স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব-১০

0
366

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০

রিফাত বাসায় এসে কারো সাথে কথা বলতে গেলেও সবাই তাকে এড়িয়ে গেল। এত্তো ছোট বিষয় নিয়ে এতগুলো দিন রেগে থাকার কারণ রিফাত ভেবে পায় না। আজ সকালে রিফাত যত খুশি নিয়ে বাসায় ফিরেছিল, বাসায় ফেরার পর ততটাই হতাশ হয়েছে। কিন্তু প্রীতিকে এতদিন পর দেখে নিমিষে মন ভালো হয়ে গেল।
রাতে রিফাত সবার সাথে খাওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে নেমে টেবিলে বসতেই দেখলো একে একে সবাই আছে কিন্তু মুন নেই। মুনের চেয়ারটা খালি দেখে কেন জানি রিফাতের বুক ধক করে উঠল। সে খাওয়ার মাঝে বারে বারে সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে, এই বুঝি মুন সিঁড়ি বেয়ে চেয়ারটাতে বসে অভিমান-ভরা চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলবে,’তোমরা সবাই আমাকে ফেলে বসে যেতে পারলে!’ রিফাত তার ভাবনার মাঝেই হেসে দিল। টেবিলে সবার দৃষ্টি রিফাতের দিকে। প্রীতিও খাওয়া ফেলে রিফাতের দিকে তাকালো। রিফাতের হুশ ফিরতেই সে আশেপাশে তাকিয়ে মাথা নিচু করে খাবারে মনোযোগ দিল, খাওয়ার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে বারবার মুনের চেয়ারটাতে চোখ বুলাচ্ছে রিফাত। রিফাতের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো -সে আগের দিনগুলোতে ছিল, রিফাতের হাসি দেখে মুন এসে রিফাতের হাতে খামচি দিয়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু এখন তেমন কিছুই হয়নি। মুনের চেয়ারটা রিফাতের সামনাসামনি হওয়াতে বারবার না চাইতেও দৃষ্টি ওখানেই আবদ্ধ হচ্ছে কিন্তু আজ খালি। কেউ মুনকে খেতে ডাকছে না কেন রিফাত ভেবে পাচ্ছে না, সে যে মুনকে একটিবার দেখতে চায়। রিফাতের আজ কেন জানি বুঁকের কোথাও শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। হঠাৎ করে মুনকে দেখার তীব্র ইচ্ছে জ্ঞাপন করল রিফাত। কিন্তু আফসোস! সবার খাওয়া শেষ আর মুনের চেয়ারটা এখনো খালিই রয়ে গেল। একে একে সবাই খেয়ে উঠে গেল কিন্তু তার ভাবনার মতো করে মুন আর সিঁড়ি বেয়ে নেমে তার সামনের চেয়ারটাতে বসে অভিমান-ভরা চোখে কারো দিকে তাকালো না। রিফাত আজ প্রীতির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে মুনকেই খুঁজতে লাগল। তবে কেন এমন হচ্ছে! সে তো মুনকে ভালোবাসেনি! এটা কী মায়া না-কি ভালোবাসা! এর উত্তর রিফাতের জানা নেই।

রাতে খাওয়া শেষ করে রিফাত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় কোনার রুমটাতে না চাইতেও দৃষ্টি দিল। রুমটা বন্ধ। রিফাত নিজের রুমে ঢোকার আগ-মুহূর্তেও মুনের রুমটার দিকে আবারো দৃষ্টি দিল। না, দরজা বন্ধ।

রাতে প্রীতি সব গুছিয়ে রুমে এসে দেখল, রিফাত ব্যালকনিতে অন্য-মনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত ব্যালকনিতে গিয়েও বারে বারে তার পাশের মুনের ব্যালকনিটার দিকে নজর বুলাচ্ছে, যে এই বুঝি মুন আসবে ব্যালকনিতে। সেই রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে বুঝতে পারছে না, মেয়েটা রিফাতের চোখে একবারও ধরা দিচ্ছে না।

পেছন থেকে প্রীতি রিফাতকে জড়িয়ে ধরতেই রিফাত বিরক্তসূচক শব্দ করে প্রীতিকে ছাড়িয়ে নিল। প্রীতি অবাক দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকাল।

-‘উফ প্রীতি, বিরক্ত করো না তো।’

রিফাতের এভাবে প্রীতিকে ছাড়িয়ে নেওয়ায় প্রীতির অপমান লাগলো। প্রতিবার তো রিফাত নিজেই প্রীতিকে জড়িয়ে ধরতো। অথচ আজ, রিফাত নিজেই ছাড়িয়ে নিলো প্রীতিকে। সে রিফাতের কাছ থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘কী হয়েছে তোমার? খাওয়ার আগে থেকেই তোমাকে অন্য মনস্ক মনে হচ্ছে।’

-‘প্রীতি একটা সত্যি কথা বলবে?’ রিফাত কোনো ভঙ্গিমা ছাড়া প্রীতির দিকে ফিরে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠল।

-‘হ্যাঁ, বলো?’

-‘আসার পর থেকে মুনকে একবারও দেখলাম না। সে কই? সে কী আমি এসেছি বলে সামনে আসছে না?’

রিফাতের কথা শুনে প্রীতি অবাক দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।
প্রীতির এভাবে তাকানো দেখে রিফাত বিরক্ত-সূচক শব্দ করে বলে উঠল,’কী হয়েছে? এভাবে তাকাচ্ছ কেন?’

-‘এ কী! মুনের ব্যাপারে তুমি জানো না?’

-‘কী জানবো?’

-‘কী জানবে মানে! মুন তো এখানে নেই। সে তো ম্যারিল্যান্ডে।’

প্রীতির কথা শুনে রিফাতের মুখ হা হয়ে গেল। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রীতির দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘ক,, কী বললে এই মাত্র তুমি?’

-‘সত্যিই তো! তোমার পরিবারের কথা তুমি জানো না ভেবে অবাক লাগছে আমার। তোমাকে কী কেউ বলে নি? পরিবারের কাছে তুমি এতটা নিচু! ভাবতেও অবাক লাগছে আমার। এ আমি কাকে বিয়ে করলাম। যার পরিবারে সে নিজেকেই কোনো মূল্য দেয় না আর আমাকে কীভাবে দিবে!’ বলে হনহন করে প্রীতি রুমে ঢুকে গেল।

আর এদিকে রিফাতের কানে প্রীতির এতো কথা ঢুকেনি। তার কানে শুধু একটা কথায় বাজছে -‘মুন এখানে নেই, ম্যারিল্যান্ডে।’

মুনের এদেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণ কী রিফাতই! সে নিজেই কী! মুন এই পরিবার ছাড়া কোনোদিন একরাতও অন্য কারো বাসায় ছিল না। সে এই পরিবারের বাইরে কোনো জায়গায় থাকার কথা মাথায়ও আনতো না আর আজ এতগুলো দিন কীভাবে বাইরে একটা অচেনা দেশে আছে! তা ভাবতেই রিফাতের মনে একরাশ খারাপ লাগা কাজ করল। কেউ না জানুক অন্ততঃ রিফাত জানে, যে মুন উপরে শক্ত দেখালেও ভেতরে অনেক নরম মনের একটা মেয়ে। হয়ত সেদিন উপরে শক্ত থাকলেও ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলো তার মনটা। মুনের পরিবার ছাড়া অচেনা একটা দেশে থাকার কথা ভাবতে গেলেই রিফাতের ভীষণ খারাপ লাগছে। তার চেয়ে বড়ো কথা, মেয়েটার কাছ থেকে এতো বড়ো অন্যায়ের জন্য আর ক্ষমাও চাওয়া হলো না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তার বোন সমান এই মেয়েটিকে সে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে হয়তো নিজেরই অজান্তে। রিফাত মুনের ব্যালকনির দিকে এক ফলক তাকিয়ে গ্রিলের বাইরে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ‘ক্ষমা করে দিস মুন’ আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠল।

—————-

কেটে গেল আরো কয়েক সপ্তাহ। এর ভেতর সব আবার আগের মতোই শুরু হলো মুনের। প্রতিদিন উঠে ভার্সিটি যাওয়া, আসা, বিকেলে ইরার সাথে একটু ঘুরতে যাওয়া আবার রাত হলে পড়তে বসা তারপর ঘুমিয়ে পড়া আর ইরার গভীর রাতে নিজের রূপ ফিরিয়ে এনে পার্টিতে যাওয়া। এভাবেই কেটে যাচ্ছে মুনের ম্যারিল্যান্ডের দিনগুলো। এর মধ্যে মুনও সেই মানুষটাকে পুরোপুরি ভুলতে বসেছে।

এমনই একদিন ভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারলো নতুন কোনো টিচার জয়েন করবে। ইরা-সিমির মুখ থেকে ওই টিচারের কথা পড়ছেই না। ইরা-সিমির ক্রাশ না-কি টিচারটা, শুধু ইরারই নয় ভার্সিটির প্রায় মেয়েই উনার কথা ফেলছে না। এর মধ্যে একদিন এসেছিল তবে ক্লাস করায়নি, সেদিন মুনের মাথা ব্যথা থাকার জন্য ভার্সিটিতে আসেনি কিন্তু ইরারা এসেছিলো। মুন না আসাতে ইরা ওই কথাগুলোতে মসলা মেখে ইন্টারেস্টেড করে মুনের মাথা খাচ্ছে। আজ টিচারটার ক্লাস আছে যার ফলে ইরা, সিমি দুইজনেই ভারী ভারী মেক-আপ করে ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়েছে।
ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মুনরা ক্যান্টিনে গিয়ে প্রতিদিনের মতো আড্ডায় বসলো। রিক তো সিমিকে কোনো কথাতেই ছাড়ছে না, এমনি সিমির ভারী মেক-আপের জন্য রিক অনেক রাগী মুডে রয়েছে। সে চায় না, সিমি অন্য কারোর উদ্দেশ্যে সাজুক। রিকের এমন ব্যবহারে অন্যরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। সিমি নিজেও এর কারণ বুঝতে পেরেছে তাই সে রিককে আরো উল্টা উল্টা জবাব দিতে লাগল।

ক্লাসের সময় হতেই আড্ডা শেষ করে ওরা ক্লাসের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে গিয়ে বসলো।
অবশেষে ইরাদের ক্রাশ টিচার এসেই গেল। মুন ইরাদের ক্রাশকে দেখার জন্য অনেক আগ্রহের সহিত ক্লাসের দরজার দিকে তাকালে তার পিলে চমকে উঠল। সে এক দৃষ্টিতে ঐদিকেই তাকিয়ে রইল।
মুনের এভাবে তাকানো দেখে ইরা মুচকি হেসে মুনকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,’কী ক্রাশ খেয়েছিস তুইও? বলেছিলাম না, অনেক সুন্দর টিচার এটা। আমার সাথে একদম পারফেক্ট।’

মুন যেন চোখই ফেরাতে পারছে না। সে ভেবেছিলো, মানুষটার সাথে বুঝি আর দেখাই হবে না! এভাবে দেখা হওয়াটা তার ভাবনার বাইরে ছিল তাও স্যারের রূপে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।