#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–5
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
বিয়ে মানে আপাতদৃষ্টিতে মজার হলেও আসলে ব্যাপারটা বিরক্তিকর। বেশ বিরক্তিকর এবং অসহ্যকর ও।
সেজুতি হাই তুলতে তুলতে শ্বাশুড়ির রুমে যাচ্ছে। মাত্র নাস্তা সেরেছে সে। নাস্তার টেবিলে শোভা আপা তাকে বেশ ক’টা বকাও দিয়ে দিয়েছে।আপাতত খাবারের সঙ্গে তার পেটে বকারাও সাতার কাটছে৷ সেজুতি মনোয়ারা আক্তারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাচ্ছে না। আপা জোড় করে পাঠাচ্ছে।
সেজুতি মনোয়ারা আক্তারের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় আচল তুলে দিয়ে রাঙা বউ সাজলো।
শ্বাশুড়ি আম্মা যদি তাকে জিজ্ঞেস করে যে সকালে নাস্তার টেবিলে এলো না কেন? সে কি উত্তর দিবে? আম্মাজান আপনার গুনধর ছেলে কালকে রাতে আমাকে ঘুমোতে দেয় নি৷ এজন্য সকাল বেলা ঘুমিয়েছি? এটা কি বলা উচিত হবে? যতোই হোক মুরুব্বি মানুষ। তবে কেন যেন আগে থেকেই আপার শ্বাশুড়িকে সেজুতি খুব অপছন্দ করত। সেই ছোট্ট বেলার কিশোরী বয়স থেকেই।
কিশোরী বয়সটায় একবার যা মাথায় ঢুকে যায় তা মন ও মাথায় স্থায়ী হয়ে বসে থাকে।
সেজুতি রুমের দরজায় কাড়া বাজালো। দুই মিনিটের ব্যবধানে দরজা খুলে দিলো মনোয়ারা আক্তার। তার পরনে ধবধবে সাদা আর গোল্ডেন পাড়ের সুতি দামী শাড়ি। মুখ ভর্তি পান চিবুচ্ছে সে।
তিনি সেজুতিকে দেখে হালকা হেসে বলে উঠে, আসো ছোট বউমা।ভেতরে আসো৷
সেজুতি তার ব্যবহারে বেশ অবাক হলো। এরপর এক প্রকার সংকোচ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। এখন এপ্রিলের মাঝামাঝি। বৈশাখের দ্বিতীয় দিন। সূয্যিমামা তার উত্তাপ দেখিয়ে দিচ্ছে। বেশ গরম পড়েছে। চড়া দুপুরে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করছে। কিন্তু আম্মার ঘর বেশ ঠান্ডা। এসি বোধহয় অনেকক্ষন ধরেই চলছে। সেজুতি রুমে ঢুকেই বুঝতে পারে, এই রুমের টেম্পারেচার মিনিমাম ২২° সেলসিয়াস তো হবেই।
মনোয়ারা আক্তার বিছানায় আয়েশ করে বসে বলেন, বসো বউমা তোমার সাথে কথা আছে।
সেজুতি ভাবতে লাগে, কি কথা হতে পারে তার সঙ্গে?
সে দ্বিধায় পড়ে গেল কই বসবে? বিছানা ছাড়া বসার জায়গা নেই। চেয়ার নেই রুমে।
মনোয়ারা আক্তার যেন ব্যাপার টা ধরে ফেললেন। তিনি আগ বাড়িয়ে বলে উঠে, বিছানায় আমার পাশে বস।
সেজুতি মাথা নিচু করে বসে পড়ে। তার কেমন যেন লাগছে। এসির বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা তার!
মনোয়ারা আক্তার বলতে লাগলো, মুহিব বড্ড নাদান!
সেজুতি একথা শুনে টাস্কি খেয়ে উল্টে পড়ল বলে! আম্মা এইসব কি বলে? উনার ছেলে নাদান না ছাই! আস্ত একটা অভদ্র!
মনোয়ারা আক্তার শর্তা দিয়ে সুপারি বেশ দ্রুত গতিতে টুকরো টুকরো করে দুই ফালি করে চলেছেন। এতো দ্রুত এমন ধারওয়ালা শর্তা দিয়ে কিভাবে সুপারি যে কাটছে কে জানে? সেজুতি তার জায়গায় হলে সুপারির জায়গায় নিজের হাত কেটে রক্তাক্ত করে একাকার করে ফেলত।
মনোয়ারা আক্তার পান বানিয়ে সেজুতির দিকে এগিয়ে দিলে সেজুতি বলে উঠে, আমি পান খাই না।
— বেশ! পান খাওয়া খুব বাজে একটা অভ্যাস। পান খেলে কাজের বুয়া গুলোর মতো লাগে!
বলা শেষ করেই মুখে পান পুড়ে নিলেন।
সেজুতির মাথা থেকে টুপ করে আচলটা নিচে পড়ে গেল। সে আর তা ঠিক করার প্রয়োজন বোধ করে না। কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য সেজুতি কোন কাজ করে না। মানুষ এমন এক প্রানী যাকে কোন কিছুর বিনিময়ে খুশি করা যায় না।
— কালকে বৌভাতের অনুষ্ঠান মনে আছে?
— জি।
— তোমাদের বাসায় যাবে না কি কালকে?
— হ্যা।
— মুহিব ও যাবে?
— যাওয়ার তো কথা। না গেলেও অসুবিধা নেই।
— আজকে সকালে এলে না কেন? তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।
সেজুতি চুপ বনে গেল।
মনোয়ার আক্তার তার দিকে তাকিয়ে বলে, অসুস্থ নাকি? আমি তো এতোক্ষন খেয়ালই করি নি। তোমার মুখ এমন শুকনা কেন?
— এমনি। অসুস্থ না। মাথাব্যথা প্রচুন্ড।
— আচ্ছা। তেতুলের শরবত খেলে মাথাব্যাথা দূর হয়। যাইহোক, মুহিব তোমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যেতে চায়৷
সেজুতি হতভম্ব হয়ে বলে, ঢাকায় চলে যাবে মানে?
মনোয়ারা আক্তার ভ্রু কুচকে বলে, মুহিব কিছু জানায় নি তোমাকে?
— না তো।
— বৌভাতের পরের দিন ও ঢাকায় চলে যাবে। সঙ্গে তুমি ও যাবে৷
সেজুতি বিড়বিড়িয়ে বলে, আমি জীবনে ও মুহিবের সঙ্গে একা এতো দূর যাব না।
— দুপুরে আমি বাসায় থাকব না। রাতে একসাথে খাব। আমরা রাত নয়টার রাতের খাবার খাই।
সেজুতি ভেবেই পাচ্ছে না আম্মার তার সঙ্গে বসে খাওয়ার দরকারটা কি?
মনোয়ারা আক্তার দ্বিতীয় পান মুখে নিয়ে বলে, আগে আমিও তোমাদের মতো পান খেতাম না। মুহিব পেটে আসার পর থেকে পান খাওয়া শুরু করলাম। বাঙালী মেয়েরা পোয়াতি হলে পান খাওয়া শুরু কিরে। পরে কেউ কেউ এই অভ্যাস ছাড়াতে পারে আবার কেউ আমার মতো আজীবন পান খেয়েই যায়৷ প্রতিদিনই বিশ টাকার পান লাগে আমার।
— ও।
উনি পানের বোটার ডগায় চুন নিয়ে তা মুখে দিয়ে বলে, ভালো কথা! কন্সিভ করা নিয়ে মুহিবের সঙ্গে কোন কথা হয়েছে? দুজনের কোন পরিকল্পনা নেই? বাচ্চা কবে নিবে?
সেজুতি চোখ বড় করে ফেলে। লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে৷ আম্মার কি লজ্জা-শরম কিছু নাই?
মনোয়ারা আক্তার সেজুতির মুখ দেখে শব্দ করে হেসে বলে উঠে, বিয়ের পর লজ্জা-শরম কমে যায়৷ তোমার বাবার শরীর কেমন?
— ভালোই।
মনোয়ারা আক্তার তার হাত থেকে চিকন দুটো চুরি খুলে সেজুতির হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলে, আজকের রাতের রান্না তুমি করবে।
— ঠিক আছে আম্মা।
— তাহলে এখন যাও।
সেজুতি চুরি হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো। আজকে এতো অসাধারণ ব্যবহার করার পরও সেজুতির মনোয়ারা আক্তার কে একবিন্দু পছন্দ হয় নি। আপাতত তার মাথায় ঘুরছে মুহিব যদি ঢাকায় যায়! তাকেও সঙ্গে নিতে চাইলে সে কি করবে?
সেজুতি রুমে ঢুকেই আরেক দফা টাস্কি খেল। রুমের অবস্থা নাজেহাল। আলমারি থেকে প্রতিটা শার্ট-প্যান্ট বের করে বিছানায় ফেলে রেখেছে মুহিব। বিছানার বেডশিট টাও অগোছালো। মনে হচ্ছে, রুমের সঙ্গে এক দফা যুদ্ধ চালানো হচ্ছে।
সেজুতি ঝাঝালো কন্ঠে বলে, রুমের এই অবস্থা কেন? কেন রুমের পরিবেশ নষ্ট করছেন?
মুহিব বিছানার সামনে দাড়িয়ে শার্ট সিলেকশন করছিলো। সেজুতির কথায় চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই ভড়কে যায়। হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে।
চোখ বড় করে সেজুতির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা সত্যি সত্যি মেজেন্টা রঙের শাড়ি পড়েছে। হাতে চিকন দুটো চুরি, গলায় ও সোনার চেইন। চুল গুলো ছেড়ে রেখেছে। চোখে কাজল। ঠোঁটে হালকা বেবি পিংক রঙের লিপস্টিক। মুহিবের মনে হলো, লাল লিপস্টিক পড়লে বেশী সুন্দর লাগত৷
সেজুতির আচলটা বেশ ঝুলানো। প্রায় ফ্লোর টাচ করছে করছে ভাব। এতো বড় আচল রেখেছে কেন? নিশ্চয়ই মুহিবকে এই আচলে বেধে ফেলার বুদ্ধি এটেছে এই মেয়ে! হ্যা এটাই কারন। নাহলে ওতো বড় আচল কেন শুধু শুধু ফেলে রাখবে? আর একদিনেই সেজুতি তাকে ধমকাচ্ছে? কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
সেজুতি বিছানার সামনে এসে দাড়াতেই মুহিব তার পরনের গেঞ্জি খুলতে লাগে । সেজুতি মুহিবকে গেঞ্জি খুলতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।
সে মুখে বিরক্তি ভাব এনে বলে, আশ্চর্য! কি করছেন এইসব?
মুহিব তার কথায় কর্ণপাত না করে বিছানা থেকে দুইটা শার্ট হাতে তুলে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে প্রথমে কালো শার্ট নিজের কাছে ধরে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগে৷
মুহিবের এই কান্ডে সেজুতি হেসে দেয়। আয়নার ভেতর থেকে সেজুতিকে মুগ্ধ হয়ে দেখলেও মুহিব এমন ভাব করল, যেন সে হেসে দেওয়ায় তীব্র পরিমাণে অসন্তোষ ।
সেজুতি মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য এনে বলে, উহু! এইটা ভালো না৷
মুহিব দ্বিতীয় শার্টটা গায়ে ধরতেই, সেজুতি মুখ বাকিয়ে বলে, ইশ! এই শার্টে আপনাকে জঘন্য লাগছে!
মুহিব দাতে দাত চেপে ধরে বলে, নীল আমার প্রিয় রঙ।
— ইশ কি বাজে চয়েস আপনার। নীল একটা ক্ষ্যাত রঙ।
মুহিব রেগে তেড়ে এলো বিছানার সামনে৷ তারপর এক এক করে তার সব কাপড় বিছানা থেকে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে এশ রঙের একটা শার্ট হাতে নিতেই তড়িঘড়ি করে সেজুতি বলল, এটা পড়বেন না। তা নাহলে লোকে বলবে মুহিব সারওয়ার বিয়ে করে পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে গেছে। এরপর সেজুতি শুরু করল মুহিবের হৃদয় কাপানো অট্টহাসি। এই হাসির শব্দে মুহিবের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।
মুহিব মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। কিছু বলতে পারলো না। তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে মুহিব বলে উঠে, তাহলে তুমিই বলো কোন শার্টটা পড়ব?
সেজুতি সুন্দর দেখে একটা চকলেট কালারের শার্ট বের করে দিলো। মুহিব সেটা পরে নিজের চুল আছড়ালো। এরপর কড়া পারফিউম দিলো।
পারফিউমের গন্ধে রুম মো মো করতে লাগে। সেজুতি মজার ছলে বলে, কোন মেয়েকে পটাতে যাচ্ছেন নাকি?
মুহিব বলে উঠে, তোমার মতো ডাইনির আশেপাশে থাকলে কোন মেয়েই আমার সাথে ঘেষবে না।
সেজুতি চোখ ছোট করে তাকাতেই মুহিব এই প্রথম খুব সুন্দর করে হাসলো।
মুহিবের হাসিটা দেখে সেজুতির বুক ধক করে উঠে। আহারে! কি সুন্দর হাসি তার। এই হাসির দিকে চেয়ে সেজুতি একটা লম্বা জীবন পাড়ি দিতে ও পিছপা হবে না।
মুহিব বলে উঠে, শোন? শোভা ভাবীকে দ্রুত সত্যটা জানিয়ে দাও। সে যে মা হতে পারবে না এই সত্য লুকানো অসম্ভব ।
— জানাবো। সময় হলেই জানাব।
— কবে সময় হবে? তোমার কি মনে সে সুখে আছে? উহু! সুখে নেই৷ কাজেই অনিশ্চয়তায় না রেখে সত্যটা বলে দাও।
সেজুতি জবাব দিলো না। আচমকা মুহিব তার কাছে এসে তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে বলে , যদি কেউ কোন দিন এসে বলে আমি কোন অন্যায় করেছি তখন কি করবে?
সেজুতি ভ্রু কুচকে বলে, অন্যের কথা বিশ্বাস কেন করব?
— আমি নিজেই যদি বলি?
সেজুতি বলে উঠে, কি অন্যায় করেছন আপনি? হু?
— এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আমাকে যেতে হবে৷
— কখন ফিরবেন?
— রাত হবে৷
— আজকে আমি রান্না করব। কি খেতে চান?
মুহিব বলে, তুমি রান্না করলে তা খাওয়ার যোগ্য হবে?
সেজুতি একথা শুনে গাল ফুলালে মুহিব এক গাল হেসে সেজুতির কপালে প্রগাঢ় করে আলতো ভালোবাসার পরশ একে বলে উঠে, আল্লাহ হাফেজ ।
উনি যাওয়ার পর সেজুতি লম্বা এক ঘুম ঘুমিয়ে রান্না করতে নেমে যায়। মুহিবের প্রিয় সরিষার তেলের তেহারি রাধলো সে।
এশার পর পর থেকে সুন্দর করে সেজে মুহিবের অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু মুহিব এলো না।
রাত বেড়ে যাওয়ায় মনোয়ারা আক্তার খেয়ে নিলেন। তাকে দেখে সবাই খেতে বসলেও সেজুতি খেল না। তার বড্ড অভিমান হতে লাগে। কান্না পেয়ে গেল।
সবার খাওয়া শেষ হলে সে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে এক দফা কান্না করল। মুহিব কি জানে সে না আসায় সেজুতি কতখানি কষ্ট পেয়েছে? না জানে না। জানলে ছুটে আসত!
বুকের কষ্ট দেখানো যায়না। প্রকাশ ও পায় না। দেখা যায় না জন্যই একজন অপর জনকে কষ্ট দিতে পারে।
সেজুতি রুম সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। সে ভেবেছিল খাওয়া শেষ করে দুইজনে এক গ্লাসে কোক খাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে! এবং সুন্দর সুন্দর গল্প করবে!
রাত বাড়তে থাকে। আকাশে মেঘ ও বাড়তে থাকে। বাড়ির কারো কোন বিকার নেই মুহিব না ফেরায়। কিন্তু সেজুতি ছটফট করতে লাগে৷ অস্থিরতায় সে ঢোক গিলতে পারছেনা।
সে সোফায় বসে তার অপেক্ষায় থেকে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ ফোনের রিংটনে ঘুম উবে যায়। স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে সে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। মনে কু ডাকে। মুহিব ঠিক আছে তো? দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে রাত বারোটা বাজে!
সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠে, আপনি মুহিব সারওয়ারের কেন হন?
চলবে।