স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-০৪

0
6774

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
||পর্ব-০৪||

ঢাকায় আসলাম আজ সপ্তাহ খানেক হলো।এরমাঝে মায়ের সাথে আমার তেমন ভালোভাবে কথা বলা হয়ে ওঠে নি।মায়ের হাতে যে ছোট্ট একটা বাটন ফোন ছিল,ওটার অর্ধাংশই অকেজো।ওখান থেকে রিসিভিং হলেও শব্দ এখানে কিছুটা শুনা যায়, আবার যায় না।
ওখানে মাকে দেখাশুনার মতোও তেমন কেউ নেই।এ নিয়ে একটু বেশিই পেরেশানি। তাই বাসায় শীঘ্রই ব্যাক করতে সিদ্ধান্ত নিই।ভাবলাম আজ বিকেলেই রওনা করে দিব।কিন্তু তার আগেই আকাশ কল করে আবদার করে বসলো। আগামীকাল সকালে তারসাথে যে করেই হোক আর একটিবার দেখা করে যেতে।
ঢাকায় পরে আবার কবে আসা হবে,না হবে তার কোনো ঠায়ঠিকানা নেই।তাই আকাশের আবদারে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই নি।রাজি হয়ে যাই।ওর সাথে দেখা করেই কাল দুপুরের পর কুমিল্লায় রওনা করবো ভেবে মনস্থির করি।

সন্ধে হয়।চারদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসে।আমি,টোয়া এবং রিনতি বেলকনির বেতের চেয়ারে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছি।চা খাওয়ার মাঝেই টোয়া ফোঁড়ন কাঁটে।ছপছপ গলায় বললো,
“কী মনোমুগ্ধকর এক সন্ধে!মৃদু বাতাস।আবছা আঁধার।সাথে এক কাপ চা!কেমন বোধ হচ্ছে তোদের?”

রিনতি তেমন উৎসাহ দেখালো না।সে তার মতো চা খাচ্ছে।আমি উৎসুক না হয়ে পারিনি।নতুন পরিবেশ মানুষকে কৌতূহলী করবে এ এমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি কৌতূহলী চোখে টোয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমার ত সেই ফিলিংস হচ্ছে!ইচ্ছে ত হয় এখনই বাইরে গিয়ে একটু ঘুরে আসি।”

“ঘুরে আসি”-এ দু’খানা শব্দ অবচেতন টোয়ার কানের মাঝ বরাবর গিয়ে বাজতেই সে তরহর বললো,
” তাহলে এখনই ঘুরে আসি,চল।”

আমি এবং রিনতি টোয়ার দিকে ধাঁধা চোখে তাকাই।ভাবলাম কৌতুক করে বলেছে হয়তো।কিন্তু পরক্ষণে আমাদের ধাঁধানো চোখকে আরো অবাক করে দিয়ে সে বললো,
“আমি রেডি হচ্ছি।তোরাও রেডি হয়ে নে।আজ মনভরে সন্ধের শহর দেখবো।”

আমি প্রথমে খানিক অবাক হলেও পরে সিরিয়াসলি বললাম,
“সত্যি বের হবি?”
“হুম,সত্যি।
এই মুহূর্তে বাইরে বের হওয়াটা রিনতি মেনে নিতে পারেনি।সন্ধের পর ঢাকা শহরে বের হওয়া প্রতিটি মেয়ের জন্যেই রিস্কি।আড়ালে আবড়ালে হিংস্র জানোয়াররা ওত পেতে থাকে,আর সুযোগ পেলেই খুবলে ধরে।সেখানে ঘুরতে বের হবে?ইম্পসিবল! ভেবেই রিনতি টগবগ করে বলে উঠলো,
“এই অবেলায়?ইম্পসিবল!যেতে ইচ্ছে হলে কাল সকালে বের হোস!”
“ঘুরার জন্যে একটা স্বাচ্ছন্দ্যকর পরিবেশ লাগে।যেটা এই মুহূর্তে আছে!”
“সন্ধের পর ফুটপাত গুলোতে বখাটের ঢোল নামে।মেয়ে মানুষের অসময়ে বাসা থেকে বের হওয়া ঠিক না।আমি কখনোই সন্ধের পর বের হইনি।যদি খুবই আর্জেন্ট প্রয়োজন হয় তখন বাবা বা ভাইয়ার সাথে বের হই।”
“উফস,কিছু হবে না রে বাবা।তুই ত কোনো সময় সন্ধের পর বের হোস নি তাই এমনটা বোধ হচ্ছে। আজ আমাদের সাথে বের হ তারপর দেখবি তোর এমন চাপা দ্বিধা মুছে গেছে!”
“কিন্তু….!”
“আর কোনো কিন্তু নয়।আয় ত!”

রিনতি কথার সাথে আর পেরে উঠতে পারে নি।এক প্রকারে বাধ্য হয়েই আমাদের সাথে বের হয়।আমি একটা ঘ্রি কালার গাউন পড়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে নিই।টোয়া সেমি-সিল্ক থ্রী-পিস। আর রিনতি টপসের সাথে বড়সড় একটা ওড়না গায়ে ছড়িয়ে নেয়।

বাসা থেকে দুই ফোঁড় পা সামনে বাড়াতেই রিনতি সপাট করে বলে উঠলো,
“আচ্ছা,শুন না?আমরা একটু শ্যামলী তে যাই।আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে!ক’দিন পর মামাতো ভাইয়ার বিয়ে।”
আমি এবং টোয়া একে-অপরের মুখের দিকে তাকাই।টোয়া কথার ফোঁড়ন কেঁটে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“কিছুক্ষণ আগে নিচে বের হবি না বলেই দু’হাত লাফ দিয়েছিস,এখন শ্যামলী তেও যাবি?”
“তেমন কিছু নয়।বাইরে আসলাম, একবারে কেনাকাটাও করে নিব।তাছাড়া,তোরা ত আছিস চয়েজ করতে সমস্যা হবে না!”
“ইট’স ওকে।নো প্রবলম।আমরা যাবো।সাথে ঘুরা হবে এবং চেনাও হবে।”
টোয়া মিনমিন করে বললো,
“রাতের বেলা কিছুই বুঝবি না।শুধু গাড়িগুলার ফ্ল্যাশ দেখবি।”
“”তা কি হয়েছে।গাড়ির ফ্ল্যাশ আলোতেও যদি কিছুটিছু চিনি।”
আমার কথা শুনে রিনতি খিলখিল হেসে দেয়।টোয়াও।

তারপর আমরা তিনজনে একটা বাসে উঠি।বাসে উঠে আবার আরেক ঝামেলায় পড়ি।বাসের সবগুলো সিটে মানুষের ছড়াছড়ি। বসার একফালি জায়গা নেই।তাদের সবার দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে।কিভাবে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে।এই মুহূর্তে রিনতির উপর আমার প্রচণ্ড রাগ হয়।শ্যামলীতে না গেলে ত এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হত না!
আমি মাথাটা টোয়ার কানের দিকে এগিয়ে বললাম,
“টোয়া,চল আমরা নেমে যাই।এভাবে দাড়িয়ে থাকতে আমার কেমন যেন লাগছে।দ্যাখ,সবাই আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে।
“কিভাবে বের হব!আমাদের সামনে আস্তে আস্তে মানুষ ভর্তি হচ্ছে।এখন নামতে গেলে সবার ঢলাঢলি খেয়ে বেরিয়ে আসতে তবে।তারচে ভালো কয়েক মিনিট একটু কষ্ট করে দাড়িয়ে থেকে শ্যামিলী পৌঁছাতে পারলেই হলো!”
“কিন্তু আমরা মেয়ে মানুষ বাসে এভাবে দাড়িয়ে থাকাটা…!”
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই টোয়া হাতে চাটি মেরে আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো,

“ঢাকায় এরকমই। মেয়েরা দাড়িয়ে যেতে পারে।শুধু নিজের সংকোচ,দ্বিধা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।”
তারপর আর কি টোয়ার কথা মেনে নিয়েই দাড়িয়ে দাড়িয়ে শ্যামলী পৌঁছাই।আমাদের মার্কেটে আসতে সাতটা ত্রিশেক বেজে যায়।আমি মার্কেটটা দেখে অনেক চমকিত হই।পুরো মার্কেট জুড়েই যেন একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া লেগে আছে!হরেক রকম দামী দামী জামাকাপড়, অর্নামেন্ট,জুতো,কসমেটিকস পুরো মার্কেটের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাজানো।আবার এগুলোর দামও চড়া!বিত্তবান লোকজন যে এখানে মার্কেট করতে আসে তা আমি অনেকটা আন্দাজ করতে পেরেছি।

রিনতি পুরো মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে অতঃপর একটা জামা চুজ করে।জামাটা আয়নার সামনে নিয়ে দাড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে রিনতি।দেখতে দেখতে আমায় বললো,
“দ্যাখো ত সানা,কেমন লাগছে আমাকে?”
“অনেক সুন্দর। তোমার গায়ের রঙ্গের সাথে জামার রঙ্গ বেশ মানিয়েছে!”
“ধন্যবাদ।”

তারপর জামাটা প্যাকিং করার পর ক্যাশে গিয়ে রিনতি টাকা জমা করে আসে।আমরা শপটা থেকে বেরিয়ে একটা অর্নামেন্ট দোকানে ঢুকি।অর্নামেন্ট গুলো খুবই সুন্দর!একজোড়া কানের দুল আর ব্যাসলেট দেখে আমার চোখ ঝলসে উঠে।কী সুন্দর মুক্তার মতো চিকচিক করছে দুল এবং ব্যাসলেটের কারু খচিত কাজগুলো!কারো নজরে পড়লে তা থেকে চোখ সরাতে কষ্ট হবে। মনে মনে একটা লোভাতুর বোধ থাকবেই।
খুব উৎসুক হয়ে যাই দাম জানতে!তবে ভেতরে ভেতরে কিছুটা সংকোচ বোধও করি- দামটা জিজ্ঞেস করার পর জিনিসগুলো যদি না কিনতে পারি তাহলে বিষয়টা খুবই খারপা দেখাবে না!তারপরও অবাধ্য মনকে সায় দিতে পারি না।ফস করে বলে উঠলাম,

“এই যে ভাইয়া,এইজোড়া কানের দুল এবং ব্যাসলেটের দাম কত হবে?”
“জ্বী ম্যাম,দুল-পাঁচ হাজার টাকা, আর বেসলেট-আড়াই হাজার।দিব?”
থতমত খেয়ে বসি।এত টাকা এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।বললাম,
“ইয়ে মানে ভাইয়া,এখন এত টাকা নিয়ে আসি নি।আবার আসলে কিনে নিব।”

বলেই রিনতি এবং টোয়াকে তাগাদা দিই বেরিয়ে আসতে।রিনতির কি নাকি চুড়ি কিনা লাগবে।তাই সে টোয়াকে নিয়ে চুড়ি চুজ করছে।আমি বেমানানের মতো দোকানের শেষ প্রান্তের কর্ণারে এসে দাড়িয়ে থাকি।কিছুক্ষণ এভাবে কেঁটে যাওয়ার পর অতঃপর রিনতির চুড়ি চুজ হয়।চুড়ি কিনে ক্যাশ করে দিয়ে বেড়িয়ে আসে।

আমরা শপিং মলের মেইন ফটকে আসতেই হঠাৎ ঝড়ের গতির মতো আকাশ কোথা থেকে এসে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। আমি চমকে ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলি।বললাম,
“আকাশ,তুই?তোর সাথে ত কাল দেখা করার কথা আমার! ”
“হুম।তোকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল তাই হাসপাতাল থেকে সোজা এখানে চলে আসলাম।”
বলেই আকাশ হাসার চেষ্টা করে।সাথে টোয়াও হাসচে!ওর হাসির মাঝে কিছু লুকানো লুকানো ভাব চলে আসছে। সে আকাশকে এখানে কল দিয়ে আনে নাই ত?নাহলে আকাশ ত জানার কথা নয় আমি এখানে আসছি!ভাবনার মাঝেই টোয়া টপকে বলে উঠলো,
“সারপ্রাইজ টা কেমন ছিল রে?”

আমি রাগ রাগ চোখে ওর দিকে তাকাই!রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার নাকের ঢগা ফুলে উঠে।ইচ্ছে হয় ওর নাকটা এক সপাটে ফাটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে দিই।কী দরকার ছিল এমন পাকনামি করার!আর না জানিয়ে অন্য আরেকজনকে হয়রানী করার!
আমার রাগ এবং চুপ থাকা দেখে আকাশ হেসে দিয়ে বললো,
“ওর ওপর রাগিস না।ওর কোনো দোষ নেই।আমি তোর খবর নিতে ওর আইডিতে নক করি।তারপর জানতে পারলাম তোরা শ্যামলী তে আছিস।এরমাঝে আমার রোগী দেখাও শেষ হয়ে যায়।তাই ভাবলাম এই ফ্রী সময়ে তোর সাথে একফোঁড় দেখা করে আসি।তবে আসবো যে একথা আমি টোয়াকে জানাই নি।না জানিয়ে চলে আসি।ক্ষমা কর এবার।”

একদম বলেই আকাশ অপরাধ ভঙ্গিতে কানে হাত রাখে।আমি আর বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারিনি।ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে দিই।আমার হাসির মাঝেই আকাশ আবার বললো,
“সানা এখানে একটু দাড়া।আমি দু’মিনিটের মধ্যেই আসতেছি।”
বলেই আকাশ আমাদের পাশ কাঁটিয়ে মার্কেটের ভেতরে ঢুকে যায়।কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে বললো,
“আচ্ছা,এবার চল।”

মার্কেট থেকে বেরিয়ে আকাশ আমাদের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়।সেখানে সে আমাদের ডিনারের অফার করে।আমি প্রথমে নাখোশ করেও ওর একপ্রকার জোরাজুরিতে ডিনারটা করতে বাধ্য হই।ডিনার করা শেষ হলে আমরা বাইরে বেরিয়ে আসি।তারপর আকাশ সামনে থেকে দুটো রিক্সা ঠিক করে বাসায় পৌঁছে দিতে।একটায় রিনতি এবং টোয়া উঠে।অন্যটায় আমি এবং আকাশ।পাশাপাশি রিক্সায় চড়ে আমি এবং আকাশ চলতেছি।এরমাঝে আকাশ আমার সাথে একফোঁড় ও কথা বলেনি।যদিও বার কয়েক রিক্সাওয়ালাকে কোন পথ দিয়ে যেতে,একটু আস্তে চালাতে এমন দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

যখন রিক্সা বাসার সামনে এসে থামে,নামতে যাবো।তখনই আকাশ আমায় পেছন থেকে মৃদু গলায় ডেকে উঠে।আমি ঘাড় ঘুরে বললাম,
“কিছু বলবি আকাশ?”
আকাশ তার স্নিগ্ধ মুখে ভুবন ভুলানো হাসি ছড়িয়ে দেয়।শান্ত এবং ধীরস্থির গলায় বললো,
“সানা,তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে!এতটাই সুন্দর লাগছে আমার কল্পনার জগৎ এর বর্ণনাতে শব্দের ঘাটতি বলতে পারিস!”

আকাশের এহেন কথায় আমার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠে।সাথে খানিকটা লজ্জা।আকাশ আবার বললো,
“বায় দ্য ওয়ে,পর নারীর সৌন্দর্যের প্রসংশা করা অবলীলায় নিচু পুরুষ কূলে ঠায় পেতে হবে।আর তোর হাতটা একটু দে!”
আমি শুধু জিজ্ঞাসূচক চোখে আকাশের দিকে তাকাই।গলা দিয়ে শব্দ বের করতে শক্তি পাইনি। আকাশ হেসে বললো,
“ভয় পাস না।ছুবো না তোকে।জাস্ট একহাতের তালু মেলে দে।”
আমি কোনোকিছু না ভেবে অবলীলায় আকাশের সামনে ডানহাতের তালু ছড়িয়ে দিই।আকাশ তার সাদা এপ্রোনের পকেট থেকে কি একটা প্যাকিং করা জিনিস আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো,
“ওরা যাতে না জানে।সযত্নে,আড়ালে নিয়ে যাস।”

বলেই আকাশ অপেক্ষা করেনি।টোয়াদের রিক্সাওয়ালাকে হাত দিয়ে ইশারা করে মোড় ঘুরাতে।নিজে যেই রিক্সায় বসে আছে সেই রিক্সাওয়ালাকেও উদ্দেশ্য করে বললো,
“মামা,রিক্সা ঘুরাও।”
আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকি।টোয়া চৈ-চিৎকার করে এদিকে এসে বললো,
“আরেহ,ভাড়াটা ত অন্তত আমরা দিই, আকাশ।এটা কিন্তু ঠিক করছিস না!”

আকাশ কথাটা একপ্রকারে তুচ্ছ করে আঁধারের শহরে দুটো রিক্সা নিয়ে মিলিয়ে গেল!

চলবে……