হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-৩৬+৩৭

0
513

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৬

আজ মিমি ও কাইফের বিয়ের ছ মাস পূর্ণ হলো। মিমি ভাবতেও পারছে না এতো তাড়াতাড়ি ছ টা মাস কীভাবে কেটে গেল ওই গম্ভীর লোকটার সাথে? মিমি নিজেদের রুমের বিছানায় চুপ করে বসে আছে। আর বসে বসে তানিয়াকে ইচ্ছে মতো বকে দিচ্ছে। তানিয়া তাকে এ কেমন বিপদে ফেলল! তানিয়া মেঘের সাথে বুদ্ধি করে তাদের ঘরের বিছানা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। মেঘ ও বউ এর কথায় নাচতে নাচতে সবটা করল। সাদা চাদরের ওপর লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। তানিয়া রুমের সাথে সাথে তাকেও ছাড় দেয়নি। মিমিকে জোর করে একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। নিজের দিকে তাকালেই মিমির কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। বারংবার সে গুটিয়ে যাচ্ছে। শাড়িটা পরানো ছাড়া তানিয়া আর কিছু করেনি। তবে তাকে মেরে ফেলার মতো চরম লজ্জা জনক কথা বার্তা বলেছে। তানিয়া মিমিকে বলেছে–

— জানিস মিমু? আমাদের ফার্স্ট নাইটের পর থেকে মেঘ রাতে আমাকে মেকআপ করতে দেয় না এমনকি লিপস্টিক ও না। যদি কোনো কারনে মেকআপ করা থাকতো, তাহলে সে ধমকা ধমকি করে তা নিজে ধুয়ে ফেলত। কেন জানিস?

মিমি বোকার মতো মাথা দুপাশে নাড়িয়ে ছিল। তানিয়া হেসে তার কানে কানে বলেছিল–

— কারণ মেকআপের স্বাদ তার পছন্দ নয়। তো আমি চাচ্ছি না ভাইয়ার কোনো প্রকার সমস্যা হোক।

মিমি লজ্জায় গুটিয়ে গেল। গলা উঁচু করে তানিয়াকে কিচ্ছুটি বলতে পারল না। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে পৌঁছেছে। শীতকালের হিসেবে রাত অনেক হয়েছে। কাইফ এখনো বাড়ি ফেরেনি। মিমি ভেবে পাচ্ছে না, কাইফ তাকে এভাবে দেখলে কি করবে? তাকিয়ে থাকবে? মিমি তো লজ্জায় মরেই যাবে। মিমির ভাবনার মাঝেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। মিমি গুটিয়ে গেল। কাইফ ভেতরে প্রবেশ করে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। রুমের লাইট নেভানো কেন? সে দরজা লক করে নিজের হাত ঘড়ি খুলে রাখল। অতঃপর রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ তার চোখ গেল বিছানায় গুটি সুটি মেরে বসে থাকা রমনীর দিকে। তার সারাদিনের ক্লান্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে শুকনো ঢোক গিলল। তার গলা শুকিয়ে আসছে। সে নিজের হাতে থাকা ব্লেজার সোফাতে ছুড়ে ফেলল। এগিয়ে গেল মিমির দিকে। মিমি কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াল। কাইফ অবাকের সাথে তাকে দেখে যাচ্ছে। মিমির শরীর লাল রঙের ফিনফিনে পাতলা শাড়িতে আবৃত। কোমর ছাড়িয়ে চুল গুলো হাওয়ায় মৃদু দুলে উঠছে। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছাপ নেই। এই সামান্য তেই কাইফের কাছে তাকে অসামান্য লাগছে। এই সাজই কাইফকে কাত করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। মিমির রিনরিনে কন্ঠে ঘোর থেকে বের হলো সে।

— হ হ্যাপি সিক্স মান্থ অ্যানিভারসেরি!

কাইফের মনেই ছিল না। তার মনে মনে একটু খারাপ লাগল। মিমির জন্য কিছু নিয়ে আসা উচিত ছিল। সে বিমর্ষ গলায় বলল–

— হ্যাঁ! হ্যাপি সিক্স মান্থ অ্যানিভারসেরি! আসলে আমার মনে ছিল না।

মিমির মুখ ভার হলো। কাইফের মনে ছিল না? মিমির মন খারাপ হতে দেখে কাইফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল–

— কি পরেছ এটা? এমন শাড়ি কোথায় পেলে? কন্ট্রোল লেস হয়ে যাচ্ছি।

মিমির মন খারাপ কেটে গিয়ে তৎক্ষণাৎ সে লজ্জায় মিইয়ে গেল। ইচ্ছে করল ছুটে পালিয়ে যেতে। সে এভাবে কাইফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! মিমি যেতে নিলেই কাইফ তার হাত ধরে ফেলল। টেনে নিল কাছে। মিমি জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। কাইফ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল–

— পালাচ্ছ কোথায়? আমাকে এভাবে কন্ট্রোল লেস করে দিয়ে কোথায় যাচ্ছ তুমি?

মিমি কথা বলে না। কাইফের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ে তার কাঁধে। সে কেঁপে ওঠে। কাইফ আবারও বলল–

— আজ তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। শুনবে?

মিমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। কাইফ তাকে আর একটু নিজের কাছে টেনে নিল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল–

— ভালোবাসি। অনেক দিন ধরেই ভালোবাসি। তোমাকে বলা হয়নি। জানোই তো আমি কেমন? গুছিয়ে ভালোবাসার কথা বলতে পারি না। এর থেকে ভালো আমি বলতে পারব না। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাস। বলো ভালোবাসো আমাকে?

গম্ভীর মানুষটা হঠাৎই যেন পাগল প্রেমিক হয়ে উঠল। মিমি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লজ্জায় সে বুঝি মরেই যাবে। কাইফ তাকে ভালোবাসে! এতো সুখ কোথায় রাখবে সে? মিমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠল–

— ভালোবাসি মিস্টার খান।

মিমি মুখ লুকায় তার বুকে। কাইফ হাসে তৃপ্তির হাসি, সন্তুষ্টির হাসি। সে মিমিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল–

— আজ তোমার মাঝে ডুবে যেতে আর কোনো বাঁধা নেই। দেবে আমাকে অনুমতি? বৃষ্টি হয়ে ছুঁয়ে দিতে চাই তোমায়। বৃষ্টি হতে চাই আমি। খুব যত্ন করে ছুঁয়ে দেব তোমায়।

মিমি লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢাকে। কাইফ তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিজের শার্ট খুলে সন্তর্পনে এক পাশে রেখে দেয়। সাথে চশমা ও। মিমির হাত সরিয়ে তার মুখশ্রী উন্মুক্ত করে কপালে চুমু আঁকে। আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় সে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা হয়। কাইফ তার ওপর আধশোয়া হয়ে তার অধরে নিজের অধর মিলিয়ে দেয়। হাত দুটো নিয়ে নেয় নিজের বলিষ্ঠ হাতের ভাজে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। আধার তাদের ঢেকে ফেলে। সময় গড়িয়ে যায়, তার সাথে সাথে কাইফ উন্মাদ হয়ে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের প্রেয়সী, নিজের ভালোবাসা, নিজের স্ত্রীর মাঝে ডুব দিতে। কাইফের বেহায়া হাতের স্পর্শে হাঁসফাঁস করে ওঠে মিমি, ছটফট করে। কাইফ তাকে ছাড় দেয় না, এক ফোঁটাও না। পুরোপুরি ডুবে যায় তার মাঝে। আকাশে চাঁদ জ্বল জ্বল করছে। জানালার পর্দা মৃদু মৃদু দুলে উঠছে। এক সময় চাঁদও মেঘের আড়ালে চলে গেল। সে বুঝি তাদের ভালোবাসা দেখে লজ্জা পেয়েছে?
———-

সকালে ঘুম ভেঙে গেল মিমির। নড়তে গিয়ে অনুভব করল কাইফ তার গলায় মুখ গুজে ঘুমিয়ে আছে। তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আঁকড়ে রেখেছে মিমির পেট। মিমি নড়ে চড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই কাইফের ঘুম ভেঙে গেল। সে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল–

— নড়ছো কেন? দেখতে পাচ্ছ না আমি ঘুমাচ্ছি?

বলেই সে তার গলায় ঠোঁট চেপে ধরল। মিমি লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে কাইফকে সরিয়ে দিয়ে নিজের গায়ে চাদরটা ভালো করে মুড়িয়ে নিল। চোখ খিচে বন্ধ করে বলল–

— সরুন আমাকে ফ্রেশ হতে হবে।

কাইফ তাকে চেপে ধরে পুনরায় গলায় মুখ গুজে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল–

— পরে। আবারও বৃষ্টি হতে মন চায়ছে। তোমার জন্য হতে পারি বৃষ্টি সব সময় যখন তখন। হবো নাকি বৃষ্টি?

মিমি অসহায় হয়ে পড়ল। বস্ত্রহীন অবস্থায় কাইফের সামনে থাকতে চরম লজ্জা লাগছে তার। সে কাইফকে ধাক্কা দিয়ে বলল–

— অসভ্য লোক। সরুন, কয়টা বাজে দেখেছেন? ছোট মা, বাবা, চাচ্চু সবাই কি ভাববে?

কাইফ মিমিকে ছেড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল–

— কি আর ভাববে? ভাববে যে তাদের রাগী গম্ভীর ছেলে বউ এর ছোঁয়ায় মারাত্মক রোমান্টিক হয়ে গিয়েছে এবং বউ ছাড়া কিছুই বোঝে না। তাদের ছেলে বউ এর আঁচল ধরে ঘুরছে।

মিমি মেকি রাগ দেখিয়ে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল–

— আপনার মাথা!

মিমি জামা কাপড় নিতে গেলেই কাইফ চেঁচিয়ে বলল–

— খবরদার থ্রি পিস পরবে না। শাড়ি পরো। শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। আমি যেন কখনও শাড়ি ব্যতিত অন্য কিছু পরতে না দেখি। তুমি শাড়ি পরবে আর আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব।

মিমি মুখ বাঁকিয়ে শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। সে বুঝল না, এক রাতে মানুষটার মধ্যে এত পরিবর্তন হলো কীভাবে? শাওয়ার নিয়ে এসে দেখল কাইফ সব পরিষ্কার করে ফেলেছে এবং সে অন্য রুম থেকে শাওয়ার ও নিয়েছে। মিমি কাইফের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল–

— আপনি এসব করতে গেলেন কেন? আমি পরিষ্কার করে নিতাম।

কাইফ মিমির কোমর জড়িয়ে কাছে এনে বলল–

— আপনার ওপর দিয়ে বেশ ঝড় গিয়েছে ম্যাডাম। আমার আদরটুকু সহ্য করতে পারেননি আপনি। গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। তোমাকে কিছু করতে হবে না। সারাদিন আজ রেস্ট নেবে।

মিমি নিজের গলার চেইনটা উঁচু করে ধরে বলল–

— এটা আপনি পরিয়ে দিয়েছেন? এটা তো আমার বাবার চেইন, যেটা..

— হ্যাঁ, যেটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। কাল তুমি আমাকে এত সুন্দর একটা রাত উপহার দিয়েছ, তোমাকে কিছু না দিলে হয়? এটাই ছিল আমার কাছে। তাই ভাবলাম এটা তোমাকে দিই। তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন পরিয়ে দিয়েছি।

— এটা সব থেকে বেস্ট উপহার। আমার খুব পছন্দের এটা। আর এর সাথে একটা স্মৃতি আছে।

— আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। আর আমি তোমাকে..

মিমি অভিমানী কন্ঠে বলল–

— আপনি আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। আমার কত ব্যথা লেগেছিল জানেন?

— তাই বুঝি? কোন গালে দিয়েছিলাম? এই গালে?

বলেই কাইফ তার ডান গালে অসংখ্য বার ঠোঁট ছোঁয়ায়। মিমি মুখ কুঁচকে বলল–

— ডান গালে না। আপনি আমাকে বাম গালে থাপ্পড় মেরেছিলেন।

— আচ্ছা? তাহলে সেখানে আদর করে দিচ্ছি।

কাইফ ঠোঁট ছোঁয়াতে নিলেই মিমি তার বুকে হাত রেখে তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল–

— থাক। আর ঢং করতে হবে না। ছাড়ুন আমাকে নিচে যেতে হবে। সারাদিন রুমে থাকলে তানিয়া আমাকে লজ্জা দিয়ে মেরেই ফেলবে।

কাইফ নাকোচ করে বলল–

— তুমি অসুস্থ। এখন নিচে যাওয়া লাগবে না। সার্ভেন্ট ওপরে খাবার দিয়ে যাবে। আর ফার্স্ট এইড বক্সে পেইন কিলার আছে।

কাইফ মিমি ঠোঁটের কোণে হাত রেখে বলল–

— খুব ব্যথা লেগেছে তাই না? এখানে কতটা কেটে গিয়েছে। সব দোষ আমার। আরও কত আঘাত দিয়েছি তোমায় ।

মিমি হেসে বলল–

— পাগল আপনি মিস্টার খান। আপনার ভালোবাসার আঘাত এগুলো, আমার একদমই কষ্ট হয়নি।

কাইফ মিমির কপালে হাত রেখে বলল–

— শরীর হালকা গরম আছে। খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। তুমি বসো আমি আসছি। রুম থেকে এক পা ও নড়বে না।

সে মিমির কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে চলে গেল। মিমি প্রশান্তির হাসি হাসল। লোকটা তাকে কতটা ভালোবাসলে এমন পাগলামি করতে পারে? মিমি সৌভাগ্য বতী যে কাইফ তার জীবন সঙ্গী।

চলবে?

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৭

ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে খান ম্যানসনে। এই অনুষ্ঠানে বাইরের কেউ নেই, সবই পরিবারের লোকজন। তানিয়ার বাবা মা সহ তার আত্মীয়স্বজন, মিমির মা-বোন, ঈশানির পরিবার, সিফাতের পরিবার এবং মিসেস ঝর্নার পরিবার। বলা বাহুল্য মিসেস ঝর্না দেশে থাকেন না। তিনি এবং তার স্বামী লন্ডনে থাকেন। তাদের কোনো সন্তান নেই। দুজন নিয়েই তাদের পরিবার। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার একটা আয়োজন করা হয়েছে। বলা যায় তানিয়ার কনসিভ করা উপলক্ষে এই ছোট খাটো অনুষ্ঠান।

যখন থেকে মিসেস ঝর্না জানতে পেরেছেন যে কাইফ বিয়ে করেছে, তাও আবার সেই ছোট ঘরের মেয়েকে। অথচ কেউ তাকে জানায়নি প্রর্যন্ত। তখন থেকেই তিনি মুখ ভার করে বসে আছেন। চেয়েছিলেন মিমি সহ তার পরিবারকে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু তানিয়ার সাবধান করা বানীতে সেই সাহস তিনি আর পাননি। তানিয়া তাকে বলেছিল–

— কেমন আছেন ফুপি? নিশ্চয় ভালোই আছেন। আর আমি জানি আপনি মনে মনে মিমিকে অপমান করার ফন্দি আটছেন। তবে কি জানেন তো? আমি আপনার ভালো চাই। ভাইয়া মিমিকে খুব ভালোবাসে। যদি আপনি মিমিকে নিয়ে ভুল করেও মুখ থেকে কোনো কটু কথা বের করেন! তাহলে ভাইয়া কি করবে জানেন?

মিসেস ঝর্না মাথা দু পাশে নাড়ায়। তানিয়া তাকে জেসির ঘটনা বর্ণনা করে শোনায়। অতঃপর বলল–

— দেখেছেন? জেসিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। আর আপনি তো গুরুজন। আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দেবে না।

মিসেস রিতা কিছু মুহূর্তের জন্য সাহস পেয়েছিলেন। তবে তানিয়ার পরবর্তী কথায় তা ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল।

— আপনাকে সম্মানের সাথে বের হয়ে যেতে বলবে এবং এই বাড়িতে আসার পথ সারা জীবনের জন্য বন্ধ করে দেবে। আপনার ভাইয়েরাও মিমিকে খুব স্নেহ করে। বুঝেছেন ফুপি শাশুড়ি?

মিসেস ঝর্না মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে ছিলেন যে তিনি বুঝেছেন। তখন থেকেই তিনি মুখ গোমড়া করে বসে আছেন।

নিশান মিমির পিছু পিছু ঘুরছে।‌ সে মিমিকে অনেক দিন পর পেয়েছে। কিছু দিন মিমি তাকে পড়াতে যায়নি। তারা বর্তমানে মিমি ও কাইফের রুমে বসে আছে। সে মিমির কোলে উঠে বলল–

— রসমালাই! তুমি তো আমার মামী হয়ে গিয়েছ। তাহলে আমি এখন তোমাকে কি বলে ডাকব?

মিমি হেসে তার গাল টেনে দিয়ে বলল–

— তোমার যেটা ভালো লাগবে তুমি সেটাই ডেকো নিশান।

— তাহলে আমি তোমাকে রসমালাই-ই ডাকব। আমার তো একটা মামী আছে, তাই আমি তোমাকে রসমালাই বলে ডাকব।

— ঠিক আছে।

তাদের কথার মাঝে কাইফ রুমে প্রবেশ করল। কোনো এক কারনে মিমি তার ওপর রেগে আছে। কথাও বলে না আর কাছেও আসে না। কাইফ পড়েছে মহা জ্বালায়। কাইফ নিশান কে মিমির কোল থেকে তুলে নিয়ে বলল–

— জানো তো সুপার হিরো? তোমার রসমালাই খুব পঁচা।

নিশান কিছু না বুঝে বলল–

— কেন মামা? আমার রসমালাই তো খুব ভালো।

কাইফ আড় চোখে মিমির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল–

— তোমার রসমালাই আমাকে একটুও আদর করে না। আর না আমাকে আদর করতে দেয়।

মিমির চোখ কপালে। এসব কি বলছে কাইফ নিশানের সাথে? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? মিমি তাকে চোখ রাঙিয়ে বলল–

— কি বলছেন মিস্টার খান? বাচ্চার সামনে এসব কি? পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি?

কাইফ নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল–

— দেখেছ সুপার হিরো? তোমার রসমালাই শুধু আমাকে বকে। রসমালাই কে বকে দাও তো একটু।

নিশান কাইফের কোল থেকে নেমে মিমির সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে নেড়ে বলল–

— এই রসমালাই! আমার মামাকে একদম বকবে না। সব সময় আদর করবে। যেমন আমাকে আদর করো, তেমনই আদর করবে। ঠিক আছে?

মিমি চোখ বড় বড় করে তাকালো। কাইফ মিটিমিটি হাসে। মিমি তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল–

— হ্যাঁ, ঠিক আছে। তোমার মামাকে একা পাই আগে, তার খুব ভালো করে তার ঘাড় মটকে মাথার ছেড়া তার জোড়া লাগিয়ে দেব।

শেষের কথা গুলো সে বিড়বিড় করে বলল। তবে তা কাইফ শুনতে পেল। মিমি লম্বা লম্বা পা ফেলে বের হয়ে যেতে নিলে শাড়িতে পা আটকে পড়ে যেতে নিল। কাইফ তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে ফেলল। হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসলো। নিশান হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে বলল–

— ইয়ে! মামা মাছ ধরেছে। মাছ ধরেছে। আমি এক্ষুনি মাম্মাকে বলে আসছি।

নিশান দৌড়ে বের হয়ে গেল। মিমি তাকে আটকাতে যেয়েও পারল না। কাইফের দিকে তাকিয়ে বলল–

— ছাড়ুন আমাকে।

কাইফ ছাড়ে না। মিমির কোমরের উন্মুক্ত অংশে নিজের হাত বিচরণ করায়। মিমির শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। শাড়ি পরার পর থেকে কাইফের বেশ সুবিধা হয়েছে। মিমি বলল–

— সব সময় অসভ্যতামি না করলে আপনার হয় না তাই না? আপনার কথা শুনে শাড়ি পরাই আমার ভুল হয়েছে।

— সব স্ত্রীর কাছে সব স্বামীই অসভ্য। আমি ব্যতিক্রম হবো কেন? তুমি সামান্য বিষয় নিয়ে আমার ওপর রাগ করে আছ কিন্তু।

— রাগ করে আছি, বেশ করেছি। আমি কি চেয়েছিলাম? শুধু একটু ফুচকা খেতে চেয়েছিলাম। আর আপনি কি করলেন? ছোট মায়ের সামনে আমাকে ধমক দিলেন। ছাড়ুন আপনি। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।

— রাস্তার খাবার খেলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়তে তো। তাই আমি ধমক দিয়ে তোমাকে থামিয়ে ছিলাম।

মিমি মুখ ঘুরিয়ে নিল। কাইফের সাথে তার কোনো কথা নেই। কাইফ বাঁকা হেসে বলল–

— দেখবে তোমাকে কীভাবে হাসাবো?

মিমি কিছু বলার আগেই সে তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি আবৃত গাল মিমির গলায় ঘষতে শুরু করল। মিমি খিলখিল করে হেসে উঠল। তার সুরসুরি লাগছে। সে হাসতে হাসতে বলল–

— সুরসুরি লাগছে। ছাড়ুন।

কাইফ থামে না। মিমির সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠে।
—–

কাইফকে বহু কষ্টে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিচে এসেছে মিমি। পুরো বাড়িতে লোকজন ভর্তি। পুরুষরা সকলে বাগানে বসে গল্প করছে আর মহিলারা সবাই ভেতরে। মিমি রান্না ঘরে উঁকি দিতেই ঈশানি এসে তার সামনে দাঁড়াল। ভ্রু নাচিয়ে বলল–

— কি খবর মিমি? শুনলাম আমার ভাই নাকি আজ কাল বড় বড় মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। কাহিনী কি?

মিমি জোর পূর্বক হেসে বলল–

— আপনার ভাই মাছ ধরা শুরু করেছে নাকি? কই আমি জানি না তো।

— সেকি তুমি জানো না? ইয়া বড় একটা মাছ। তোমার মতোই বড়।

মিমি লজ্জা পেল। নিশান সবাইকে বলে দিয়েছে। নিশানের জন্য তাকে এখন লজ্জা পেতে হচ্ছে। মিমি কাঁচুমাচু হয়ে বলল–

— আমি একটু তানির কাছে যাচ্ছি আপু।

বলে সে পালিয়ে গেল। ঈশানি তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে হাসে। তার ভাইয়ের সাথে মিমির সব ঠিক ঠাক হয়ে গিয়েছে এতেই শান্তি।

এতো লোকজনের মধ্যে রিহার কোনো কাজ নেই। সে ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখছে। হঠাৎ হেঁচকা টানে আড়ালে চলে গেল। দেখলো সিফাত তার হাত ধরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিহা লজ্জা পেল। এমন নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে কেন লোকটা? রিহা নিচু কন্ঠে বলল–

— এখানে টেনে আনলেন কেন আমায়? কেউ দেখে ফেললে কি হবে?

সিফাত তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল–

— তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে গো পিচ্চি। তোমাকে সব সময়ই এতো সুন্দর লাগে কেন বলো তো?

রিহা হাসে। সিফাতের মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল–

— আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই আপনার চোখে আমার সব কিছুই সুন্দর।

সিফাত রিহার হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল–

— কবে যে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসব পিচ্চি? অপেক্ষা বড় কষ্টের জানো তো?

রিহা বলল–

— এতো পাগল কেন আপনি?

— তোমার জন্য পাগল।
—–

সেদিনের মতো অনুষ্ঠান শেষ। সকলে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। শুধু রয়ে গিয়েছেন মিসেস ঝর্না ও তার স্বামী এবং ঈশানি, নাহিদ ও নিশান। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর্ব ইতোমধ্যে শেষ। মিমি মিসেস রিতার হাতে হাতে কাজ করে মাত্র রুমে এসেছে। কাইফ সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মিমি তার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে দেখল কাইফ বিছানায় বসে ফোন টিপছে। মিমি বিছানার পাশে গিয়ে কম্বল তুলে নিয়ে সোফাতে ধপ করে শুয়ে পড়ল। কাইফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো। গলার স্বর উঁচিয়ে বলল–

— এটা কি হলো? তুমি সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়লে কেন?

— বিছানায় শোবো না তাই।

— মানে! বিছানায় কি সমস্যা?

— আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন তো। এতো কথা কিসের? ঘুমাচ্ছি, চুপ থাকুন।

— মিমি তুমি আসবে কিনা?

— না।

— লাস্ট বার বলছি। আসবে নাকি না?

মিমি মুখ কুঁচকে কম্বল থেকে মুখ বের করে বলল–

— বললাম তো যাবো না।

সে পুনরায় কম্বলের নিচে ঢুকে গেল। কাইফ ছোট্ট শ্বাস ফেলে ফোনটা এবং চোখ থেকে চশমাটা খুলে পাশের ছোট টেবিলে রেখে দিল। অতঃপর লম্বা লম্বা পা ফেলে মিমির দিকে এগিয়ে গেল। কম্বলসহ মিমিকে কোলে তুলে নিল সে। মিমি হকচকিয়ে গিয়ে মৃদু শব্দে চেঁচিয়ে বলল–

— এই কি করছেন আপনি? আমাকে তুললেন কেন? ঘুমাতে দিন আমায়।

কাইফ বিছানার দিকে এগোতে এগোতে বলল–

— তোমাকে ভালোই ভালোই বলেছিলাম চলে আসতে। কিন্তু তুমি আসলে না। তাই আমাকে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হলো। আর ঘুম! আজ তোমাকে ঘুম থেকে বঞ্চিত করা হলো।

মিমির চোখ কপালে। কাইফের কথা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। কেন যে পাকনামো করতে গেল? কাইফ তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। নিজে তার ওপর আধশোয়া হয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে নিল দুজনকে। গলায় মুখ ডুবিয়ে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। মিমি বরাবরের মতই তাকে বাঁধা দিতে পারল না। কাইফের আগ্রাসী স্পর্শে নেতিয়ে পড়ল সে। সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। সে রাতে তার আর ঘুম হলো না। কাইফ তার ঘুম হারাম করে ছাড়ল। মিমি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল যে আর কখনও সে কাইফের কথার অবাধ্য হবে না। কখনও না।

চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ। রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।}