সুযোগ নেওয়া হচ্ছিলো নাকি আমার?’

বেলা ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায়, ‘আ আমি কেন সুযোগ নিতে যাবো?’

‘তাহলে এতক্ষণ কী করছিলে আমার ওপর ঝুঁকে?’

বেলা থতমত খেয়ে বলল, ‘আপনার চোখের ওপর মশা বসেছিলো।’

শাইনি ভার গলায় বলল, ‘রাতে শ্বাশুড়ি মা নিজে অ্যারোসল স্প্রে করে গেছেন ঘরে। মশা আসলো কোথা থেকে? আর তাছাড়াও মশা তো আর আমার চোখের ওপর বসে চুমু খাবে না, খাবে আমার রক্ত!’

লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘ধুর..’

‘ভালোই মিথ্যে বলা শিখেছো দেখছি!’

বেলা বলল, ‘জানেনই যখন, আবার এত জেরা করছেন কেন?’

শাইনি বাঁকা হেসে বলল, ‘ভালো লাগে তাই। পানিশমেন্ট দেওয়ার আগে জেরা করে নেওয়াটাই তো নিয়ম। অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে বলে কী জেরা করবো না?’

বেলা ভ্রু কুঁচকালো, ‘অপরাধী, জেরা.. এসব কী বলছেন আপনি?’

শাইনি বাঁকা হেসে বলল, ‘আমার শান্তিপূর্ণ ঘুমটা ভেঙেছে তোমার সুইটডুইট মর্নিং কিসের কারণে। অথচ আমি রাতে যখন চাইলাম, তখন দিলে না। নিজে থেকে তো কোনোদিনও আদর দাও নি আমায়, আমি কিন্তু কাল রাতে নিজে থেকেই তোমাকে আদর দিলাম, আমি এতোটাও কিপটে নই৷ আর বিনিময়ে কী দিলে এটা তুমি? পিঁপড়ের সাইজের একটা সুইটডুইট মর্নিং কিস! তুমি আমার অধিকার ক্ষুন্ন করেছো, তাই তুমি অপরাধী। তার জন্য এখন কী পেতে হবে? ইয়েস, পানিশমেন্ট!’

রাতের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বেলা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললো। এই লোক এমন নির্লজ্জ, বেহায়া কেন? প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য কিছু একটা করা উচিৎ, আর তা হলো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। শাইনির সামনে থাকলে সে অনর্গল কথা বলে বেলাকে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টায় থাকবে। যেমনটা পাহাড়ে থাকার সময় করতো। পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই একরাশ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল বেলার উদাসী মনটা। ঘর থেকে বেরুনোর উদ্দেশ্যে পা নামাতেই শাইনি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘যাচ্ছো কোথায়?’

বেলা হতভম্ব গলায় বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে যাব, কেন?’

‘এত সকালে কেন?’

‘সকাল সাড়ে সাতটা। আর আপনি এত সকাল বলছেন? আংকেল আছেন বাসায়, আম্মু একা একা নাস্তা বানাতে হিমশিম খাবে। আমার যাওয়া দরকার সেখানে।’

শাইনি মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘আমার থেকে পালানোর চেষ্টা তাই না?’

বেলা স্বীকার করলো না। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় সে শাইনিকে বলল, ‘আমাদের আরাফাত ভাইকে কে বা কারা জানি মারধর করেছে। ঘটনাটা জানেন আপনি?’

শাইনির কপালে ভাঁজ পড়লো, ‘সে কে?’

‘আরে আরাফাত ভাই, আপনার চিকিৎসায় যিনি অনেক হেল্প করেছিলেন!’

শাইনি কটমট করে বলল, ‘ওই ডাক্তার?’

বেলা দুঃখ পাওয়া গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। জানেন, কিছু দুর্বৃত্ত ওনার ওপর অ্যাটাক করেছিলো। হাত ভেঙে, অনেক জখমও হয়েছে।’

শাইনি কাঠ কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কষ্ট হচ্ছে?’

বেলা মন খারাপ করা গলায় বলল, ‘কষ্ট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যে লোক ওনার এই অবস্থা করেছে তাকে সামনে পেলে ঠাটিয়ে গাল ফাটিয়ে দিতাম। গুন্ডাগিরি সব জায়গায় চলে না, ভালো একটা মানুষের ওপর কীসের এত রাগ থাকতে পারে কারোর? স্ট্রেঞ্জ!’

শাইনি এবার রেগে বলল, ‘উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। অন্যের বউয়ের কাছে নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে গেলে এরকম অবস্থাই হবে।’

বেলা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মানে? আপনি ওনার এই অবস্থা করেছেন?’

শাইনি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো, ‘করেছি, একশো বার করব।’

বেলা আর্তনাদ করে বলল, ‘কেন?’

‘তোমার কাছে স্মার্ট হতে চেয়েছিলো। দেশে ফিরে প্রথমেই ওর ক্লাস নিয়ে নিলাম।’

বলেই চুপ করে গেল। কারণ বেলা জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চুপ হয়ে যাওয়ায় বেলা পুরো ঘটনা শোনার জন্য ওকে চেপে ধরলো। অগত্যা শাইনি পুরোটা স্বীকার করলো ওর কাছে। সব শুনে বেলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এমনও লোক হয়? এত্ত জেলাসি শাইনির মাঝে? যদিও বেলার নিজেরও কম নয়। হোটেলঘরের কথা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলো। তবুও, শাইনির এই কাজটা করা উচিৎ হয় নি। আরাফাত নিতান্তই ভদ্র ছেলে, যথেষ্ট স্মার্টও। ওর বিয়ের জন্য মেয়েও দেখা হচ্ছে। বেলার সামনে কখনোই নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করে নি। ওরা তো খুব ভালো বন্ধু। বেলা মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘আপনি ওনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবেন।’

শাইনির কপালে ভাঁজ পড়লো, ‘কেন?’

‘আমি বলছি তাই।’

শাইনি বলল, ‘পাগল! যদি জানতে পারে আমি করেছি তাহলে তোমাদের ফ্যামিলির সাথে রিলেশন থাকবে না।’

বেলা চিন্তিতমুখে বলল, ‘ঘটনা জানানোর প্রয়োজন নেই। সেটা পরে একদিন আমি বলবো। আপনি ওনাকে স্যরি বলবেন।’

শাইনি হতাশ হয়ে মুখ কালো করে বলল, ‘দেখা যাবে।’

বেলা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘যাইহোক, আপনি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। ঔষধের বক্সটা টেবিলের ওপর রাখা আছে, ভুলে যাবেন না আবার। আর কাজটা মোটেও ভালো করে নি আপনি।’

শাইনি বিগলিত গলায় বলল, ‘ঠিক আছে।’

বেলা ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে শাইনির কাপড়চোপড় বের করে বিছানার ওপর রেখে দিয়ে রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করতে চলে গেলো। শাইনির মন ভার হয়ে আছে। বেলার মুখে আরাফাতের নাম ওর একদমই সহ্য হচ্ছে না। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বিড়বিড় করে সে বলল,’যার জন্য করলাম চুরি, সে-ই বলে চোর।’

…………………

বিকেলের দিকে বেলার পুরো পরিবার আরাফাতদের বাসায় ওকে দেখতে গেলো। শাইনি মোটেও রাজি হচ্ছিলো না। কিন্তু বেলা জোর করায় যেতেই হলো। নাইমুদ্দীন সাহেব, সীমা বেগম, শিলা, আলম সাহেবও গেলেন। শিলা এবং সব বয়স্ক ব্যক্তিরা ব্যস্ত ড্রইংরুমে গল্পগুজবে। আর ওখানে গিয়ে বেলা শুধু আরাফাতের সাথেই গল্পগুজব করে কাটালো। শাইনির সঙ্গে কথা বললো না, এড়িয়ে চলছিলো। মনে মনে অভিমান আর রাগ হয় শাইনির। পরে নিজে থেকেই আরাফাতের কাছে গিয়ে ‘স্যরি’ বললো। আরাফাত অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কেন স্যরি বলছেন?’

শাইনি থমথমে গলায় বলল, ‘আসলে আমি আপ..’

বেলা শাইনির কান্ড দেখে ভেতরে ভেতরে হেসে খুন। এবার ওকে থামিয়ে দিয়ে আরাফাতকে উদ্দেশ্যে করে বলল, ‘এমনি বলেছে, ওনি সারাদিন কাউকে না কাউকে স্যরি বলতেই থাকেন। এটা ওনার ব্যাড হেবিট বলতে পারেন।’

আরাফাত হেসে বলল, ‘ওহ আই সী। বাই দ্যা ওয়ে, আমার জন্য একটা মেয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। এবার বোধহয় বিয়েটা সেরে ফেলতেই হবে।’

শাইনির বুক থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেলো যেন। বলল, ‘নতুন জীবনের জন্য অগ্রিম শুভ কামনা, ডাক্তার সাহেব।’

তারপর মনে মনে বলল, ‘যাক, হাতভাঙা ডাক্তার সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে যাক, আমি এবার নিশ্চিন্ত। বেলা বউ আমারই থাকবে, আজীবন।’

বেলা আড়চোখে ওকেই লক্ষ্য করছিলো। ওকে মুচকি হাসতে দেখে নিজেও হেসে ফেললো। লোকটা পাগলই বটে! আরাফাতদের বাসা থেকে বিদায় নিতে নিতে রাত নয়টা বেজে গেলো। যার ফলে সেদিন আর শাইনিদের বাড়ি ফিরে যাওয়া হয়নি। পরদিন সকালে নাস্তা সেরে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে বেলা শাইনির সঙ্গে রওয়ানা দিলো ভালোবাসার সংসারটাকে নতুন উদ্যমে শুরু করার জন্য। পুরোনো সকল ঝামেলা মিটলো, বেলার বাবা সবকিছু খুশিমনে মেনে নিয়েছে, শাইনিও সুস্থ! এসবের থেকে খুশির বিষয় আর কী হতে পারে! বেলার কথায় আলম সাহেব নাজনীনকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন। তিনি খুব অনুতপ্ত। কিন্তু বেলা ছাড়া আগের মতো তার সাথে আর কেউ কথা বলে না। অবশ্য বেলার বিশ্বাস, সময়ের সাথে তার ভালোবাসার সংসারে যেটুকু জটিলতা আছে সেসবও মিটে যাবে। একটা অনাবিল সুখের ঘর হবে ওর, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবে!

………………..

সময়টা শ্রাবণের মাঝামাঝি। বৃষ্টি শেষে পূর্বাকাশ দখল করে উঠেছে রংধনু। সোনালি সূর্য মেঘের নিচে ঢাকা পড়েছে সেই কখন। আকাশে ওড়াওড়ি করা কালচে তুলোর মতো মেঘকুঞ্জরা দ্রুতগতিতে পথ পাড়ি দিচ্ছে। পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে বেলা লক্ষ্য করছিলো রক্তিম আভায় রচিত আকাশের লালিমাটুকু। গায়ে তার ঘন মেঘ অঙ্কিত শাড়ি, চুলগুলো এলো করা খোঁপায় আটকে আছে, মুখে নেই কোনো প্রসাধনী। কয়েক গাছি চুল কানের পাশে পড়ে আছে অবহেলিত ভাবে। শাইনি সেগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। মুগ্ধ চোখে তার প্রাণনাশিনীর দিকে তাকিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলো। বেলা মুচকি হাসলো। বিমোহিত গলায় বলল, ‘খুব সুন্দর আজকের আকাশ, তাই না?’

শাইনি ভ্রু কুঁচকে ওকে লক্ষ্য করে বলল, ‘হ্যাঁ, আজকের আকাশ খুব সুন্দর। শ্রাবণের আকাশে আজ অনেক মেঘ।’

বেলা এবার দৃষ্টি ফিরালো শাইনির দিকে। একবার নিজের দিকে তাকিয়ে তারপর কঠিন গলায় বলল, ‘আমি আমার কথা বলছি না।’

‘আমিও আমার কথা বলছি না। বলছি আজ শ্রাবণের আকাশে অনেক মেঘ। মেঘের রঙে মেঘবতী সেজেছে সে।’

বেলা ধৈর্যহীন গলায় বলল, ‘আপনি পারেনও বটে।’

‘ভালোবাসি বলেই না!’

বেলা হেসে ফেললো। তখন পাহাড়ের ওপর ঝুপ করে নেমে পড়লো এক পশলা বৃষ্টির রুমঝুম ছিঁটেফোঁটা। দুজন চলে এলো খড় দিয়ে তৈরি করা সেই ঘরটির ভেতর। প্রায় তিন বছর পরেও ঘরটি আগেরমতোই আছে। শ্রাবণ এলেই পাহাড়ে আসার জন্য শাইনি উদগ্রীব হয়ে পড়ে। এবার বেলাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে। দু’জন একান্তে পাহাড়ের মাঝে সময় কাটাতে খুবই ভালোবাসে। সবকিছু খুন রঙিন মনে হয়। এই পাহাড়, সবুজ গাছাগাছালির হিমেল বাতাস, পাহাড়ের পাদদেশের ছোট ছোট ঘরবাড়ি, দূরের মন্দির থেকে আসা ঘন্টার আওয়াজ সবই মনে দোলা দিয়ে যায়। পাহাড়ে ওপর মাচায় বসে ওরা দু’জন পাশাপাশি বসে যখন রাতের আকাশ দেখে, তখন মনে হয় তাঁদের চেয়ে সুখী পৃথিবীতে আর কেউ নয়।

আজকের আকাশেও অসংখ্য তারা। রাত নেমেছে অনেক আগে। শাইনি বেলার হাড়মাংস জ্বালিয়ে খেয়েছে এতক্ষণ। এটা করো না, ওটা করো না বলতে বলতে একসময় বেলা একসময় প্রচন্ড রেগে যায়। পাহাড়ে এসে যদি বাড়ির মতো নির্দেশনা মানতে হয় ওর, তাহলে ওকে নিয়ে এসেছে কেন? শুধু একটু বৃষ্টিতে ভিজায় কাল রাতে জ্বর এসেছিলো বেলার। সকালেই তা কমে গেছে। দুপুরবেলা বৃষ্টি দেখে খুব ইচ্ছা করছিলো আবার বৃষ্টিতে ভিজার। তাতেই শাইনি রেগে একাকার। বেলা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে মাচায় এসে বসে রইলো। শাইনি দেখলো সেটা, খারাপ লাগলো ওর। মেয়েটা সত্যিই ভিজিতে পছন্দ করে। রাগারাগি করাটা ঠিক হয়নি। ভালোবেসে বুঝিয়ে বললেই হতো। আসলে, অভিমান রাগ একমাত্র তার উপরেই করা যায়, যাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা যায়। কীভাবে বেলার রাগ ভাঙাবে ভাবতেই চট করে মাথায় একটা আইডিয়া আসলো। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে মাচায় গিয়ে বেলার পেছনে বসে রইলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। বেলা রাগী স্বরে বলল, ‘ছাড়ুন আমায়!’

‘ছাড়বো না। রাগ ভাঙো আগে।’

বেলা কটমট করে বলল, ‘ভাঙবো না। আপনি কথা বলবেন না আমার সাথে, আর আমিই বা কেন কথা বলছি আপনার মতো নির্দয়ের সাথে। ছাড়ুন আমায়, আমি একা থাকতে চাই!’

শাইনি সটান উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর গলায় বলল, ‘একা থাকতে চাও? দ্যান ওকে। আমি মরে গেলে একা-ই থেকো। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার ভালোবাসা তোমার প্রতি কখনোই ফুরুবে না, তোমাকে ছাড়া একা থাকা কখনোই সম্ভব না আমার পক্ষে। অসুস্থতার সময় তুমি পাশে ছিলে বলে বাঁচার ইচ্ছা হয়েছিলো। এখন যেহেতু আমাকে লাগবেনা, তাই মরে যাওয়াটাই বেটার।’

শাইনি বড় বড় পা ফেলে পাহাড়ের কিনারে যেতে লাগলো। বেলা আঁতকে উঠলো। লোকটার যা জিদ, যা বলবে তাই করতে দ্বিধাবোধ করবে না। বেলা ওঠে একপ্রকার দৌড়েই ওর পথ আগলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ‘আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন, আমি আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচবো ভাবলেন কী করে, মরে যাবো আমি!’

শাইনি চোখ বন্ধ করে বলল, ‘একা থাকতে চাও কি-না তাই..!’

‘হুহ, ভালোবাসি!’

শাইনি একগাল হেসে বেলার অধরে ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো। বেলা ওর শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলো। তখন মেঘ সরে চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণ আলোকিত চাঁদ হাসছে ওদের দেখে। অজানা এক সুখে ভাসছিলো তাঁরা। শাইনি বেলার ঘাড়ে থুতনি রেখে কানে কানে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

“মেঘে মেঘে লুকোচুরি
ভালোবাসায় খানিক বাড়াবাড়ি।
পাহাড়ের পাদদেশে, অন্তনীল আকাশে
রংধনু ছড়িয়ে দেব, আর দেবো মেঘ!
তোমার প্রেমে মগ্ন আজ
শ্রাবণের রামধনুর রঙ।
রঙিন মেঘ আছে আমার আকাশে,
মুঠো করে পাঠিয়ে দিলাম
আজ কিছু,
শ্রাবণ তোমার আকাশে!”

সমাপ্ত।
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]