সেদিন মুষুলধারে বৃষ্টি ছিল পর্ব-১১

0
660

#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–11
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

বাইরে থেকে সূর্যের তীক্ষ্ম উত্তাপ এসে গায়ে লাগছে মুহিবের। সে মুখে তিক্ততা এনে চোখ খুলে দেখে ফকফকা রোদ রুমে এসে উঁকিঝুঁকি মারছে৷ তার ভ্রু কুচকে গেল। সে একটা হাই তুললো। অনেক দিন পর একটা আরামদায়ক ঘুম হলো তার।

মাঝে মাঝে সেজুতির বাসায় এসে এভাবে একটা শান্তিময় ঘুম ঘুমিয়ে যেতে হয় তো!

সে ফোন বের করে অন করতেই অবাক হয়ে যায়। এখন পৌনে এগারোটা বাজছে। এতোবেলা হলো কখন?

সে মাথা ঘুরিয়ে রুমে সেজুতি কে খুজতে লাগলো। কিন্তু রুমে সেজুতির উপস্থিতি নেই। মুহিব আরো একটা হাই তুললো। চোখ থেকে ঘুম-ঘুম ভাব সরছেই না৷ নেশা করেও তো এতোক্ষন ঘুম ভাব থাকে না।তার একটু শীত-শীত করছে। একটা পাতলা কাথা জড়িয়ে নিলে খুব মজা হত৷

মুহিব আবারো শুয়ে পড়ে। সেজুতি সারারাত ছাদেই ছিলো? মুভি তো তিন ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এরপর সে কি করলো?

একবারো মুহিবের ব্যাপারে ভাবলো না?

সেজুতি কি জানে না? আজকে দুপুর হলেই মুহিব ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবে। জানার তো কথা! না জানলে তাকে জানিয়ে দিতে হবে। সেজুতিকে সাথে নেয়ার ইচ্ছা ছিলো খুব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না নেয়াই উত্তম। সেজুতি তার উপরে রেগে আছে। কিছুদিন যাক, এরপর ঢাকায় একেবারে সেজুতি কে নিয়ে শিফট হতে হবে।

ওলরেডি এগারোটা বাজে। আর দেরি করা যাবে না। বাসায় যেতে হবে। বাসা থেকে দুইটা বাজার আগেই বেরুতে হবে। কালকে ঢাকায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে তার। মুহিব আরো একটা হাই তুললো। এই মূহুর্তে বিছানা থেকে উঠতে মন চাচ্ছে না।মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে যুদ্ধ চলছে৷ মন চাচ্ছে আরো একটু ঘুমিয়ে নিক আর মস্তিষ্ক চাচ্ছে এখনি উঠে যাক!

মিনিট দশ পর মুহিব উঠে দাড়ালো এবং বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে পকেট থেকে সেজুতির ফোন বের করে টেবিলে রেখে, রুম থেকে বের হলো।

রুম থেকে বের হতেই সেজুতির বাবার সঙ্গে তার দেখা মিললো।

তিনি এক গাল হেসে মুহিবকে বলে উঠে, আরে জামাইবাবু! উঠে গেছো। আসো বাবা নাস্তা খেতে আসো।

মুহিব অস্বস্তি ভরা হাসি হাসলো। এরপর নাস্তা খেতে গেল। চোখ ঘুরিয়ে সে সেজুতিকে খুজছে। মেয়েটা গেল কই? নিজের বাসা থেকে হাওয়া হয়ে গেল? নাকি ছাদে হাওয়া খাচ্ছে?

মুহিবকে চমকে দিয়ে সেজুতি রান্নাঘর থেকে হাতে ট্রে নিয়ে বের হলো। ট্রেতে লুচি, আলুত দম, মিস্টি আর গরুর মাংস লাল লাল করে রান্না করে সাজানো আছে। সঙ্গে কয়েক প্রকারের ফল-মূল।

দিনাজপুর আর চিটাগংয়ের মানুষজন গরুর মাংস খেতে দারুণ পছন্দ করে।

মুহিবকে খাবার বেড়ে দেয়া হলো। মুহিবের কাছে আজকে সেজুতি কে কিছুটা অন্য রকম লাগছে৷ মুহিব বুঝে পাচ্ছে না এই অন্যরকম লাগার কারণটা কি? সেজেছে কি? নাহ মনে হয়!

মুহিব খাওয়ায় মন দিলো। সেজুতির সঙ্গে একা একা কথা বললে বোধহয় সুবিধা হত৷ কিন্তু সে উপায় ও নেই৷

সে ইতিমধ্যেই রান্নাঘরে চলে গেছে৷ আর একটু পর নাস্তা করেই বের হবে মুহিব। পারলে এখনি চলে যায় সে। কিন্তু এটা অভদ্রতামি জয়ে যায় কাজেই বসে বসে লুচি ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে৷

খাওয়ার মাঝে মুহিব সেজুতির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমাকে আজকে দুপুরে ঢাকা ব্যাক করতে হবে৷

সেজুতির বাবা মুহিবের মুখে একথা শুনে ভারী অবাক হলো। তিনি বলে উঠে, আজকেই যাওয়া টা খুব জরুরি বাবা?

মুহিব হেসে উত্তর দিল, জরুরি নাহলে আমি নিজেই যেতাম না।

উনি হালকা হাসলেন।

মুহিব বলে উঠে, আমি চাচ্ছি সেজুতি এখানে কয়েকদিন থাকুক। এরপর আমি কিছুদিন পর এসে ওকে ঢাকায় নিয়ে যাব৷

উনি বললেন, ঠিক আছে।

— আমাকে তো এখন উঠতে হবে।

খাওয়ার টেবিলে সেজুতির বেশ কয়েকজন কাজিন বসেছিল তার সঙ্গে। এরা সেই হলুদের দিন ও সেজুতির সঙ্গে দেখা করার জন্য পাচ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল।

মুহিব তার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা বুঝলো তাহলো, ম্যারিজ ইস এ লস প্রজেক্ট!

তার খাওয়া শেষ। তবুও সে বসে আছে। ট্রে থেকে আপেলের পিস তুলে মুখে দিচ্ছে। সে মূলত সেজুতির অপেক্ষায় আছে।কিন্তু রাধুনি সাহেবা সেই যে রান্নাঘরে ঢুকেছে আর তো বের হন না!

আধ ঘন্টা পর মুহিব দাড়িয়ে বলে উঠে থমথমে গলায় বলে, আসসালামু আলাইকুম আংকেল। যাই তাহলে।

— আচ্ছা। বাবা। সেজুতির সঙ্গে দেখা করো।

মুহিব বলে উঠে, দরকার নাই। যাই তাহলে আমি। আল্লাহ হাফেজ।

মুহিব বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসতেই তার মনে পড়লো, সেজুতি তখন মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছিল এজন্য অন্য রকম দেখতে লাগছিল তাকে!

এই সামান্য একটা নতুনত্বে কিভাবে একজনের চেহারায় এতো পরিবর্তন এসে গেল সেটাই বুঝে পাচ্ছে না মুহিব৷

মুহিবের গাড়ির হর্ণের শব্দ রান্নাঘর থেকে শুনতে পেল সেজুতি।তার ভ্রু কুচকে গেল। সে মাত্র দুপুরের রান্না চড়িয়েছে। এক চুলায় বিরিয়ানি আর অন্য চুলায় দুধ চা। মুহিব নাকি সকালে এক কাপ দুধ চা খায়৷

সেজুতি ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে বের হলো রান্নাঘর থেকে।

তাকে আসতে দেখে তার বাবা মুখে গাম্ভীর্য এনে বলে উঠে, মুহিব তো চলে যাচ্ছে।

সেজুতি মুখ ফসকে বলে, কোথায়?

— মা তুমি কিছু জানো না?

— কি জানব!

— মুহিব আজকে ঢাকায় চলে যাচ্ছে।

— ওহ৷ (ভাবলেশহীন ভাবে বলল কথাটা)

উনি ভারী অবাক হলো এবং কড়া গলায় বলে, মুহিবের সঙ্গে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত তোমার ছিলো৷ আমি কিন্তু এক ঘরে দুই মেয়ে দিতে চাইনি। তুমিই জোর গলায় বললে এই ছেলেকেই বিয়ে করবে৷ নাহলে বিয়েই করবে না। এজন্য কেবল তোমার জন্য আমি রাজী হয়েছি।

সেজুতি মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে বলে, এসব কথা অযথা এখন কেন বলছো আব্বু?

উনি রাগী গলায় বলে উঠে, অযথা বলছি না। তুমি নিজ ইচ্ছায় মুহিবকে বিয়ে করেছ।আমরা তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছি৷ এখন তোমার উচিত আমার সম্মান রাখা৷

সেজুতি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে৷ বাবার কথা তার মাথায় ঢুকছে না। সে বলে, আচ্ছা। তোমার সম্মান আমার কাছে আমানত স্বরুপ।এর খিয়ানত হবে না৷

এটুকু বলে সে রান্নাঘরে এসে চুলায় বসানো কেতলি থেকে দুধচা ফেলে দিলো৷

তাদের বাসার সাহায্য কর্মী বকুল আপা তা দেখে থ হয়ে যায়। বকুল জানে ছোট আপামনির মেজাজ বেশ চড়া। হুট করে রেগে যায় আর রাগের স্থায়িত্ব ও দীর্ঘমেয়াদী হয়৷

সেজুতি বিরিয়ানি চড়ানো চুলাটাও বন্ধ করে দিতে দিতে বলে, বকুল আপা বাকি রান্না তুমি কর।

বকুল ভয়ে ভয়ে বলে, কিন্তু ছোট আপা রান্না না আপনার করার কথা ছিলো৷

— আমরা অনেক কথাই তো বলি। সব তো আর রাখা সম্ভব। আমি রুমে যাচ্ছি। কেউ যেন আমাকে না ডাকে। নিজ থেকে উঠে দুপুরে খাব৷

— আচ্ছা আপা৷

সেজুতি নিজের রুমে এসে বেশ শব্দ করে দরজার খিল লাগালো। এরপর একটা জোড়ে শ্বাস ফেলে বলে উঠে, গেছে ভালোই হইসে। আনকালচারড একটা লোক৷

সে বিছানায় এসে ঘাপটি মেরে শুয়েই উঠে বসলো। বিছানার চাদর থেকে মুহিবের গায়ের গন্ধ ভেসে আসছে৷ কি একটা যন্ত্রণা!

সে একবার ভাবলো চাদর বদলাবে পরে আর বদলালো না। সেভাবেই শুয়ে পড়ে।

মুহিব সেদিন দুপুরের আগেই রওনা হলো। সে ভেবেছিল সেজুতি অন্তত একবার তাকে কল করে বিদায় জানাবে। এসে সি অফ করবে এর আশা অবশ্য করেনি৷

যখন সেজুতির ফোন কল ও সে পেল না তখন নিজের উপর রাগ হতে লাগে। এই অহংকারী মেয়েটার জন্য সে আমেরিকা থেকে ছুটে আসলো? লাভ কি হলো এসে?

★★★

জুই অপারেশন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে সঙ্গে সব ব্যবস্থা ও করে রেখেছে। আজ থেকে প্রায় পাচ বছর ধরে সে ব্রেইন টিউমারের মতো মরনব্যাধিতে আক্রান্ত। এর আগেও একবার তার অপারেশন হয়েছে৷ কিন্তু অসুখ সারেনি। এবার ও অপারেশন হবে৷ কিন্তু জুইয়ের মন বলছে সে আর বাচবে না। তার আয়ু শেয়।সে মনে মনে যা ভাবে তাই ঘটে। এর আগে বহু বার সে যা ভেবেছে তাই ঘটেছে।

কালকে রাত থেকে তার খাওয়া বন্ধ। ওটি আজকে দুপুর একটায় হবে। তার অপারেশন থেয়েটারে। ডক্টর এলবার্ট সহ কানাডিয়ান এক বিখায়ত সার্জন ও থাকবে৷ জটিল এক অপারেশন যাকে তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে৷

আমেরিকানরা চ্যালেঞ্জ নিতে বড্ড পছন্দ করে।

সে খুব সকালে উঠে সান রাইস দেখেছে। তখনো হসপিটাল বেডে অভিক চুপটি করে ঘুমুচ্ছিলো। এখনো ঘুমাচ্ছে৷

জুই গিয়ে তার কপালে চুমু দিলো। কালকে রাত থেকে কত হাজার বার যে সে ছেলেকে আদর করেছে তার কোন হিসেব নেই।অবুঝ অভিক কিচ্ছুটি বুঝছে না৷ মায়ের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে কিছু ই জানা নেই তার৷

জুইয়ের চোখ ভরে এলো। আচ্ছা তার বেবি যে দুধ ডিম খেতে চায় না! সে মারা গেলে কে।অভিককে বোকা বানিয়ে পুডিং খাইয়ে দিবে? সকালে ঘুম থেকে উঠে কান্না করলে কে আদর দিয়ে কান্না থামাবে? রাতে ঘুমানোর আগে কে বেড টাইম স্টোরিস শোনাবে?

জুই নিজেকে শান্ত করে অভিকের কাছে গিয়ে তার গা ঘেঁষে বসে পড়ে।

জুইয়ের এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই। আচ্ছা অভিকের বাবাকে কি একবার কল দিবে? নাহ থাক! ওর সাথে বহু আগেই সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে৷ নতুন করে এসব ঘাটানার দরকার নেই। তাছাড়া সে যদি মারা যায় তাহলে অভিকের বাবার জন্য বেশ বড় ধরনের একটা শক অপেক্ষা করছে৷

অভিকের দিকে তাকালো সে।আটটার মধ্যে তাকে ইনজেকশন পুশ করবে ডক্টর। তার হাতে আরো ও দুই ঘন্টা আছে। জুই ঠিক করে এই দুই ঘন্টা সে প্রাণ ও চোখ ভরে অভিককে দেখে নিবে।

জুই আচমকা কেদে উঠে প্রায় ফিসফিস করে বলে উঠে, হে করুণাময়! তুমি যদি আমাকে অভিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নাও। তাহলে আমার বেবির জন্য একটা মা পাঠিয়ে দাও! যে অভিককে আদর করে খাইয়ে দিবে! রাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দিবে! প্লিজ আমার ছেলেকে কোন কষ্ট দিও না! ও বড্ড আদুরে! মানুষ খাবারের অভাবে মারা যায় আর আমার বেবি হয়তোবা আদরের অভাবে মারা যাবে৷

তার কাদার বেগ বেড়েই চললো। সে একটু শব্দ করে বলে, জানি আমি অনেক বাচ্চামো প্রার্থনা করছি। কিন্তু প্লিজ! আমার বেবির জন্য একটা মা পাঠাও ঈশ্বর! নয়তো একটা এঞ্জেল পাঠাও। এটা একজন মায়ের দাবী৷

চলবে৷